ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

অভিযোজিতা মিঠুয়া -সুপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায়


জ্জ্বল শ্যামরঙা নিখুঁত সুন্দরী ভী-ষ--ণ  মিষ্টি মিঠুয়া। সোহাগের জন্মান্তরের বন্ধু। কে কখন কাকে প্রথম দেখেছিল, কিম্বা কাছাকাছি এসে খেলা করেছিল দু'জনের কারোরই স্মরণে নেই।

সোহাগের চোখে মিঠুয়া একাধারে বিশ্বসুন্দরী ও মহামানবীও বটে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কত সহস্রবার মুগ্ধ বিস্ময়ে খুঁটিয়ে দেখেও এক চুল অসৌন্দর্য্য খুঁজে পায়নি বেচারী! মাসের মধ্যে একবার অন্ততঃ বলবেই, 'উফ্ তুই যদি আমার যমজ বোন হতিস, কি ভালো হত!'


বয়ঃসন্ধির পর থেকেই সম ও অসম বয়সী পুরুষদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল মিঠুয়া। কত পুরুষ মানুষ যে তার সঙ্গে আলাপের প্রস্তাব রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। কাউকে অপমান না করে প্রতিজনের সঙ্গে আলাপচারিতার অছিলায় অন্য ধরনের সম্পর্ক পাতিয়ে কায়দা করে সরে এসেছে হাসিমুখে। একবার তো সোহাগের দূর-সম্পর্কের কম শিক্ষিত ও বেকার টুটুদা সোহাগদের বাড়িতে হঠাৎ করেই নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করে বেশ উত্যক্ত করতে শুরু করল বোনটিকে। 'ঝোটন (সোহাগের ডাক নাম), দেনা তোর বন্ধুর সঙ্গে ব্যবস্থা করে.....!' নাছোড় অযোগ্য প্রেমিকটিকে হতাশ কিম্বা অপমান না করেও সোহাগকে বিরক্তিকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে কোন কৌশলে টুটুদার সোহাগদের বাড়িতে যাতায়াত রুখে দিল, জানিনা।


কারও সাথেই ওই ধরনের সম্পর্কে জড়িত নয় সে, তার জলজ্যান্ত সাক্ষী সোহাগ স্বয়ং। কারণ সোহাগ, মানে ঝোটনের দিবারাত্রির দৌরাত্ম্য হজম করবার জন্য সদা প্রস্তুত মিঠুয়া। স্কুলে তো নিয়ম করে যেতে হবেই। এর বাইরে পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রাম সংক্রান্ত জরুরী কাজগুলি সোহাগের ব্যস্ততা আর অনুপস্থিতির সময়টুকুর মধ্যেই সারতে বাধ্য হত সে। স্কুল- কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়েও সেরা শিক্ষার্থী ছিল সে।


কাকাবাবু অনেকদিন যাবৎ সুপাত্রের সন্ধানে রত, গ্রামের দিকে যা হয় আর কি! যত শীঘ্র আদরিনী কন্যার বিদায় অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করা যায়! আপাত সেরা, সত্যিকারের শিক্ষিত বনেদী পরিবারের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মীর সঙ্গে সম্বন্ধ পাকা হবার পথে। হবু শাশুড়ী ঠাকরুন ঠিক এমন একটি কন্যার সন্ধানেই ছিলেন। বর্তমানে যদিও অধিকাংশ বাবা-মায়েরই একটিই সন্তান, ছেলে হোক বা মেয়ে। তবে লোকশ্রুতি, কিছুকাল পূর্বেও এক ছেলের মা নাকি ছেলে-বউয়ের পারস্পরিক নৈকট্য অথবা সুখ বরদাস্ত করতে চাইতেন না। যদিও কথাটির সত্যতার শতাংশ বিষয়ে সন্দিগ্ধ আমার মতন অনেকেই! 


