ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

আবন্ধী -তুষার সরদার

 
                                                     
যে কোনো দুপুরে 

দি ন রাতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দুপুরটাই বোধহয় সবচেয়ে বিশ্রী, ভীষণ একঘেয়ে আর ক্লান্ত লাগে। শুধু এ বাড়ির নয় চারপাশের সব বাড়ির পুরুষ তো বটেই, অনেক বাড়ির মহিলাও বিভিন্ন ধরণের কাজে বেরিয়ে যায়। কমবয়সি ছেলে-মেয়েরা স্কুলে বা কলেজে যায়। যারা বাড়িতে থাকে তাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া আর খুচরো কাজ শেষ হলে তারা সবাই আলস্যমুখী হয়। 

প্রায় বাড়ির দরজা বন্ধ। জানালাগুলো আধবোজা চোখে ঝিমাতে থাকে। বাতাসেরা ঘষটে ঘষটে চলতে থাকে। রোদগুলো বদমেজাজী ঢেউ তুলতে থাকে। এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দেওয়ালের নিশ্ছিদ্র কাঠিন্য বয়ে নির্জনতা ঘুরে ঘুরে বেড়ায় শুধু। দু’একটা রিক্সার ভাঙাচোরা রুগ্ন চিৎকার, ফেরিওয়ালার ময়লাটে ডাক সে দেওয়ালের কাঠিন্যে লেগে খুব ব্যর্থভাবে গড়িয়ে পড়ে যায়।

ওরা দুইবোন, বিভা আর বুলা এই সব একাকীত্বে ডোবানো পরিবেশের ছোটোবড়ো কর্কশ টুকরোগুলো গিলে গিলে খায়, খেতে হয়। কেন না ওদের ঘুম পায় না। দিনের বেলা ঘুম ওদের কাছে একেবারেই ঘেঁষে না। বোবা নির্ভাষ দৃষ্টি মেলে, কখনও বা শুধু শুধু চোখ বুজিয়ে ওরা চুপচাপ পড়ে থাকে বিছানায়।
 
সারাটা দুপুরের বিশাল লম্বা লম্বা মুহূর্তগুলো আহত সরীসৃপের মতো অতিকষ্টে ওদের উপর দিয়ে বেয়ে যায়। অসংলগ্ন কত টুকরো টুকরো ভাবনা ছুঁয়ে অথবা শূন্য হা হা মনে যে যার মতো আলাদা করে অথবা একসঙ্গে ওরা অতিসর্পিত হয় জরণ সময়ের পিছনে পিছনে। 

এই বাড়িতে পুরুষ বলতে দু’জন। একজন ওদের ছোটো ভাই অশোক, এখন অফিসে। অন্যজন অশোকের ছেলে সমিত। ক্লাস সিক্সে পড়ে। সে এখন স্কুলে। পাশের ঘরে রমলা এই সময়টায় ঘুমোয়। ছেলের স্কুল থেকে ফিরতে সেই সাড়ে চারটে- পৌনে পাঁচটা। পাখা চালিয়ে উপুড় হয়ে, চিৎ হয়ে, কাত হয়ে, বিছানা ধামসে ঘুমায় সে প্রায় সাড়ে চারটে পর্যন্ত। 

ছেলে স্কুল থেকে ফিরলে তার বড়োপিসি বিভা তাকে খেতে দেবে। খেয়েই সমিত ছুটবে খেলার মাঠের দিকে। খানিক পরে রমলা ঘুম জড়ানো গলায় হাঁক দেবে,- মেজদি, চা হল নাকি গো? বুলা তখন হয়তো চা করে ফেলেছে বা করছে। 

এক হাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে জলের জাগ নিয়ে রমলার ঘরে ঢুকে আসে বুলা। রমলা ততক্ষণে উঠে কোঁচকানো আধময়লা চাদর পাতা বিছানায় দুই পা ছড়িয়ে বসে সবজেটে ছোপধরা মাড়ির দাঁত অনেকটা ফাঁক করে বড়ো বড়ো হাই তোলে। 
বুলার হাত থেকে জলের জাগ নিয়ে উঁচু করে ধরে গলার মধ্যে জল ঢেলে কঁৎ কঁৎ শব্দ করে গিলতে থাকে। তারপর পাছা ঊরু হাতড়ে চুলকাতে চুলকাতে বিছানার পাশে টুলে রেখে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে আস্তে হাত বাড়ায়।

বুলা ততক্ষণে আর দু’কাপ চা নিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে গেছে। নিঃসঙ্গতা এতক্ষণে খাড়া হয়ে সটান দাঁড়িয়ে ছিল দরজা জুড়ে। এবার হাঁটুমুড়ে আস্তে আস্তে বসে পড়ে দরজার পাশে। ঝিমধরা পঙ্গু দুপুর একটু একটু করে শব্দের সাড় ফিরে পেতে থাকে।


