শ্বিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর দিনকয়েকের মধ্যেই আরম্ভ হবে কার্তিক, আর
তারপরেই দুর্গাপুজো। পুজো তো এবার কার্তিকেই। এর মধ্যেই আজকাল রাতের দিকে একটু
ঠাণ্ডা পড়তে আরম্ভ করেছে জলপাইগুড়িতে। সন্ধ্যে হলেই কেমন একটা শীত-শীত ভাব।
দু-একটা জায়গায় ঘন ধোঁয়াটে কুয়াশাও দেখতে পাওয়া যায়। উত্তুরে হাওয়ার আনাগোনা
দেখে মনে হয় শীত বোধহয় এবার তাড়াতাড়িই এসে যাবে।
বাইকের স্পীডটা বাড়ায় অমিতা। জঙ্গলের পথটা তাকে
দ্রুত পার হয়ে যেতে হবে। রাতের বেলায় রাস্তার দুধারের বড় বড় গাছগুলোর দিকে আলো
পড়লে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। ভূতের ভয় অবশ্য অমিতার নেই, ভয় কেবল বন্য
জন্তুর। তার থেকেও বেশি ভয় মানুষকে। অমিতা ফিরছিল লাটাগুড়ির এক রিসোর্ট থেকে,
সেখানকার এক কর্মচারীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে। তাকে এরকম অনেক জায়গায় প্রায়ই
যেতে হয়। লাটাগুড়ি, ময়নাগুড়ি, জল্পেশ, বোদাগঞ্জ এইসব জায়গায় সে প্রায়ই
প্যাসেঞ্জার নিয়ে যায়। বাইক ভাড়া দেওয়ার এই কাজটা জলপাইগুড়িতে অমিতাই প্রথম
আরম্ভ করেছিল। বড় বড় শহরের মতো এখানে এখনও অ্যাপ ক্যাবের তেমন প্রচলন নেই। দূরে
কোথাও যেতে হলে একমাত্র ভরসা ট্যাক্সি। এখন অবশ্য অনেকেই অ্যাপ বাইক চালানোর
কাজ করে থাকে, তবে অমিতা কোনও অ্যাপ বাইক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত নয়। সে নিজের
কাজটা করে নিজের মতো করে। কিন্তু, এই কাজটা করতে গিয়েও কম অশান্তি পোহাতে হয়নি
অমিতাকে। একে তো সে মহিলা, তারপর আবার কম খরচে, অনেক দূরের যাত্রীকেও পৌঁছে
দিয়ে আসে অনেক রাতের বেলাতেও। সেইকারণেই প্রথম প্রথম চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল শহরের
অন্যান্য ট্যাক্সি চালকদের। ভয় দেখানো, হুমকি সবরকম অত্যাচারই চলেছে তার ওপর,
কিন্তু কোনও পরিস্থিতিই থামিয়ে রাখতে পারেনি অমিতাকে।
জিন্সের পকেটে মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে। দেরি দেখে
বোধহয় ফোন করছেন মা। রাত এখন তা-ও এগারোটা হবে। ছেলেমেয়ে দুটো খেল কিনা কে
জানে! কী যে করবে অমিতা? রোজগারের জন্য তাকে পথে বেরোতেই হয়। তাও ভাল যে সে
ছোটবেলা থেকে বাইক চালানো শিখেছিল, তাই না রোজগারের একটা রাস্তা খুলে গেল।
হ্যাঁ বাইকই চালায় অমিতা, স্কুটি নয়। আরও একটা বিষয়েও ছোটবেলা থেকে তালিম
নিয়েছে সে, মার্শাল আর্ট। তাই তো এত সাহসের সঙ্গে রাতবিরেতেও সে একা চলতে পারে।
আসলে ছোটবেলায় তার ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে পুলিশে চাকরি করবে। তার শরীর খুব মজবুত,
মনেও সাহস খুব। কিন্তু, পরিস্থিতি তাকে পুলিশ কেন তেমন কিছুই হয়ে উঠবার সুযোগ
দেয়নি কোন দিন। বাবার অসুস্থতার কারণে খুব অল্প বয়েসেই বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী
ছিলেন শিক্ষক, দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামুটি সুখেই দিন কেটে যাচ্ছিল। বছরখানেক
হল হার্টের অসুখে ভুগে অমিতার স্বামী মারা যান। তারপর থেকেই অমিতা তার বিধবা মা
