ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

হৃদয়ের পৃষ্ঠা- ৪ -তুষার সরদার


ত্তর দশকের গোড়ার দিক। আগুনঝরা এক ভয়াবহ সময়ের কথা। আগ্রাসী সেই হুতাশনের ভীষণ দহনে ঝলসে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে বাংলার টগবগে যৌবন। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল তরুণ, তরুণীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। তবে তারা সবাই ছিল ইউনিভার্সিটি বা কলেজ ও উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী। তাদের কেউ ছিল নাবালক বা সদ্য সাবালক বা সাবালক।

         সেই প্রজ্বলিত আগুনের পোশাকি নাম ছিল নকশাল আন্দোলন। একচেটিয়া ধনিকতন্ত্রের আগ্রাসী কবল নিপীড়িত অসহায় দারিদ্রের মুক্তির জন্য সে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সে সময় প্রধানত কলকাতা আর সন্নিহিত এলাকা অনলগর্ভ হয়ে উঠেছিল সেই আন্দোলনের প্রভাবে। তখন রোজই কিছু না কিছু প্রাণোচ্ছল তারুণ্য ছিঁড়ে খেয়ে নিচ্ছিল নির্মম সরকারি বুলেট। প্রায় দিনই কোথাও না কোথাও লুটিয়ে পড়ে থাকে প্রাণ ছিঁড়ে নেওয়া শূন্য দেহ। তাদের কচি পিঠে বা বুকে দেখা যায় বুলেটের অবধারিত বীভৎস গর্ত।

দিন-দুপুরে বা রাত-দুপুরে, যখন খুশি নির্মম কালো গাড়ি তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ গোপন করে এসে দাঁড়ায় তার পছন্দসই কোনো বাড়ির সামনে। তার পর সেই গাড়ি প্রায় প্রত্যেক দিন কোনো না কোনো বাড়ি থেকে হতভাগ্য বাবা-মাকে অনিবার্য সমাদরে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ মর্গে, - বাসি রক্তে মাখামাখি কোনো যৌবন সনাক্তকরণের জন্য – তাঁদের আপাত-শূন্য কোল সেই তীব্র অকালে সত্যিই চিরতরে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে কিনা তা পুলিশকে নিশ্চিতভাবে জানানোর জন্য।
 
 
মহকুমা শহর থেকে বহুদূরের নিতান্তই এক অজগ্রাম থেকে জুনিয়র হাইস্কুলের পড়া শেষ করে নিতান্ত আনস্মার্ট বোকাটে আমি তখন ডায়মন্ডহারবারের মহকুমা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে এসেছি। বাড়ি থেকে স্কুলে আসা-যাওয়া করা সম্ভব নয় বলে স্কুলের বদান্যতায় একটু দূরে স্কুলেরই একটা ছিদ্রভূষিত টিনের চালের অনাদৃত ঘরে বিনা ভাড়ায় আমি ও আরও দু’জন ছাত্র থাকি। 

আমাদের স্কুলের কাছেই একটা সস্তার ভাতের হোটেল আছে। সেই হোটেলের বেশির ভাগ খদ্দের হল খানিক দূরের মহকুমা দেওয়ানি আদালতে মামলা-মোকদ্দমা করতে আসা অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকজন। তারা দিনে এসে মামলা-মোকদ্দমার ফাঁকে দুপুরে সেই হোটেলে ভাত খেয়ে দিনের শেষে উকিলের বিজয়-আশ্বাস বুকে পুরে যে যার বাড়ি ফিরে চলে যেত। 

সেজন্য দিনের বেলা ভিড়ভাট্টা থাকলেও রাতের বেলা সেই হোটেলটা খদ্দেরের ওভাবে বেশ ঝিমোত। আমরা সেখানে খুব অল্প টাকার মাসিক বন্দোবস্তে দুপুরের খাওয়া আর গরম করা দুপুরের বাসি ভাত তরকারি দিয়ে রাতের দরিদ্র খাওয়া সারতাম। সেই হোটেল মালিকের নামানুসারে সেই হোটেলটাকে বলা হত ‘পল্টু’র হোটেল। 