পূর্বানুবৃত্তি

ভাইবোনদের মধ্যে বিভাই সবার বড়ো। ফের পর পর দুই বোন। তিন তিনটি কন্যার অনভিপ্রেত জন্মের পর অদম্য চতুর্থবারের চেষ্টায় বিভার বাবা-মা অন্তত একটি পুত্রলাভের চরম মোক্ষে পৌঁছুতে সমর্থ হয়েছিলেন। ছেলে অশোকের বয়স যখন আটবছর হয়েছে, তখন মেয়েদের মধ্যে ছোটোটি হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে মারা যায়। তাতে অবশ্য একটি অবাঞ্ছিত পোষ্য কমে গিয়েছিল।

বিভার বাবার চাকরি ছিল যৎসামান্য। চতুর্থ শ্রেণির সরকারী কর্মচারী। সে সময় বেতনও ছিল অতি অল্প। মাস আনা, মাস খাওয়া। তবু তার ভিতরেই অতিকষ্টে সন্তানপালন সংসারযাপনের ফাঁকে ফাঁকে একটুকরো জমিও কেনা হল। 

তার পর তাতে বাড়ি বানাবার চেষ্টা করতে গিয়ে বিভার বাবা একেবারে ফতুর হয়ে গেলেন। অভাবের দুঃসহ তাড়নাতেই হয়তো শেষের দিকে বাড়ি বানানো শেষ করার জন্য তিনি যেন ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। উন্মাদের মতো ধারদেনা করে চললেন।

পাঁচ ইঞ্চি গাঁথনির দেওয়ালের ওপর কোনোক্রমে টিনের ছাউনি দেওয়া দু’কামরার কুণ্ঠিত বাড়িটা শেষ পর্যন্ত যখন তাঁদের থাকবার জন্য ডেকে নিল, তখন বিভার বাবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে ফেলেছেন এবং অবসরকালীন অর্থের সবটাই বাড়ির পিছনে খুইয়ে ফেলেছেন। আর একই সঙ্গে গভীর দেনার পাঁকে তিনি আমুন্ডপদ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। 

তখন বিভা চল্লিশ আর বুলা আটত্রিশ অতিক্রম করেছে। অশোকের চৌত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেলেও তখনও পর্যন্ত সে কোনো চাকরি বাকরি পায়নি। এতদিনে বিভার বাবার ঠিকমতো খেয়াল হল, দু’দুটি মেয়ের কারুর বিয়ে তিনি দিতে পারেননি – আর পারবেনও না।

প্রথমত বাড়ি বানাবার নেশায় খেয়াল করেননি মেয়েদের বিয়ের বয়স প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত যে ঋণের তলায় তিনি চাপা পড়েছেন তা পর্বতপ্রমাণ। তাঁর জীবদ্দশায় সেই ঋণ কোনোভাবে শোধ করা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব।
 
ঋণদাতারাও সেটা মোটামুটি আন্দাজ করেছিল। সেজন্য তাদের আচরণ ও তাগাদা দেবার ধরন দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। এই অনড় পরিস্থিতিতে পড়ে বিভার বাবা আর বেশি দেরি করতে না পেরে বিদায় নিয়ে নিলেন। বিভার অসুস্থ মাও বছরখানেকের মধ্যেই বিনা চিকিৎসার সহজ পথ ধরে স্বামীর অনুগমন করলেন।

অথই দৈন্যে খাবি খেতে খেতে বছরচারেকের আপ্রাণ চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত অশোক একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ঢোকবার সুযোগ পেয়ে গেল। চাকরিটা ছিল ছোটোখাটো। তাতে যা মাইনে আসত তাতে সংসারের স্থবির দিনগুলো কোনোমতে গড়াতে লাগল। 

অশোকের পক্ষে দিদিদের বিয়ের ব্যবস্থা করার সাধ এবং সাধ্য দুটোই জন্মাবার আগেই মরে গিয়েছিল। সেজন্য তার নিজের বিয়ের কথা অশোক কল্পনাতেও আনল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই দিদি মিলে অশোককে ধরে বসল। বুলাই কথা বলল বেশি, বিভা সায় দিল-
‘আমাদের তো বিয়ে করার ইচ্ছাই ছিল না। এখন তো আর সে প্রশ্নই ওঠে না। তুই অন্তত বিয়েটা কর। একটা নতুন মানুষ আসুক।’ 
‘কিন্তু মেজদি, এইরকম অভাবের মধ্যে বিয়ে করে সংসার চালানো একেবারেই অসম্ভব। তাছাড়া বিয়ের পর মানানোর সমস্যা যদি হয়, তখন কী হবে? আমি না পারব এদিকে ছাড়তে, না পারব ওদিকে ছাড়তে।’
‘সংসার ঠিক চালিয়ে নেব যাহোক করে। সংসারের অভাব জেনে বুঝে যে মেয়ে আসবে, তাকেই তো আনবি। আর মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা? ওটা নিয়ে তুই একদম ভাবিস না। আমরা ঠিক মানিয়ে নেব দেখিস।’
তাই হয়েছিল। দাঁতালো অনটনের মধ্যে খুবই আশ্চর্যজনকভাবে নতুন বউ আসার পরেও ভাই-বোনেদের বা ননদ-ভাজের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। রমলাও বউ হয়ে এ বাড়িতে এসে দু’জন নিরীহ নির্জীব ননদকে ভালোই মানিয়ে নিল।


