গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ এই অরণ্যে কখনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। প্রত্যেকদিন বিকেলের দিকে অনঘ, রাজগৃহের কাছে এই বৃহৎ অরণ্যে ফুল কুড়োতে আসে। আগে বাবা জোর করে পাঠাতেন কিন্তু এখন না এলে অনঘের নিজেরই যেন কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই স্যাঁতসেঁতে, শীতল, সবুজ জঙ্গলের সোঁদা গন্ধে একটা মায়া আছে, একটা অভিভাবকত্ব আছে—যা ওর মতো একটা দামাল কিশোরকে শান্ত করার জন্য যথেষ্ট। বাবা শিবের নাম জপ করেন সারাক্ষণ। বিশেষ বিশেষ তিথিতে উপাসনাও করেন। তবে উপাসনার স্থান কেউ জানেনা। কিন্তু অনঘের মনে হয়, ভুলও হতে পারে, জায়গাটা শোন নদীর তীরে কোথাও।
সেদিন বিকেলে বড় একটা শাল গাছের পেছনে লুকিয়ে অনঘ কিছু ন্যাড়া মাথার মানুষ দেখেছিল। গেরুয়া কাপড় অদ্ভুত ভাবে প্যাঁচ দিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। আর সবসময় কিছু একটা বিড়বিড় করছিলেন সবাই। মনে হয় মন্ত্র-টন্ত্র কিছু। ও বাবাকেও রোজ দেখে মন্ত্র পড়তে, কিন্তু—কিন্তু এই মন্ত্র তো একদম অন্যরকম!
ঘরে এসে সে কথা বলতে গিয়েও বলা হয়নি বাবাকে। যদি প্রচন্ড রেগে যান!—বলা যায় না, তিনি এমনি খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। নতুন কিছু বিষয়ে বলতে গেলেই তিনি বলেন, অত ঔৎসুক্য ভালো না। পাঠে মন দাও।
যাইহোক, ঔৎসুক্য তো কমেইনি বরং দিন দিন বেড়েই চলল। একদিন ঐ 'অদ্ভুত' মানুষদের ডেরা খুঁজে বের করবে বলে মনস্থির করে নিল সে।
প্রায় নয়টি পূর্ণিমা পেরিয়ে গেছে। অনঘ বুঝতে পারছেনা তাঁদের কি খোঁজা ছেড়ে দেবে? অধ্যয়নে মন বসাতে পারছেনা সে; এমনিতে সে বুদ্ধিমান। চতুষ্পাঠীর গুরুদেব যদিও বলেছেন, কখনও নিজের প্রাপ্ত জ্ঞানে সন্তুষ্ট হলে চলবেনা। এই জ্ঞান কিছুই না, বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছুর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত এই জ্ঞান ধূলিকণার সমান।
অপেক্ষা, ধৈর্য। সাফল্যের আসল ভিত ওখানেই লুকিয়ে আছে—অনঘ জানতো। একদিন কেন যেন, শেষরাতের পর থেকেই অনঘ চঞ্চল হয়ে উঠল। শরীরে একটা চাপা যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু কেন? কিছুটা সজ্ঞানে, কিছুটা সম্মোহিত হয়ে ও জঙ্গলের দিকে ছুটে চলেছে। শরীর নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছু একটা হচ্ছে, যা আগে হয়নি ওর। আবহাওয়া শীতল হয়ে এসেছে এখন—পথের কুকুরগুলো কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। এখনও আবছা অন্ধকারে চতুর্দিক নিস্তব্ধ। দুই একটা মহাজনের ঘর থেকে প্রদীপের অত্যন্ত মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। আজকে অনঘ মোহের বশে অরণ্যের অন্যদিকে প্রবেশ করেছে, যে দিকটায় আগে কখনও যায়নি—আর তাছাড়া এপাশটা সাঙ্ঘাতিক নির্জন; একটা পাতা পড়লে জোড়ালো শব্দ মনে হয়। জায়গাটা ঘিরে কতরকম প্রেতচর্চার কাহিনী শুনেছে ও ছোটবেলায়। অনঘের ঘোর ভাঙল। একটা প্রকান্ড ছায়ামূর্তির নীচে বেশ কিছু মানুষের গুঞ্জন; তবে সেই গুঞ্জনে কোনো উত্তেজনা নেই, উগ্রতা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই অনঘ দেখল, ধীর গতিতে দিনের প্রথম কিরণ এই রহস্যময় আঁধারের ঘোমটা তুলে ফেলছে। ঠিক সেই সময়ে, তার নজর পড়ল সেই প্রকান্ড ছায়ামূর্তির ওপর—ওটা আসলে একটা বৃহৎ বৃক্ষ, বট কিংবা অশ্বত্থ অথবা পাকুড় তো হবেই। কুয়াশায় দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। ঠিক তার নীচে ধ্যানরত অবস্থায় এক ব্যক্তি। স্পষ্ট আলোয় দেখলো সে—তিনি কি জীবিত না মৃত?
