ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা (১৯৪৪-১৯৭৭) এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম: একটি আলোচনা -অভিজিৎ চক্রবর্তী


ভা রতবর্ষে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির জন্ম হয়েছে কমপক্ষে একশো বছর আগে। এই দীর্ঘ একশো বছর যাবৎ চলচ্চিত্র তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে নিজস্ব এক বলয়বৃত্ত, যে বলয়বৃত্তের অন্দরে সহজাতভাবে এসে ধরা দিয়েছেন অগুনতি সাধারণ মানুষ বা বলা ভালো, “চলচ্চিত্র শিল্পের অনুগামী দর্শক-শ্রোতাবৃন্দ”। সেকারণেই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শক্তিশালী গণমাধ্যম বলতে আমরা চলচ্চিত্র বা সিনেমাকে ইঙ্গিত করতে পারি। গণমাধ্যম ছাড়াও সিনেমা আজকের দিনে শক্তিশালী গবেষণার বিষয়ও বটে। তবে আজ আমরা শুধুমাত্র সিনেমাতেই থমকে দাঁড়িয়ে নেই। নিরবচ্ছিন্নভাবে গল্প বলার কায়দা হোক বা নির্দিষ্ট সময়ের বাঁধুনি মেনে গল্পকে পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে চলা হোক— এই দুই চিরায়িত গৎকে অতিক্রম করে আমরা ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছি টিভি-সিরিজ বা ওয়েব-সিরিজের দিকে। ক্রমশ বদলে ফেলছি চিরাচরিত পন্থাকে অনুসরণ করে একক আঙ্গিকে গল্প উপস্থাপনের ভঙ্গিমাকে। হাসি কান্না সুখদুঃখের মিশেল হোক বা তুখোড় অ্যাকশন-সিনেমার মধ্য দিয়ে সবকিছুকেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। 
 
এতসব কিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে যে ঐহিক বৈশিষ্ট্যগুলি মূর্ত হয়েছে, তার মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি সেটি হল-  রূপোলি পর্দায় সময়ের ছাপ বা পরত থেকে যাওয়া। আরও একটু ভেঙে বলতে গেলে বলতে পারি, সময় অর্থাৎ যুগোপযোগী কিছু বৈশিষ্ট্য বারংবার পর্দায় ফুটে উঠতে দেখা গেছে; তা সে সুর করে কথা বলা হোক বা নাকি সুরে গান গাওয়া কিংবা স্টুডিওর অন্দরে শুটিং হোক বা বাউন্স আলোর ব্যবহার— সময়ের ছাপ থেকেই যায়। সেই ছাপকেই মর্মোদ্ধার করতে পারলে ইতিহাসের অন্দরে উঁকি দিয়ে মানুষের জীবনচেতনার ধারাকে  কিছুটা হলেও ছুঁতে পারা যায়। 
 
আজকে আমার আলোচনার বিষয়- বাংলা চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিস্ফুটন। আলোচনার পটভূমি এতটাই ব্যাপকতায় বিস্তৃত এবং স্বল্প সময়ে আলোচনার মত বিষয় তা নয়। তথাপি সময়ের সুবিধার্থে, আলোচনাকে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে নিচ্ছি; তাতে সামগ্রিক আলোচনা একটি স্থির লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে যেতে পারবে। প্রথমত, আমি আমার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখবো ১৯৪০ এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক সময়কালের বাংলা চলচ্চিত্রের অন্দরে। উক্ত সময়ের মধ্যে বাংলা চলচ্চিত্র তথা আনুষঙ্গিক বিষয়গুলির সামগ্রিক ঝলক ব্যক্ত করতে চেষ্টা করব। দ্বিতীয়ত, বাংলা বলয়ের সঙ্গে হিন্দি বলয়ের চলচ্চিত্রের তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চেষ্টা করব। শেষত, বাংলার মূল ধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে অপরাপর স্বাধীনতা সংগ্রামের চলচ্চিত্রগুলির তুলনা করার চেষ্টা করব। 


 || ১ || 

“ ...সিনেমা, সিনেমা, সিনেমা। উঠতে সিনেমা, বসতে সিনেমা, খেতে সিনেমা, শুতে সিনেমা --- খালি রাত দিন শুধু সিনেমা। সিনেমা-ই হয়েছে এক একটা ইনস্টিটিউশন। আর ইস্কুলগুলো হয়েছে সব পলিটিক্সের জায়গা... ”  
 