বিভা

কোমরের ব্যথাটা কদিন হল আবার খুব বেশি বেশি লাগছে। ডানপায়ে বছরখানেক হল একটা কাঁপা কাঁপা ভাব একটু একটু করে বাড়ছে। এছাড়া বহু পুরনো সঙ্গী আছে মাইগ্রেনের তীব্র যন্ত্রণাদায়ক মাথাব্যথা। কিন্তু এগুলোকে আমল দিলে চলে না। সংসারের কাজকর্মের বেশির ভাগটাই করে সে। ইচ্ছা করে জোর করেই করে। তাতে মনের ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা অনেকটাই কমে। 

তবে অনেকটা কাজকর্মের পর বিশ্রাম তো টানাটানি করবেই শরীরটাকে। সে সময়েই যত জ্বালা- সেই একাকীত্ব। দিনে, রাতে কামড়ে চলে ... কামড়েই চলে। না, বিয়ে হয়নি বলে বিভার কোনো আপশোশ বা হতাশা নেই। বরং বিয়ে করাতেই তার তীব্র অনীহা আছে। পুরুষ তার কাছে কখনই বন্ধু বা নর্মসহচর নয়, গভীর বিতৃষ্ণার, আতংকের আর ঘৃণার পাত্র।

নিজেদের বাড়ির চার দেওয়ালের নিরাপত্তার মধ্যেই ঘটে যাওয়া যে ঘটনাটা বিভাকে এভাবে বদলে দিয়েছিল সেটা অনেকদিন আগেকার কথা। বিভা তখন ষোড়শী কিশোরী। পুরুষ সম্পর্কে তার নারীসত্বার দু’চারটি পাতা আর কুঁড়ি সদ্য বিকশিত হয়েছে। সবে একটু উন্মুখ হয়েছে তার কিশোরী মন সমবয়সী ছেলেদের ভাবগতিক লক্ষ করার। এটা সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের সময়ের কথা। 

স্থানীয় এক পলিক্লিনিকের এক ডাক্তারের সঙ্গে বিভার বাবার কিভাবে যেন অসম এক ঘনিষ্টতা হয়েছিল। বাবার মতো মাও ডাক্তারকে খুব খাতির করত। মাঝে মধ্যেই ডাক্তার তাদের বাড়িতে চা খেতে, আড্ডা দিতে আসত। বিভা কিন্তু লোকটিকে একদম পছন্দ করত না। তাকে কাছাকাছি পেলেই ডাক্তার তার সারা পিঠে বিশ্রীভাবে হাত ঘষতে ঘষতে বলত- ভালো আছ তো মা বিভা?
একবার বিভার ডায়েরিয়া হয়েছিল। বিভার মা ডাক্তারকে খবর দিয়েছিল। খবর পেয়ে বিকেলে ডাক্তার তাকে দেখতে এল। বাড়িতে তখন বিভার মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিভার মা যথেষ্ট সমাদরে ডাক্তারকে অভ্যর্থনা করল-
‘আসুন ঠাকুরপো, আসুন। বড়ো মেয়েটা খুব অসুস্থ। আপনার দাদা তো খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে অফিস গেল।’
‘আমাকে আগে খবর দেননি কেন? যাক এসে গেছি যখন আর কিছু ভাববেন না বউদি। আমি দেখে সব ব্যবস্থা করছি।’
ঘরে ঢুকে বিভার বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসল ডাক্তার। জুলজুলে চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল-
‘তোমার হাতটা একবার দেখি মা।’ 
বাঁহাত বাড়িয়ে বিভার ডানহাতটা প্রায় টেনে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ টিপে দেখে ধরেই রইল ডাক্তার, ছাড়ল না-
‘বউদি, একটা চামচ নিয়ে আসুন তো। গলার ভিতরটা একবার দেখে নিতে হবে। চামচটা খুব ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে তার পর আনবেন।’
বিভার মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই ডাক্তার আচমকা ডানহাতটা দিয়ে বিভার ডানবুকটা সজোরে খামচাতে খামচাতে মুখের ওপর হামলে পড়ে তার বিশুষ্ক ঠোঁট দুটো কদর্য ভাবে চুষতে লাগল। নিতান্ত অভাবিত সেই কল্মাষ পুরুষ পীড়নে রুগ্ন দুর্বল বিভা প্রচন্ড আতংকে প্রথমটা একেবারে জমে গেল। 
তার পর উঁ-উঁ করে শব্দ করে ছটফটিয়ে উঠতে লাগল। হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে উঠে দাঁড়াল ডাক্তার। বিভার মা চামচ নিয়ে ঢুকতে চামচটা হাতে নিয়ে বিভার দিকে ফিরে বলল- 
‘একটু হাঁ করো তো দেখি মা বিভা!’
দারুণ ঘৃণায় আতংকে বুক ও ঠোঁটের যন্ত্রণা নিয়ে দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল বিভা। ডাক্তার তৎক্ষণাৎ বিভার মায়ের দিকে ফিরে বলল-
‘ঠিক আছে বউদি, আমি সব দেখে নিচ্ছি। আপনি গিয়ে একটু চা বসান। আমার খুব তাড়া আছে।’ 
বিভার মা বেরিয়ে যেতেই ডাক্তার হিসহিসিয়ে উঠল- 
‘শোনো, বাবা বা মাকে এসব কথা বলে কোনো লাভ হবে না। কেউ তোমার কথা বিশ্বাসই করবে না। আজ যাচ্ছি। এটা প্রথমবার বলে তেমন ভালো লাগল না হয়তো। তবে পরে পরে তোমার ভালো লাগবে এসব। আমি কিন্তু ফের আসব।’ 