ও সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই থেকে যায়। সেইসময় অর্থাভাবের কারণে হন্যে হয়ে
ছুটতে হয়েছে অমিতাকে চাকরির জন্য। কিন্তু কেউ চাকরি দিতে রাজি হয়নি চল্লিশ
পেরিয়ে যাওয়া এই মহিলাকে। অগত্যা তাকে বেছে নিতে হয়েছে এই ভিন্ন উপায়। তবে
অমিতা তার বাইক নিয়ে বের হয় সন্ধ্যের পর। সকাল থেকে তার সময় কোথায়? বাজার করা,
রান্না করা, ছেলেমেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, ঘরের কাজ, এতকিছু করে সে আর পেরে
ওঠে না। নিরাপদ জীবনের আশ্রয় ছেড়ে তাই তাকে বেরোতেই হয় রাতের দিকে।
শহরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে অমিতা অনেকক্ষণ। করলা নদীটাকে
দ্রুত পাশ কাটিয়ে সে এগিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। নদীর ওপরে একটু কুয়াশা জমে আছে
বলে মনে হল। রাস্তার ওপরেও কেমন যেন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে। কুয়াশা নাকি ধোঁয়াশা?
ধোঁয়াশাই হবে। জলপাইগুড়ি শহরেও আজকাল দূষণ বড় কম নয়। যত এগোনো যায় ততই স্পষ্ট
হয়ে ওঠে ধোঁয়াশার চাদরটা, সাদা জমাট বাঁধা ধোঁয়াশা। কিংবা ঠিক সাদাও নয়, একটু
নীলচে-নীলচে যেন। শহরটাকে আজ অস্বাভাবিক রকমের শুনশান মনে হয় অমিতার। পথে-ঘাটে
একটাও লোক নেই, গাড়ি চলছে না, কেমন যেন থমথমে পরিস্থিতি। অথচ পুজোর আগে এরকমটা
একেবারেই হওয়ার কথা নয়। হঠাৎই গা শিরশির করে ওঠে অমিতার। বেশ জোরে কয়েকবার হর্ন
বাজালো সে, ধোঁয়াশার কারণে সামনে মানুষ বা কুকুর থাকলেও ঠাহর হওয়ার জো নেই।
গাড়ির গতি বাড়িয়ে কোন রকমে পৌঁছে গেল নিজের কলোনিতে। যাক, এবার খানিকটা
নিশ্চিন্ত। বাড়ি পৌঁছতেই মা ও ছেলেমেয়েদের থমথমে মুখটা চোখে পড়ল প্রথমেই।
এতক্ষণ তারা চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাদের কাছ থেকেই অমিতা জানতে পারল যে
আজ জলপাইগুড়িতে তিন-তিনটে খুন হয়েছে, তিনজনই প্রাইভেট গাড়ির চালক। ঠিক শহরের
মধ্যে নয়, খানিক বাইরে, বোদাগঞ্জের রাস্তায়। কে বা কারা খুন করল এখনও ধরতে
পারেনি পুলিশ, উত্তেজিত জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে থানা ঘেরাও করে রাখে দীর্ঘক্ষণ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটিয়েছে। আর তারপর থেকেই শহর
জুড়ে এরকম নিঃস্তব্ধতা।
পরদিন সকালে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে অমিতার
মোবাইলে। রিসিভ করতেই অপরদিক থেকে একটি ভারী পুরুষ কণ্ঠ উপদেশের সুরে ঝড়ের বেগে
কিছু কথা বলে যায়, তারপর ফোন কেটে দেয়। ফোন বাজার শব্দে পাশের ঘর থেকে ছুটে
এসেছেন অমিতার মা-ও। ফোনের বিষয়ে জানতে চাইলে অমিতা জানায়, জলপাইগুড়ির
ট্যাক্সিচালকদের যে কমিটি আছে তারই সেক্রেটারির ফোন, দুপুর বারোটায় তারা একটা
মিটিং করবে, অ্যাপ বাইক চালকদেরও ডাকা হয়েছে, অমিতাকেও সেখানে উপস্থিত থাকতে
বলা হয়েছে। কিন্তু অমিতা যেতে রাজি নয়, তার এসব মোটেও ভাল লাগেনা। অমিতার মা
কিন্তু যাওয়ার জন্য তাকে জোরাজুরি করতে থাকে, কেনই বা এই মিটিং ডাকা হল সেটাও
তো জানা দরকার। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই অমিতা গিয়ে উপস্থিত হয় কমিটির মিটিংএ।