পল্টুদা মোটের উপর লোক ভালো ছিল। খুব গরীব হলেও আমাকে তেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত না। পল্টুদার বউ নাকি বেশ সুন্দরী। আমি কোনোদিন পল্টু-বউদিকে দেখিনি। তার দরকারও হয়নি। পল্টুদার কাছেই সুন্দরী বউদির কথা শুনেছি। সেই সুন্দরী বউকে নিয়ে পল্টুদার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। বউদিকে নিয়ে পল্টুদার সেসব দুর্ভাবনার কারণ বা ধরন কিছুই ঠিকমতো বুঝতাম না। আর আমার কাছেই বা পল্টুদা সেসব কেন যে বলত তাও আমার অপরিণত মাথায় ঢুকত না। টালির ছাউনি দেওয়া সেই হোটেল সংলগ্ন আলাদা ঘরে বউদি আর একটা বাচ্চা ছেলে নিয়ে পল্টুদা থাকত।

           বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের গন্ডি ছাপিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়েও তখন নকশাল ঢেউয়ের দোলা পৌঁছে গেছে। আমাদের স্কুলের উঁচু ক্লাসের বেশ কয়েকজন ছাত্র তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। তারা প্রত্যেকেই সেই শহরের মোটামুটি সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। তারা স্কুলে এসে নানারকম নকশাল বিপ্লবের কথা বা গল্প বলত।

 আমি অজগ্রামের এক অতি দরিদ্র স্কুলশিক্ষকের ছেলে। আমার কাছে পেটের কঠিন দায় থেকে উদ্ধার পেতে তখনও পর্যন্ত পড়াশোনাটাই একমাত্র অবলম্বন ছিল। যদিও শুনেছিলাম নকশাল-পন্থীরা গরীবদের জন্যই মৃত্যুপণ করে সরকারের ও ধনীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছে। তবুও সে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা ভাবা আমার পক্ষে অনেকগুলি তীক্ষ্ণ কারণে কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
 


একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি আচমকা আমাদের বিশাল তিনতলা স্কুলবিল্ডিংএর সীমানা পাঁচিলের দেওয়াল থেকে শুরু করে ভিতরে তিনতলা বিল্ডিংয়ের সবর্ত্রই আলকাতরা দিয়ে বিভিন্ন রকমের নকশাল স্লোগান লিখে একেবারে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। দেখে মনে হল গতরাতেই এসব লেখা হয়েছে। কারণ আগের দিন এসব কিছুই ছিল না। আলকাতরায় লেখা সেইসব স্লোগানের অক্ষরগুলো স্কুলের অতি পরিচিত পরিবেশটাই মাত্র একরাতের মধ্যেই বদলে দিয়েছে। 

শিক্ষক ও ছাত্ররা সবাই স্কুলে আসলেও সেদিন আর ঠিকমতো ক্লাস হলই না। ছাত্র, শিক্ষক সকলের মধ্যেই চাপা উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। সেদিন আমাদের ক্লাসের তিন-চারজন ছেলে বলল, তারা আজ থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে অন্যান্য ক্লাসের আরও কয়েকজনও যাচ্ছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে একথার মানে ঠিক কী সেটা তখন বুঝতে পারিনি। তবে তারা পরদিন থেকে তারা স্কুল তো বটেই সেইসঙ্গে তাদের নিজেদের বাড়ি থেকেও একেবারে উধাও হয়ে গেল। পরের দুবছর আমার সেই স্কুলে পড়ার সময়ের মধ্যে তাদের আর কখনই স্কুলে ফিরে আসতে দেখিনি। 

সেইসব সময়ে পুলিশ একটা অদ্ভুত নির্মম কাজ করত বা করাতো বলা চলে। সন্দেহভাজন হিসেবে ধৃত নকশালপন্থীদের দিয়েই বিভিন্ন সকুল বা সরকারীভবনের দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা নকশাল স্লোগানগুলোর উপর আলকাতরার পোঁচ চালিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়ার কাজ করাতো। ফলে দেওয়ালগুলো দেখতে আরও বেশি কুৎসিত হয়ে যেত। কড়া পুলিশ পাহারায় গনগনে রোদের মধ্যে কোমরে মোটা দড়িবাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান মুছতে থাকা সেইসব শুকনো পিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে আমার গ্রাম্য নির্বোধ বুকের ভিতরটা এক অজানা তীক্ষ্ণ বেদনায় টনটন করত। 


