ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

অঞ্জলি লহ মোর -সুপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায়



"...   ...   ... ...             ......            ......
চার দুগুণে  আট, পাঁচ দুগুণে দশ
ভুল হয়ে যায়, ...      ...       ...        ....
পড়ার কথা ভাবলে চোখে জল পড়ে টস টস!
...,এবার বোধয় সিংহ-রাজের  কেশর দিল জুড়ে।
অসুর বোধহয় বেরিয়ে গেছে মোষের পেটটি ফুঁড়ে!
মন মানেনা আর!
...             ...              ...
...             ...               ...
কুরুর কুরুর তাক!"

-চণ্ডীমণ্ডপে মা দুর্গার সাবেকি মূর্তি গড়াকালীন  আবহে শিশুপাঠ্য ছড়াটি শিল্পী সনৎ সিংহের কণ্ঠস্বরে রণিত,মুখর ও আদৃত শহর ও গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে। 
কালের ছন্দে একচালা ছাপিয়ে প্রণোদিত হল গণেশ-কার্তিক-মা দুগ্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতীর পৃথক মূর্তিসম্পন্ন পরিবার। এল আলোক সজ্জায় অভিনবত্বের প্রতিযোগিতা; অবশেষে জাঁকিয়ে বসল থীম-পুজোর  আঙ্গিক। প্রথম দিকে মর্ত্যে মায়ের সপরিবার আগমনের বিষয়টি গুরুত্ব পেল; পরবর্তীতে শুরু হল গ্রাম-নগরের, দেশ-বিদেশের  কিম্বা মহাজগতের খুঁটি নাটি সামাজিক ও অন্যান্য কর্মকান্ড অথবা নানাবিধ প্রাকৃতিক ও ব্যবসায়িক প্রচারের আবেদন। এল গ্রামীণ অথবা আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, দেশ-বিদেশের নানান মন্দিরের নকল, আরও কত কী!

শারদীয়া আনন্দযজ্ঞের গভীরে প্রোথিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার শক্তি আরাধনার শিকড়টি। শ্রীমদ্ভাগবতগীতার ৪র্থ অধ্যায়স্থ দু'টি প্রাসঙ্গিক শ্লোক বাংলা তর্জমায়,
'হে ভারত যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।।৭।।'
                              আর 
'সাধুদের পরিত্রাণ করবার জন্য এবং দুষ্কৃতি কারীদের বিনাশ করার জন্য ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।।৮।।

ঋষি মার্কণ্ডেয় 'দেবীমাহাত্ম্যমে' গেঁথে রাখেন মহিষাসুরমর্দিনীর  গল্পটি। বরাহপুরাণে  আছে, দৈত্য বিপ্রচিত্তির  কন্যা মাহিষ্মতী  মহিষের বেশে ভয় দেখানোর ফলে তপস্যারত  ক্রুদ্ধ ঋষি সিন্ধুদ্বীপ  তাকে অভিশাপ দেন, 'তুমি মহিষীই  হও'। অন্যদিকে রম্ভ ও করম্ভ অসুর পূত্রলাভের বাসনায় পঞ্চনদের জলে ডুবে কঠোর তপস্যা শুরু করলে ভীত ইন্দ্র কৌশলে বিনাশ করলেন করম্ভকে। ভাইয়ের বিরহে শোকার্ত রম্ভ স্বীয় মুন্ডচ্ছেদ করে আগুনে আহুতি দিতে উদ্যত হলে অগ্নিদেব প্রসন্ন হলেন; আর রম্ভের প্রার্থনা মঞ্জুর করে ত্রৈলোক্যবিজয়ী পুত্রলাভের বর দান করলেন তাকে। অতঃপর রম্ভ খুশি মনে ঘরে ফেরার পথে ভবিতব্য অনুসারে সমাসক্তা হন অভিশপ্তা মাহিষ্মতীর প্রতি। তাদের পুত্রই মহিষাসুর।

