ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

সেই বাদল মেঘের মানুষটি - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়




বাদল মেঘের মানুষটি”- পিওন থেকে প্রকাশক

বই – পিওন থেকে প্রকাশক

লেখক – বাদল বসু

প্রকাশনী – আনন্দ

পৃষ্ঠাসংখ্যা – ৬১৬

প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৬


প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সুমিত্র বসাক, পি এস কুট্টি, রৌদ্র মিত্র এবং সুদীপ্ত দত্ত

মুদ্রিত মূল্য - ৭৫০/- 


ভরাট ও আন্তরিক গলায় সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- "লিখেও টাকা পাওয়া যায়!" তারপর দরাজ গলায় হেসে বলেছিলেন- "আমার একটা ছোটদের কাগজ আছে তাতে কাজে লাগবে।"

'বুধসন্ধ্যা'- র নিমন্ত্রন পত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন- "খাওয়া হবে আঠারো, চান্স হল পাঁঠারও। বুধসন্ধ্যায় হঠাৎ 'ইলিশদুপুর' কিংবা 'চিংড়িদুপুরে'-র পর এবার এক বর্ষাকালের দুপুরে পাঁঠার মাংসের ভোজ। ……… "


বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, কম কথা বলা, তীক্ষ্ণ চোখের চাউনি এবং গোঁফও তীক্ষ্ণ, স্বভাবে শান্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা, কঠোরভাবে ধার্মিক আজীবন নিরামিষাশী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভুতে বিশ্বাসী। ভুতকে তিনি অনুভবও করেছেন এবং সেই অনুভুতি থেকেই লেখা- 'মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি'।


বুদ্ধদেব বসু প্রকাশনার খুঁটিনাটি জানতেন। তাঁর লেখা 'পাতাল থেকে আলাপ' বইয়ের বিজ্ঞাপনের 'কেদাক্ত' শব্দচয়ন সঠিক অর্থ বহন না করায় পাল্টে দিয়ে 'বেদনাবিদ্ধ' বা 'বিস্ময়কর' করতে বলেছিলেন।


গৌরকিশোর ঘোষ নকশাল আন্দোলনের জেরে জেলবন্দী থাকাকালীন সাঙ্কেতিক চিঠি পাঠাতেন- যা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ হলেও গভীর অর্থ বহন করত।


হাসিখুশি আড্ডাপ্রিয় এবং বারবার বাড়ি বদল করা বিমল কর ছিলেন অত্যন্ত সাবধানী ও ভীতু প্রকৃতির মানুষ। গাড়ি চালানো শিখেও ভয়ে গাড়ি চালাননি কোনদিনও। তাঁর চালকের নাম ছিল 'বাঘ'। দাঁত তোলার ভয়ে আতঙ্কিত বিমলবাবু চলন্ত বাসে উঠে পড়েছিলেন।


লি ঙ্কন স্ট্রিটের এক বিদ্যুৎহীন বস্তিতে হ্যারিকেনের আলোয় অবিস্মরণীয় সব ছোটগল্প লিখে চলেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র।


হাসপাতালের শবাগারে একটির পর একটি ড্রয়ার খুলে খোঁজা হচ্ছে শিবরাম চক্রবর্তীর মৃতদেহ। অবশেষে মিলল তাঁর প্রসন্ন মুখ।


অত্যন্ত সুদর্শন নায়কোচিত সুরথ বসু যিনি সমরেশ বসু, কালকূট বা ভ্রমর ছদ্মনামে বিখ্যাত, একটানা লিখতে পারতেন, যাঁর লেখায় একটাও কাটাকুটি থাকতো না, যিনি লেখার প্রতিটি বিষয়ের গভীরে যাওয়ার জন্য নিখুঁত গবেষণা করে তথ্য সংগ্রহ করতেন। তিনি বলেছিলেন- "গৌরাঙ্গ প্রেসের অনেকের সাথেই পরিচয় হয়ে গিয়েছে। তাঁর মধ্যে বাদল বসু অন্যতম। ওঁর মেঘের মত গায়ের রঙ দেখেই বাদল নাম রাখা হয়েছিল কিনা জানিনা। অথবা বাদল দিনে জন্মেছিলেন বলে। কিন্তু সেই কালো মুখে সাদা ঝকঝকে হাসিটা উজ্জ্বল।………"


বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের এই ধরনের বহু আলাপচারিতা, চিঠি, বার্তালাপ, উপন্যাস সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী, আড্ডার গল্প, ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে আনন্দ প্রকাশনীর অন্যতম কর্ণধার বাদল বসুর আত্মজীবনী রচনা "পিওন থেকে প্রকাশক" এক কথায় অনবদ্য এক গ্রন্থ। তাঁর শৈশবের কথা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে ছোট ছোট অনুগল্পের সমাহারে সমৃদ্ধ করে এই রচনা। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে সেই সময়কালের শহর-দেশ-বিদেশ।