সেখানকার আলোচনার মূল বিষয় হল, গতকালের তিনটি খুন। আলোচনার শেষে সিদ্ধান্ত হয়
জলপাইগুড়ির সব চালক আপাতত কয়েকদিন গাড়ি চালানো বন্ধ রাখবে, প্রয়োজনে গাড়ি
চালালেও এখন শহরের বাইরে যাওয়া চলবে না, অন্তত সপ্তাহখানেক। দুপুর একটা নাগাদ
বাড়ি ফিরে আসে অমিতা। কমিটির সিদ্ধান্ত সে চুপচাপ বসে বসে শুনেছে, হ্যাঁ না
কিছুই বলেনি। তাদের সিদ্ধান্ত যাই হোক, তা শুনলে অমিতার চলবে কেন? তার দৈনিক
রোজগারের ওপরেই তো টিঁকে আছে সংসারটা। সামনেই পুজো, তখন তো কয়েকদিন কাজ বন্ধ
রাখতেই হবে, সুতরাং এখন এদের কথার আমল দিলে তার মোটেই চলবে না। কিন্তু, আরও
একটি বিষয় ভাবিয়ে তুলছে অমিতাকে। কমিটির মেম্বাররা তার নাম্বার পেল কোথায়?
প্রশ্নটা তো আগে মাথায়ই আসেনি। মিটিঙের আলোচনার ফাঁকে তার দিকে অনেক তির্যক
মন্তব্য ছুটে এসেছে যেগুলো এতক্ষণ গায়েই মাখেনি অমিতা। আচ্ছা, তাকে কোণঠাসা
করার জন্য বা ভয় দেখানোর জন্য এ আবার নতুন কোনও চক্রান্ত নয়তো? ঠিকমতো কিছুই
বুঝে উঠতে পারে না অমিতা, সবকিছু কেমন এলোমেলো ধোঁয়াশার মতো লাগে। গত রাতের সেই
নীল নীল ধোঁয়াশাটার মতো।
আজ আর শহরের বাইরে যেতে হয়নি অমিতাকে।
রাস্তাঘাটে লোকজনও কম, তাই একটু আগে-আগেই বাড়ি ফিরছিল সে। রাত তখন সাড়ে নটা কি
পৌনে দশটা মতো হবে। বাড়ির কাছাকাছিই চলে এসেছিল, এমন সময় খুব কাছ থেকেই এক
মহিলা কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল- ‘হেল্পপপপ! হেল্পপপপ! প্লিজ! হেল্প মি!’ গাড়ির গতি
কিছুটা শ্লথ করল অমিতা। আর মুহূর্তের মধ্যেই এক মাঝবয়সী মহিলা প্রায় হুড়মুড় করে
এসে পড়লেন তার বাইকের ওপর, আর একটু হলেই তিনি পায়ে শাড়ি জড়িয়ে পড়েই যেতেন।
কোনওরকমে সামলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন- ‘আমাকে আশ্রমপাড়ার ভেতরটায় নিয়ে
চলুন প্লিজ!’ মহিলার বিপদ আন্দাজ করতে পেরেই অমিতা আর কথা না বাড়িয়ে তাঁকে নিয়ে
রওনা হল সেইদিকে, বাড়ির কাছে পৌঁছেই মহিলা বাইক থেকে নেমে দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে
দিলেন অমিতার। কী হয়েছিল, জিজ্ঞেস করায় তিনি কেবল এইটুকু বললেন যে তাঁকে কতগুলো
লোক তাড়া করেছিল। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘অত কথা এখন বলতে পারব না। আপনি
এক্ষুনি ফিরে যান। নইলেই বিপদ!’ বলেই ভদ্রমহিলা একটি বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকে
যান, তারপর সদর দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকে সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দেন। ঘটনার
আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে যায় অমিতা। তারপর ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরে।
কিন্তু, বেশিদূর সে যেতে পারে না, রাস্তার ওপর কারা যেন কাঁচের গুঁড়ো ছড়িয়ে
রেখে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখের সামনে আবার সেই নীল ধোঁয়াশার আচ্ছাদন,
সামনের ল্যাম্পপোস্টটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ভাল করে। গাড়ি ঘুরিয়ে বিকল্প
রাস্তা ধরতে যাবে অমিতা, এমন সময় ধোঁয়াশার নীল পর্দাটা ফরফর করে কারা যেন ছিঁড়ে
