ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

খানসাহেব -তুষার সরদার



|| এক ||

তি ন মূর্তির নিখুঁত একটি দল ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। দলের সদস্যরা শুধু লড়াকু নয়, তারা ভীষণ দুঃসাহসী এবং অত্যন্ত পোড়খাওয়া। আগে থেকে করে রাখা পরিকল্পনামাফিক কাজ যথাসম্ভব দ্রুততায় সেরে ফেলত তারা। দুর্দান্ত বোঝাপড়া ছিল তাদের মধ্যে। কাজে নেমে অকারণ বাক্যব্যয় বা সময় নষ্ট করতে হত না। দিনে দিনে তারা নিজেদের কাজে আরও দক্ষ আরও শাণিত হয়ে উঠছিল।

ওরা তিনজন-ইসমাইল, অজিত আর জামশেদ টাকা রোজগারের একটা পোক্ত লাইনে ঢুকে পড়েছিল। লিডার ছিল ইসমাইল। রেল লাইনের শালকাঠের স্লিপার আর ইস্পাতের জিনিসপত্র চুরি করে এনে অন্যত্র বেচে দেবার লাইন। সব পি.ডব্লু.আই. অফিসের ঘেরা চত্বরের এদিকে ওদিকে ডাঁই করা থাকে রেললাইনে ব্যবহার্য হরেকরকম জিনিস। শালকাঠের স্লিপার, স্লিপারের পাতি, স্লিপারের চাবি, ফিসপ্লেট, ছোটো বড়ো নাট বল্টু, বেড়া বা ফেনসিং দেবার জন্য লোহার লম্বা লম্বা পাতি ইত্যাদি নানা রকমের ইস্পাতের বা লোহার জিনিসপত্র আলাদা আলাদা স্তূপ করে রাখা থাকে। প্রয়োজনমতো রেলকর্মীরা সেখান থেকে সেসব জিনিস নিয়ে গিয়ে রেল লাইন মেরামতির কাজ করে। 

রাত যখন একটু একটু করে বুড়ি হতে থাকে, তার চোখে আঁধারের ছানি পড়ে চোখ ঘোলাটে হয়, তার পর বুজে আসতে থাকে তখন স্টোর অফিসের চত্বরে মাঝে মধ্যেই কয়েকটা ছায়া ছায়া শরীর নিঃশব্দে নড়ে চড়ে বেড়ায়। রাত ডিউটিতে থাকা ছগন চৌকিদার সে সময় অফিস চত্বরের এক অন্ধকার কোণে বসে খুব সুবিধাজনক ভাবে ঝিমোয়।

ছগন চৌকিদার পুরুষানুক্রমে ভারী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ও চৌকিদার। ছগনের বাবা অযোধ্যা চৌবেও পি.ডব্লু.আই. অফিসে চৌকিদারের কাজ করত। ছগনের বয়স যখন প্রায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তখন তাকে বড়ো বাবুয়ানিতে ধরল। আগে বিহারে নিজের দেশবাড়িতে ছগন খেতি-বাড়ির কাজ কাম করত। শাদি ভি হয়ে গেছিল। রামজীর কৃপায় চার-পাঁচটি বালবাচ্ছাও হয়েছিল। 

এমন সময় হঠাৎ একদিন ছগন খেতি-বাড়ির কাজ বন্ধ করে সাফ সাফ তার বাবা অযোধ্যাকে জানালো, সেও বংগালে গিয়ে চাকরি করবে বাবার মতো। আর মিট্টি ঘেঁটে হাত গন্ধা করবেই না। অনেক বুঝিয়েও কিছুতেই তাকে থামানো গেল না। তার এক কথা, সে আর এই দেহাতের গাঁওমে থেকে গিয়ে খেতি-বাড়ির কাজ করবেই না। অগত্যা ছগনের বাবা অযোধ্যা হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি, দেড় কেজি বাগদা চিংড়ি আর কেজি আড়াই এর একটা কাতলা মাছ নিয়ে সন্ধের মুখে পি. ডব্লু. আই. সাহেবের পায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

পরের সপ্তায় ছগন, পিতা অযোধ্যা, বয়স সাতাশ বছর, শিক্ষাগত যোগ্যতা -তৃতীয় শ্রেণী অকৃতকার্য, -  চৌকিদারের অস্থায়ী পদে নিযুক্ত হল। তার পর তিন বছর বাদে স্থায়ী পদে বহাল হয়ে গেল বারো তেরো বছর অতিরিক্ত চাকরি অর্থাৎ ষাট বছরের জায়গায় বাহাত্তর তিয়াত্তর বছর বয়স পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা সমেত।

চৌকিদারের চাকরিতে খানিকটা পেকে ওঠবার পর ছগন বুঝে গেল চৌকিদারের চাকরিতে চোখ আর কানের সঠিক ব্যবহার জানাটা খুবই জরুরি। কান বা চোখের ঝাঁপ সময়মতো ফেলে দিতে পারলে বাড়তি টাকা রোজগার হওয়ার নানা সুবিধা হয়। জামশেদদের সঙ্গে চুক্তিতে এল সে। চোখ, কান বন্ধ রাখার সে গূঢ় চুক্তিতে আরও ঢুকে পড়ল স্টোরবাবু এবং পি.ডব্লু.আই.সাহেব এবং স্থানীয় আর.পি.এফ. বা রেলসম্পদরক্ষী বাহিনীর লোক।