কয়েকটা ওষুধ লিখে দিয়ে ডাক্তার চলে গেল। তিনচার দিন পরে আতংকগ্রস্ত বিভা শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে গেল। আশ্চর্য এক সমাপতনে আরও কয়েকদিন পরে কোনো বিশেষ কারণে ডাক্তারও সেই পলিক্লিনিকে আসা ছেড়ে দিল। কিন্তু সেই দুঃসহ আতংক আর থকথকে ঘৃণা বিভাকে ছাড়লই না। অনির্ণেয় অনারোগ্য ব্যাধির মতো তার কোমল অপরিণত মনকে বিষাক্ত পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল।

 ডাক্তার একটা কথা ঠিকই বলেছিল- এই ব্যাপারে বিভার কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না। ডাক্তারের ছদ্ম আচরণ একেবারে নিখুঁত ছিল কিনা। অন্যদিকে বিভা ছিল বড়ো কোমল আর ভীরু স্বভাবের মেয়ে। এই গভীর মর্মঘাতী অপমান আর গ্লানির কথা সে কাউকেই মুখফুটে বলে উঠতে পারল না। দিনে দিনে সে মনের গভীরতর থেকে গভীরতম স্তরে আক্রান্ত হতে থাকল। 

বাবা আর ভাই ছাড়া পৃথিবীর প্রত্যেকটি পুরুষকেই তার হিংস্র নেকড়ের মতো বলে মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল। তার মুকুলিত উন্মুখ নারীসত্বা ধীরে ধীরে একটি মাত্র বৈশিষ্ট্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল- তা হল তীব্র পুরুষ-ঘৃণা। 

তার পর কতগুলো বছর গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেছে। এখনও ভাই আর ভাইপো ছাড়া কোনো পুরুষকেই সে সহ্য করতে পারে না। যৌবনের স্বাভাবিক চাহিদা কখনো তাকে পুরুষসঙ্গের জন্য একটুও উন্মন করে তোলেনি এমন নয়। কিন্তু প্রবল পুরুষ-ঘৃণার উত্তাপে তা সহজেই বাষ্পীভূত হয়ে তাকে ফেলে রেখে যেত এক সুতীক্ষ্ণ অথল ঐকল্যের গ্রাসে। 


বুলা 

টুইশন পড়াতে পড়াতে হঠাৎই খেই হারিয়ে ফেলল বুলা। তার সামনে খোলা বইখাতা, বসে থাকা দুই ছাত্রীকে রেখে সে আচমকা ভেসে গেল কোন্‌ এক জ্ঞানাতীত অনিধার্য উদ্দেশে। এরকম আজকাল মাঝে মাঝে হচ্ছে তার। 

কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই তার মন হঠাৎ হঠাৎ এক হা হা শূন্যতার গভীরে লুপ্ত হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার যে অবস্থা থেকে সে হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল আবার সেই অবস্থায় ধীরে ধীরে ফিরে আসে- বাস্তবে স্থিত হয়।

এবারেও বেশ কিছুক্ষণ গভীর শূন্যতায় নিরুদ্দিষ্ট থাকার পর আবার সে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে লাগল। আবার পড়ানোর দিকে মন দেবার চেষ্টা করে সে। প্রথম প্রথম এরকম হলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। শরীর কাঁপা কাঁপা লাগত। 

এখন এই ব্যাপারটা মোটামুটি কিছুটা সয়ে গেছে তার। ওই রকম হলে এখন আর অত বেশি ভয় লাগে না। যদিও এই ব্যাপারটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে বাড়ছে। সংখ্যায় এবং স্থায়িত্বে- দুভাবেই বেড়ে যাচ্ছে। 

সাংসারিক অসচ্ছলতার সঙ্গে এঁটে উঠতে কয়েকটা টুইশন করে সে। কমবয়স থেকেই এসব করা অভ্যাস ছিল তার। ছাত্রী হিসেবে সে ভালো ছিল। ধারালো অভাবের মধ্যেও ছোটোবেলা থেকেই পড়াশোনা করার খুব জেদ ছিল তার। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় সে বুঝল তার পড়ার খরচ যোগানোর ইচ্ছা থাকলেও তার বাবার সেই ক্ষমতা আর নেই। কিন্তু বুলা হাল ছেড়ে দিল না কিছুতেই। 

টুইশন করা শুরু করল সে, নিজের পড়া চালিয়ে যাবার খরচ যোগানোর জন্য। অভাবের সঙ্গে লড়াই দিতে দিতে সে যথেষ্ট ভালো ফলাফল করে উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গেল। কিন্তু এবার? এবার তো খরচ অনেক বেশি। ক’টা টুইশনের স্বল্প এবং অনিশ্চিত আয়ের উপর নির্ভর করে আর এগোনো অসম্ভব বলে তার মনে হল। 