দেয়। আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে তিনটি মুখোশধারী লোক, তাদের প্রত্যেকের হাতে
পিস্তল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় অমিতার, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের ওঠানামার
আওয়াজটাও যেন স্পষ্ট। ধোঁয়াশার দিকে তাকালে এক পলকের জন্য ভেসে ওঠে মা ও
সন্তানদের মুখ। হঠাৎ একটি মুখোশধারী হুংকার দিয়ে ওঠে- ‘মেয়েটাকে কোথায় রেখে
এলি? শিগগিরি বল। নইলে তোকেই শেষ করে দেব’। অমিতা দেখে তিনটি বন্দুক তার দিকেই
তাক করে আছে। ভয়ে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না, তাছাড়া ঐ ভদ্রমহিলাকে বিপদে ফেলতেও
সায় দেয় না অমিতার মন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে একটি লোক আচমকাই তার ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বাইকের সিট থেকে টেনে তুলে আনে, হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে
হেলমেটের বেল্টটা, মাথা থেকে খুলে পড়ে হেলমেটটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। বাইকটাও কাৎ
হয়ে পড়ে যায় রাস্তার ওপরে। এইবার সম্বিৎ ফিরে আসে অমিতার। বহুদিন আগে শেখা
বিদ্যেটার প্রয়োগের একটা সুযোগ পেয়ে যায় সে। তার গলার কাছে পিস্তলটা চেপে
ধরতেই, সে লোকটির হাত ধরে একটা জোরে ঝাঁকুনি দেয়, পিস্তলটা হাত থেকে ছিটকে
সামনের ল্যাম্পপোস্টটায় গিয়ে লাগে, একটা ঠং করে শব্দ হয়। ততক্ষণে আরও একটি লোক
তাকে পেছন থেকে চেপে ধরেছে, অমিতা তারও সঙ্গে লড়ছে, তারও হাতের পিস্তল ছিটকে
পড়ে ধোঁয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যায়। দুটোকেই যখন প্রায় কাবু করে এনেছে অমিতা ঠিক
তখনই গর্জে ওঠে তৃতীয় মুখোশধারীর পিস্তল। গুলি এসে লাগে অমিতার বাম হাতের
কনুইয়ের ওপর। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে অমিতা, তবু সে লড়বে বলেই আবার উঠে দাঁড়ায়।
এবার পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ, আর বেশি কিছু করার অবকাশ পায় না অমিতা, একবার
শুধু তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করে, নীল ধোঁয়াশাটাকে কেমন বজ্রগর্ভ কালো মেঘের মতো
মনে হয়, আর তারপরেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে অমিতা দেখে সে হসপিটালের
বিছানায় শুয়ে। তার সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা, কোথাও কোথাও বোধহয় ব্যান্ডেজও
বাঁধা রয়েছে, স্যালাইন চলছে, বোধহয় ব্লাডও দিতে হচ্ছে তাকে। বেশ কিছুক্ষণ সে
একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। কখন যেন চোখটা আবার বন্ধ হয়ে এসেছিল- ‘কী রে, কোনও কষ্ট
হচ্ছে?’ কানের কাছে খুব পরিচিত একটা গলার আওয়াজ। তাকিয়ে দেখে, বিপ্লবদা- অমিতার
জ্যাঠতুতো দাদা, মালবাজারে থাকে। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে এক অপরিচিত ভদ্রলোক।
অমিতার বিপদ শুনে গতকাল রাতেই তড়িঘড়ি ছুটে এসেছে বিপ্লবদা, সঙ্গে বউদিও। দাদার
কাছ থেকেই অমিতা জানতে পারে কাল রাতেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেছে দুষ্কৃতীদের