ব্যবসাটা দুর্দান্ত রকম জমে উঠেছিল। কখনও নতুন বা আধপুরনো শালকাঠের স্লিপার, কখনও রেললাইনে ব্যবহার্য ইস্পাতের নানা মালপত্র ছোটো ম্যাটাডোরে চেপে মাঝে মাঝেই নিরুদ্দেশ যাত্রা করছিল। ছগন, ছগনের সাহেব, স্টোরবাবু, আর.পি.এফ. সব্বাই যে যার ন্যায্য বখরা নির্ঝঞ্জাটে পেয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এসে গোলমাল বাধালো খানসাহেব। 


|| দুই ||

গতরাতেই ওরা এক বাঁধা জায়গায় খেপ মারতে গেছিল। সেখানে যেতেই ছগনচাচা তাদের তাড়াহুড়ো করতে তাগাদা দিচ্ছিল বার বার। সেজন্য এবারে গিয়ে বেশি মাল সরানো যায়নি। তবে যেসব মাল আনা হয়ে ছিল, সেগুলো ঠিকমতোই পাচার হয়ে গেছে। আজ রাতে সেই মালের নগদ পেমেন্ট পাবার কথা আছে। 

সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে আগের মতোই মসৃণভাবে। তবু ওদের তিনজনের মন খচখচ করছে সমানে সেই গতরাত থেকে। ছগনকে বড্ড আড়ষ্ট নির্জীব আর কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল - 
‘যত তাড়াতাড়ি পারিস কাজ শেষ কর। তাছাড়া এবারেই হয়তো শেষ কারবার। এরপর ভালো করে জেনে বুঝে আগেভাগে খবর করে তবে এখানে কারবার শুরু করবি কিন্তু!’
‘কেন ছগনচাচা, হলটা কী? বখরা আরো বেশি চাও তুমি? আল্লার কসম -’
‘না না, ওসব কথা নয়।’ 
‘তবে কী কথা? ঝেড়ে কাশো না বাপু।’
‘এখানে, - এখানে খানসাহেব এসেছে।’
‘খানসাহেব? সে সুমুন্দি আবার কে?’
‘আর.পি.এফের নয়া ইনসপেকটার – খানসাহেব।’
‘ধুত্তোরি! আমি ভাবলোম কে না কে? সে ব্যাটাও মাল চায় তো?’ 
‘মাল চাইলে তো ঝামেলা মিটেই যেত।’
‘তবে কী চায়? মেয়েছেলে? চেষ্টা করলে তার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।’
‘না না, ওসব কিছু নয়। এ অন্যরকম চিজ আছে। একেবারে খুনে। পরে শুনবি সব। এখন কেটে পড়। তবে এই হয়তো শেষবার। আর -’
‘আর কী চাচা?’
‘একটু সাবধানে থাকিস তোরা। তোদের খোঁজখবর লাগাচ্ছে বলে মনে হয়।’
‘লোকটা টাকা চায় না, মেয়েছেলেও চায় না, কিন্তু কিছু একটা তো চায় বটে। সেইটা কী বলো না!’
‘সেইটা যে কী সে তো আমিও বুঝতে পারছি না। অন্যদের মুখে শুনেছি কী সব আটঘাট বাঁধছে। কী কেসে কাকে ফাঁসাবে কে জানে?’


|| তিন ||

সন্ধে হয়ে গেছে। স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে নির্জন এলাকায় রেললাইনের গায়ে একটা ঝুপড়ি আছে ওদের। সেই ঝুপড়ির মধ্যে বসে ওদের নানা কাজের আগাম মতলব আঁটা, কাজ হাসিলের পর লব্ধ টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় এখানে। অবসর সময়ে সন্ধের পর তাসের জুয়া, দিশীর বোতল খোলাও হয় এখানে। 

কুপি জ্বালিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে বসে অপেক্ষা করছিল ইসমাইল আর জামসেদ। অজিত পেমেন্ট নিয়ে এলে ভাগাভাগিটা করা হবে। ততক্ষণ সময় কাটাবার জন্য তাস নিয়ে বসেছে ওরা। কিন্তু তেমন জমেনি খেলা। একটা কঠিন সমস্যা হতে চলেছে ওদের। সমস্যাটার নাম খানসাহেব। তাস খেলতে গিয়ে ওদের মধ্যে সেই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া হচ্ছিল।

‘এতো মহা বাগড়াই কেস হতে যাচ্ছে রে জামশেদ! ইচ্ছামতো ধান্দা করে পেট চালাবি তার উপায় নেই?  এরপর ওই শালা আমাদের দিকেও সত্যি সত্যি হাত বাড়াবে নাকি? তাহলে যেটুকু করে খাচ্ছিলাম সেসব তো বন্ধই হয়ে যাবে।’ 

বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে ইসমাইল। জামশেদ তার ডান হাঁটুর উপর তিন চার বছরের পুরনো দাদটা একমনে চুলকাচ্ছিল। ইসমাইলের কথায় চুলকানিটা থেমে যায় তার। একটু অনিশ্চিত গলায় বলে - 
‘মনে তো হয় না। আমাদের এদিকের ব্যাপারটা এখনও ঠিক জানে না বোধহয়। জানবেই বা কী করে? তাছাড়া আমাদের ছগনচাচা তো রয়েছে ওখেনে। ওর কাছেই নিশ্চয়ই ওর সব খোঁজখবর আগাম পেয়ে যাব। সেই বুঝে ধান্দা চালানো যাবে।’
‘আচ্ছা ওই শালা খানসাহেব না কী যেন, - ও ব্যাটা কী করে ধরবে আমাদের? কোন প্রমাণ আছে ওর কাছে?’ 
‘কিসের প্রমাণ? তাছাড়া আমাদের তো চেনেই না। আমাদের ধরতে অনেক অসুবিধা আছে।’ 
দুটো বিড়ি একসাথে ধরে লম্পর শিখায় বিড়ির মুখের দিকটা পোড়াতে পোড়াতে উত্তর দেয় জামশেদ। একটু পুড়ে উঠলে ইসমাইলের হাতে একটা দেয়। অন্য বিড়িটা নিজের মুখে গুঁজে প্রথম টানটা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ঝুপড়ির বন্ধ দরজাটা টেনে খুলে হঠাৎ করে ভিতরে ঢুকে এল একজন - অচেনা একজন। ঢুকেই সে ঝুপড়ির দরজাটা বন্ধ করে দেয়। 

ওরা প্রথমে অজিতের কথা ভেবেছিল। কিন্তু এ অজিত নয়। লোকটা মাঝারি লম্বা, পেটানো চেহারা। ছাইরঙা ট্রাউজার, কালো রঙের টি-শার্ট। পায়ে স্নিকার। ভড়কে গিয়ে কুপি নেভাতে বা বিড়ি টানতে ভুলে গেল দুজনেই। খুব ঠাণ্ডা গলায় লোকটা বলে ওঠে -
‘পালাবার বা কোনো রকম ঝামেলা করার কোসিস কোরো না। তাহলে একদম ফুঁড়ে দেব!’ 
এর মধ্যেই লোকটার ডান হাতে কখন একটা রিভলভার নিঃশব্দে উঠে এসেছে। কুপির আলোতে সেটা চক্‌চক্‌ করে উঠেছে। তার বাঁহাতে একটা লম্বা টর্চ।
‘তোমাদের মধ্যে ইসমাইল কৌন আছে?’ 


|| চার ||

খানসাহেব! নিশ্চয়ই এটা সেই খানসাহেব! ওরা চেনেই না তাকে, দেখেই নি কোনোদিন। শুধু নামটা কানে শুনেছে মাত্র। তবু ওদের কোনো সন্দেহ নেই এটাই খানসাহেব! এটা সেই শালা খানসাহেব ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না!
‘আমি ইসমাইল।’ 
শুকনো গলায় আস্তে আস্তে ইসমাইল নিরুপায় জবাব দেয়। লোকটা এবার জামশেদকে জিজ্ঞেস করে -
‘আর তুম কৌন আছে? অজিত না জামশেদ?’
‘আ-আমি অজিত! -না না মানে আমি জামশেদ।’
‘ঠিক হ্যায়। তুম অজিত ইয়া জামশেদ যো ভি হো, উস্‌মে খুব একটা কুছু আসবে যাবে না।’  
লোকটা একটু হাসল বোধহয়। কুপির ময়লাটে আলোতে তার হাসিটা ভালোভাবে বোঝা গেল না। তবে তার কাটছাঁট গলাটা ভালোভাবে বোঝা গেল -
‘শোনো ইসমাইল, তুমি দলের লিডার আছ, তোমাকেই বলছি তোমরা রেলের মালপত্র চোরি করার কামটা ছেড়ে দাও। আমি এককথা দু-বার বলি না কিন্তু। প্রথম বার বলাটাই হচ্ছে আমার শেষবার বলা। তোমাদের শরীরে তাগদ আছে। অন্যভাবে ইনকাম বানাবার চেষ্টা করো। তাতে না হয় দুবেলা মাছ-ভাত জুটবে না। কিন্তু আখির মে ধরা পড়ে জেলের লপসি তো খেতে হোবে না। বিবি-বাচ্ছা ভুখা তো মরবে না। ছোটো খাটো ব্যাবসা বা রিক্সাভ্যান চালিয়ে তো পেট চালাচ্ছে অনেক লোক। তোমরা সেসবও তো করতে পারো।’ 
রিভলবার সমেত ডান হাতটা এতক্ষণে ট্রাউজারের পকেটে আলতো ঢোকায় খানসাহেব। বিশ্রীভাবে ফুলে ওঠে ডান পকেটটা। আড়ষ্ট গলায় ইসমাইল আস্তে কথা বলে ওঠে -
-‘ব্যাবসা করার জন্য টাকা বা রিক্সাভ্যান কেনার টাকা কোথায় পাব?’
-‘হুঁ-, সমঝ গিয়া। নানা জায়গায় বখরা দিতে দিতে আর পেট চালাতেই চোরির মাল বেচার টাকা শেষ হয়ে যায়। তবু এসব কাম চালিয়েই যাচ্ছ! ঠিক হ্যায়। ফাইন্যালি কী করবে ওহি আগে ঠিক কর। ব্যাবসা করার টাকা বা রিক্সাভ্যান কেনার টাকার জোগাড় হয়ে যাবে। কাল বিকেলে সোনাইপুর আর. পি. এফ. পোস্টে এসো। আমার সঙ্গে কথা হবে। সৎপথের কাজকামে এসো ভাই, আমি তোমাদের পাশে আছি। লেকিন আবার রেলের মাল চোরির পথে গেলে -’ 
একটু থামে খানসাহেব। তার পর ওদের চোখে চোখ দিয়ে খুব ভয়ংকর গলায় বলে ওঠে - 
-‘অ্যারেস্ট নেহি করুঙ্গা ...গোলি মার দুঙ্গা!’ 
কথা শেষ করে বন্ধ দরজাটা টেনে খুলে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে খানসাহেব অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে যায়। কুপির আলোতে ঝুপড়ির দরমার বেড়ার গায়ে ওদের ছায়াগুলো কাঁপতে থাকে।

পরদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওরা তিনজন সোনাইপুর আর. পি. এফ. পোস্টে যাবার বদলে ঝুপড়িতে দিশীর বোতল আর ঝাল চানাচুর নিয়ে বসল। যথেষ্ট যুক্তি তর্কের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মত ভাবে তিন সদস্যের কমিটির এই মত প্রতিষ্ঠিত হল যে বর্তমান ধান্দাটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো এই ধরণের ধান্দার চেষ্টা করতেই হবে ইনশাল্লা! খানসাহেব যাই বলুক না কেন রিক্সাভ্যান চালিয়ে বা আনাজ কিনে বেচে তারা তাদের ইজ্জত এবং জিন্দেগী কিছুতেই বরবাদ করবে না।

এরপর ঠিক ছাব্বিশ দিনের মাথায় শেষরাতে ইসমাইলরা আর একবারের জন্য খেপ মারতে গিয়েছিল পি. ডব্লু. আই. চত্বরে এবং সেখানেই অজিতের সঙ্গে সকাল পর্যন্ত শুয়ে থাকল ইসমাইল, হাসপাতালের ডোম কালো পলিথিন আর কালচে বাঁশটা নিয়ে আসা পর্যন্ত। অজিতের বুকে গুলি লেগেছিল। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই সে খুব বাধ্যভাবে চুপচাপ হয়ে গেছিল। 

ইসমাইলের পেটে গুলি লেগে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো হাত দিয়ে চেপে ধরে পেটের ভিতরে ঢোকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত সে থেমে যায়। জামশেদ ম্যাটাডোরে মাল গোছানোর দায়িত্বে ছিল। ঘন ঘন গুলির শব্দ শুনে কোনোমতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিল সে। গুলিতে টায়ার ফাঁসা ম্যাটাডোরের চালক পালাবার চেষ্টাও করতে পারেনি, ভয়ে কাঁপছিল।
ছগন চৌকিদার ভোর না হতেই মুলুকের ট্রেন ধরে তাদের দেহাতে চলে গেল। এখানে নোকরি আর করবেই না সে। খানসাহেব সে রাতে এসে তার মুখ হাঁ করিয়ে ভিতরে রিভলভারের নল ঠেসে দিয়ে বলেছিল - 
-‘আজ তোকে জিন্দা ছেড়ে দিলাম। ভালো চাস তো আপনা দেহাত মে ভাগ যা। খেতি-বাড়ি কর গিয়ে। এরপর যদি আবার এখানে তোকে কোনোদিন দেখি, তাহলে মুর্দা হয়ে সোজা মর্গে ঢুকে যাবি।’


|| পাঁচ || 

শুধু ইসমাইলদের নয় সাউথ সেকশনে যত এই ধরণের চক্র ছিল সব ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল খানসাহেব। জামশেদ বেশ কিছুদিন অনেক দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াল। তারপর পরিস্থিতি পুরো শান্ত হবার পর যখন শুনল খানসাহেব তার কোনোরকম খোঁজ আর করছে না তখন সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এল। বেশ কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকার পর সে হেদাতুল্লার দলে ভিড়ে গেল।

হেদাতুল্লাও সেই রেলের জিনিসপত্রের কামকাজই করে। হেদাতুল্লা অবশ্য জামশেদের মতো রেললাইনের লোহা, কাঠ বেচার মতো গোবদা কাজ করে না। হেদাতুল্লার কারবারের আইডিয়াটা অন্য রকমের, বেশ আধুনিক। এই কাজে খাটনি কম পয়সা বেশি। প্রথমে জামশেদকে দলে নিতে চাইছিল না হেদাতুল্লা। আনকো আনাড়ি লোক নেওয়া চলে না তার দলে। পরে যখন শুনল জামশেদ আগে ইসমাইলের দলে ছিল, তখন আর আপত্তি না করে তাকে দলে নিয়ে নিল।

 শহরতলির লোকাল ট্রেনের কামরাগুলোর শুধু যে বাইরেটাই দেখতে সুন্দর, তা নয় ভিতরটাও বেশ সুন্দর। দারুণ ঝকঝকে চকচকে। হালকা অথচ মজবুত বড়ো বড়ো বোর্ড নানারকমের দামী ধাতুর চওড়া প্যানেল দিয়ে আটকে ভিতরটা তৈরি করা হয়েছে। মূল্যবান বোর্ডগুলোতে মুখ দেখা যায়। ফুটবোর্ড দামী অ্যালয় স্টিলের তৈরি।

