ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

কর্মবীর আলামোহন -পুষ্কর সিকদার


প্র তিবার যখন আমতা লোকালে চড়ে হাওড়া স্টেশনে যেতাম তখনই চোখে পড়ত দাশনগর স্টেশনটা। আমরা বেশিরভাগ প্রত্যেকে নিজেদের জেলার প্রাচীন গ্রামগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত নই, আর ছোটো থাকার সময় কেউই এই বিষয় নিয়ে কথা বলেন না। অথচ কতো অজানা বিষয় লুকিয়ে রয়েছে গ্রামের পুরনো মন্দিরে বা সেই পুরোনো জমিদার বাড়িতে। এমনকি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীর জলধারাও বলে "আয়,আয়.."; যেন কোনো এক অজানা কাহিনী শোনাতে চায় সেই নদীটা। যেমন, প্রাচীনকালে নানা সভ্যতার জাগরণের মাধ্যমে বর্তাতমনের এই সুসজ্জিত সমাজ। যার সংস্কারে উঠে এসেছেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ আরো অনেকে। সেইমত আজকে জেনে নেব হাওড়া জেলার বিশেষ উদ্যোগপতি ও দাশনগরের প্রতিষ্ঠাতা কর্মবীর আলামোহন দাশ- এর কিছু অজানা কাহিনী।

১৮৯৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে হাওড়া জেলার খিলা-বারুইপুর অঞ্চলে সুরেন্দ্রমোহন দাশ জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরুটা ওনার অনেকটা হতাশার সাথে শুরু হয়েছিল। দেখেছিলেন মৃত্যুর বন্যা, মা-বোনেদের চোখে অজস্র চোখের জলের ধারা। সংক্রামক রোগে নিজেদের চেনা জানা অনেক স্বজন এমনকি নিজের মা বিরাজময়ীকে নিজের চোখের সামনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে দেখেছেন। পিতা, গোপীমোহন দাশ খুব কষ্টে বাঁচেন অনেক চিকিৎসায়। আশ্চর্য হবেন আপনারা এটা শুনে যে ওনার নাম ছিল সুরেন্দ্র মোহন দাশ,কিন্তু আলামোহন দাশ হলো কি করে। সেটারও এক আশ্চর্য কাহিনী রয়েছে এবং জানা যায় যে সেই সংক্রামক রোগে তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং স্থানীয় কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেও ওনার আরোগ্য করতে পারেননি কবিরাজ। সুতরাং, সংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যু হয়েছে ভেবে বাড়ির লোকেরা তাকে শ্মশানে নিয়ে যান। কিন্তু এমন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে এটা কেউ কখনও আশা করতে পারেননি। ওনাকে যখন শবদেহ রূপে কাঠের উপর রাখা হয় তখন ওনার কাকা লক্ষ্য করেন ওনার চোখের পাতা নড়ছে। এই আশ্চর্য ঘটনার ফলে অনেকে বলেন ওনাকে 'এলা ছেলে', যেহেতু তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন। আর তা থেকেই ওনার নাম হয় আলামোহন। বর্তমান আমতা থানার অন্তর্গত এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম করেছিলেন এবং মন থেকে ছিলেন স্বদেশ প্রেমী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়,সেখানে ব্যবসা-বাজার সম্পর্কে জানতে শুরু করেন আর সেখান থেকেই ওনার উদ্যোগপতির পথে চলা শুরু হয়েছিল। প্রথমে ছোটখাটো ব্যবসা করেন আর পরে তিনি খাদ্য শস্যের দোকান খুলেছিলেন কৃষকদের সুবিধার্থে। এরপরই উনি ঝোঁকেন বড় শিল্পের দিকে যেখান থেকে উনি ব্যবসার প্রতি আগ্রহ দিতে শুরু করেন। মন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনার প্রতি ছিল ওনার বিশেষ আকর্ষণ। স্বাধীনতার আন্দোলনেও তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নিজের ক্ষমতায় নানান সামাজিক কাজে যুক্ত রেখেছেন নিজেকে তা পুকুর খনন থেকে শুরু করে গরিবদের সহায়তা পর্যন্ত। এরপরই প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়া মেশিনারি কোম্পানি যেখানে ওজনের যন্ত্র, লেদ ও নানা উৎকৃষ্ট মানের সুলভ যন্ত্র তৈরি হতো। এরপর প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান জুট মিল যা উদ্বোধন করেছিলেন আমাদের বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এরপর হাওড়া ইন্সুরেন্স কোম্পানি ও এশিয়ান ড্রাগ কোম্পানি স্থাপন করেন। এরপর এগুলোর মাধ্যমে তিনি আর্থিক সচ্ছলতা পাওয়ার পর দাশ সুগার কোম্পানি, আরতি কটন মিল স্থাপন করেন যা ছিল ওনার অনত্যম কৃতিত্ব। তিনি নিজেকে এতদূর প্রসারিত করেছিলেন যে,নিজস্ব ব্যাঙ্কের ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং তারও প্রায় ১২ থেকে ১৪ টি শাখা ছিল। এভাবেই বাংলার বুকে তিনি হতাশার জীবন থেকে উঠে এসে নিজেকে কর্মবীর হিসাবে প্রমাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে নিজেরই নামে নগরী পত্তন করেন আর নাম দেন দাশনগর। আর সেই নামে আজও এই নগরী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আর সেখানেই নিজের পিতার স্মরণে খিলা গোপীমোহন শিক্ষা সদন উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। যে কারণে তিনি আজও দাশনগরবাসীর হৃদয়ে জানা অজানায় রয়ে গিয়েছেন। সামাজিক কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এই ব্যক্তিটি। এই ব্যবসায়ী এবং সংস্কারী জীবনের পাশাপাশি ১৯৫১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আমতা বিধানসভা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছিলেন। শেষে তিনি ১৯৬৯ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আজও আলামোহন দাশ রয়েছেন দাশনগরের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। যা তিনি করে গিয়েছেন তা গর্বে প্রতিটি হাওড়াবাসীর মাথা উঁচু করে দেয় সকলের সামনে। সবশেষে একটাই কথা, আলামোহন-বাবু অমর রহে।



এটিই মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’-এর সর্বশেষ সংস্করণ। (বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