কখন যে সন্ধ্যে হয়ে এল, বোঝা গেল না। একে একে যেন সবকিছু দূরের—বহুদূরের কোন মনুষ্যস্পর্শহীন সরোবরের বক্ষে মিলিয়ে গেল। আমাকে বলা হয়েছিল এই যাত্রায় কোথাও বেশি দিন থেকে গেলে সেই স্থানের মাটিতে নিজের শিকড় প্রোথিত হয়ে যায়। তারপর একটা স্থায়ী দৃশ্য, অবচেতন মন আঁকড়ে পড়ে থাকে। আর আমরাও বাস্তবের অভিনেতারা আগামী দিনের প্রত্যেক নতুন দৃশ্যে পুরোনো দৃশ্যের খোঁজ করতে থাকি। এ তো গেল দৃশ্যের কথা—মানুষের ক্ষেত্রেও কি তাই নয় ?
সেই জন্যই একটা সময়ের পর রঙ্গমঞ্চ ফিকে হয়ে যেতে থাকে। অথচ সাঁতরে ফেলে আসা যাবতীয় স্মৃতির ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। অসম্ভব! সেখানে কর্তৃত্ব খাটেই না।
আধুনিক সভ্যতার দোহাই দিয়ে বেড়ে ওঠা নগর-মহানগরের পিচের ধোঁয়ায় আবৃত চায়ের ঠেকে ফুটন্ত রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির মাঝে কালক্রমে হারিয়ে গেছে এই পুরোনো দৃশ্য, পুরোনো মানুষ, পুরোনো প্রত্যয়; হয়তো এরা চেয়েছিল বলেই হারিয়েছে। আর হারিয়েছে আমার গ্রামের সেই বর্ষামুখর উদাসীনতা।
এই জনবহুল মহানগরে দাঁড়িয়েও, মাঝে মাঝে সেই নদীপাড়ে অযত্নে পড়ে থাকা শ্যাওলা আবৃত নৌকোটির কথা খুব মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি যখন যেতাম আষাঢ়-শ্রাবণে; উপচে পড়া ঘোলাটে জলের পাশে আমি বসতাম। বসে থাকতাম সেই পরিত্যক্ত, উল্টানো নৌকোর পাশে। আচ্ছন্ন করে দেওয়া অন্ধকারের মধ্যে দূরের মৃদু আলোর উঁকিঝুঁকি আমার কাছে নতুন ভৌগোলিক আবিষ্কার বʼলে মনে হতো। সেই স্যাঁতসেঁতে পরিসরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গেছে আমার অবচেতন মনের ভবিষ্যৎ রসদ। তখনও এভাবেই সন্ধ্যে হয়ে যেত—বাড়ির সবাই হাক দিত দূর থেকে। শুনতাম, কিন্তু সাড়া দিতাম না। সব শব্দ জমিয়ে রেখেছিলাম আজকের জন্য। ঢেকে রেখে ছিলাম আমার অবাস্তবতার জমিন। জানতাম, এই আবরণ চিরদিন রাখা যায় না।
রাত হয়ে এল; আর কি থাকা যাবে এই শহরে? এখানে কেউ ডাকার থাকে না। এখানে শ্যাওলা নেই।
0 মন্তব্যসমূহ