কালিকাপুরাণমতে,সুমেরু পর্বতে দীর্ঘকাল তপস্যারত মহিষাসুর ব্রহ্মার সন্তুষ্টিবিধান  করে প্রার্থণা করে অমরত্বলাভের বর। মৃত্যু জীবের সনাতন ধর্মবিধায়  ব্রহ্মা তাকে অন্য বর প্রার্থণার নির্দেশ দেন। নারীকে গণনাবাচ্য মনে না করায় অতিচতুর  মহিষাসুরের চূড়ান্ত ভিক্ষাটি ছিল  দেব, দানব ও মনুষ্যজাতীয় পুরুষ হতে তার মৃত্যু না হবার প্রার্থণা। যাচিত বরদানের পর ব্রহ্মা তাকে অবগত করলেন কোনও নারীর দ্বারাই তার অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুবিধানের কথা। উদ্ধত মহিষাসুর দ্বারা ক্রমান্বয়ে পরাভূত ও স্বর্গচ্যুত দুর্দশাক্লিষ্ট দেবতারা সুবিচারের আশায় শিব ও বিষ্ণুসহ শরণাগত হলেন পিতামহ ব্রহ্মার নিকটে- হিমালয়ের সু-উচ্চ পর্বতে কঠোর তপস্যামগ্ন কাত্যায়নের  আশ্রমে।

প্রথমে বিষ্ণু আর পরে ব্রহ্মা ও মহেশ্বরের ক্রোধ হতে একটি করে জ্যোতি বেরিয়ে এল। ইন্দ্রাদি দেবতাদের দেহ হতেও নির্গত হল অনেক জ্যোতি। সকল তেজরাশি একীভূত হয়ে রচিত হল এক নারীমূর্তি- দেবী দুর্গা!

শিবের তেজে দেবীর মুখ,যমের তেজে কেশ পাশ,বিষ্ণুর তেজে বাহুসকল, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও ঊরুদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল,সূর্যের তেজে পদাঙ্গুলিসমূহ, অষ্টবসুর তেজে করাঙ্গুলিসকল এবং কুবেরের তেজে নাসিকার উৎপত্তি ঘটল।

বিচিত্রবর্ণা, দেবতাদের তেজরাশি সম্ভূতার দশটি হাতে দেবতারা তুলে দিলেন নিজেদের দশটি অস্ত্র। মহাদেব শুল, বিষ্ণু সুদর্শনচক্র, বরুণ শঙ্খ,  অগ্নি শক্তি, পবনদেব একটি ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, দেবরাজ বজ্র ও ঐরাবত ঘণ্টা, যম কাল দন্ড, ব্রহ্মা মালা-কমন্ডুলু, দিবাকর কিরণরাশি, নিমেষাদিকালাভিমানিনী একটি প্রদীপ্ত খড়্গ ও একটি উজ্জ্বল ঢাল,সমুদ্র অম্লান পদ্মমাল্য, গিরি রাজ বাহন (সিংহ), কুবের পানপাত্র আর রত্ন হারা  দেবগণ অলঙ্কার আর  বস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করলেন মহামায়াকে। দেবীর অট্টহাস্য, হুঙ্কার আর সিংহ-নাদের উৎস সন্ধানে নির্গত হলেন ভয়ার্ত মহিষাসুর। দুর্গাদর্শনে শুরু হল মহারণ। চিক্ষুর,  চামর,উদ্রক,অসিলোমাদি পালোয়ানেরা একে একে হল বিধ্বস্ত। সর্বশেষে এলেন মহিষাসুর- যাকে বধের দ্বারা দেবী জগৎ-খ্যাতা  ও পূজিতা হলেন মহিষাসুরমর্দিনী রূপে।

শক্তির বিনাশ হয় না, তা সকলেই জানি। যান্ত্রিক শক্তি  থেকে শুরু করে আলোক,শব্দ,তাপ, চৌম্বক, তড়িৎ, পারমাণবিক, রাসায়নিক ও সৌরশক্তি- সর্বসাধারণের পরিচিত কাজ করবার সামর্থ্যযুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির পারস্পরিক রূপান্তর ঘটে ও বস্তু হতে বস্তুতে সঞ্চারিত হতে পারঙ্গম সেগুলি।E=mc2  সূত্রবলে শক্তি থিতু হয় পদার্থে, যেমনটি হয় ফিশন প্রক্রিয়ায়। পদার্থ বিজ্ঞান মথিত শক্তির এই প্রাচীন আদিরূপটি ধরা দেয় সৃষ্টির আদিতে মানবের দেবত্বে রূপান্তরণের মধ্য দিয়ে।

'দুর' অর্থে প্রাণ-তা-ই দুর্গা প্রাণের দেবতা। আবার দুঃখে যার প্রাপ্তি, তিনিও দুর্গা। দেবীসূক্তে দেবী বলেছেন,"ব্রহ্ম-বিদ্বেষী অসুরবধের জন্য আমি ধনুকে জ্যা সংযোগ করি; সজ্জনকে রক্ষা করবার জন্য সংগ্রাম করি।"

