প্র
তি বছরের মত এই বছরও এক বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জীবনের
শ্রেষ্ঠ আনন্দময় উৎসব দুর্গোৎসব প্রায় আসন্ন। আগামী ২রা কার্ত্তিক, ১৪৩০
দুর্গাষষ্ঠী। সারা বছরের ক্লান্তি, হতাশা, দুঃখ, বেদনা, গ্লানি, হিংসা, ক্লেশ
সমস্ত কিছু ভুলে বছরের এই ক’টি দিন সারা পৃথিবীর সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিরা
মেতে ওঠেন উৎসব যাপনে। এবং এর মাধ্যমেই প্রাণভরে সঞ্চয় করে নেন আগামী একটি
বছরের বেঁচে থাকার রসদ।
দেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিই সাধারণত বিভিন্ন অঞ্চলে অধিক পূজিত
হয়। কিন্তু এরই মাঝে কিছু কিছু জায়গায় উৎসবের আমেজে ভিন্নতা আনার লক্ষ্যে
দেবী দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন রূপ পূজিত হয় বা বলা ভালো দর্শনার্থীদের জন্য
প্রদর্শিত হয়। দেবী দুর্গার একশত আটটি রূপের কথাই সমধিক প্রচলিত। কিন্তু
অধিকাংশ মানুষই দেবীর বিশ্বরূপ বা সহস্র রূপের বিষয়ে আজও অজ্ঞাত। দেবী
দুর্গার বিশ্বরূপ ধারণের সেই পুরাণকথাই আজ আমি বলব।
বর্তমান কল্পের সৃষ্টির প্রাক্কালে একদা লোকপিতামহ ব্রহ্মা ও পুরুষোত্তম
নারায়ণ নিজেদের মধ্যে আলাপে রত ছিলেন। ব্রহ্মা একসময় অহংকারবশত নারায়ণকে
বললেন, "আপনি সর্বাত্মক, অনন্ত, সর্বপ্রাণীর অন্তরাত্মা ও পরমাত্মা। আমি
সর্বলোকের মহেশ্বর, আমিই ব্রহ্মা পরমপুরুষ। আপনি ও আমি ভিন্ন অন্য পরমেশ্বর
নেই। বস্তুত, আমরা একমুর্ত্তি, লোকপিতামহ ও নারায়ণ- এই দুইরূপে ভিন্ন মাত্র।"
বিষ্ণু এই কথা শুনে বললেন, "অহংকারই বিনাশের মুল। আপনি কি প্রকৃতিপুরুষের
ঈশ্বর, অব্যয় অধিপতি ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞাত নন? যোগীশ্রেষ্ঠগণও যে মহেশ্বরকে
দর্শণ করতে পারেননা, আপনি সেই অনাদিনিধন ব্রহ্মস্বরূপ মহাদেবের শরনাপন্ন
হোন।" ব্রহ্মা এতে বিষ্ণুর উপর ক্রুদ্ধ হলেন। বিষ্ণুকে কটূক্তি করে তিনি
বললেন, "ওহে বিষ্ণু, তুমি এখনও কিঞ্চিৎ নিদ্রাগ্রস্ত আছো বলে মনে হচ্ছে।
নিদ্রা ত্যাগ কর, স্বীয় আত্মাকে অবলোকন কর। পরমব্রহ্ম সম্পর্কে আমি সম্যকরূপে
জ্ঞাত, সেই সঙ্গে এটাও আমার জ্ঞাত যে তুমি-আমি ভিন্ন তাঁর অন্য কোনো প্রকাশ
নেই। " বিষ্ণু তখন কেবল, "আপনি পারমেশ্বরী মায়ার দ্বারা মোহিত হয়েছেন"
বলে স্তব্ধ হলেন। ব্রহ্মার দর্পচূর্ণ করার জন্য সেখানে তেজোময়, জটাজুটশোভিত,
শূলপাণি, পরমনিধি মহাদেব আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মা মহাদেবকে দর্শণ করে অভিভূত ও
মোহিত হলেন ও বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করলেন, "হে জনার্দ্দন, শূলপাণি, ভীষণকায়,
ত্রিলোচন এই তেজোময় পুরুষ কে?" বিষ্ণু তখন মহাদেবের স্বরূপ কীর্তণ করলেন,
"ইনিই দেবাদিদেব মহাদেব। ইনিই স্বয়ং জ্যোতিঃস্বরূপ, অচিন্ত্য, শংকর, শম্ভু,