দলটা। রাতে পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছিল শহরজুড়ে। অমিতার ওপর যখন দুষ্কৃতীরা চড়াও
হয় তখন তারা কাছাকাছিই ছিল, গুলি চালানোর আওয়াজ পেয়েই গাড়ি নিয়ে সেইদিকে ছুটে
আসে। কেউ পালানোর অবকাশ পায়নি। বিপ্লবদার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকটি পুলিশেরই একজন
বড়মাপের কর্তা। আহত অমিতাকে তিনিই হসপিটালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন, তার
মানিব্যাগ, লাইসেন্স ইত্যাদি ঘেঁটে বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে বাড়ির লোককে খবর
দেন, এমনকি অমিতার বাইকটা উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও ইনিই করেন।
পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে অনেক তথ্য। যে ভদ্রমহিলাকে রাত্রিবেলায় অমিতা তার
বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক, তাঁর স্বামীও একই
সংবাদপত্রের অফিসে কাজ করেন। কয়েকদিন আগে গোপন সূত্রে তাঁরা খবর পান যে,
জলপাইগুড়ির সন্নিকটে বোদাগঞ্জের জঙ্গলের ভেতর আস্তানা গাড়ছে একদল দুষ্কৃতী, এরা
পুজোর সময় শহরের অভ্যন্তরে কোনও নাশকতার ছক কষতে পারে এমনটা আশঙ্কা করেই,
সংবাদপত্রের তরফ থেকে তাঁদের পাঠানো হয় অনুসন্ধানে। হাতে কোনও সঠিক প্রমাণ না
থাকায় আগে থেকেই পুলিশকে কিছু জানানো সম্ভব হয়নি। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা
গাফিলতিও ছিল সাংবাদিক দম্পতির। এই দুষ্কৃতীদের দলটিও ছিল যথেষ্ট তৎপর। কয়েকদিন
ধরেই হুমকি আসছিল দম্পতির ফোনকল এবং হোয়্যাটসঅ্যাপে। এমনকি বাড়িতে হুমকি চিঠিও
এসেছে দুবার। এই পেশায় এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়, তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি
তাঁরা। এর ফলেই ঘনিয়ে আসে বিপদের মেঘ। গত পরশু বিকেলের দিকে স্বামী-স্ত্রী
দুজনেই তাঁদের পার্সোনাল কারে গিয়েছিলেন বোদাগঞ্জের জঙ্গলের ভেতর যেখানে
দুষ্কৃতীদের আস্তানা আছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। পার্সোনাল কারে গিয়েছিলেন কারণ
প্রেসের গাড়ি দেখলে সবারই সন্দেহ হতে পারে, তাঁরা গিয়েও ছিলেন পর্যটকের মতো
করেই। সেখানে গিয়ে অনেক দূর থেকে ভাল ক্যামেরায় তাঁরা দুষ্কৃতীদের কার্যকলাপ
ক্যামেরাবন্দী করতে থাকেন, কাজ প্রায় হয়েই এসেছিল, এমন সময় কীভাবে যেন
দুষ্কৃতীরা তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়, মুহূর্তের মধ্যে তারা বনজঙ্গল ভেদ
করে ছুটে আসতে থাকে দম্পতির দিকে। দুবার গুলিও চালায়, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
এঁরা দুজন গাড়ির কাছেই থাকায় দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়ে পালাতে সক্ষম হন। গাড়িটা
নিমেষের মধ্যে অনেক দূরে চলে যাওয়ায় দুষ্কৃতীরা গাড়ির নম্বর পড়তে পারে না, শুধু
মডেলের ওপর লক্ষ্য রেখে তারাও গাড়ি নিয়ে পেছন-পেছন ধাওয়া করে। এই সাংবাদিকদের
নিবাস যে জলপাইগুড়িতে সেটা দুষ্কৃতীদের অজানা নয়, তাই তারা গাড়ি ছোটায়
সেইদিকেই, কিন্তু এঁদের ধরা সম্ভব হয় না। পথে যেকয়টি একই মডেলের গাড়ি দেখতে পায়