সত্যযুগে মহিষাসুর নিধনকালে, ত্রেতাযুগে রাম চন্দ্রের অকালবোধনে  আর কালিকাপুরাণে  পার্বতীরূপে  দশমহাবিদ্যারূপ  স্বয়ং শিবকে দর্শাতে এক দেবীই  আবির্ভূতা হন।

আধুনিক সমাজ বহুলাংশে নাস্তিক হলেও বিজ্ঞানমনস্কও বটে।তাছাড়া করোনা মহামারীর তারণায় মানবধর্ম ঘিরে ফেলেছে বাস্তব সমাজকে।যুগান্তরের সামাজিক কলঙ্ক আর গ্লানির নির্মোচনে  বারম্বার অনুভূত হয়েছে অসাধারণ শক্তিসম্পন্না মাতৃসুলভ সুরক্ষাতন্ত্রের। অথচ এরই মাঝারে অনাদি-অতীত-অনন্ত কালপ্রবাহে চক্রাকারে চলেছে ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মহেশ্বর অর্থাৎ ত্রিদেবকৃত সৃষ্টি-স্থিতি- প্রলয়ের খেলা।

শক্তিশালী তড়িৎক্ষেত্রের দ্বারা বাতাসের বৈদ্যুতিক ভাঙন এবং শক্তিপ্রবাহের  সবচাইতে নাটকীয় নজির 'বিদ্যুৎ চমক'- মায়ের শক্তির উদ্ভাসের সঙ্গে তুলনীয়! আবহমণ্ডলের তড়িৎ বিভব শক্তি সেক্ষেত্রে তাপশক্তি, আলোক শক্তি এবং শব্দশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনীতে শিল্প কলায় বন্দী সে সবই।

গীতার ছত্রে ছত্রে বিশেষ জ্ঞানেরই আবহ।আজও আমরা রাজ্য, দেশ, মহাদেশ, বিশ্ব এমনকি মহাজাগতিক সৃষ্টির শক্তিরক্ষার্থে অবিচল প্রতি মুহূর্তে।

বস্তুতঃ হিন্দুশাস্ত্রে কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলারূপীনি যে 'দশমহাবিদ্যা'র 'কথা বলা হয়েছে তার সমন্বিত রূপটিই 'দুর্গা'। এই দশমহাবিদ্যার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের শক্তিস্বরূপা লোচনা, যামকী, পান্ডারা, আর্যতারা ও বজ্রধনত্বেশ্বরী আদি পাঁচদেবীর অস্তিত্বের সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। বৌদ্ধদেবী 'মারীচি ' আবার দুর্গার ন্যায় দশভূজাই। 'মহাবস্তু'তে  গৌতমবুদ্ধ যে অভয়াদেবীর পদবন্দনা করেছিলেন, অনেকের মতে তিনিই দুর্গা বা দেবী চণ্ডিকা। জাপানে 'সপ্তকোটি  বুদ্ধমাতৃকা চনষ্টি  দেবী' রূপে পূজিতা সংস্কৃত চণ্ডীরই সমার্থক। চীনের ক্যান্টন শহরে বৌদ্ধমন্দিরে  প্রাপ্ত শতভূজা দেবী মূর্তিরূপটি একই ইঙ্গিতবাহী। জৈনধর্মে  দেবী সরস্বতীকে কেবলমাত্র কলাবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী রূপে চিন্তা না করে বিশ্বরূপিনী ও সর্বশক্তিময়ী হিসেবে শ্রদ্ধারোপের কালে অনুভূত হয় আমাদের 'মহামায়া'র অস্তিত্ব। মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী প্রণীত ' অভয়ামঙ্গল '-এর অভয়া আদতে বাংলাদেশের দেবী 'চণ্ডী' বা দুর্গাই।

আনুমানিক তৃতীয়-চতুর্থ শতকে রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণেই প্রথম দেবীর বিস্তারিত পরিচয়ের হদিশ মেলে। ৮১-৯৩ মোট ১৩ টি অধ্যায়ে চণ্ডীর বিশেষ পরিচয় উল্লিখিত। সাতশত শ্লোকের মধ্যে দেবীমাহাত্ম্যের বর্ণন এখানে। 'শ্রী শ্রী চন্ডী' অংশটিতে বিধৃত দেবী কর্তৃক মহিষাসুর, শুম্ভনিশুম্ভ, চন্ডমুন্ড, রক্তবীজ, মধুকৈটভ, দুর্গমাসুর  প্রভৃতি অসুরের বিনাশ কাহিনী, তৎসহ মহামায়ার মহাশক্তির মাহাত্ম্য। আধ্যাত্মিক এরূপ ধারাবিবরণী ধরা রয়েছে বারাহীতন্ত্র, স্কন্দপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবীভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, কালিকাপুরাণ, বামনপুরাণ,  বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, হরিবংশ পুরাণের ছত্রে ছত্রে।