 হেদাতুল্লার দলটা কামরার ভিতরের ওইসব নানা দামী অংশ ভেঙে বের করে ট্রেনের বাইরে ফেলে দেয়।। তার পর সেগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন চোরাই মাল কেনার ঠেকে নিয়ে গিয়ে বিক্রির কারবার করে। একটু গ্রামের দিকে রেললাইনের দুপাশে বসতিহীন এলাকায় যেখানে একটা স্টেশন থেকে অন্য স্টেশন যেতে বেশি সময় লাগে সেগুলোই বাছে। ভর দুপুর বা বেশি রাতের অপেক্ষাকৃত নির্জন ট্রেন কাজের জন্য পছন্দ করে ওরা।

নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়লেই ওদের চার-পাঁচজনের দলটা ওঠে। ফুলহাতা শার্টের হাতায় লুকানো থাকে ছোট ছোট ভারী শাবল। সেগুলোর একমুখ চ্যাপটা ধারালো। অন্যমুখ সরু ‘V’ আকারের, যার খাঁজ দিয়ে স্ক্রু বা রিভেট তোলা বা ভাঙা যায়। ট্রেন ছাড়লেই ওরা ঝটপট কাজে লেগে পড়ে। মেঝের ধাতব চাদর, জানালার বিভিন্ন অংশ, প্যানেলের ধাতব পাত ইত্যাদি ভেঙে উপড়ে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের খোলা দরজা পথে ফেলে দিতে থাকে। তাদের নেশাগ্রস্ত গালিগালাজ আর উদ্যত শাবলের বিক্রমে উপস্থিত যাত্রীরা ত্রস্ত হয়ে কামরার একপাশে গিয়ে জড়সড় হয়ে থাকে। 

পরের স্টেশনে ঢোকার সময় ওরা শাবলগুলো আবার জামার হাতায় লুকিয়ে নেয়। ট্রেনের গতি একটু কমলেই ওরা চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে যায়। তারপর রেললাইন ধরে উলটো দিকে হাঁটতে থাকে। ভাঙা অংশগুলো কুড়িয়ে বস্তাবন্দী করে নির্দিষ্ট জায়গায় চালান দেয়। জামশেদ সে দলে ঢোকার সপ্তা তিনেকের মাথায় হেদাতুল্লার সঙ্গে হঠাৎ খানসাহেবের দেখা হল। বরং একথা বলাই ভালো খানসাহেব নিজেই এসে হেদাতুল্লার সঙ্গে দেখা করল।




|| ছয় ||

সেদিন হাটবার। গ্রামের হাট হলেও সেটা বেশ বড়ো হাট। সপ্তাহে দুদিন হাটবারে হাটে এসে দু’এক কাপ চা খাওয়া সবারই খুব ইচ্ছা। তিন চারটে বড়ো চা দোকান আছে। সবগুলোতেই ভিড়। দোকানের ভিতরে এবং বাইরে বাখারির তৈরি বেঞ্চি সব ভর্তি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অনেকেই চা খাচ্ছে। হেদাতুল্লা এক স্যাঙাতের সঙ্গে একটা দোকানের ভিতরে বসেছিল। খোস মেজাজে চায়ের ছোট্ট গ্লাসে সে চুমুক দিচ্ছে। এমন সময় সেই দোকানের সামনে হঠাৎ একজন অচেনা ফর্সা সুগঠিত চেহারার লোক এসে দাঁড়ালো।