আরও কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতির জন্য সে বাড়তি খোঁজাখুঁজি করে বাড়তি টুইশন জোগাড় করল। কিন্তু তাতে অন্য এক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে গেল। তার নিজের পড়ার সময়টা খুব সংকুচিত হয়ে পড়ার উপক্রম হল। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় বুলা পড়াশোনার পর্ব চুকিয়ে দেবার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছিল। 

সংকটজনক সেই সময়ে হঠাৎ যেন ঈশ্বরের এক দূত হয়ে তার কাছে এল সমরেশ সান্যাল, তার এক ছাত্রীর বয়স্ক অবিবাহিত দাদা। সমরেশ সেই এলাকার রাজনৈতিক দলের একজন উঠতি নেতা। তাছাড়া সে উচ্চ সংগতিসম্পন্ন পিতার একমাত্র বংশরক্ষক। বুলার লেখাপড়া করার আগ্রহ, জেদ ও সমস্যা জানতে পেরে সমরেশ তাকে উৎসাহ দিল-
‘তুমি পড়াশোনা চালিয়ে যাও। কলেজে ভর্তি হও। খরচের জন্য ভেব না। ওটা আমি দেখছি। আমি নিজে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশেষ লেখাপড়া করে উঠতে পারিনি। সেজন্য এখন খুব আপশোশ করি। তাই কারোর লেখাপড়ায় জেদ আছে দেখলে আমি তাকে সাহায্য করি। তাতে খানিকটা শান্তি পাই মনে। 

করলও সে তাই। কলেজের ভর্তি-ফি থেকে শুরু করে সমস্ত বই খাতা-পত্র তো বটেই, বুলার সসংকোচ আপত্তি অগ্রাহ্য করে তার জন্য প্রাইভেট টিউটর পর্যন্ত বহাল করল সমরেশ। এতখানি অপ্রত্যাশিত সহায়তা অযাচিতভাবে পেয়ে বুলা নতুন পূর্ণ উদ্যমে পড়া শুরু করল। স্বভাবতই এই নিঃস্বার্থ সাহায্যকারী দেবদূতপ্রায় সমরেশ ক্রমে তার কৃতজ্ঞ তরুণী মন দখল করে বসল।

বুলার ছাত্রী একটু রোগেভোগা ধরণের ছিল। সে মাঝে মধ্যেই শরীর খারাপ লাগছে বলে পড়তে বসত না। সেই সব দিনগুলোতে খুব বিরক্তি বোধ করত বুলা। মিছামিছি কষ্ট করে এতদূর হেঁটে আসা হল, তারপর ফিরে যাওয়া। সম্প্রতি অবশ্য একটা ব্যাপার ঘটছে। ছাত্রী অনুপস্থিত থাকলে ছাত্রীর দাদা উপস্থিত হয়ে যায়। বিভিন্ন আলাপে তর তর করে কেটে যায় পড়ানোর সময়টা। তাদের সম্পর্কটা দ্রুত সহজ আর গাঢ় হয়ে উঠতে থাকল।

এইরকম একদিনের কথা। পড়াতে এসে পড়ানোর ঘরে চেয়ারে বসে আছে বুলা। একটু আগে সে এখানে ঢুকেছে। কাজের লোক পড়ার ঘরের দরজা খুলে তাকে বসিয়ে ভিতরে বুলার ছাত্রীকে ডেকে দিতে গেছে। বুলা সামান্য চঞ্চল। আজও কি তার ছাত্রীর শরীর খারাপ হয়েছে? সে কি পড়তে আসবে না? নাকি ছাত্রীর বদলে ছাত্রীর দাদা-’
হঠাৎ পেছন থেকে তার দুচোখ দুহাতে চেপে ধরে কেউ। প্রথমটা দারুণ চমকে গেল বুলা। দুহাত দিয়ে তার চোখ চেপে ধরা হাত স্পর্শ করে কেঁপে ওঠে সে ... এ তো সমরেশ! নিশ্চিত সমরেশ! তার দুহাত অবশ শিথিল হয়ে নেমে আসে। ফিস্‌ ফিস্‌ করে কোনোমতে সে উচ্চারণ করে-
‘ছাড়ুন! কেউ দেখে ফেলবে।’।
‘কেউ এখন এখানে আসবে না। আর ছাড়তে পারি, যদি বলো ‘ছাড়ো’। ছাড়ুন বললে কিন্তু ছাড়ব না।’। 
বুকটা ভীষণভাবে ধুক ধুক করতে থাকে বুলার। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে তার। তখনকার মতো নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ফ্যাকাশে গলায় কোনোমতে আস্তে করে বলে-
‘ছাড়ো।’
চোখের উপর থেকে হাত দুটো আলগা করে সমরেশ, কিন্তু ছাড়ে না। চোখ থেকে হাত নেমে বুলার দুকাঁধে আসে। তারপর দুহাতের হাতের চেটোয় বুলার দুগাল চেপে ধরে থাকে। তার গাঢ় কণ্ঠস্বর শোনা যায়-
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই বুলা। তুমি রাজি তো?’ 
বুলা এর মধ্যে সমরেশকে হৃদয় ঢেলে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এত দ্রুত এতসব এতদূর পর্যন্ত কখনও কল্পনাই করেনি সে। থর্‌ থর্‌ করে কাঁপতে থাকে বুলা। কিছু বলতে পারে না। সমরেশের অধৈর্য দুই হাত এবার বুলার কুমারী বুকে নেমে আসে। তার কাঁধ আর গলার খাঁজে মুখ ঢুকিয়ে বলতে থাকে সমরেশ- 
‘তুমি না কোরো না প্লিজ। আমি তাহলে ঠিক মরে যাব। পরশুদিন বুধবার সন্ধ্যায় তুমি আমার গোডাউনের অফিসঘরে সাড়ে সাতটায় এসো। ওইদিন ওখানে বসে দুজনে মিলে ঠিক করব কবে আমরা রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে করার নোটিশ দিতে যাব। রেজিস্ট্রি বিয়েটা হয়ে গেলে তারপরেই বাড়িতে জানাব। এখন যাই আমি। পপিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