ঈশান, সর্বাত্মা, পরমাত্মা। ইনি ধাতা-বিধাতা ও প্রকৃতিপুরুষের ঈশ্বর। ইনিই
চরাচর সৃজন করেন, রক্ষা করেন; এমনকি কালরূপে তার বিনাশও করেন। ইনি আপনাকেও
সৃজন করেছেন, বেদসকল ইনি হতেই সৃষ্ট। হে লোকপিতামহ, আপনার দিব্যচক্ষু হোক।
দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে আপনি ব্রহ্মাধিপতি যোগেশকে সম্যকরূপে আত্মস্থ করুন।"
দিব্যদৃষ্টির মাধ্যমে ব্রহ্মা সম্মুখস্থিত পরমেশ্বরকে জানতে পারলেন। পরমজ্ঞান
লাভ করে ব্রহ্মা অনন্তর কৃতাঞ্জলিপুটে মহাদেবের স্তব করতে লাগলেন। মহাদেব
প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মাকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। ব্রহ্মা বললেন, "ভগবন, আমি
আপনাকে পুত্ররূপে অথবা আপনার সদৃশ একটি পুত্রের কামনা করি।" মহাদেব সস্নেহে
ব্রহ্মাকে হস্তদ্বারা স্পর্শ করলেন ও বললেন, "বৎস, তুমি যা প্রার্থনা করলে
তাই হবে। তোমার দিব্য ঐশ্বরজ্ঞান হোক, তুমি এক্ষণ বিবিধ জগৎ সৃজন কর ও
সর্ব্বভুতের আদিকর্ত্তারূপে তুমি সকল প্রাণীতে মায়াবিস্তার কর।"
![]() |
প্রজাপতি ব্রহ্মার জগৎ সৃষ্টি (চিত্র সৌজন্যঃ Ramanarayanadatta astir) |
এই বলে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। তখন প্রজাপতি যোগবলে ব্রহ্মা পূর্বের ন্যায় বিবিধ জগৎ সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি সনক, সুনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার; এই চারজন মানসপুত্র করে সৃষ্টি করলেন, এদের একত্রে “চতুঃসন” বলা হয়। তারপর ব্রহ্মা যোগের সাহায্যে মরীচি, ভৃগু, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষ, অত্রি এবং বশিষ্ঠকে সৃজন করলেন। এই জন্য পুরাণে এদের “নবব্ৰহ্মা” রূপে অভিহিত করা হয়। এঁরা সকলেই ব্রহ্মার তুল্য সাধক ও ব্রহ্মবাদী। দেবদেব পিতামহ ব্রহ্মা মরীচি প্রমুখ ঋষিদের এই ভাবে সৃষ্টি করে সেই সমস্ত মানসপুত্রের সঙ্গে তপস্যায় রত হলেন।
![]() |
অর্ধনারীশ্বর রূপ (চিত্র সৌজন্যঃ pinterest) |
এই তপস্যার সময়ে ব্রহ্মার মুখ থেকে কালাগ্নি উদ্ভূত ত্রিশূলধারী, ত্রিনয়ন, অতি ভীষণাকৃতি অর্ধনারীশ্বরের রূপ ধরে রুদ্র প্রাদুর্ভূত হলেন। তা দেখে ব্রহ্মা ভীত হয়ে বললেন, “নিজেকে বিভক্ত করে ফেল”। তারপর তিনি অন্তর্হিত হলেন। তাঁর কথায় রুদ্র নিজেকে স্ত্রী ও পুরুষরূপে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। সেই পুরুষ অংশটিকে এগারোটি ভাগে ভাগ করলেন। এই এগারোজন পুরুষ বিরূপাক্ষ, কপালীশ, অজপদ, পিঙ্গল প্রমুখ “একাদশ রুদ্র” নামে পরিচিত হলেন। তাঁরা ত্রিজগতের ঈশ্বর এবং দেবকার্যে নিজেদের নিয়োগ করলেন। মহাদেব নিজের সৌম্য-অসৌম, শান্ত-অশান্ত, সিত-অসিত রূপের সঙ্গে নারী অংশকেও নানা ভাগে ভাগ করলেন । রুদ্রের অংশস্বরূপ এই বিভূতিই লক্ষ্মী প্রভৃতি শক্তি নামে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে প্রচার লাভ করলেন এবং ঈশ্বরী শঙ্করী এই সমস্ত শক্তির সাহায্যে সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে রইলেন।