নেভি ব্লু রঙের ট্রাউজার। ক্রিম রঙের টি-শার্ট পরা। ট্রাউজারের ডান পকেটটা বিশ্রীভাবে ফুলে উঁচু হয়ে আছে। পকেটের মুখে ডান হাতের আঙুলগুলো ঢোকানো আছে। লোকটি এসেই বিনা ভূমিকায় সটান হেদাতুল্লার দিকে চেয়ে বলল -
-‘হেদাতুল্লা, তোমার সাথে কথা আছে। বাহার এসো।’
খালি ব্যাগ হাতে হাটুরেরা এলোমেলো ভাবে ঘুরছে বা চায়ের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে তিন জন এবার সটান সতর্ক হয়ে দাঁড়ালো। তাদের হাত থাকা ময়লা বাজারের ব্যাগ খসে পড়ল। দেখা গেল তিন জনের হাতেই রিভলবার। দোকানের ভিতরে বসে থাকা হেদাতুল্লা অবশ্য ওই সামনের অচেনা একজনকেই দেখতে পাচ্ছিল। তার কান মাথা ঘিরে একটাই শব্দ ভীষণভাবে হিস্‌ হিস্‌ করছিল - 
...খানসাহেব! খানসাহেব! খানসাহেব! খান...!’
-‘বাহার এসো হেদাতুল্লা, কোনো ডর নেই। আমি এখন তোমাকে ধরতে আসিনি। তুমি বা তোমার আদমি আভি কোনো ঝামেলা না করলে গোলিও চলবে না। খানসাহেবের জবান কভি নড়ে না।’
এতক্ষণে চারপাশে ভিড় জমে উঠেছে। খানসাহেবের কথা অনেকেই শুনেছে। কিন্তু চোখে দেখেনি। প্রশংসা, সমর্থন, সমীহ মেশানো মনোভাব নিয়ে সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে, এগিয়ে এসেছে। আধখাওয়া চায়ের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে হেদাতুল্লা খুব শুকনো হয়ে বাইরে বেরিয়ে এগিয়ে এল সামনে। 
-‘হেদাতুল্লা, তোমার আব্বাজান একজন মুয়াজ্জিন। ইমানদার আদমির লড়কা হয়ে তুমি ট্রেন ভেঙে বেচে দাও। ইয়ে বহুত শরম কী বাত! ট্রেন ভাঙার কাম ছোড় দো ভাই। দশহাজার রুপেয়ার ট্রেনভাঙা মাল বেচে তুমি হয়তো দোহাজার রুপেয়া পাও। এদিকে জানালা ভাঙা, মেঝে ভাঙা ট্রেনে পাবলিক খত্‌রার মধ্যে যাওয়া আসা করছে। একাম ছেড়ে সিধা কাম কুছ করো। আমি তোমাদের হেল্প করতে পারি, সিধা কাম কাজের কুছ হদিশ ভি দিতে পারি।। সে কামে হয়তো খাটুনি বেশি আছে মগর ইজ্জত বাঁচবে, জান ভি বাঁচবে।’
জমে ওঠা ভিড়টা এতক্ষণে খানসাহেবের কথা শুনে সবটা বুঝে বা না বুঝে ক্ষোভে দুলছে। দু’চারজন বলেই উঠল - 
-‘স্যার ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। আমরা এক্ষুনি ওকে...’
-‘নো - ও!’ - গর্জে ওঠে খানসাহেব, -‘হর আদমির হক আছে অন্তত একবার ওয়ার্নিং পাবার। ওকে আজ কেউ কুছ করবে না। যাও ভাই হেদাতুল্লা তুমি এখান থেকে চলে যাও। কিন্তু তুমার শোচনেকা টাইম এই একবারই মিলবে। দুস্‌রা বার, - দুস্‌রা বার আমার সাথে তোমার দেখা হলে সেই দেখাটা কিন্তু স্পটেই হবে। তবে -’
একটু থামে খানসাহেব। সবাই উদগ্রীব হয়ে খানসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব ঠাণ্ডা গলায় খানসাহেব বলে - 
-‘তবে আমাদের সে দেখা যাতে কভি ভি না হয় তার জন্য আমি আল্লাহ্‌র কাছে মোনাজাত করব! তুমিও মোনাজাত কোরো হেদাতুল্লা, যেন আমাদের স্পটে দেখা না হয়! মাশ্আল্লাহ্‌!’ 
হতভম্ব ত্রস্ত হেদাতুল্লাকে আর বিস্মিত হাটুরে জনতাকে পিছনে রেখে খানসাহেব সঙ্গী তিন জনের সঙ্গে চলে গেল।




|| সাত ||

কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। একদম নতুন ঝাঁ চকচকে চার চারখানা আট বগির গাড়ি দিল এই সেকশনে। কামরার ভিতরের ঝকঝকে দামি ধাতুর বিভিন্ন অংশগুলো দেখে হাত নিশপিশ করতে থাকে হেদাতুল্লার। কিন্তু খানসাহেবের ভয় তাকে থামিয়ে দমিয়ে রাখে।

হঠাৎ একটা মস্তবড়ো সুযোগ এসে গেল। খানসাহেব দশদিনের ছুটিতে গেছে। সোনাইপুর স্টেশনের আর. পি. এফ. পোস্ট থেকে পাকা খবর এনেছে হেদাতুল্লার দলের পোক্ত লোক সুলেমান। গতকাল খানসাহেব চলে গেছে। তার মনে হাতে আর মাত্র ন’ দিন আছে। ন’দিনে অন্তত রাতে আর ভরদুপুরে আপ্রাণ খেটে সাত আটখানা কামরার মাল ভেঙে নামাতেই হবে। তবে একদিনও দেরি করলে হবে না। কাল থেকেই একটানা কাজে লাগতেই হবে।

