
১
৯৬০ এর দশক থেকে মহাকাশ গবেষণা ও মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বের
প্রধানত আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বেশ কয়েক দশক জুড়ে স্থায়ী
ছিল। অন্যান্য গ্রহের তুলনায় চাঁদের প্রতি ছিল তাদের প্রবল আগ্রহ। যেকারণে এক
দীর্ঘকাল ধরে চাঁদে আজ অবধি ১২ জন মানুষ পাঠিয়েছিল আমেরিকা; কিন্তু এই অবতরণ
মিশন ১৯৭২ অবধি প্রচলন রেখেছিল। এর পাশাপাশি উদ্ভব হয়েছিল রোভার মিশন, যেখানে
প্রযুক্তির অগ্রগতিতে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নই আবার নিজের প্রভাব বিস্তার ঘটায়।
কিন্তু এসবের মাঝে মহাকাশ গবেষণার স্বপ্ন সত্যি করার জন্য দিন গুনছিল সদ্য
স্বাধীন হওয়া দেশ ভারত। ১৯৬২ সালে বিজ্ঞানী ডক্টর বিক্রম সারাভাই এর
প্রতিনিধিত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (ইনকোসপার)
নামে এক গবেষণাকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। নানান রকমের প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে
পথ চলা শুরু হয় মহাকাশ গবেষণার। প্রথম প্রথম নিম্ন রেঞ্জের রকেট উদ্ভাবন করে
সেটির ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতো। পরে ১৯৬৯ সালে, এই ইনকোসপার নামটি পরিবর্তিত
হয়ে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) নামে প্রচলিত হয়। ক্ষুদ্র সময়ের
ব্যবধানেই “আর্যভট্ট” উপগ্রহ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে মহাকাশ গবেষণায় নিজেদের
পদচিহ্ন দিতে শুরু করে ভারতীয়রা। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে ২০০৮ সালে চাঁদেও
ইমপ্যাক্ট মিশন চন্দ্রযান-১ এর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ভারতীয় মহাকাশ
গবেষণাকেন্দ্র,দেশকে এক উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এরপরে আর পিছন ফিরে তাকাতে
হয়নি ইসরো কে। ২০১৯ এর অর্ধসাফল্যের দ্বিতীয় চন্দ্রযান (চন্দ্রযান-২) মিশনের
অরবিটর কে একমাত্র সাফল্যের সঙ্গী করে ২০২৩ এর ১৪ই জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের
শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে এলভিএম৩ এম৪ উৎক্ষেপণ রকেটের
মাধ্যমে চাঁদের দিকে পাড়ি দেয় চন্দ্রযান-৩। এটি একটি রোভার মিশন; যার
ল্যান্ডারটি “বিক্রম” এবং রোভারটি “প্রজ্ঞান” নামে নামাঙ্কিত করা হয়। গতবারের
ব্যর্থতাকে ভুলে গিয়ে এবারে আরো নতুন প্রযুক্তির সংযোগের মাধ্যমে, ২৩ শে আগস্ট
সন্ধ্যা ৬ টা ২ মিনিট নাগাদ চন্দ্রপৃষ্ঠে সফটল্যান্ডিং করে চন্দ্রযান-৩। অবতরণ
স্থলের চন্দ্র স্থানাঙ্ক ছিল ৬৯.৩৬৭৬২১° দক্ষিণ অক্ষাংশ ও ৩২.৩৪৮১২৬° পূর্ব
দ্রাঘিমাংশ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) এবং চীনের পর
চতুর্থ দেশ এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরণ করা প্রথম দেশ হিসাবে এক নতুন
ইতিহাস রচনা করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র ইসরো।
যে বিষয়গুলি মিশনকে আরো সাফল্য এনে দিয়েছে:-