কম্পমান বুলার গন্ডদেশে একটা চুমু বসিয়ে দিয়ে সমরেশ চলে গেল। একটু পরে বইখাতা নিয়ে বুলার ছাত্রী পপি ঘরে ঢুকল। কিন্তু সেদিন পপিকে আর ঠিকমতো পড়ানো হয়ে উঠল না। একটু আগে যা ঘটে গেছে তাতে তার শরীর-মন একেবারেই নিজের আয়ত্তে নেই। বুলা সে সন্ধ্যায় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল। 

সমরেশের মতো বিদ্যানুরাগী, নিঃস্বার্থপর ও ধনবান মানুষ তার মতো এক অতি সাধারণ মেয়েকে ভালোবেসেছে! শুধু তাই নয় তাকে এখনই বিয়ে করতে আগ্রহী! আর আগামী পরশুই ঠিক হয়ে যাবে কবে তাদের রেজিস্ট্রি বিয়েটা হবে! উত্তেজনা এবং বিচলন তাকে এতটাই অভিভূত করে ফেলেছিল যে দিদি বিভাকেও বলা হয়ে উঠল না কথাগুলো।

নির্দিষ্ট দিন বুধবারে সমরেশের সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য সন্ধ্যার পর বুলা বেরিয়ে পড়ল। সাড়ে ছটা বাজে। আধঘন্টার মতো লাগে হেঁটে যেতে। সাতটা নাগাদ সে পৌঁছে যাবে সমরেশদের বাড়িতে। যদিও সাড়ে সাতটায় যাবার কথা, তবু বাড়িতে স্থির থাকতে না পেরে বেরিয়ে পড়েছিল বুলা। খুব বুক ঢিব ঢিব করছিল তার। সমাগত পরম সৌভাগ্য এতটাই আকস্মিক এবং এত অভাবিতপূর্ব ছিল যে তার অর্ধপরিণত মন দিশাহীন ভাবে উত্তাল তরঙ্গায়িত হচ্ছিল।

বড়ো রাস্তার গায়ে সমরেশের অফিসঘরটা তাদের মূল বাড়ির একটু পাশে। মাঝখানে খানিকটা গাছপালা ভরা জায়গা আছে। ইট-বালি-সিমেন্টের ব্যাবসা আছে তার। সিমেন্ট রাখার বড়ো গোডাউন আছে সামনের দিকে। পিছন দিকে লাগোয়া একটা অফিসঘর। অফিসঘরে একপাশে টেবিল আর খানতিনেক চেয়ার আছে। অন্য পাশে নীচু একটা তক্তাপোশ। খরিদ্দারদের সঙ্গে এখানেই ব্যাবসার কথাটথা হয়।

সাতটা দশে সেখানে পৌঁছে গেল বুলা। গোডাউনের সামনের আলোটা জ্বলছে না। একদিক থেকে ভালোই হল। গোডাউনের সামনের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার সময় কেউ তাকে দেখতে পাবে না। আজ সাতটার সময়েই এ বাড়িতে তার পড়াতে আসার কথা। এখন তাকে কেউ দেখে ফেলুক এটা সে চাইছিল না।

গোডাউনের শেষ প্রান্তে অফিসঘরের কাছাকাছি পৌঁছাতে একটা চাপা হাসির হুল্লোড় শুনতে পেল বুলা। তবে কি সব খরিদ্দার এখনও চলে যায়নি? হতেও পারে। এখন তো সবে সাতটা পাঁচ বাজে। সে-ই বেশি তাড়াতাড়ি এখানে এসে পড়েছে।
 