বৃহদ্ধর্ম পুরাণ ও কালিকাপুরাণ অনুসারে, রাম-রাবণের যুদ্ধে রামকে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পুজো করবার পরামর্শ দেন স্বয়ং রামচন্দ্রকে। তখন শরৎ কাল; এসময়ে দেবতারা নিদ্রামগ্ন থাকেন; সেহেতু মূল বাল্মীকি রামায়ণে অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও অকালবোধন দ্বারা রামচন্দ্র দুর্গার পুজো করে ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, প্রাকচৈতন্য  যুগে পঞ্চদশ  শতকের বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর 'রামায়ণ পাঁচালী 'গ্রন্থে রামচন্দ্র কর্তৃক 'অকালবোধন '-এর উল্লেখ করেছেন। দোর্দণ্ড প্রতাপ রাবণের বিরুদ্ধে সমরাভিযানে সুনিশ্চিত বিজয় কামনায় শরৎকালেই  রামচন্দ্র কালিদহ  সাগর হতে সংগ্রহ করলেন ১০৮ টি নীল পদ্ম। অতঃপর দুর্গাপুজো সম্পন্ন করে কৃপালাভে হলেন ধন্য।

স্বামী বিবেকানন্দ 'দুর্গা'কে কন্যা বা কুমারী রূপেই দেখেছেন- নারীনিগ্রহের বিরুদ্ধে জাগ্রত ও সোচ্চার হবার প্রতীকী, অবশ্যই। আর আমাদের ঘরের পরম আত্মীয় শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব  মাকে দেখলেন মানবতার এক বিরাট মূর্তিরূপে। 'লোকসাহিত্য' গ্রন্থের 'ছেলে ভুলানো ছড়া' প্রবন্ধে কবিগুরুর আবেগময় বার্তা, 'বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো..... এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।' একাধারে রুদ্রানী মূর্তিতে সংকটমোচনা  এবং মমতাময়ী মায়ের দৃষ্টিতে কন্যার যন্ত্রণা অনুভূতির প্রকাশময়তায়  বাঁধা পড়ে  সমগ্র বিশ্বের বাঙালি সহ সকল মাতৃশক্তি।

২০০১ সাল থেকে এদেশের একাধিক রাজ্যের সংস্কৃতি ও উৎসব নিয়ে একটি সমীক্ষা শুরু করে UNESCO। ২০২১- এর হেরিটেজ তালিকায় স্থান-সংকুলানের আবেদন জানায় পশ্চিমবঙ্গ। ১৩-১৮- ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের প্যারিসে আয়োজিত Inter Government Committee র ১৬ তম অধিবেশনে কলকাতার দুর্গাপুজো UNESCO- র Intangible Cultural Heritage of Humanity র তালিকায় সংযুক্ত হল। ডিসেম্বরেই আসে স্বীকৃতি।তাই কলিযুগেও শীতকালীন অকালবোধন উৎসব শুরু হল উল্টোডাঙ্গা তেলেঙ্গা বাগানের কাছে কবিরাজ বাগানে। কুমোরটুলি থেকে মূর্তি এনে ঢাক ও আলোর রোশনাইসহ  আয়োজিত অনুষ্ঠানে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত জনারণ্য  নিয়ন্ত্রণে পথে নামেন স্বেচ্ছা-সেবকের  দল।

উৎসবটি ধর্ম,লিঙ্গ এবং সমস্ত অর্থনৈতিক স্তরের বাধাগুলি পেরিয়ে সবাইকে অন্তর্ভুক্তির পদ্ধতির জন্য সবিশেষ প্রশংসিত। UNESCO-র বার্তায় প্রাপ্ত,"দুর্গাপুজোকে ধর্ম ও শিল্পের সর্বজনীন মিলনক্ষেত্রের সর্বোত্তম উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।এই উৎসব শহুরে এলাকায় বড় আকারে পালিত হয় এবং মণ্ডপগুলির পাশাপাশি রয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢাক এবং দেবীর পূজা।" উৎসব চলাকালীন লিঙ্গ-বৈষম্যহীন দর্শক জনিত ভিড়ের কথাও উল্লিখিত ও প্রশংসিত হয় UNESCO র দরবারে।