বাদল বসু
বাদল বসু


বাদল বসুর জন্ম ১৯৩৭ সালে ঝাড়গ্রামের দহিজুড়িতে। ছোটবেলা গ্রামের বাড়িতে কাটালেও পরে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। প্রথম জীবনে তিনি ঘি বিক্রি করেছেন, চালের দোকানে বসেছেন। তারপর ছাপাখানার কাজ। শুরু করেছিলেন ছাপাখানার কনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে। জীবনের চরাই-উৎরাই ধাপে-ধাপে পেরিয়ে একসময় তিনি হয়েছিলেন আনন্দ প্রকাশনীর কর্ণধার। সেই সূত্রে তাঁর বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষদের সান্নিধ্যে আসা, বিশ্বের বিভিন্ন বইমেলায় অংশগ্রহণ করা এবং প্রকাশক হিসাবে অগুন্তি ভালো ভালো বাংলা বই প্রকাশ করার অভিজ্ঞতা হয়। তাঁর জীবনে তিনি সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অমর্ত্য সেন, শিবরাম চক্রবর্তী, গৌরকিশোর ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিমল কর, বুদ্ধদেব বসু, বুদ্ধদেব গুহ, রমাপদ চৌধুরী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, লীলা মজুমদার, হুমায়ুন আহমেদ, বেলাল চৌধুরী, শঙ্খ ঘোষ, বাণী বসুর মতো বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। পেশাদারী সম্পর্ক অনেক সময়ই ব্যক্তিগত সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। সাক্ষী থেকে গেছেন প্রচুর ঘটনার। সেই সব অভিজ্ঞতার কথাই তিনি টানটান গদ্যে লিখে গিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা, 'পিওন থেকে প্রকাশক' গ্রন্থে। যে লেখা পড়লে শুধু সেইসব মানুষজনদের নিজস্ব জগৎকেই চেনা যায় না, সেই সঙ্গে চেনা যায় এক সময়কে-  যাকে আমরা বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে জেনে থাকি।


এ বইয়ের প্রতি ছত্রে মিশে আছে অভিজ্ঞতার রেশ, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, বিখ্যাত মানুষদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকে। প্রত্যেক গুণীজনের পাঠানো কয়েকশো চিঠি অতি যত্নে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন তিনি। যদিও তথাকথিত গল্প-উপন্যাসপ্রেমী পাঠকদের এই আবেগবর্জিত প্রায় পেশাদারীসুলভ লেখনী পছন্দ নাও হতে পারে। তবে নিজের প্রিয় লেখকের বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকলে এই বই অবশ্য পাঠ্য। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ইতিবাচক সুন্দর দিকগুলো তুলে ধরার সাথে সাথে কিছু স্বনামধন্যের নেতিবাচক দিকের কথাও বলেছেন লেখক। কিন্তু তা কখনই সীমা লঙ্ঘন করে কারও বদনাম তৈরি করেনি। বইটির অনেকটাই জুড়ে আছেন সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে তাঁর প্রিয়তম ছিলেন তা তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়।


বইয়ের একটি ছোট্ট ঘটনা বলে আমি লেখা শেষ করব। ঘটনাটি পড়ে আমি খুব মজা পেয়েছিলাম —

সত্যজিৎ রায়ের গল্পের একাংশ এমন ছিল।

"জানেন ভানুবাবু, আমার তো একটু খ্যাতি হয়েছে। নেহরুজিকে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেই বলেন, ‘ইয়েস মিস্টার রে, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ!' তাই বিলেত গিয়ে নীরদবাবুকে ফোন করলাম। ভাবলাম একটি বিগলিত উত্তর পাব। বললাম, ‘হ্যালো, আমি সত্যজিৎ রায় ফোন করছি।’ অপরপ্রান্তে নীরদবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তাতে কী এল-গেল'।’"


এই বই শুধু আত্ম অভিজ্ঞতাই নয়। এই বই বহু হারিয়ে যাওয়া লেখক সাহিতিক্যের খোঁজ দেয় আমাদের। আমার বইয়ের তালিকায় যুক্ত হয়ে যান এখনও না পড়া সাহিত্যিকের নাম ও রচনা। বাদল বসু নিজেই বহু লেখকের পরিচয় প্রসঙ্গে আক্ষেপ করে গেছেন-

"বাংলা পাঠক কোনোদিন জানল না তিনি সাহিত্যের ইতিহাসে কতকিছু করে গেছেন বা কেউ তাকে মনে রাখল না বা তাকে অনেকেই চিনল না"।

মল্লিকা সেনগুপ্তের কথায়- "আমাদের সেই বাদল মেঘের মানুষটি'- র প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা যিনি বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেলেন এক অজানা অধ্যায়ের সাথে।"


লেখকের লেখার বিষয়ে তো আমরা সবাই জানতে পারি। কিন্তু লেখকদের বিষয়ে জানতে ক’জন পারি? পাণ্ডুলিপি থেকে একটি বই ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার পশ্চাতে যে বিপুল পরিমাণ পরিশ্রম থাকে তাও কি আমরা জানতে পারি? কোন কোন লেখক যে নিজের লেখা লিখেই শুধু ক্ষান্ত হতেন না, সেই বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে অলঙ্করণ সমেত যাবতীয় বিষয়ের খুঁটিনাটিও স্বচ্ছভাবে ব্যক্ত করতেন তাও আমরা কোনোদিন জানতে পারিনা। এই বই সেই সমস্ত বিষয়ের অসাধারণ বর্ণনা দেয়। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন এবং যারা বইয়ের বিষয়ে জানতে চান, তাদের অবশ্য পাঠ্য এই বই।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