এ কী দেখছে অনঘ! এ জগতের কিছু দেখছে কি? সেই ব্যক্তি চোখ খুলে কিছু একটা বোঝাচ্ছেন সামনে নীচে বসা মানুষগুলোকে। একটা কথাও তার কান অবধি যাচ্ছেনা তবু মনে হচ্ছে এই কথাগুলি শুনবার জন্যই অনঘের জন্ম। গুরুদেবের বলা বিশ্বসংসারের রহস্য উদঘাটন! অনঘ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই পবিত্র দৃশ্য গিলতে থাকে। হঠাৎ সে দেখে, সেই সৌম্যদর্শন সাধুটিকে কেন্দ্রে রেখে চারপাশ কেমন যেন ধূসর বায়ুতে ভরে যাচ্ছে। অস্বস্তি করছে, খুব গরম লাগছে ওর। সাধুটি এখন কথা থামিয়ে একদৃষ্টে অনঘকে দেখছেন। অনঘ অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে, অর্থহীন দৃশ্য—আগুন, ধোঁয়া, উদ্ভট পোশাক পরিহিত মানুষেরা, আর....আর দুটো ক্লান্ত চোখ।
|| দুই ||
"কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে ছুটি নেই, মাই ফ্রেন্ড! আরেকদিন যাবো—প্রমিস। তোর বৌকে শুধু ছলচাতুরী করে বাপের বাড়ি পাঠা; তারপর সারারাত পার্টি! উপস্! শুনে ফেলল নাকি? ইয়ে মানে, সরি সিস্টার, মজা করছিলাম...হা হা হা! আচ্ছা রাখি...তোমরা ভালো থেকো।"
মোবাইলটা রেখে কৌশিক একটু আপনমনে হাসল, তারপর আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসল। কাজের খুব চাপ এই সপ্তাহে। শনিবার স্পেশাল মিটিং আছে—তাই বন্ধুকে দেওয়া কথা রাখতে পারেনি ও। কথা ছিল শনিবার সকালে কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর নতুন বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে, পরদিন সকালে মায়াপুর ঘুরে তারপরের দিন অর্থাৎ সোমবার ভোরে ট্রেন ধরে সোজা অফিস। প্রমোশন হওয়ার ফলে মাইনে বেড়েছে আর সঙ্গে দায়িত্বও।
রাত দেড়টা। কৌশিক ঝিমোচ্ছে। একটা চমকে ওর ঘুম ভাঙ্গল। রাতে ডিনার করতে ভুলে গেছে, এখন মাঝরাতে আর খাওয়ার কোনো মানে নেই। শালিনীর সাথে ডিভোর্সের পর থেকেই কৌশিক এখন একা থাকে এই ফ্ল্যাটে। যদিও মাঝেমধ্যে ওদের দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যায়–তবে সেটা তাদের মেয়ের জন্মদিন, গার্জিয়ান মিটিং কিংবা পুজোর শপিং-এ।
বাইরে ঝোড়ো বাতাস বইছে। আকাশটাও লালচে; মনে হয় বৃষ্টি হবে। ব্যালকনিতে এসে একটা সিগারেট ধরাল কৌশিক। শীতল হাওয়ার স্পর্শে মনের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল তার। একটা সুন্দর সাজানো ছোট পরিবার! হতেই পারত। রাতে এখন বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে শোয়—সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো মাঝে মেয়ে