দুষ্কৃতীরা সেকটির ওপরেই হামলা চালিয়ে গাড়ির চালককে খুন করে। প্রত্যেকটা খুনের
পরেই তারা বুঝতে পারে মারাত্মক বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, তখন তাদের মধ্যে
জেগে উঠেছে প্রবল প্রতিশোধস্পৃহা। জলপাইগুড়িতে পৌঁছেই তারা সেই দম্পতির বাড়িতে
যায় কিন্তু গিয়ে দেখে বাড়ির বাইরে থেকে তালা বন্ধ, সেখানে কেউ নেই। আসলে এমন
কিছুই হবে, সেটা আঁচ করতে পেরেই সেই দম্পতি আর বাড়িতে না ফিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন
এক আত্মীয়ের বাড়িতে। কিন্তু, তিনটে খুনের ঘটনা শোনার পর থেকেই ভদ্রমহিলার
স্বামী ট্রমার মধ্যে চলে যান, বাড়ি থেকে বেরোনো বা গাড়ি চালানোর মতো অবস্থায়
তিনি আর নেই। তাঁরা আরও কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে পারতেন কিন্তু অফিসে
রিপোর্ট জানানোর জন্য ভদ্রমহিলার দরকার হয়ে পড়ে ল্যাপটপের, যেটা তাঁর বাড়িতেই
পড়ে রয়েছে। সেইকারণেই গতরাতে তিনি ভাইকে সঙ্গে করে বাড়ির দিকে আসছিলেন।
কাছাকাছি পৌঁছনোর পর তাঁর মনে হয় বিপদের আর আশঙ্কা নেই, তাই একরকম জোর করেই
তিনি ভাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন, যদিও ভাই সঙ্গে থাকলেও তাঁর কতটা কী উপকার হত
সেকথা বলা যায় না, তবু সঙ্গে এনেছিলেন ভাইকে, আবার নিজেই ফিরিয়েও দিলেন বিপদের
আশঙ্কা নেই ভেবে। কিন্তু বিপদ ওঁত পেতেছিল সেখানেই। তাঁকে একা পেয়েই তাড়া করে
লোকগুলি। মহিলার পরনে আগের দিনের শাড়িটা থাকার কারণেই হয়তো তাদের চিনে ফেলতে
অসুবিধে হয় না। তারপর? তারপরের ঘটনা অমিতার সবটাই জানা। তবে, তদন্তে আরও একটা
বিষয়ও উঠে এসেছে। যেহেতু, অমিতা অনিচ্ছাকৃতভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে এই ঘটনাটির
সঙ্গে, সেহেতু তদন্তে নেমে পুলিশ তার দিকগুলোও খতিয়ে দেখতে ছাড়েনি। সেই সূত্রেই
জানা গিয়েছে যে, ট্যাক্সিচালকদের কমিটির সেক্রেটারি অমিতার পার্সোনাল নাম্বার
পেয়েছিল তারই এক প্রতিবেশির কাছ থেকে। অবশ্য পেয়েছিল বললে ভুল হবে, কিছুটা চাপ
সৃষ্টি করেই আদায় করে নিয়েছিল। সেকথা অবশ্য সেক্রেটারি স্বীকার করেছে পুলিশের
কাছে। তবে, এই ঘটনার সঙ্গে দুষ্কৃতীদের আক্রমণের কোনও যোগ নেই বলেই আপাতত মনে
করছে পুলিশ। যাক, তবু কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
কিছুক্ষণ পর, কেবিনের দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন অমিতার মা।
তাঁর দিকে তাকালে মনে হয় একরাতেই তাঁর বয়সটা যেন আরও দশ বছর বেড়ে গিয়েছে। ধীরে
ধীরে খুব শান্তভাবে এগিয়ে এলেন অমিতার দিকে, কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলেন অমিতার
কপালের ওপর। কী নরম ঠাণ্ডা হাত! আরামে আবারও চোখ বুজে এল অমিতার।
এরপর কেটে গিয়েছে গোটা একটা মাস। অমিতা এখন অনেকটাই সুস্থ।
ডাক্তার তাকে বাইক নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর অনুমতি দিয়েছেন, তবে এক-দেড় ঘণ্টার
বেশি বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি নেই। প্যাসেঞ্জার নিয়ে শহরের বাইরে যাওয়ার
অনুমতিও মেলেনি এখনও।
ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যে সাতটা। খুব সাবধানে সাবধানে অমিতা