           
স্কুলবিল্ডিংএ নকশাল স্লোগান লেখা হবার তিনদিন পরের কথা। রাত একটা পর্যন্ত পড়ে আমাদের ঘরে যে যার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছি। তার কতক্ষণ পর জানি না দরজায় সন্তর্পিত ঠুকঠুক শব্দ হল। আমার ঘুম বরাবরই খুব সহজে ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে প্রথমে মনে হল আমার মনের ভুল বা শোনার ভুল। ঠুকঠুক শব্দটা আবার হতে আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম - 
‘কে?’ 
সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর এল না। আবার জিজ্ঞাসা করতে দরজার বাইরে থেকে হোটেল মালিক পল্টুদার ত্রস্ত গলা পেলাম - 
‘আমি- আমি পল্টুদা, দরজাটা একটু জলদি খোলো ভাই। খুব বিপদে পড়েছি।’ 
ঘুমচোখে উঠে দরজা খুলতেই পল্টুদা প্রায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে সাঁৎ করে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়েই দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিল। তার পর ফিসফিস করে বলল - 
‘ভীষণ বিপদ হয়েছে ভাই। ইস্কুলের সামনে পুলিশ একেবারে ভর্তি হয়ে গেছে। এখানে নকশাল ধরতে এসেছে। তাই আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি।’ 
‘পুলিশ নকশাল ধরতে এসেছে? কিন্তু সেজন্যে আপনি কেন পালাবেন?’
‘আমার হোটেলের ভিতরে বেঞ্চিতে কয়েকজন লোক শুয়ে আছে। যদি তাদের নকশাল বলে ধরে নেয় তাহলে আমাকেও তো ছাড়বে না। তুমি একটা কাজ কর ভাই। তুমি এখুনি আমার ভিতরবাড়িতে গিয়ে তোমার বউদিকে বলে এসো যে আমি তোমাদের এখানে লুকিয়ে আছি। নাহলে ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই আমাকে না দেখতে পেলে আমার বউটা আমার জন্য দারুণ দুশ্চিন্তা করবে। দুশ্চিন্তায় পড়ে কন্নাকাটি জুড়ে দিতেও পারে। যাও ভাই তুমি একটু যাও এখুনি। ব্যাপারটা ভীষণ জরুরি।’
 


পরিস্থিতির সাতপাঁচ না ভেবে বেরিয়ে পড়লাম। সেটা ছিল মে অথবা জুন মাস। আমার পরনে শুধু একটা হাফপ্যান্ট, আর খালি গা। জরুরি পরিস্থিতি বলে পল্টুদা তাড়া দিচ্ছিল বলে ওই অবস্থাতেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলাম। পায়ে হাওয়াই চপ্পলটা পর্যন্ত গলানো হল না। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশেই একটা রাস্তা। রাস্তাটা খানিক এগিয়ে গিয়েই বড়ো রাস্তায় পড়েছে। সেখানেই নাকি পুলিশ এসেছে।

কাঁকর বিছানো রাস্তাটা দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে বাঁদিকে একটা সরু গলি আছে। সেই গলিতে ঢুকে দুটো বাড়ি পেরিয়ে গেলে পল্টুদার ভিতরবাড়ি। সেখানে পৌঁছে পল্টুদার বলে দেওয়া সেই বাড়ির সংকীর্ণ বারান্দায় উঠে দরজায় শব্দ করতে একটু পরে দরজা খুলে কোনোমতে শুধু শায়া-ব্লাউজ পরা সদ্য ঘুমভাঙা আলুথালু বউদি বারান্দায় বেরিয়ে এল। আমি বউদিকে ঠিকমতো না দেখলেও বা চিনলেও বউদি আমাকে চেনে বুঝলাম - 
‘কী হয়েছে গো ঠাকুরপো?’ 
পল্টুদা যা বলতে বলেছিল তা বউদিকে বললাম। বউদিকে একটুও চিন্তিত বা উদবিগ্ন মনে হচ্ছিল না। আমার বলা কথায় তেমন ভ্রূক্ষেপ না করে ‘আচ্ছা’ বলে বউদি আবার ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিতে গিয়ে আবার দরজাটা খুলল। খোলা দুটো পাল্লার উপর দিকটা দু’হাত দিয়ে ধরে বউদি আমাকে বলল -
‘পুলিশের কথা শুনে আমার কেমন ভয় ভয় করছে গো! ঘরের ভেতরে এসে এখানে একটু বসবে ঠাকুরপো?’
‘না বউদি। ফিরে গিয়ে পল্টুদাকে এখুনি এই খবরটা আমাকে দিতে হবে।’
আমার কাজ শেষ করে বারান্দা থেকে নেমে এলাম। আমি বুঝতেই পারছিলাম না এত রাতে পল্টুদা আমাকে ঠিক কী কারণে এখানে পাঠালো। যার জন্য আমাকে ঠেলে পাঠালো সেই বউদিকে তো মোটেই উদবিগ্ন বা চিন্তিত মনে হল না। যাহোক এবার ঘরের দিকে ফিরে চললাম। কিন্তু আমার ফিরে যাওয়াটা মোটেই সহজ হল না।