থাকত আর ঐ পাশে স্ত্রী। আরামের ঘুম, আরামের জীবন। আর কী চাই? বেশি কিছু কখনোই চাইতে নেই। কৌশিকও চায়নি কোনোদিন। তবু অফিস থেকে ফ্ল্যাট, ফ্ল্যাট থেকে অফিস—এই যাতায়াতের মাঝে কোনও সুখী নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি চোখে পড়লে, মনটা কেমন করে ওঠে। ওর মনে সবসময় একটা দুশ্চিন্তা কাজ করে, কে জানে মেয়েটা বাবার ব্যাপারে কী ভাবে! আদৌ ভালো চোখে দেখে কিনা, এধরনের ঝামেলায় পড়ে সন্তানরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়—কৌশিক জানে। এইতো সেদিনও বিরিয়ানি খাওয়ার সময় মা-মেয়ে দুজনের কথাই মনে পড়ছিল।
এইসব ভাবতে ভাবতে সিগারেটটা কখন যে ফুরিয়ে এসেছে, ওর হুঁশ নেই। আঙুলে ছ্যাঁকা খেয়ে সম্বিত ফিরল। হঠাৎ চোখ পড়ল আলনার নীচে ঠেস দিয়ে রাখা একটা খবরের কাগজে মোড়ানো আয়তাকার বস্তুবিশেষ। ওহ্! হ্যাঁ!—মনে মনে বলল কৌশিক। আজকে বিকেলে আসার সময় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কাছে সিগনালে যখন ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল, তখন ও দেখে এক বৃদ্ধ আর্টিস্ট নিজের কিছু সৃষ্টিকর্ম বিক্রি করছিল। কিন্তু ব্যস্ত মহানগরীর সন্ধ্যেবেলায় গাড়ির জানালাগুলি থেকে একটা অবহেলিত প্রত্যাখান ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়না। দেখে মায়া হলো কৌশিকের। ও শিল্পের কদর বোঝে। পাঁচটা ছবির মধ্যে এই ছবিটাই ওর মনে ধরেছে। কিনে নিল।
কাগজ সরিয়ে ছবিটা খাটের ডানপাশে টাঙাতে টাঙাতে কৌশিক দেখল ছবিটা সত্যিই খুব সুন্দর। গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের নীচে বসে শিষ্যদের ধর্মের উপদেশ দিচ্ছেন। তাঁর শরীর থেকে যেন দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। সবাই করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকানো। চারিদিকে ঘন জঙ্গল, গাছপালা পশুপাখি। ছবির মধ্যেই অনেকদূরে কোনও একজন মানুষ গাছের আড়ালে দাঁড়ানো। কৌশিকের মনে হল, এটা বেশ বেমানান। বোধহয় শিল্পী তুলির ভুল টান ঢাকতে ঐ ব্যক্তিটিকে এনেছেন। যাইহোক, ছবির বিষয়টা সাধারণ। আগেও অনেক দেখেছে এই টাইপের ছবি। তবে এই আজকের ছবির মধ্যে একটা প্রাণচঞ্চল ব্যাপার রয়েছে।
মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। কত জাতকের কাহিনীই না শোনাতেন তিনি কৌশিককে। তার মধ্যে একটা কাহিনী...কী যেন ছিল...ভাবতে ভাবতে কৌশিক খাটে বসে পড়ে। দুইজন ফেরিওয়ালা...একজন সৎ আরেকজন অসৎ...সৎ ফেরিওয়ালাটি ছিলেন আসলে বুদ্ধদেব...