একটু এগিয়ে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল বুলা। এখন সমরেশের কাছে না যাওয়াই উচিত। অন্য লোকেরা আগে চলে যাক। তার পর অফিসঘরে ঢুকবে সে। কিন্তু এখানে পথে দাঁড়িয়ে থাকলে খদ্দেররা চলে যাবার সময় তাকে দেখে ফেলতে পারে। আর একটু এগিয়ে গিয়ে পথের পাশে একটা গাছের আড়াল নিয়ে দাঁড়ালো বুল। হাসির হুল্লোড় থিতিয়ে যেতে সমরেশের গলা স্পষ্ট ভেসে উঠল-
  ‘মেয়েটা পুরো ভার্জিন আছে রে! গত পরশু সন্ধ্যায় গায়ে একটু হাত মারতেই মেয়েটা কাঁপছিল থর্‌ থর্‌ করে। গলার আওয়াজ গেছিল বন্ধ হয়ে। কত মেয়ে তো দেখলাম। এরকমটা কিন্তু এর আগে কখনও দেখিনি।’
একটু বিরাম। তারপর আবার সমরেশের গলা ভেসে আসে-
‘এখানে পড়াতে আসার পর যখন আমার নজরে পড়ে গেল তখন ভালো করে খোঁজ খবর লাগিয়ে শুনলাম মেয়েটা এখনও আনটাচট আছে। সেইজন্যেই তো দুগ্গা বলে অনেকগুলো টাকা ইনভেস্ট করে দিলাম ওর পেছনে।’
‘তুমি গুরু কি আর কাঁচা কাজ করার লোক? তাই তো বলি কোতাগার কে? না বোনের দিদিমনি! তার পোঁদে এত বেশি ফালতু খর্চা করা কেন? আসল ব্যাপারটা এবার বোঝা গেল! তা গুরু তোমার ওই ভাজ্জিন না মাজ্জিন কী একটা যেন বললে, ওটা তোমার কাছে আসবে কখন? সন্ধে তো হয়ে গেছে।’
‘তুই বাঞ্চোত তো স্রেফ একটা ধেড়ে পাঁঠা! তুই ভার্জিনের আসল মর্ম কী বুঝবি?’ 
‘সে অবশ্য ঠিক কথা। আমি সত্যি ওসব ভাজ্জিন বা মাজ্জিন মানে আসলে যে কী, সেটা আমার মাথায় আসে না। আমার কাছে মেয়েছেলে হল মেয়েছেলে। তা গুরু আজ তোমার হয়ে গেলে পোসাদ একটু পাব তো?’
‘সে দেখা যাবে’খন। এখন ফোট্‌ তো তুই! ওই দরজাটা দিয়ে গোডাউনের ভিতরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দে। সাড়ে সাতটায় টাইম দেওয়া আছে। পাঁচ দশ মিনিট এদিক ওদিক হতেই পারে। তবে মেয়েটা আসবেই আসবে। তাকে একেবারে রেজিস্ট্রি বিয়ের টোপ গিলিয়ে দিয়েছি যে! খ্যা খ্যা খ্যা ...!

আবার মিলিত কদর্য হাসির একটা চাপা হল্লা ওঠে। বুলা ততক্ষণে শক্ত হয়ে যাওয়া শীতল মৃতদেহের মতো জমে গেছিল। আতঙ্কে? ঘৃণায়? অসহ বিস্ময়ে? ধ্বংসে? না কী সবেতেই? বুলা আজও সেদিনের সেই সময়ের অনুভূতির কথা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। 

তবে এটুকু স্পষ্ট মনে আছে সামনে এগোবার বা পিছনে সরে আসার কোনো ক্ষমতাই তখন তার ছিল না। গাছটায় ঠেস দিয়ে কোনোমতে সে প্রাণপণে নিজের পড়ে যাওয়া সামলাচ্ছিল। খানিকক্ষণ পরে শরীরে একটু সাড় ফিরে পেয়ে একটু একটু করে সে পিছিয়ে গোডাউনের দেওয়াল ধরে ধরে বড়ো রাস্তায় ফিরে আসতে পেরেছিল।

অমেধ্য সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে একসময় রাতে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই রাতটা ছিল এক বীভৎস উন্নিদ্র রাত। দু’বোন এক জায়গায় শুতো। সে রাতে দুজনের কেউ ঘুমায়নি- ঘুমাতে পারেনি। বুলা এক ভয়ংকর অভ্যন্তরিক ধাক্কায় ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছিল দিদির জড়ানো দু’হাতের আশ্রয়ে থেকে। আর বাঁধভাঙা চোখের জলে সিক্ত করে দিচ্ছিল বিভাকে। 

বিভা বোনের মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে বিছানায় বসেছিল, আর তন্ত্রসিদ্ধা ডাকিনীর মতো করাল হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে ঘরের অন্ধকার বিদ্ধ করছিল- ফালা ফালা করছিল। চাপা বিষদিগ্ধ স্বরে সে হিসহিস করছিল-
‘জানি রে বোন! ... আমি জানি ওরা কী! ওরা কেমন! আমি জানি রে! ওদের কাউকেই কখনও বিশ্বাস করতে নেই।’