১৯৬৬ সালে রিলিজ হওয়া “গল্প হ’লেও সত্যি” সিনেমায় এক তিতিবিরক্ত স্কুল শিক্ষকের কন্ঠ থেকে ধ্বনিত হয় এই সংলাপ। কে ভেবেছিল, আবিষ্কারের মাত্র একশো বছরেরও কম সময়ে চলচ্চিত্র বিষয়টি একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশৃঙ্খলাচর্চার অন্তর্ভুক্ত হবে। বিশেষ করে বলতে হয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের নিরিখে তুলনামূলক অনেক ছোট ক্ষেত্রে অবস্থান করেও বাংলার চলচ্চিত্র শিল্প যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই আলোচিত হয় প্রতিষ্ঠানগুলির অন্দরে; এই পাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একপ্রকার আশীর্বাদই বলা চলে। তবে বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে একটু পূর্ব ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর দরকার আছে বৈকি। বাংলার চলচ্চিত্র যার হাত ধরে যাত্রা শুরু করেছিল, তিনি যদি হন হীরালাল সেন; তাহলে বলতে হয় বাংলা সিনেমাকে বিনোদন থেকে বাণিজ্যিক পর্যায়ে যিনি উন্নীত করেছেন তিনি হলেন নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার, বীরেন্দ্র নাথ সরকার। এখানে একটি বিষয় খেয়াল করার ব্যাপার আছে। সামগ্রিক শহুরে শিক্ষিত বাঙালী মধ্যবিত্তকে সম্বোধিত করার প্রয়াসে প্রয়াসী হতে থাকে এই চলচ্চিত্র রূপায়ণ-শিল্প। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্রে বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে মধ্যবিত্তপণা যেমন দেখি; তেমন ভাবেই দেখি বহু শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষ এই চলচ্চিত্র বিনোদনের কারিগরি শিল্পে এসে হাত পাকাতে আরম্ভ করেন। একটি কথা ঠিক- প্রথমদিকে সিনেমা, থিয়েটার বা নাটক ইত্যাদি শিল্পমাধ্যম এবং সেসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কুশীলবদের সমাজে অপাংক্তেয় করে রাখা হত। কিন্তু সময়ের সাপেক্ষে যতই মধ্যবিত্ত মানসে পৌঁছতে আরম্ভ করে; ততই যেন মধ্যবিত্তীয় জীবনের চেনা গণ্ডির এক অন্যরকম রূপ ফুটে উঠতে থাকে পর্দায়। এর সঙ্গে আরও বলা যায় যে,  মধ্যবিত্তের চাহিদাকেও মর্যাদা দিতে আরম্ভ করা হয় অল্প অল্প করে। 
 
এখন একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন আমাদের ভিতর উঠে আসবে। মধ্যবিত্ততা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? বা, মধ্যবিত্ত মনোভাবের ঐহিক লক্ষণগুলি আসলে কেমন। মধ্যবিত্ততা আসলে এমন এক মনোশ্চেতনা, যে চেতনায় আমরা দেখি, বহির্জগতের স্থূল বা সূক্ষ্ম পরিবর্তন সচেতন বা অচেতন ভাবেই অন্তর্জগতের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ফেলে। এবং সে জন্যেই অন্তর্জগতের এত টানাপোড়েন নিয়ে মধ্যবিত্তের জীবনাবর্তকে ক্রমাগত দোলাচলতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। মার্জিত ভাষাবোধ, হৃদয়বান, বিবেকবান, কৃচ্ছ এবং বৈভবকে সমদূরত্বে রেখে স্বল্পতায় সন্তোষের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলার যে জীবন প্রবাহ আমরা দেখি--- তাকেই এখানে “মধ্যবিত্ততা” বলে আখ্যায়িত করলাম।  
 