এই ভাবে বিভাগ করার পর ঈশানী নিজের অংশকে পৃথক করলেন এবং মহাদেবের আদেশে সেই মূর্তিতে পিতামহ ব্রহ্মার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মা তাঁকে বললেন, “তুমি দক্ষের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ কর”। ব্রহ্মার আদেশে তিনি দক্ষের ঔরসে প্রসূতির গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। দক্ষ কন্যা সতী শূলধারী দেবাদিদেব মহাদেবকে স্বামীরূপে গ্রহণ করলে দক্ষ তাঁর বিরোধিতা করেন ভগবান শিবকে অপমান করলেন। স্বামীনিন্দার অপমানে সতী দেহত্যাগ করলে শিব রুদ্রমূর্তি ধারণ করে মহাতাণ্ডবে সমগ্র বিশ্বচরাচর ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞায় ব্যাপ্ত হন। যদিও ভগবান বিষ্ণু কল্যানে সেই ধ্বংসলীলা শান্ত হয়ে যায়। ভগবান বিষ্ণু শোককাতর মহাদেবকে সান্তনাদানকালে বলেন, “শিব ও সতী অবিচ্ছেদ্য। সতী পুনরায় জন্মগ্রহণ করবেন এবং আবার আপনাদের মিলন ঘটবে।”
![]() |
দেবী পার্বতীর জন্ম (চিত্র সৌজন্যঃ নীলেশ মুখোপাধ্যায়) |
পর্বতরাজ হিমালয়ের স্ত্রী মেনা কন্যা কামনায় তপস্যায় রত ছিলেন। প্রজাপতির আদেশে কালক্রমে হিমালয়ের ঔরসে মেনার গর্ভে কন্যারূপে পরমেশ্বরী হৈমবতীর জন্ম হয়। মেনা ও হিমালয়ের কন্যারূপে দেবী শক্তি নিজ অভিলাষে পর্বতকন্যা অর্থাৎ “পার্বতী” রূপে জন্ম গ্রহণ করেন। মনোরম পার্বতীকে দেখে হিমবানের পত্নী মেনকা হিমবানকে বললেন, “রাজা, আমাদের তপস্যার ফলে সকল জীবের কল্যাণের জন্য উদ্ভূত পদ্মের মতো সুন্দরাননা কন্যাকে দেখুন”। হিমবান নিজ কন্যার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। নবোদিত সূর্যের মতো তাঁর রূপ, জটামণ্ডিতা। তাঁর তিন চোখ, চার মুখ, তীব্র স্পৃহা সমৃদ্ধ, আয়তনয়না অষ্টভুজা এবং চন্দ্রকলায় সজ্জিতা। সকল গুণ থেকে নিমুক্ত, তাঁকে প্রত্যক্ষ করা যায় সাক্ষাৎ গুণময়ী রূপে। তাঁর মধ্যে সৎ অথবা অসৎ কোনটিরই প্রকাশ নেই । হৈমবতী বলে জেনে জ্ঞান স্বরূপা, অতি লালসা, ব্যোমনাম্নী মাহেশ্বরী শক্তি, মঙ্গলময়ী সকল পদার্থে নিশ্চিতরূপে অনুসূতা, অনন্তা, ত্রিগুণাতীতা, অবয়বরহিতা, অদ্বিতীয়া অথচ তার বহু বিভাগ। ব্রহ্ম, তেজোরূপে পরমব্রহ্মে সংস্থিতা। সূর্যের ভাস্বর দীপ্তির মতো তার স্বাভাবিক প্রভা।
কন্যার এহেন রূপ দেখে ও তাঁর তেজে অভিভূত হয়ে হিমবান ভক্তিযুক্ত হয়ে করজোড়ে পরমেশ্বরীকে বললেন, “হে বিশালাক্ষ্মী, অর্ধেন্দুভূষিতে দেবি, আপনি কে? আপনাকে আমি জানিনা। আপনি যথার্থরূপে নিজের পরিচয় দিন।”