           
গলি থেকে বেরিয়ে সেই সরু কাঁকুরে রাস্তাটায় পা দিতেই বড়ো রাস্তার দিক থেকে তিন চারটে টর্চের আলো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কেউ চেঁচিয়ে বলল - 
‘হল্ট!’ 
খানিক চমকে গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কড়া গলায় নির্দেশ ভেসে এল -
‘এদিকে এগিয়ে এসো। পালাবার কোনোরকম চেষ্টা করলেই গুলি করব!’ 
আমার সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। বক্তা বা বক্তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। সেদিক থেকে আসা টর্চের উজ্বল আলোয় আমার চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। হাত তুলে চোখ একটু আড়াল করার চেষ্টা করতে যেতেই আবার নির্দেশ এল - 
‘খবরদার! চোখমুখ আড়াল করার চেষ্টা করবে না! হাত নামাও! সোজা সামনের দিকে হাঁটতে থাকো!’
কাঁপা পায়ে সেদিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি যেতেই একজন বলে উঠল - 
‘এটাকে বেশ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এটাকে এখনই তুলে নেওয়া হোক।’ 
আমি আগেই শুনেছিলাম পুলিশ কাউকে নকশাল বলে তুলে নিলে আর সে ফিরে আসে না। তার সেই ভয়ানক প্রস্তাব শুনে অন্য আর একজন বলল - 
‘না, এটাকে তোলার আগে একবার বড়োবাবুর কাছে নিয়ে চল।’ 
           একজন আমার হাত চেপে ধরে একদিকে, সম্ভবত বড়োবাবুর কাছে নিয়ে চলল। জায়গাটা আমাদের স্কুলের সামনের চওড়া রাস্তা। আমার হাতের তালুর মতো সেই চেনা জায়গাটা এখন যেন কেমন অচেনা মনে হচ্ছিল। হয়তো এত গভীর রাতে কখনও সেখানে আসিনি বলে। অথবা সে রাতে সেখানকার চার দিকটা পুলিশ আর আতঙ্কে ভরা বলে বলে অচেনা লাগছিল।
 