১৯৪৪ সালে বাংলা ভাষায় একটি সিনেমা নির্মিত হয়; যা ছিল সেই সময়ের সাপেক্ষে ‘এগিয়ে থাকা’ ছবি। এবং পরবর্তী সময়েও যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল সে ছবি। ছবির নাম, “উদয়ের পথে”। পরিচালক ছিলেন বিমল রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রমিক-মালিক চেতনা, বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রী চিন্তাধারায় এই ছবি গল্প বলেছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ বিরোধ করতে দেখা যায় নি। তা সত্ত্বেও বলতে হয়, পরাধীন ভারতবর্ষের বুকে শ্রমিক চেতনা, উচ্চবিত্তের আস্ফালন, মধ্যবিত্তের হৃদয়ে মূল্যবোধের কড়া নাড়া সবকিছুকে যত্নশীলতার সঙ্গেই দেখানো হয়েছে। এবং সাধারণ মানুষের সংগঠন নিজস্ব অধিকার আদায় করার  কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে ব্রিটিশের দ্বারস্থ হবে, সে ক্ষীণ ধারণাও যেন আমরা পাই সে ছবি থেকে।মূলত এই ছবির মূল কথা- ব্রিটিশ মদতপুষ্ট তাঁবেদার শ্রেণির মানুষের কাছে সর্বহারা সাধারণ মানুষের অস্তিত্বকে তুলে ধরা। সে কারণেই সর্বাগ্রে এই ছবিটিকে স্থান দেওয়া গেছে।  
 
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একাধিক চলচ্চিত্রের উদাহরণ দেখাতে পারা যায়, যেখানে পরাধীন ভারতবর্ষের নিপীড়িত ভারতীয়দের স্বাধীনতার সংগ্রাম চিত্রিত হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্রে। কালো সাদা যুগের প্রেক্ষিতে বিচার করলে ১৯৪৪ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত কমপক্ষে প্রায় ২০টি ছবির নাম পাই যেখানে এই স্বাধীনতার সংগ্রাম ফুটে ওঠে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এর ভিতর অধিকাংশ চলচ্চিত্র-ই কোনো মহামানবের জীবনকে অবলম্বন করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন”(১৯৪৯) — ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে সংঘটিত হওয়া যুব বিদ্রোহের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রায়ণ; “বিয়াল্লিশ”(১৯৫১) ¬ — ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সাপেক্ষে মেদিনীপুরের মানুষের কর্মকাণ্ড, “আনন্দমঠ” (১৯৫১) – বাংলার সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের কর্মকাণ্ড এবং “শপথ নিলাম”(১৯৭২) — বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার এবং তাঁর সহকারীদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড — এই তিনটি সিনেমা ছাড়া বাংলায় ঘটনামুখী স্বাধীনতা সংগ্রামের সিনেমা কম; অধিকাংশই বিপ্লবীদের জীবনকে অবলম্বন করেই চিত্রিত হয়েছে। তবে এইসব ছবির মধ্যে অন্যান্য বেশ কিছু ছবি বাদ পড়েছে, যেমন- ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত সেই সমস্ত ছবির কথা এখানে উল্লেখ করা হয় নি, যার মধ্যে দেশভাগের গভীর ক্ষত আছে; বা মৃণাল সেনের “নীল আকাশের নীচে” বা অজয় কর বা যাত্রিক গোষ্ঠী১০ এবং অন্যান্য পরিচালকদের পরিচালিত বেশ কিছু ছবির কথা এখানে বলা হল না, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ রয়েছে।        
 