কাকাবাবু যাতে আরও কতিপয় সুপাত্র সন্ধানের ফুরসৎ না পান কিংবা যাতে অতীব সুলক্ষণা পাত্রীটি কোনোক্রমে হাতছাড়া হয়ে না যায়, সে জন্য মরিয়া হবু শাশুড়ীমাতা যখন-তখন এসে উপস্থিত হতে লাগলেন মিঠুয়াদের বাড়িতে।


কাকিমনির ইচ্ছে মেয়ে-জামাইয়ের বয়সের ফারাক হবে বছর পাঁচেকের। তাঁর বাসনায় জল ঢেলে অগত্যা বছর পনেরোর তফাতে উপস্থিত পাত্র অরণ্যের সঙ্গে ঘটা করে শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হল এক শুভলগ্নে।


অদৃষ্টের পরিহাস বলব, না অন্য কিছু জানি না। ফুলশয্যার রাত্রে মিঠুয়ার হাত ধরে টেনে খাটের বাইরে নামিয়ে দিয়ে পাত্রের পাশের সুদৃশ্য বালিশে মাথা রাখল অন্য এক রূপসী- হিন্দোল। মিঠুয়ার মায়ের পক্ষে এ ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানা সম্ভব ছিল না। আর তাছাড়া মেয়ে এমন কোনও কথা মা-বাবার কাছে প্রকাশ করবে না যাতে তাঁরা কষ্ট পান। অরণ্যও প্রতিবাদ করল না। মিঠুয়া ঘরে থাকবে, না বেরিয়ে যাবে, বেরিয়ে কোথায়ই বা যাবে; নতুন জায়গা, অল্প পরিচিত আর অপরিচিত ক'টি মানুষের শহুরে আস্তানা। মাস ছয়েক একই ধরনের বঞ্চনা সহ্য করবার পর স্বভাবসিদ্ধ মিষ্ট স্বভাবের মিঠুয়ার সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে উঠল হিন্দোলের, সোহাগের শূন্যস্থানটুকু বুঝি ভরে দিল সে!


বাড়ির অন্যান্যরা যাতে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারে তাই একই ঘরে একটি ক্যাম্প খাটে বিছানা করে শুতে শুরু করল মিঠুয়া। দু'দিন ধরে দেখছে হিন্দোল ওর সঙ্গে চাপাচুপি করে ক্যাম্পখাটে শুচ্ছে! অতঃপর হিন্দোল ঘুমোবার পর বড় খাটে দু'জনে আরামসে শুতে পারল। দু'দিন পর থেকে ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গবার পর দেখে ক্যাম্পখাটের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে মিঠুয়া আর অরণ্যের মাঝে শায়িত গদগদ হিন্দোল। এরপর থেকে শাশুড়ীমায়ের ঘরে ক্যাম্পখাটটি পেতে হিন্দোলকে নিয়ে কিছুক্ষণ শুতে শুরু করে অরণ্য। ও ঘুমালে অরণ্য চলে যেত নিজেদের ঘরে। এ সমস্ত অস্বাভাবিকত্ব ঘটবার কালে অরণ্য ছিল পুরোপুরি নির্বিকার। মিঠুয়া ভেবেছিল এটি সংকোচের ফসল হতেও পারে।


বছর ঘুরে মিঠুয়ার কোল আলো করে এল তাতান। তাতানের প্রতি কর্তব্য ছাড়া অরণ্যের তরফে অধিক টান কিছু দেখতে পেত না মিঠুয়া। ও ভাবে,'মানুষ কি এমনই হয়! কই, আমার বাবা তো অন্যরকম। মায়ের সঙ্গে কত ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলেন এবং আমাকেও যে চোখে হারান! এক এক জন মানুষ হয় তো এক এক রকম হয়!'