বাইকটা বের করে আনল গ্যারেজঘর থেকে, আস্তে আস্তে নিয়ে এসে দাঁড় করালো বাড়ির
গেটের সামনে, গাড়ির সিটের ওপর বসে হেলমেটটা পরে নিল মাথায়, তারপর চাবি ঘুড়িয়ে
স্টার্ট করল গাড়িটা। পুরনো অভ্যাসমতোই একবার পেছন ফিরে দেখে নিল মা ও
ছেলেমেয়েদের। তারপর টাটা দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে পক্ষীরাজ ছুটিয়ে রওনা হয়ে গেল
অমিতা।
রাত তখন সাড়ে-আটটা হবে, অমিতা ফিরে চলেছে বাড়ির পথে।
জলপাইগুড়িতে ইতিমধ্যেই বেশ শীত পড়ে গেছে। সিল্কের কুর্তির ওপর স্টোলটা ভাল করে
জড়িয়ে নিয়েছে অমিতা। বাইক চালানোর সময় ঠাণ্ডাটা এমনিতেই একটু বেশি করে বোধ হয়।
শহর এখন খুব জমজমাট, সামনেই জগদ্ধাত্রী পুজো, আবারও শক্তির আরাধনা। শহরজুড়ে
চলছে তারই প্রস্তুতি। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই রাস্তাটা আবার একটু নির্জন হয়ে যায়।
আসলে এই এলাকায় তেমন কোনও পুজোই হয় না এক সরস্বতী পুজো ছাড়া। তাই সারাবছরই
অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে এলাকা, তার ওপর বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায়
ঠাণ্ডাটাও এখন বেশি অনুভূত হচ্ছে, রাস্তায় বেশি লোক না থাকার সেটাও একটা কারণ
হতে পারে।
অমিতা বাইক চালাচ্ছিল কিছুটা শ্লথ গতিতেই।
কিন্তু, নির্জন রাস্তাটায় আসা মাত্রই কেন জানি মনে হল কিছুটা দূরে আবার সেই নীল
ধোঁয়াশাটা জমাট বেঁধে তারই পথ রোধ করার পরিকল্পনা করছে। সেই রাতের ভয়াবহ
অভিজ্ঞতার পর থেকে অমিতার এমনটাই মনে হয়। ধোঁয়াশা সম্পর্কে একরকম ভীতি জন্মে
গেছে তার। পুরো শীতকালটা জুড়ে তাকে কুয়াশা-ধোঁয়াশার সঙ্গে অনেক লড়াই করতে হবে।
কিন্তু এই নীল ধোঁয়াশাটাকে দেখলেই তার কেমন বুক ঢিপ ঢিপ করে, মনে হয় বিপদ যেন
হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আরও কিছুটা এগোতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধোঁয়াশার চাদরটা। গাড়ির
স্পীড বাড়ায় অমিতা, ধোঁয়াশার চাদরটা ভেদ করে তাকে দ্রুত পেরিয়ে যেতেই হবে।
কিন্তু, নিজের অজান্তেই কখন যেন গতি কমিয়ে ফেলে সে, আর তখনই সামনের নীল পর্দাটা
আবার যেন কারা ফরফর করে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। খসে পড়তে থাকে একটার পর একটা আস্তরণ।
আস্তরণ? নাকি পাপড়ি? ফুলের পাপড়ি? পদ্মফুলের? নাহ্, ধোঁয়াশার আড়াল থেকে এবার আর
কোনও পিস্তলধারী মুখোশ বেরিয়ে আসে না। বেরিয়ে আসে নীল রঙের পদ্মফুল।
একটা-দুটো-তিনটে করে পুরো একশ আটটা। সেইসঙ্গে এক নীল জ্যোতির্ময়ী আলো বিচ্ছুরিত
হতে থাকে পদ্মের পাপড়ি থেকে, আশার আলো, বাঁচার আলো, এত আলো কখনও দেখেনি অমিতা,
তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অমিতার চোখে এখন কেবলই বিস্ময়। ঠিক তখনই তার কানের কাছে,
কানের খুব কাছে কারা যেন বলে ওঠে- ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ’।।
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো হয়েছে। তবে শেষ-টা আরো কিছু রোমাঞ্চ জন্য অপেখ্যা করছিলাম, কিন্তু শেষ হয়ে গেল। any way খুব ভালো হয়েছে, আরো নতুন লেখা পড়ার অপেখ্যায় রইলাম।
উত্তরমুছুন