তখন যোগীদের অভয়দাত্রী পরমেশ্বরী হিমবানের কথা শুনে বললেন, “আমাকে মহেশ্বরে সমাশ্রিতা পরমাশক্তি বলে জেনো। অনন্যা, অনশ্বরা, অদ্বিতীয়া এই আমাকেই মুমুক্ষ ব্যক্তিরা দেখে থাকেন। আমি সর্ব জীবের আত্মা, সর্ব প্রকার কল্যাণ আমার মধ্যেই রয়েছে। নিত্য ঈশ্বর-বিষয়ক যে পরম জ্ঞান, তাই আমার রূপ। সমস্ত কার্যের আমি প্রেরণাদাত্রী । আমার অন্ত নেই, আমার মহিমার সীমা নেই । জীবগণকে আমি সংসার-সমূদ্র থেকে উদ্ধার করি। আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু, দিলাম, তুমি আমার বিভূতিসম্পন্ন রূপ দেখ”।
![]() |
দেবী পার্বতীর বিশ্বরূপ ধারণ (চিত্র সৌজন্যঃ pinterest) |
এই কথা বলে হিমবানকে দেবী নিজের পারমেশ্বর দিব্যরূপ তাঁকে দেখালেন। কোটি সূর্যের মতো সেই রূপের দীপ্তি, তা যেন তেজের বিম্বস্বরূপ, অসংখ্য অগ্নিশিখা তাতে নিশ্চল হয়ে আছে। শত শত কালানলের মতো তা ভীষণ, দ্রংষ্টাকরাল, দুর্ধর্ষ, জটাজুটমণ্ডিত। সেই দেবীর হস্তে ত্রিশূল আর বরদামুদ্রা। তিনি অতিভীষণা হয়েও সৌম্যকান্তি, সন্দরবদনা। তাঁর মধ্যে অনন্ত বিস্ময় লুকিয়ে আছে। তাঁর মস্তকে চন্দ্র শোভা পাচ্ছে, কোটি চন্দ্রের প্রভার মতো তাঁর লাবণ্য। তাঁর মাথায় মুকুট, হাতে গদা, পায়ে নূপুর, গলায় দিব্যমালা, পরণে দিব্যবস্ত্র। তিনি দিব্য সৌরভে অনূলিপ্ত। শঙ্খচক্রধারী এই কমনীয় মূর্তি ত্রিনয়না আর ব্যাঘ্রচর্মধারী। এই রূপে ব্রহ্মাণ্ডের বাইরেও যেমন ব্যাপ্ত, তেমনি ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরেও অনুস্যূত । এই রূপ সকলের বহিস্থ আবার অভ্যন্তরস্থ । এই রূপ সর্বশক্তিময়, শুভ্রবর্ণ, সর্বরূপধারী আর সনাতন। ব্রহ্মা, ইন্দ্র, উপেন্দ্র ও যোগীশ্রেষ্ঠগণ এর পাদপদ্মে নিত্য প্রণাম করেন। হিমবান দেবীর যে রূপে দেখলেন, তার সমস্ত দিকেই হস্ত, সমস্ত দিকেই পদ, সমস্ত দিকেই চক্ষ, আর সমস্ত দিকেই মস্তক ও মুখ। হিমবান আরও দেখলেন যে এই রূপে দেবী সমস্ত পদার্থ আবৃত করে রয়েছেন। পর্বতরাজ দেবীর এহেন মাহেশ্বরী রূপের দর্শন করে ভীত অথচ পুলকিত চিত্তে পরমাত্মায় আত্মসংযোগ করলেন, তারপর ওঙ্কার উচ্চারণ করে পরমেশ্বরীকে এক হাজার আটটি নামে স্তব করলেন।
অষ্টোত্তর সহস্র নাম দ্বারা স্তব করে দেবীকে কৃতাঞ্জলীপুটে হিমবান বললেন, “পরমেশ্বরীর ভয়ানক অপরূপ ঐশ্বর্য রূপ দেখে আমি ত্রস্ত হয়েছি, আপনি আমাকে অন্য রূপ দেখান।”
![]() |
মহেশ্বরী দেবী পার্বতী (চিত্র সৌজন্যঃ pinterest) |
পার্বতী নিজের ভয়ানক রূপ সংহরণ করলেন এবং হিমবানকে অন্য এক রূপ দেখালেন। সেই রূপ নীলপদ্মের পাপড়ির মত, নীল পদ্মের মতই তাঁর সুগন্ধ। অতীব সুন্দর এই দেবীর দুই নয়ন এবং তিনি কৃষ্ণঘন কেশে সজ্জিত। পদ্মের মতো পা দু’খানির তলদেশ রক্তবর্ণ, করতলও রক্তবর্ণ। অতি সুশ্রী ও বিলাসময়ী এক মূর্তি। ললাট তিলকে উজ্জ্বল, বিচিত্র অলঙ্কারে দেবীর অতি পেলব ও সুন্দর অঙ্গ সজ্জিত। বক্ষোদেশে তাঁর অতি বিশাল এক কনকমালা, তাঁর সুন্দর বিম্বসদৃশ ওষ্ঠে ঈষৎ হাসি। তাঁর পদ্মের মতো সুন্দর চরণে নূপুর ঝংকৃত। প্রসন্নবদনা এই দেবীর রূপ স্বর্গীয় আর অনন্ত মহিমার আধার।