এত কথা বলার প্রয়োজন একারণেই হয়ে পড়ল, পাঠককুলের কাছে এই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন খুব দরকার যে স্বাধীনতা উত্তর বাংলায় বহুবার বহুছবি তৈরি হয়েছে যার মুখ্য বা গৌণ অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবার একটি প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসবে, এতবার এতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম অনুষঙ্গ ব্যবহার করার কারণ কী? তাহলে কি বলতে হয়, বাংলার মানুষ অনেক বেশি নস্ট্যালজিক; সে কারণেই বারংবার পিছন ফিরে দেখা? আসলে বিষয়টা তা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুনভাবে ইতিহাস রচিত হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু বইয়ের পাতায় আটকে থাকা ইতিহাসের ঘটনা কেবল শিক্ষিত জনগণ জানবেন, বুঝবেন। সর্বসাধারণের স্তরে পৌঁছে দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হল সিনেমা বা চলচ্চিত্র। তাতে যেমন একইসঙ্গে একাধিক মানুষের হৃদয়কে ছুঁতে পারা যায়; সেইসঙ্গে ইতিহাসের বোধ বা জাতীয়তার ধারণা গ্রথিত করতে পারা যায় সুন্দরভাবে। এটা ছাড়াও যা হয়, তাতে বুঝি- মহামানবদের জীবনাদর্শ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা জন্মায় এবং মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ভীষণ সহায়তা করে। এ কথা ধরে নিতেই পারি স্বাধীনতা উত্তর বাংলায় এই ধরণের ছবি করার মধ্য দিয়ে বাঙালী পরিচালকগণ যেন চাইছিলেন, উত্তর যুগের কাছে কিছু মাইল ফলক ছেড়ে যেতে, যেগুলি অনুসরণ করলে দেখা যাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ কী পরিমাণ কন্টকাকীর্ণ ছিল এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতার যেন সঠিক মূল্য দেওয়া যায়।  
 
আরো দু-একটি ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। দেশভাগের যে মারাত্মক ঘটনা বাংলার সঙ্গে ঘটেছিল, তাতে কলকাতাকেন্দ্রিক সিনেমা ব্যবসার ব্যাপক ক্ষতি হয়। সমূহ আর্থিক এবং মানবসম্পদ হারানোর জন্য “নিউ থিয়েটার্স” যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জৌলুস হারিয়ে ফেলে। ফলে দেশভাগ এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা চলচ্চিত্র মহল চেয়েছিল এমন সিনেমা বানাতে যেটা দেখতে সমাজের সকল মানুষ দর্শক হিসেবে আসতে পারে; তাতে অন্তত কিছুটা হলেও লাভের মুখ দেখা যেতে পারে। সে কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি বারংবার বেছে নেওয়া হচ্ছিল। আরো বলা যায়, স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙালী বিপ্লবীদের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। সেই বলিদানকেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার চেষ্টা চলেছে বারেবারে।     
 

 || ২ || 
 
স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলা ব্যতীত অন্যান্য প্রান্তে (বিশেষ করে হিন্দি বলয়) যে সিনেমাগুলি ক্রমাগত তৈরি হয়ে যাচ্ছিল, সেগুলির ভিতর দেশপ্রেম, নতুন ভাবে দেশ গড়া, নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্ব, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকে বারংবার তুলে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেইসব ছবি গুলির মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবির নাম প্রায় নেই বললেই চলে। স্বাভাবিক প্রশ্ন- সে যুগের হিন্দি সিনেমা জগতে স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে সিনেমার সংখ্যা এত কম কেন? “আনন্দমঠ”(১৯৫২)১১ বা “ঝাঁসি কি রানী”(১৯৫৩)১২ ছাড়া সে অর্থে আর কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবি দেখতেই পাই না। তাহলে কী বলতে হয়-- বাণিজ্যমুখী সিনেমা তৈরী করাই ছিল সে সময়কার প্রযোজক পরিচালকদের প্রধান উদ্দেশ্য? এবং এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবিতে যেহেতু বাণিজ্যিক লাভ হচ্ছিল না, সেজন্যে তাঁরা হয়ত ভিন্ন স্বাদের গল্প নিয়ে রুপোলি পর্দায় উপস্থাপন করতেন। “ন্যায়া দৌড়”, “মাদার ইন্ডিয়া”, “ধর্মপুত্র”, “পূরব অউর পশ্চিম”১৩  ইত্যাদি নানা দেশপ্রেম বিষয়ক ছবি আমরা নিঃসন্দেহে দেখতে পাই; তবে সেখানে নতুন ভারত নির্মাণের আভাস থাকে। কিন্তু যে ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে সে ধরণের চিত্র ফুটতে দেখি না। এদের মধ্যে বেশ কিছু ছবির প্রেক্ষিত ব্রিটিশ ভারত হলেও ছবির গল্পগুলি পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই নির্মিত। সেখানে দেশের সংগ্রাম অপেক্ষা পরিবার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমরা যদি এখানে বাংলার দিকে তাকাই, দেখবো বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম যুক্ত ছবি সংখ্যায় যথেষ্ট বেশি। প্রশ্ন হল কেন? একটু গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে কয়েকটি কথা পাবো। প্রথমত, সে যুগে বাংলা ছবি দেখতে আসেন কারা? যারা আসেন তারা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ। এবং এই মধ্যবিত্ত চেতনার এক এবং একমাত্র সম্বল হল- নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ। কারণ মধ্যবিত্তের কাছে অর্থের অহংকার নেই; নেই দেখনদারিত্বের দাপট। যতটুকু যা সম্বল তা এই নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চেতনা। সে কারণেই হয়ত মনে হয়, স্বাধীনতার শুভ লগ্নেই দেশভাগ হয়েছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালী ঘর ছেড়ে উদ্বাস্তুর মতন জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন; ভিটে মাটি ছেড়েছেন। কিন্তু এই সামূহিক অসহায়তার মাঝেও বাঙালী যাকে আঁকড়ে রেখেছিল তা হল তার নৈতিকতার প্রয়াস। ফলে নৈতিকতা মূল্যবোধ খুব সহজে ধরা দেয় সেযুগের বাংলা ছবিতে; এবং বরেণ্য বিপ্লবীদের জীবন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ভালো ভাবে এই নীতি শিক্ষাকে আত্মস্থ করা যায়। সে জন্যেই হয়ত স্বদেশী যুগের বিপ্লবীদের জীবন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে এত সংখ্যায় সিনেমা হয়েছে সে সময়ের বাংলায়।  