চন্দ্রযান-২ এর থেকে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডিং অঞ্চল ৪০ গুন বড়ো করে দেওয়া
হয়, অর্থাৎ যেটা ৫০০×৫০০ মিটার ছিল সেটাকে বাড়িয়ে ৪×২.৪ কিমি. করে দেওয়া
হয়। চন্দ্রযান-২ এর যে অরবিটার টি আজও চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সেটির
দ্বারা তোলা চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি বিক্রম ল্যান্ডারের মধ্যে ইনস্টল করা হয়, যার
ফলে অবতরণ অঞ্চল অনুধাবনে কোনো সমস্যা না হয়। নতুন সফটওয়্যার মডিফিকেশন এবং
আরো সোলার প্যানেল লাগানো হয় যাতে দক্ষিণ মেরুর অন্ধকার প্রান্তে থেকেও সংযোগ
বজায় রাখা যায়। যা বর্তমানে অনেকটা সুফলদায়ক হয়েছে এছাড়াও অনেক সেন্সরকে
উন্নত করা হয়েছে কমিউনিকেশন বজায় রাখার জন্য আর সাথে জ্বালানির পরিমাণও
বাড়ানো হয়েছে। যার ফলে চন্দ্রযান-৩ চাঁদের পৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করেছে।
কী কী মডিউল/পেলোড ও সেন্সর রয়েছে এবং তাদের কাজ:-
চন্দ্রযান-৩ এর মধ্যে ৩ প্রকার মডিউল রয়েছে। যথাক্রমে- ল্যান্ডার,রোভার এবং
প্রোপালসন মডিউল। এই প্রোপালসন মডিউলটির কাজ ল্যান্ডার মডিউলকে চাঁদের
নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপন করা এবং তারপর এটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে চাঁদকে
প্রদক্ষিণ করে চলা। এটির মধ্যে একটি বিশেষ যন্ত্র রয়েছে যা দিয়ে অন্যান্য
গ্রহের সন্ধান করা যেতে পারে; যার নাম দেওয়া হয়েছে স্পেকট্রো-পোলারমিট্রি অফ
হ্যাবিটেবল প্ল্যানেট আর্থ (শেপ)।

বিক্রম এবং রোভার মডিউলের মধ্যে থাকা যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ গুলো বিশেষ
গুরুত্বপূর্ণ। যা চন্দ্রপৃষ্ঠে জলের অনুসন্ধান,সেখানকার তাপমাত্রা ও তার
ধূলিকণার পরীক্ষার মাধ্যমে নানান তথ্য তুলে ধরেছে।
২৬ কেজির “প্রজ্ঞান” রোভারের মধ্যে দুটি বিশেষ যন্ত্রাংশ রয়েছে। যেগুলি
হলো- লেজার ইনডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপি (এলআইবিএস)এবং আলফা পার্টিকেল
এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (এপিএক্সএস)। প্রথমত, উভয়ের কাজ চন্দ্রপৃষ্ঠে মাটি,
ধুলো এবং পাথরের মধ্যে নানান রাসায়নিক পদার্থের বিশ্লেষণ করা,কিন্তু পদ্ধতি
ভিন্ন। এলআইবিএস প্রধানত লেসার ফোকাসের মাধ্যমে চাঁদের পৃষ্ঠে প্লাজমা সৃষ্টি
করে তার বিশ্লেষণ করে এবং এপিএক্সএস আলফা রশ্মি প্রদানের মাধ্যমে তেজষ্ক্রিয়
পদার্থের অনুসন্ধান করে। এটির নিজস্ব ৬টি চাকা রয়েছে যা রোভারটিকে চাঁদের
পৃষ্ঠে বিচরণ করতে সাহায্য করে।
১৭২৬ কেজির “বিক্রম” ল্যান্ডারের মধ্যে প্রধানত ৪টি বিশেষ যন্ত্রাংশ রয়েছে।
যেগুলি হলো-
রেডিও অ্যানাটমি অফ মুন বাউন্ড হাইপারসেনসিটিভ আয়নোস্ফিয়ার অ্যান্ড
অ্যাটমোস্ফিয়ার (আর.এ.এম.বি.এইচ.এ) প্রধানত ৫ সেমি. লম্বা একটি ধাতব শলাকা
(প্রোব),যেটি ল্যান্ডারের ওপরের অংশে থেকে বাতাসে ইলেকট্রন ঘনত্বের মাত্রার ওপর
প্লাজমা কে বিশ্লেষণ করে বাতাসে বিভিন্ন আয়নের অস্তিত্ব অনুসন্ধান করে।