বলাবাহুল্য হলেও বলি, একই স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে ধন্য ২০১০ সালে পুরুলিয়ার ছৌ লোকনৃত্য, কেরলের মুদিয়েত্তু লোকনৃত্যনাট্য, রাজস্থানের কালবেলিয়ে লোকগীতি, এছাড়া কুটিয়াত্তম সংস্কৃত থিয়েটার,রামলীলা, বৈদিক জপের ঐতিহ্য এবং লাদাখের বৌদ্ধ নাম-জপ। ২০১৩ সালে মণিপুরের সংকীর্তন অনুষ্ঠানের গান, ২০১৪ সালে পঞ্জাবের ঐতিহ্যবাহী পিতল এবং তামার কারুকাজ, ২০১৬ সালে যোগচর্চা এবং ২০১৭ সালে কুম্ভমেলাকে এই স্বীকৃতি দ্বারা ভারতীয় ঐতিহ্যের ন্যায্য মূল্যায়ন করে UNESCO। পাঠকবন্ধুরা, পূর্বে জ্ঞাত হওয়া সত্বেও পুনরায় অনুমান করতে পারছেন বাংলা তথা কলকাতার দুর্গাপুজো সংক্রান্ত হট্টমেলার অনুরূপ কিম্বা কম বেশি উল্লাসের পসরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গোটা ভারত জুড়ে!

একটি ছোট্ট  সংসারকে গড়ে ও গড়িয়ে নিয়ে চলেন পরিবারের কর্ত্রীই।রাজ্য, দেশ ও সমাজের বিস্তৃত ক্ষেত্রেও নারীর সংযোজন, অংশগ্রহণ ও প্রাধান্য আজ কাম্য।তবু নারীশক্তির লাঞ্ছনা নজরে পড়ে সমাজের কোণায় কোণায়! এতদসত্বেও শক্তির বন্দনায় বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিনতে পেরেছেন UNESCO; ষোলকলার পূর্ণতায় শাসন বিভাগ পূর্ণ সম্মান প্রাপ্তির অধিকারী, অস্বীকারের নয়।কিন্তু ভগীরথসম  আনন্দ-সম্মানের ধারাটির আগল উন্মোচিতা শ্রীমতি তপতী গুহঠাকুরতা (ভূতপূর্ব অধ্যাপিকা, প্রেসিডেন্সি কলেজ) সহ আপামর বাঙালির আবেগ ধন্যবাদ রহিত  না হয়! 

শক্তি আরাধনায় ২০২২- এর আবেগ ও আনন্দ উদযাপনকে সাথী করে নতুন বছরে পুনরায় ধ্যান-মগ্ন বিশ্ববঙ্গ দুর্গা অনুরাগীদের ভক্তিপূর্ণ আবেদনটি বাংলা তর্জমায়,
'যে চণ্ডীকা মধুকৈটভাদি দৈত্যনাশিনী, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী,
যিনি ধূম্রলোচন- চন্ডমুন্ডাসুর-সংহারিণী, যিনি রক্তবীজ- ভক্ষয়িত্রী,
যে মহাশক্তি শুম্ভ-নিশুম্ভাসুর-বিনাশিনী ও শ্রেষ্ঠ সিদ্ধিদাত্রী
এবং নবকোটি-সহচরী-পরিবৃতা, সেই জগদীশ্বরী দেবী আমাকে পালন করুন।

কিন্তু আজকের সমাজে চলে নির্লজ্জ লাঞ্ছনা উমার প্রতীকীর উপরে!- মাতৃগর্ভে জন্মলাভ করবার পর পৃথিবীর আলোকপ্রাপ্তি সত্ত্বেও পাশবিক প্রবৃত্তি বস্তুতঃ সামাজিক রোগ হিসেবেই মান্য। কোনও মহাযজ্ঞেই নিধন হবে ঐ বর্বরতার! তবু  'বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।' তাই জননীর স্নেহাশীষ প্রাপ্তির অধিকারী হবেন অবশ্যই প্রকৃত মনুষ্যকুল! কালের রথ বয়ে চলবে যুগান্তরের পথে। আর সেই পথযাত্রীদের বিস্মৃত হলে চলবে না রবিঠাকুরের নির্দেশনাটি-

"..        ...           ...
যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত,
ঢেউ ওঠে উত্তাল,
হয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিয়ো তাল _ জয় জয় জয় গান গাইয়ো।
....          ...            ...."

পরিশেষে, সমবেত কণ্ঠে মাতা চণ্ডীর উদ্দেশ্যে জানাই,

"অসতো মা সদগময়
তমসো  মা জ্যোতির্গময় 
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়
ওম শান্তি; শান্তি ; শান্তি;..."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