 || ৩ || 
 

ক্রমিক সংখ্যা

সাল

ছবির নাম

পরিচালক

১৯৪৪

উদয়ের পথে

বিমল রায় 

১৯৪৬

বন্দেমাতরম

সুধীরবন্ধু 

১৯৪৬

সংগ্রাম 

অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় 

১৯৪৬

নিবেদিতা 

প্রতিভা শাসমল 

১৯৪৭

দেশের দাবী 

সমর ঘোষ

১৯৪৭

পথের দাবী 

সতীশ দাশগুপ্ত, দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়

১৯৪৮

ভুলি নাই 

হেমেন গুপ্ত 

১৯৪৯

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন

নির্মল চৌধুরী 

১৯৫০

জাগ্রত ভারত

পুষ্পিত নাথ চট্টোপাধ্যায়

১০

১৯৫১

বিয়াল্লিশ

হেমেন গুপ্ত 

১১

১৯৫১

আনন্দমঠ

সতীশ দাশগুপ্ত 

১২

১৯৫১

বিপ্লবী ক্ষুদিরাম

হিরন্ময় সেন

১৩

১৯৫২

নীলদর্পণ

বিমল রায় (জুনিয়র)

১৪

১৯৫৩

বাঁশের কেল্লা

সুধীর মুখোপাধ্যায়

১৫

১৯৫৮

আমার দেশের মাটি

পথিকৃৎ

১৬

১৯৫৮

বাঘা যতীন 

হিরন্ময় সেন

১৭

১৯৫৯

নীল আকাশের নীচে 

মৃণাল সেন

১৮

১৯৬২

ভগিনী নিবেদিতা

বিজয় বসু

১৯

১৯৬২

দাদাঠাকুর

সুধীর মুখোপাধ্যায়

২০

১৯৬৬

সুভাষচন্দ্র

পীযূষ বসু

২১

১৯৬৮

চারণকবি মুকুন্দদাস

নির্মল চৌধুরী 

২২

১৯৬৯

অগ্নিযুগের কাহিনী 

বীরেন রায়

২৩

১৯৭০

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন

অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় 

২৪

১৯৭১

মহাবিপ্লবী অরবিন্দ

দীপক গুপ্ত

২৫

১৯৭২

শপথ নিলাম

শচীন অধিকারী 

২৬

১৯৭৪

দেবী চৌধুরাণী

দীনেন গুপ্ত 

২৭

১৯৭৭

সব্যসাচী 

পীযূষ বসু


তালিকা- ১৯৪৪–১৯৭৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত বাংলা সাদা কালো স্বাধীনতা সংগ্রামের ছায়াছবির বিবরণ১৪ 
 