মিঠুয়ার বাৎসল্যেও ছিল ইশ্বরদত্ত প্রাচুর্য্য। হিন্দোল আর তাতানকে আদর যত্ন ও ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখত সে। ক্রমে হিন্দোল হয়ে উঠল তাতানের মা ও ঠাকুমার পরবর্তী সেরা আশ্রয়। পা-পা -মা-মা-তা-তা বলবার পাশাপাশি তাতান মাঝেমধ্যে হিন্দোলের ভাষায় কথা বলবার চেষ্টা করে; বলে 'কাউ - কাউ - কু-কু'। ক্রমে হিন্দোলের পিঠে চড়ে শক্ত করে ধরত গলার চেনটি; মিঠুয়া নিশ্চিন্ত। কিন্তু মায়ের মন বুঝতে পারে ছেলে-বউয়ের মানসিক নৈকট্য বলে কিছুই নেই।


ওদিকে প্রথম প্রেমের দুর্নিবার আকর্ষণে অরণ্য অফিস থেকে প্রায়শঃই বাইরে যেত; সঙ্গে স্টাইলিশ সোনালী। আবার কখনও-সখনও সঙ্গে জুড়ে যেত সুগ্রীব দোসর, মানে মায়ের সঙ্গে মামাবাড়িবাসিনী তিস্তা।


উৎকন্ঠিতা শাশুড়ীমা,  বৌমার কেশবিন্যাসের স্টাইল পাল্টে,  যথাসম্ভব আধুনিক পোশাক পরিয়ে পাল্লা দিতে চাইলেন সোনালীর সঙ্গে। মিঠুয়ার সাদা মনে কাদা নেই। ও ভাবল, এভাবে সাজগোজ করলেই বুঝি স্বামীর মন পাওয়া যাবে। শাশুড়ি মা সহ পরিবারের আরও কয়েকজন হিতাকাঙ্খীর তাড়নায় অরণ্য বাড়ি ফেরবার কিছু আগে থেকেই গেট থেকে বেরিয়ে পায়ে পায়ে মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়াত সে। একদিন আরেকটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; একটি কালো ফোর্ড গাড়ী এসে দাঁড়াল; ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ভদ্র গোছের চেহারাযুক্ত জনৈক ব্যক্তি গাড়ী থেকে অবতরণ করে জিজ্ঞেস করলেন, 'রেট কত?' মিঠুয়া বুঝতে পারে না। ক্রমাগত পরের পর কয়েকটি গাড়ির সওয়ারী তাকে বায়না করতে চাইছে। ওকে কি মা-দুগ্গা মনে করল নাকি! সহসা ট্যাক্সি থেকে নামল অরণ্য। 'তুমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছ? জানো না  খুব বাজে জায়গা এটা? তোমাকে বাড়ি থেকে ছেড়েছে টা কে?' প্রত্যুত্তর, 'মা'। আসলে দোষ নেই, মা চাইছেন পাশের পাড়ার নামকরা বিশে গুন্ডার পরিত্যক্ত পরিবারের সঙ্গে একমাত্র ছেলের সম্পর্ক রুখতে। তাই না এত খুঁজে পেতে অমন পরমা সুন্দরী লক্ষ্মী প্রতিমাকে ঘরে নিয়ে এসেছেন। এখানেই ক্ষান্ত নন, তাকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দ্বারা প্রতিনিয়ত একশো আশি ডিগ্রী অভিমুখে ঘোরাতে চেয়েছেন খোকার মন।


লাভ তো হলই না; উপরন্তু সোনালীর চক্রান্ত ও কুপরামর্শে দিনকে দিন ক্রমবর্দ্ধমান  হয়ে উঠল মিঠুয়ার প্রতি অরণ্যের ঔদাসীন্য ও দুর্ব্যবহারের মাত্রা।


কিন্তু মিঠুয়ার সব ভাল হলেও জটিলতা বোঝবার মতন উর্বর  মস্তিষ্ক নয়। তাই দৈবের দোহাই দিয়ে পূজার্চনা আর সংসারের জোয়াল টানার কাজটি করে চলে নিষ্ঠা সহকারে। সঙ্গে রয়েছে তাতানের বড় হয়ে ওঠা। আর ওদিকে রায়বাঘিনী কুকুরানী- দুষ্টু মিষ্টি হিন্দোল!


আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কুপোকাত হত যার রূপে, এখন এক অর্থে সম্পূর্ন মূল্যহীনা সে। প্রিয় পাঠক বন্ধুদের উর্বর মগজে অনেক সুপরামর্শ উকি ঝুঁকি মারছে  মিঠুয়ার পরিবারটিকে সুখমন্ডিত  করবার জন্য, তা বেশ বুঝতে পারছি। আশ্বস্ত করবার জন্যেই বলি, শাশুড়ীমায়ের পূর্ণ সহযোগিতায় তার নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়ে জীবনের পথে সুখী মিঠুয়া এগিয়ে চলেছে কালের রথে চড়ে। দশভূজার ন্যায় তাতানকে আগলে মানুষ করেছে সে। নতুন চরিত্রটি পিছলে যায়নি। সে ঠিক মিঠুয়ার বাবার মতন সূচনাকে নিয়ে সুখী দাম্পত্য স্রোতে বহমান। আর মিঠুয়ার বর্তমান কাজের ত্রিধারায় রয়েছে সংসারের কাজে প্রয়োজনমত সূচনাকে সাহায্য করা, পূজার্চনা আর একটি এন জি ও- র সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় নির্যাতিতা মহিলাদের পাশে সাধ্যমত দাঁড়ানো।


অরণ্যকে ফিরতে হয়েছে অবসর জীবনে।  প্রাণবন্ত জীবনভর ময়ূরী ছেড়ে কাকের পিছনে ছুটে মরীচিকার পশ্চাদ্ধাবন হয়েছে, সেটি তার নিকট জলের ন্যায় স্বচ্ছ আজ।


সোহাগ যেদিন জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে আবার উঠে দাড়াতে চাইছে, সেদিন একটি মাত্র হাত সে ধরতে পেল, সেটি মিঠুয়ার, অন্য কারও নয়। সোহাগ সেদিন একটি কথাই জানতে চাইল মিঠুয়ার কাছে,'  যথেষ্ট যোগ্যতার অধিকারিণী হওয়া সত্বেও স্বামীর পথভ্রষ্টতার কারণে সামাজিক, পারিবারিক, মানসিক অপমান আর বিপর্যয়ের শিকার তুই। আজ সত্যিকারের মা দুর্গার মতন শক্তিময়ী হলি কি করে!  তুই কি ভাবে পারিস পথহারা বন্ধুর সংকট মোচন করে আবার চেনা পথে তাকে ফিরিয়ে আনতে?'


 জবাবে মিঠুয়ার অকপট স্বীকারোক্তি, 'দশ জনের জীবনের লড়াই দেখে আর তাদের সহযোদ্ধা হতে পেরে বুঝতে পেরেছি আমার তুলনায় অনেক বেশি কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে অনেক মা,বোনেরা। তুই তো এদের বাইরে নোস! আর নিজে যে সুখ আর আনন্দের স্বাদ উপভোগ করতে পারিনি,সেই অনুভূতি উপহার হিসেবে বহুজনের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারার মতন পরিতুষ্টি অন্য কোনও ভাবে হয় না রে!'


কালের স্রোতপথে এসেছে আর আসবেও কত সোনালী, মিঠুয়া- কেউ ঠকাতে, কেউ ঠকতে আবার কোনও মমতাময়ী হয়তো বা গভীর মূল্যবোধের তাড়নায় ক্ষমা করতে করতে পরিশীলিত করে চলবে অতীত, বর্তমান আর বাকি সর্বকালের মলিনতাকে।আর তাই বুঝি প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকে চিরকাল গ্রহ হতে গ্রহান্তরে, স্বমহিমায় অভিযোজিতা মিঠুয়াদের হাত ধরে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