গড়াতে থাকা রাত 

বছরের পর বছর গড়িয়ে গেছে। তবু কারো ভিতরের ক্ষতই তেমন শুকায়নি। নিষ্করুণ ভাবে বিদ্ধ করে দগ্ধ করে আসছে ওদের শেষহীন ভাবে। দুই বোনই এখন কমবেশি মধ্যপঞ্চাশে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সের কারণে বুলা শারীরিক সামর্থে সামান্য একটু এগিয়ে আছে দিদি বিভার থেকে। 
সকাল-সন্ধ্যায় গোটাতিনেক টুইশন করে সে। তার সঙ্গে সংসারের কাজ তো আছেই। হাঁপানি আছে তার। শীতটা অমানুষিক কষ্টে কাটে। তলপেটের ডানদিকে কুঁচকির কাছে একটা ফোলা জায়গা আছে। যন্ত্রণা হয় ওখানে। ডাক্তার বলেছিল ওটা নাকি হার্নিয়া। অপারেশন ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা নেই। 

খরচের কারণে অপারেশনের কথা ভাবাও যায় না, ভাবতে চায়ও না বুলা। যে কদিন এমনিই বাঁচা যায়। দুই বোন দুই বোনের জন্যই বাঁচতে চায়। একই সঙ্গে দুজনেই জীবনের দীর্ঘতাকে বড়ো ভয় পায়। বাঁচা অথবা মরা কোনোটাই তাদের কাছে প্রিয় অথবা অপ্রিয় নয়। গভীর অনীপ্সা ওদের মনকে ক্রমশ নির্জীব করে দিয়েছে।

বিভা আর রমলা মিলে রাতের রান্না করে ফেলে নটার মধ্যে। টুইশন সেরে নটার পর বুলা ফিরে আসে। অশোক ফেরে সাড়ে নটায়। সমিত ওদের স্কুলের একজন টিচারের কাছে সন্ধ্যার পর পড়তে যায়। সাড়ে নটা থেকে পৌনে দশটার মধ্যে সে ফিরে আসে। সন্ধ্যা থেকে ঘন্টা-মিনিটগুলো যান্ত্রিকভাবে শব্দ না তুলে গড়াতে থাকে।

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ওরা খেতে বসে। খাওয়া শেষ হলে বাসন মেজে ধুয়ে রান্নাঘরের কাজ রাতেই সেরে রাখে বিভা। তার সঙ্গে বুলা ও রমলাও হাত লাগায়। সকালে উঠেই বিভা প্রথমে রান্না বসাবে। রমলা একটু বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। তারপর সে রান্নাঘরে ঢোকে। 

সব সেরেটেরে দুই বোন একসঙ্গে বা সামান্য আগে পিছে তাদের নিস্পৃহ বিছানার কাছে যখন এসে পৌঁছায় তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। ঘরের অন্য প্রান্তে আর একটা বিছানায় সমিত তখন ঘুমিয়ে কাদা। এবার রাত ক্রমে যতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকে।

ওরা দুইবোন একসঙ্গে পাশাপাশি একা একা শুয়ে থাকে বিছানায়। দুপুরে একটুও না ঘুমাতে পারলেও ওদের রাতের ঘুম আসতে খুব গড়িমসি করতে থাকে। আশেপাশের রাস্তায় পথকুকুরের মিলিত চিৎকারে, রাতপাখির কর্কশ ডাকে, খানিক দূরের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্সের জোরালো হুটারের উদ্বিগ্ন শব্দে ওদের বিনিদ্র মুহূর্তগুলো বিভৃত হতে থাকে।

দেওয়ালের ঠিক ওপাশের লাগোয়া ঘরে রমলা ও অশোক শোয়। রাত ভারী হলে উপরের টিনের ছাউনি আর দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ওঘরের শব্দ, কথাবার্তা সশরীরে এঘরে চলে আসতে থাকে। অনিচ্ছুক চারণায় এঘরে ঘুরে ফিরে বেড়াতে থাকে সেসব। শুয়ে পড়ার পর বেশির ভাগ রাতে ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে নানা প্রসঙ্গে অকারণ জোরে জোরে কথা বলে। 

দেওয়ালের ওপারে অপ্রিয় নানা প্রসঙ্গ নিয়েও ওরা আলোচনা করে। কখনও শুধুই পরচর্চা করে, কখনও সাংসারিক কলহে জড়িত হয়। ওদের উত্তেজিত কথা কাটাকাটি অনেক রাত পর্যন্ত চলে এসে এঘরের স্তব্ধতাকে খান খান করে দিতে থাকে। কদাচিৎ ম্লান নিরুপায় পিঠ পেতে থাকা প্রৌঢ় রুগ্ন খাটে একঘেয়ে কিচকিচ শব্দ তুলে ওরা নিতান্ত অভ্যাসগত সঙ্গমে উদ্বৃত্ত সময় খরচে লিপ্ত হয়।

দেওয়ালের এপারে তখন সম্পূর্ণ বিগতস্পৃহ শীতল এক সম্মূঢ় চেতনার মরুপথ বেয়ে দুই হতযৌবনা নারী প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে শুধু ঘুমের আশ্রয় খুঁজে খুঁজে অবসন্ন হামাগুড়ি দিতে থাকে ঘুমের চবুতরে। তার পর কোনো একসময় ঘুমিয়ে পড়ে ... আর জেগে থাকতে পারে না বলে, যেমন ওরা বেঁচে রয়ে গেছে ... ঠিকমতো মরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি বলে।



এটিই মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’-এর সর্বশেষ সংস্করণ। (বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