এখন প্রশ্ন: অন্যান্য বাণিজ্যমুখী সাদাকালো বাংলা সিনেমার সঙ্গেও এই ধরণের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড যুক্ত বাংলা ছবিকে মানুষ কেমনভাবে গ্রহণ করত? বা বলা ভালো এই ধরনের সিনেমার দর্শক কেমন ছিল তা অবশ্যই জানতে আগ্রহ হয় বটে। উপরের তালিকা থেকে একটি কথা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৭৭—প্রায় দীর্ঘ তেত্রিশ বছরে প্রায় ২৭ টি এই ধরণের ছবির নাম পাওয়া যায়। ফলে বুঝতে পারি যে, সাধারণ দর্শক অন্যান্য জনপ্রিয় বাণিজ্যমুখী ছবির পাশাপাশি এই ধরণের 'ভিন্নধারা'-র ছবিকেও গ্রহণ করতেন। এর মানে এটা নয়, যে কয়টি স্বদেশী যুগ বা বৈপ্লবিক আন্দোলন বিষয়ে ছবি হল প্রতিটি ছবি বাণিজ্য সফল। সেটা মোটেই হত না। তবে একটি কথা নিশ্চিত আমরা বলতেই পারি যে, সাধারণ দর্শকের কাছে এইসব ছবিগুলি নিশ্চয়ই সমাদর পেত; নইলে প্রযোজক পরিচালকগণ এই ধরণের ছবি বারংবার নির্মাণ করার উৎসাহ পেতেন না। এক্ষেত্রে আরো একটি কথা বুঝতে পারি- দর্শক চাহিদাই আসলে সিনেমার বিষয়বস্তুকে নির্ধারণ করে। সেকারণেই বোম্বাইয়ের চিত্র জগতে গুটিকতক এই স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবি আমরা দেখেছি। কারণ একটাই- সেখানকার দর্শক অন্য ধারার গল্প বলা শুনতে চেয়েছেন, আর বাংলার দর্শক অন্য ধারার গল্প বলা চেয়েছেন। সে কারণেই পার্থক্য বিদ্যমান। তালিকাটি ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে, ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে যথেষ্ট সংখ্যক বাংলা ছবিতে স্বাধীনতার চেতনা, স্বদেশিয়ানা, দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ ইত্যাদি ছিল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দেড় দশকের ভিতরেও অনেক সংখ্যায় এই ধরণের ছবি নির্মিত হত। ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে সেই সংখ্যা কমতে লাগল। অর্থাৎ দর্শকরুচিকে জোর দিতেই বাণিজ্যিক-তথা-জনপ্রিয় ছবি বাজারে ছড়িয়ে যেতে আরম্ভ করল। পরবর্তী পর্যায়ে একুশ শতকে এসে কিছু স্বদেশী যুগের গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে বটে তবে এর মূল উদ্দেশ্য একটিই- বাংলা ছবির দর্শকের কাছে ব্যাপক ভাবে পৌঁছতে পারা।    
 
চিরকাল-ই দর্শক এবং সিনে-জগৎ পরস্পরের পরিপূরকে অবস্থান করে। ভালো সিনেমা যেমন পারে অনেক সংখ্যক মানুষের রুচিবোধকে বদলে দিতে; আবার মানুষের রুচিবোধ এবং চাহিদাই সিনেমার গল্প কথনকে প্রভাবিত করে। এবং বাংলা ছবির প্রবহমানতার মধ্যে যে মধ্যবিত্তের চেতনা আছে; সে চেতনা যেন বারংবার অতীতের উজ্জ্বলতাকে ফিরে দেখতে চায়। সেই উজ্জ্বলতার স্মৃতিচারণ তাই বারংবার মূর্ত হয় স্বদেশীয়ানা বা দেশাত্মবোধের সিনেমায়। এবং বাংলার বর্তমান চিত্র নির্মাতাগণ সেই ট্র্যাডিশনে হাঁটতে চান মাঝে মাঝে—একথাই যেন বারবার মনে হয়।  