চন্দ্রের সারফেস থার্মো ফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট (চ.এস.টি.ই) নামমাত্র,
স্পষ্টতই চাঁদের পৃষ্ঠে গভীরতা অনুযায়ী তাপমাত্রার রকমফেরকে বিশ্লেষণ
করে।
![]() |
বিক্রম ল্যান্ডার |
লুনার সিসমিক অ্যাক্টিভিটি যন্ত্র (ই.এল.এস.এ) চাঁদের ভূকম্পন-সংক্রান্ত তথ্য
তুলে ধরতে বিশেষ ভাবে সহায়ক।
নাসা প্রদত্ত লেজার রেট্রোরেফ্লেক্টর অ্যারে (এলআরএ) চাঁদের পৃষ্ঠে নানান
রিফ্লেক্টর স্থান গুলিকে লেসার দ্বারা চিহ্নিত করে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারটির
সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করে।
চাঁদ সম্পর্কে যে সকল তথ্য এখনও অবধি জানা গেছে চন্দ্রযান-৩ এর
মাধ্যমে:-
“প্রজ্ঞান” রোভারে থাকা এ.আই.বি.এস এবং এ.পি.এক্স.এস এর মাধ্যমে চাঁদের দক্ষিণ
মেরুর কাছে সালফার এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা বিশ্বে সকল বিজ্ঞানীদের
কাছে এক অবিশ্বাস্য তথ্য এনে দিয়েছে। আর প্রাথমিক বিশ্লেষণে চন্দ্র পৃষ্ঠে
অ্যালুমিনিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ক্রোমিয়াম এবং টাইটানিয়ামের
উপস্থিতি উন্মোচন করেছে। আরও পরিমাপ ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন এবং অক্সিজেনের
উপস্থিতি প্রকাশ করেছে। হাইড্রোজেনের উপস্থিতি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত
চলছে।
“বিক্রম” ল্যান্ডারে থাকা—
আর.এ.এম.বি.এইচ.এ চাঁদের বাতাসে প্লাসমাকে অনুসন্ধান করে ইলেকট্রন ঘনত্বের
প্রেরিত কারেন্টকে বিশ্লেষণ করেছে। আর প্রাথমিক মূল্যায়ন ইঙ্গিত করে যে চন্দ্র
পৃষ্ঠকে ঘিরে থাকা প্লাজমা তুলনামূলকভাবে বিক্ষিপ্ত, যা প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ইলেকট্রন পর্যন্ত সংখ্যার ঘনত্ব দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই
মূল্যায়ন বিশেষভাবে চন্দ্র দিনের সময়ের প্রাথমিক পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত।
প্রোবটি কোনো বাধা ছাড়াই কাজ করে, যার লক্ষ্য চন্দ্র দিন জুড়ে
কাছাকাছি-পৃষ্ঠের প্লাজমা পরিবেশে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলি অন্বেষণ
করা।
![]() |
বিক্রম ল্যান্ডার |
চ.এস.টি.ই চাঁদের সর্ব উপরিস্থানে থাকা ভূত্বক থেকে প্রতি সেমি.
গভীরতায় উষ্ণতার পরিবর্তনকে যাচাই করে। আর এটির প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায়
প্রতি ২ সেমি. গভীরতায় উষ্ণতা প্রায় ১০° হারে হ্রাস পায়।
ই.এল.এস.এ-তে ছয়টি উচ্চ-সংবেদনশীলতা অ্যাক্সিলোমিটারের একটি ক্লাস্টার
রয়েছে, যেগুলি সিলিকন মাইক্রোমেশিনিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
কোর সেন্সিং এলিমেন্টে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশে-গঠিত ইলেক্ট্রোড সহ একটি স্প্রিং-মাস
সিস্টেম থাকে। বাহ্যিক কম্পনগুলি স্প্রিং এর বিচ্যুতি ঘটায়, যার ফলে
ক্যাপাসিট্যান্সের পরিবর্তন ঘটে যা ভোল্টেজে রূপান্তরিত হয়। যা থেকে সহজে
চাঁদে ভূকম্পন হলে সেটির মাত্রা জানা যায় এবং এটির নতুন তথ্যও পেশ করেছেন
ইসরো’র বিজ্ঞানীরা।
0 মন্তব্যসমূহ