বড়োবাবু অর্থাৎ ডায়মন্ডহারবার থানার বড়ো দারোগা খানিকদূরে একটা জিপের ধারের সিটে বসেছিলেন। এখানে ওখানে কালো মিশমিশে বেশ কয়েকটা ছোটোবড়ো পুলিশভ্যান অন্ধকারে গা মিলিয়ে যেন ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে আছে। জিপের একেবারে কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে দাঁড় করানো হল। ঠিক কোথায় কিভাবে আমাকে পাওয়া গেছে তাও জানানো হল। সবটা শুনে বড়োবাবু খানিকক্ষণ আমাকে খুঁটিয়ে
দেখলেন। তারপর শুকনো গলায় বললেন - 
‘তুমি এত রাতে একা একা ওখানে বাইরে ঘুরছিলে কেন?’ 
‘আমি, আসলে আমি -’ 
‘সত্যি কথা বলো কোথায় গিয়েছিলে। নইলে এখানেই ঠেঙিয়ে হাত-পা ভেঙে ফেলে রেখে দেব।’ 
‘আমি ওখানে বউদির কাছে গিয়েছিলাম।’ 
‘অ্যাঁ! খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরে এই রাত আড়াইটায় একলা চুপিচুপি বউদির কাছে যাওয়া হয়েছিল! বাঃ! বাঃ! দারুণ ব্যাপার তো! এই বয়সেই এতটা বেশি পেকে উঠেছ? তা কতক্ষণ আগে বউদির কাছে যাওয়া হয়েছিল?’ 
‘এখুনিই গিয়েছিলাম।’
‘এরকম রাতের বেলা এর আগে কত বার বউদির কাছে গিয়েছিলে?’
‘আজকেই প্রথমবার গিয়েছিলাম।’
‘আজকেই প্রথমবার! আচ্ছা, তা ঠিক কী জন্য আজ গিয়েছিলে?’ 
এবার পল্টুদা আমাদের ঘরে যাওয়া থেকে শুরু করে যা বলেছিল বা ঘটেছিল তার আগাগোড়া সবই বললাম। শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বড়োবাবু বললেন - 
‘এখুনি পল্টুর হোটেল রেড করো। যে কটাকে পাবে সব তুলে আনো। আর পল্টুকে স্পট করতেই হবে। সে পালালো কেন?’ 
           তৎক্ষণাৎ কয়েকজন পুলিশ দুদ্দাড় করে পল্টুদার হোটেলের দিকে দৌড়ে গেল। বড়োবাবু আমাকে বললেন - 
‘কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?’ 
‘ক্লাস টেন। এই স্কুলেই পড়ি।’ 
‘ক্লাস টেনে তোমার মোট ক’বছর হল?’ 
‘একবছর চলছে। আমি ক্লাস টেনের সেকেন্ড বয়।’ 
‘কোন সেকশন?’ 
‘এ’ সেকশন।’ 
     ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়? গ্রামের নাম কী?’ 
     ‘গ্রাম, ধান্যঘাটা।
         ‘থানা?’
         ‘থানা, মন্দিরবাজার।’ 
‘তোমার বাবা কী করেন?’ 
‘আমার বাবা ওখানকার স্কুল টিচার।’ 
‘আগামী কাল তোমাদের স্কুল আওয়ার্সে আমি এই স্কুলে আসছি। আজ রাতের মধ্যেই তুমি তোমার যে পরিচয় দিয়েছ তা আমি যাচাই করে নেব। কাল তুমি অবশ্যই স্কুলে আসবে। আমি হেডস্যারের ঘরে এসে তোমাকে ডেকে নেব। যদি দেখি একটা কথাও মিথ্যে বলেছ তাহলে কিন্তু মারাত্মক বিপদে পড়ে যাবে। আর কেমন ছেলে তুমি? তোমাকে কেউ এসে কিছু বলল, আর তখুনি তুমি তার কথায় বাইরে বেরিয়ে পড়লে? বিশেষ করে এত গভীর রাতে? যাও, এখন নিজের ঘরে চলে যাও। দু’জন এর সঙ্গে যাও। এদের ঘরটা ভালো করে খুঁজে দেখে এসো। যদি পল্টুকে পাও তাহলে তুলে নেবে। তবে মনে হয় তাকে ওখানে পাবে না’।




কী আশ্চর্য! পল্টু’দা সত্যিই আমাদের ঘরে ছিল না। পুলিশ দুজন ঘরের ভিতরে বাইরে তন্ন তন্ন করে পল্টুদাকে খুঁজল। কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। আমার দুই রুমমেট তখনও অকাতরে ঘুমাচ্ছে। পুলিশ দুজন খোঁজাখুঁজি শেষ করে নিজেদের মধ্যে নীচু গলায় কিছু আলোচনা করল, তারপর আমাকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তে বলে চলে গেল। 

হতভম্ব, ভ্যাবাচ্যাকা আর ভয়-পাওয়া - এসবের এক মিশ্র অদ্ভুত ভাব নিয়ে দরজা বন্ধ করে আমি বিছানায় গেলাম। খরখরে কাতর আমার চোখে ঘুম আসছিল না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর যখন পুলিশের কালো কালো ভয়ানক গাড়িগুলো খুব চাপা আওয়াজ করে চলে যাচ্ছিল তখনও হতনিদ্র আমি সেসব আওয়াজ কানের মধ্যে নয়, বুকের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