ফুল টিম নিয়ে জরুরি প্ল্যান করতে বসে গেল হেদাতুল্লা। ঠিক করা হল কোন দিন, কখন, কোন স্টেশন থেকে কাজ শুরু করা হবে। ট্রেন-ভাঙা মালগুলো পাচারের দায়িত্বে কে কে থাকবে। পরিকল্পনা মতো সেদিনই দেউলা স্টেশন থেকে ওরা অন্যান্য দুচার জন যাত্রীর সঙ্গে ট্রেনে উঠল। একটু রাতের ট্রেন বেছেছে ওরা। ট্রেন ছাড়তেই ওরা ঝটপট্‌ শাবলগুলো বের করে ফেলল। পরের স্টেশন আসার মধ্যেই এই কামরার মাল ভাঙার কাজ সারতেই হবে। লিডার হেদাতুল্লা বীভৎসভাবে গর্জন করে উঠল -
-‘আমরা ট্রেন ভাঙব। সবাই যে কোনো একদিকে চলে গিয়ে চুপচাপ থাক্। যে খানকির ব্যাটা ঝামেলা করবি - জানে খতম করে দেব!’
হুড়মুড় করে ত্রস্ত সবাই কামরার একপ্রান্তে চলে যায়। এলাকা ভাগ করে নিয়ে ওরা দুমদাম করে প্রবল বিক্রমে শাবল চালাতে থাকে মেঝেতে, জানালা, দরজার মূল্যবান ধাতব প্যানেলে -’
-‘রুখ্‌ যাও!’ 
শক্ত জোরালো গলায় একটা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে কেউ। কিন্তু ওদের থামতে বলার এত সাহস হল কার! হেদাতুল্লা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকায় সেদিকে। ওদের সঙ্গেই লুঙ্গি পরা, চাদর মুড়ি দেওয়া একজন আধবুড়ো কুঁজো লোক এই কামরাতেই ওদের সঙ্গে উঠেছিল। এখন তার লুঙ্গি চাদর সব মেঝেতে পড়ে আছে। লোকটা ট্রাউজার - টি শার্ট পরা! ডানদিকের পকেটটা বিশ্রী ভাবে ফুলে ফুলে উঁচু হয়ে আছে। একদম সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে-ই হুঙ্কারটা দিল। 
-‘খানসাহেব!! শালা তাহলে ছুটিতে যায়নি?? তাহলে আজই ওই শালার ইন্তেকাল হবে!’
হাতের ধারালো ভারী শাবলটা প্রাণপণ জোরে খানসাহেবের মাথা লক্ষ্য করে নির্ভুল ভাবে ছুঁড়তে উদ্যত হয় হেদাতুল্লা। পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের ‘পুলিশ স্পেশ্যাল’ সযত্নে ধমকে ওঠে তাকে। ফুটবোর্ডে ঝড়াক্‌ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হেদাতুল্লা। তারপর কামরার সিলিংএর দিকে একদৃষ্টে সোজা তাকিয়ে থাকে। 

জামশেদ আর সুলেমান প্রচণ্ড আতঙ্কে পরের বুলেট এড়াতে প্রায় একই সঙ্গে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেয় বাইরে। দলের বাকি দুজন একটু
নতুন। তারা দিশেহারা হয়ে কামরার অন্যপ্রান্তে যাত্রীদের মধ্যে ঢুকে পড়ে সিটের তলায় আশ্রয় নিল।

হেদাতুল্লার লাশটা গড়িয়ে ট্রেনের বাইরে ফেলে দেয় খানসাহেব। তারপর এগিয়ে এসে সিটের তলা থেকে হিঁচড়ে বের করে সেই দুজনকে। তাদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলে - টু ইয়াং টু শ্যুট। তারপর রিভলভারটা পকেটে পুরে যাত্রিদের সাহায্যে দুজনকে পিছমোড়া করে বাঁধে। তারপর স্টেশনে ট্রেন থামতে তাদের নামিয়ে নিয়ে চলে যায়।

ট্রেন দুষ্কৃতীদের কাছে ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ালো খানসাহেব। অনেকসময় খানসাহেবকে সম্পূর্ণ আলাদা দু’জায়গাতে একই দিনে একই সঙ্গে দেখা গেছে বলে গুজব রটতে লাগল। দুষ্কৃতীদের কাছে খানসাহেব হয়ে দাঁড়ালো সাক্ষাৎ আজরাইল, আর সাধারণ মানুষের কাছে আল্লাহ্‌র ফেরেশ্‌তা। নিশ্চিন্ত নিরাপদ ট্রেন যাত্রা তাদের উপহার দিয়েছে খানসাহেব।

ট্রেনের অংশ ভাঙা, কেব্‌ল চুরি, ওভারহেডের তার চুরি, অন্যান্য চুরি ও অপরাধের যতগুলো চক্র গড়ে উঠেছিল সেই সেকশনে সবগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এনকাউন্টারে মারা গেল সাত-আটজন অত্যন্ত কুখ্যাত চাঁই। চাঁই’রা হঠাৎ খুন হয়ে যেতে লিডারের অভাবে দলগুলো ভেঙে গেল। খানসাহেব নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাদের ক্রিমিন্যাল কেসে ঝোলাবার বদলে বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করে দিল।

কিছুদিন পর বাবা কিংবা মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে হঠাৎ খানসাহেব এবার সত্যি সত্যিই কিছুদিনের ছুটি নিয়ে উত্তর প্রদেশের কানপুরে নিজের বাড়িতে চলে গেল। দীর্ঘদিন কেটে যাবার পরও খানসাহেব এ অঞ্চলে আর ফিরে এল না। শেষে লোকমুখে শোনা গেল কানপুরে এক পথ দুর্ঘটনায় খুব গুরুতর ভাবে জখম হয়েছে খানসাহেব। পরে শোনা গেল খুব সম্ভবত হাসপাতালেই মারা গেছে খানসাহেব। মোটমাট খানসাহেব আর কখনও ফিরে আসবে না এবং তার কোনো খবরও নেই বলে এই এলাকায় বলে সবাই বলাবলি করছে।


|| আট ||

যেদিন হেদাতুল্লা গুলি খেয়ে উলটে পড়ল সেদিন ট্রেন থেকে সুলেমান আর জামশেদ দুজনে দুদিকে লাফিয়ে পড়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সুলেমান যেখানে লাফিয়ে পড়েছিল সেটা ছিল শক্ত কাঁকুরে জমি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাড় ভেঙে তার মৃত্যু হয়। জামশেদ দৈবাৎ একটা বড়ো ঝোপের উপর পড়েছিল। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ খানিকটা কেটে ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু হয়নি তার। 