          
তথ্যসূচী
১. Purabi Ghosh Roy,“Cinema as Social Disclosure”, Proceedings of the Indian History Congress Vol. 64, 2003: 1185, URL: https://www.jstor.org/stable/44145546 
২. Ibid: 1185
৪. পিনাকী চক্রবর্তী, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিউ থিয়েটার্স (কলকাতা: আনন্দ, ২০১৫), পৃ- ১৭ 
৫. https://youtu.be/j-GESepqOis?si=WY8oVZmMI9HWSAbM (পরিচালনা – বিমল রায়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশে শ্রমিক মালিক সম্পর্কের বয়ান ব্যক্ত করে এই ছবি। অভিনয়- রাধামোহন ভট্টাচার্য; তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ।)
https://youtu.be/j-GESepqOis?si=WY8oVZmMI9HWSAbM (পরিচালনা – বিমল রায়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশে শ্রমিক মালিক সম্পর্কের বয়ান ব্যক্ত করে এই ছবি। অভিনয়- রাধামোহন ভট্টাচার্য; তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ।)  
৯. ঋত্বিক ঘটকের অধিকাংশ সিনেমা-ই দেশভাগ-উত্তর বাংলার বেদনাকে ব্যক্ত করে। এক্ষেত্রে “মেঘে ঢাকা তারা”(১৯৬০)-র নামই বিশেষভাবে উল্লেখ্য।  
১০. মৃণাল সেনের “নীল আকাশের নীচে”(১৯৫৯) সিনেমায় ১৯৩০-এর সময়কার কলকাতা দেখানো হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে ভারত চীন সম্পর্ক-ই এখানে মূল প্রতিপাদ্য। এ ছাড়াও অজয় কর পরিচালিত “সপ্তপদী”(১৯৬১) সিনেমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিত পাওয়া যায় এবং যাত্রিক গোষ্ঠীর “কাঁচের স্বর্গ”(১৯৬২) সিনেমাতেও এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রেক্ষিত ফুটে উঠেছে। 

১১. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি ছায়াছবির নির্দেশনায় ছিলেন বাঙালী পরিচালক হেমেন গুপ্ত।  

১২. ১৯৫৩ সালে নির্মিত এই ছবির পরিচালনা করেন সোহরাব মোদী। 

১৩. ন্যায়া দৌড়” (১৯৫৭) – বি আর চোপড়া নির্দেশিত ছবি। অভিনয়ে – দিলীপ কুমার এবং বৈজয়ন্তীমালা। নতুন এবং পুরাতনের দ্বন্দ্ব নিয়ে কাহিনী রচিত। 
“মাদার ইন্ডিয়া” (১৯৫৭) – মেহবুব খান পরিচালিত “অউরত” ছবির পুনঃনির্মিত রূপ। অভিনয়ে – সুনীল দত্ত, নার্গিস, রাজেন্দ্র কুমার। নতুন ভারতবর্ষে কৃষিকাজে জোর দেওয়া; নারীশক্তির সম্মান। 
“ধর্মপুত্র” (১৯৬১) – যশ চোপড়া নির্দেশিত ছবি। অভিনয়ে- মালা সিনহা, শশী কাপুর। হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে গল্পটি বর্ণিত। 
“পূরব অউর পশ্চিম” (১৯৭০) – মনোজ কুমার নির্দেশিত ছবি। অভিনয়ে- মনোজ কুমার, সায়রা বানু। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য চেতনার মতদ্বৈত। 
১৪. Bengal film archive –এর official website, উইকিপিডিয়া।


গত ০৩-০৪-২০২৪ তারিখে রামকৃষ্ণ মিশন স্বশাসিত আবাসিক কলেজ, নরেন্দ্রপুরে আয়োজিত “ক্লিও-ভেঞ্চার ২০২৪” অনুষ্ঠানে ‘ভারতীয় সিনেমায় স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বিভাগে এই প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছে।

এটিই মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’-এর সর্বশেষ সংস্করণ। (বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