শৈলরাজ এই রূপ দেখে সমস্ত আতঙ্ক ভুলে পূলকিত হয়ে পরমেশ্বরীকে বললেন, “আজ আমার জন্ম সার্থক হল, তপস্যা ফলবতী হল। কারণ আপনি অব্যক্তা হয়েও প্রত্যক্ষ হয়ে আমার দৃষ্টির সম্মুখে দেখা দিলেন। আপনি সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করেছেন । প্রকৃতি প্রভৃতি আপনাতেই অবস্থিত। আপনার মধ্যেই সমস্ত জগৎ লয় পায়। আপনি পরমাগতি। কেউ কেউ বলেন আপনি প্রকৃতি, কেউ বলেন আপনি প্রকৃতিরও পর, অন্য কোন কোন পরমার্থদর্শী বলেন, যেহেতু আপনি শিবে সমাশ্রিতা, তাই আপনি শিবা।“
এইরূপে হিমবান দেবীর গুণগান করার পর অঞ্জলিবদ্ধ হয়ে নত মস্তকে দেবীকে প্রণাম করলেন ও পরম আত্মজ্ঞানের উপায় জানতে চাইলেন।
এই কথা শুনে দেবী পরমেশ্বরী তাকে সেই পরম জ্ঞানময় উত্তম আত্মযোগ ও তার উপায়গুলির কথা সবিস্তারে যথাযথ ভাবে বললেন। গিরিরাজ লোকমাতার মুখপদ্ম থেকে নিঃসৃত পরম জ্ঞানের কথা শুনে যোগের প্রতি আসক্ত হলেন।
দেবী বললেন, “দিব্যযোগ লাভ করে ব্রহ্মলোক পার হয়ে দেবীর পরম স্থান লাভ করে সেই ব্যক্তি যে পবিত্র ও তদগত চিত্তে শিবসন্নিধানে ভক্তির সঙ্গে দেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন নামক অধ্যায় পাঠ করবে, সে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে দিব্যযোগ লাভ করে ব্রহ্মলোক পার হয়ে দেবীর পরম স্থান প্রাপ্ত হবে। ভক্তিযোগযুক্ত যে ব্রাহ্মণ, দেবীর এক হাজার আট নাম জেনে সূর্যমণ্ডলের মধ্যে স্থিতা দেবীকে আবাহন করে গন্ধপুষ্প দ্বারা পূজা করবে এবং দেবীর সঙ্গে মহেশ্বরের পরম ভাব স্মরণ করে অনন্য মনে আমরণ নিত্যদিন জপ করবে, সে মৃত্যুকালে স্মৃতি লাভপূর্বক পরমব্রহ্মে গমন করবে। অথবা সেই ব্যক্তি ব্রাহ্মণের পবিত্র কূলে জন্মগ্রহণ করে পূর্বজন্মের সমস্ত সংস্কারের মাহাত্ম্যে বেদবিদ্যা লাভ করে পরমেশ্বর সম্বন্ধীয় সেই দিব্য পরম যোগ প্রাপ্ত হবে এবং শান্ত সংযত হয়ে পরে শিবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি ত্রিসন্ধ্যা ঐ প্রত্যেকটি নাম উচ্চারণ করে হোম করবে, সে মহামারীকৃত দোষ এবং গ্রহবৈগুণ্য থেকে মুক্ত হবে। লক্ষ্মীলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি বিধি অনুসারে দেবী পার্বতীকে পুজো করে আলস্য ত্যাগপূর্বক সারাবছর দিবারাত্র এই সকল নাম জপ করবে। যে ব্যক্তি ভক্তির সঙ্গে দেবীর পার্শ্বস্থিত ত্রিনয়ন শম্ভুকে পূজা করে, সে মহাদেবের প্রসাদে বিপুলা শ্রী লাভ করতে পারে। অতএব দ্বিজগণ সমস্ত রকম যত্ন আশ্রয় করে সর্ব পাপ নাশের জন্য দেবীর সহস্র নাম জপ করবে। দেবীর মুখনিঃসৃত এই সকল বাণী শুনে হিমবান ধন্য হলেন। এই অনুপম দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা কালচক্রে ঋষি মুনিদের মাধ্যমে গোলোকধামে প্রচারিত হতে থাকল।
কৃতজ্ঞতাঃ কমলেন্দু সূত্রধর
তথ্যসূত্রঃ - কূর্মপুরাণম ( অনুবাদ- দেবার্চনা সরকার )
0 মন্তব্যসমূহ