স্মৃতিচারণা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। গভীর রাতে একবার যেন তার মনে হলো, অনেক অনেক দূরে সে হারিয়ে যাচ্ছে, ময়ূর ডাকছে। অনেক মানুষ একসাথে কিছু বলছে। শান্তি...শান্তি...খুব শান্তি। কী একটা মিষ্টি গন্ধ সারা ঘরে। ঠান্ডা লাগছে, তবে মনোরম ঠান্ডা। কেন যেন মনে হচ্ছে, ও একটা জঙ্গলে শুয়ে রয়েছে। তবে চোখ খুলতে পারছেনা, চোখের পাতা খুব ভারী ভারী লাগছে।
একটা দমকা গরম বাতাসে কৌশিক ধড়মড় করে উঠে বসল।
|| তিন ||
অনঘ অচেতন হয়ে পড়েছিল অনেকদিন। উঠে দেখে মাথার কাছে বাবা বসে আছে। ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
"তোমার মতো একজন পুত্র পেয়ে আমি কি যে সমস্যায় পড়েছি। জানো তুমি কতদিন জঙ্গলে শুয়েছিলে? বাঘ-ভাল্লুক-নেকড়ে যে তোমাকে উদরসাৎ করেনি, সে আমার গতজন্মের করা পুণ্যের ফল। ভাগ্যিস কিছু ব্যাধ তোমাকে দেখতে পেয়েছিল সেদিন। ওরা বলছিল, ঐ অঞ্চলে নাকি শাক্যমুনি আর তাঁর শিষ্যেরা ছিলেন কয়েকদিন।"
অনঘ কিছু শুনতে পাচ্ছেনা অথবা ওর মন নেই সেদিকে। যে অবস্থায় ও শেষবার সজ্ঞানে ছিল, এখনও যেন সেখানেই আছে। কী হয়েছিল ওর? কেন এমন হচ্ছে? শাক্যমুনি...শাক্যমুনি বুদ্ধ! উনিই কি তাহলে সেদিন...
তাহলে, ওগুলো কী দেখছিল সে? আগুন, ধোঁয়াশা...এগুলোর অর্থ কী?
বাবাকে ও বলল, " উনি কোথায় বাবা?"
"কে?"
" শাক্যমুনি!"
" ওরা তো বলল, তোমাকে যেদিন উদ্ধার করা হয়েছিল, উনি তো সেদিনই সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন।"
অনঘ আর কিছু বলল না। বলতে পারল না। শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল।
|| চার ||
বহুতলটিকে ধীরে ধীরে আগুনের লেলিহান শিখা জড়িয়ে ধরছে। সঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কৌশিক প্রাণে বেঁচে গেল। পাঁচজনের দেহ এখনও অবধি উদ্ধার হয়েছে। দমকল কর্মীরা যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে কাজ করছেন।
জানলা দিয়ে কৌশিককে নামানো হয়েছে। ভাঙা কাঁচের জানালায় কনুই একটু কেটে গেছে।
ঘুম না ভাঙ্গলে কী যে হত! কৌশিক ভাবল। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে; মনে পড়েছে। ছবিটার কথাও মনে পড়ল। ওকে যখন নামানোর জন্য কোমরে হার্নেস বাঁধা হচ্ছিল, তখন, শেষবারের মতো ও ঐ ছবিটা দেখে।
তবে কৌশিক দুশ্চিন্তামুক্ত এখন। ল্যাপটপ আর মোবাইলটা সঙ্গে কোনোরকমে আনতে পেরেছে। আগামীকালের মিটিং-এ কোনও সমস্যা হবে না। আজকে রাতটা না হয় কোনও কলিগের বাড়ি থাকা যাবে। কী যে সব উটকো ঝামেলা। এইসব ভাবতে ভাবতে ও দেখতে লাগল, পুরো বিল্ডিংটা দাউদাউ করে জ্বলছে।
এদিকে অনঘ ছুটে চলেছে। জঙ্গলে, অন্ধকারে, কুয়াশার মধ্যে। আর ফিরে যাবে না, কখনও। শাক্যমুনির সঙ্গে একটু বাক্যালাপ করতে হবে। কিছু উত্তর ওকে জানতেই হবে। বিশ্বসংসারের সমস্তটুকু না জানা অবধি ওর শান্তি নেই। সমস্ত কিছুর রহস্যের সমাধান করতে হবে। ও খুব বিচলিত। ছুটে চলেছে...অনেকদূর যেতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