খানসাহেবের মৃত্যুর গুজব শুনে জামশেদ একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারল না বটে, কিন্তু খানসাহেবের দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাকে ধীরে ধীরে উৎসাহিত করে তুলল। তার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাল যে খানসাহেব সত্যিই মরে গেছে। খুঁজে খুঁজে জনাতিনেক পুরনো স্যাঙাতকে পেয়ে গেল। শলা-পরামর্শ চলল বেশ কিছুদিন ধরে। খাটা-খাটনির সাদাসিধে কাজ তারা আর করবেই না।

তার পর সবচেয়ে বেশি পোড়খাওয়া জামশেদের নেতৃত্বে দলটা কাজে নামবে বলে ঠিল হল। ওই ট্রেনেই কাজ করবে ভাবল ওরা। ট্রেনের কাজ করে ওরা অভ্যস্ত। তবে এবার ট্রেন ভাঙা নয়। আরও একটু সূক্ষ্ম কাজ করা হবে - ট্রেনে ছিনতাই। এটাতে ঝুঁকি একটু বেশি কিন্তু লাভও অনেক বেশি। বিশেষত খানসাহেব যখন আর এ তল্লাটেই নেই তখন ঝুঁকি অনেক কম হয়ে যাচ্ছে।

দুপুরের দিকে আজকাল খুব ভিড় হচ্ছে ট্রেনে। তাই ওরা বেশি রাতের ট্রেন বাছলো। প্ল্যানমাফিক রাত দশটা দশের লোকাল ট্রেনে একটা স্টেশন থেকে ওরা যাত্রী সেজে উঠে সিটে বসল। ফুলহাতা জামার ভিতরে লুকানো চপার, ভোজালি, ছুরি।

ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই ওরা তিনজন উঠে দাঁড়ালো। কামরার বেশ কয়েকটা টিউব অকেজো। ফলে আলো বেশ কম। ছড়ানো ছেটানো ট্রেনযাত্রীদের নিশ্চিন্ত ঝিমুনি ছটকে গেল জামশেদের বাজখাঁই হুঙ্কারে। তার হাতে ঝক ঝক করছে মাংস-কাটা বড়ো চপার। চোখে মুখে নির্ভেজাল খুনির হিংস্রতা। 

আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে সামনেই বসা এক মহিলার গলার চেনটা এক হ্যাঁচকায় ছিঁড়ে নিল। চিৎকার করে বলে উঠল -
-‘দুল দুটো খুলে দে! নয়তো ছিঁড়ে নেব।’ 
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মহিলাটি কানের দুল খুলতে লাগল। স্যাঙাতরা যে যেমন পারছে অন্যান্য যাত্রীদের টাকাপয়সা-গয়না কেড়ে নিচ্ছে। দুর্দান্ত সহজ আর মসৃণভাবে কাজ চলছে। সবার চোখেমুখে ওদের প্রত্যাশিত ভয়... কোথাও কোনো প্রতিরোধের চিহ্নমাত্র নেই।
এমন সময় হঠাৎ জামশেদের নজর পড়ল লোকটার ওপর। সামনের ফুটবোর্ডের এক কোণে প্রায় কিনারায় আলো আঁধারিতে কে যেন দাঁড়িয়ে! ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা মাঝারি লম্বা চেহারা। গনগনে জ্বলন্ত দুটো চোখ মেলে এদিকেই তাকিয়ে দেখছে। তার ট্রাউজারের ডানদিকের পকেটটা সেইরকম বিশ্রীভাবে ফুলে উঁচু হয়ে আছে।
-‘খানসাহেব!!’
চোখের নিমেষে হাতের ধারালো চপারটা সজোরে খানসাহেবের দিকে ছুড়ে মারে জামশেদ। চপারটা নিঃশব্দে খানসাহেবকে ফুঁড়ে বেরিয়ে ওপারে গিয়ে ঠং করে কোথাও লেগে ছিটকে বাইরের অন্ধকারে চলে যায়। ভারী চপারটা তো ঠিকমতোই লাগল, কিন্তু ওর কিছুই হল না!! খানসাহেবের ডানহাতটা এবার ট্রাউজারের ফুলো পকেটের উপর চলে এসেছে। এখন কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝে ফেলে জামশেদ। সঙ্গী দুজন স্তব্ধ জামশেদকে বলে ওঠে -
-‘কী হল বস্‌?’
তার পর তারা জামশেদের দৃষ্টি অনুসরণ করে ভীষণ ভাবে চমকে ওঠে। ভয়ানক আতঙ্কে প্রাণপণে চিৎকর করে ওঠে জামশেদ - 
-‘পালা! ঝাঁপা! খানসাহেব!!’
দু-এক মুহুর্তের ব্যবধানে পর পর চারটি দেহ ট্রেন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। আচমকা সেইসময় ওভারহেড তারের কারেন্ট চলে গেল। সব কামরার আলোগুলো একসঙ্গে ঝুপ করে নিভে গেল। জনবসতিহীন নিরালোক মাঠের মধ্যে রেললাইন আঁকড়ে ধরে হুড়মুড় করে হতভম্ব ট্রেনটা আন্দাজে ছুটতে ছুটতে মিলিয়ে যেতে থাকে দূরের অন্ধকারের দিকে...’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