য়মন্ড হারবার মস্ত শহর। কথিত আছে মোঘল বাদশাহ শাহজাহান একদা নদীপথে এই স্থান
অতিক্রম করার সময় ডুবন্ত সূর্যের আলোয় নদীপাড়ে জমে থাকা বিপুল বালিরাশির ওপর
সূর্যের আলোয় চকমক করতে থাকা দৃশ্য দেখে আপন মনে বলেছিলেন 'হীরা বান্দারগাহ'।
সেখান থেকেই নাকি ডায়মন্ড হারবার। ইতিহাস কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে নদীর পাশে
ভগ্নপ্রায়,পুরনো কেল্লাটার মতোই। আর যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাকে ভাগিরথীর ঘোলাজল
আর সভ্য-অসভ্য মানুষের দল কুরে কুরে খাচ্ছে।
পশ্চিমদিক থেকে গাদিয়াড়া পার করলেই এপারে যে অংশটুকু তা
নূরপুর,রায়চক,ডায়মন্ড হারবার,কুলপি হয়ে কাকদ্বীপ ছাড়িয়ে সাগরে মিশেছে। নূরপুর
থেকে ভাগিরথী নদীর পাড় ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে ডায়মন্ড হারবার। এখানে মানুষ আছে,জিনিস
আছে আর আছে শ্মশান।
এত কথা না বলে সোজাসাপটা লিখলেও হত যে আমি একটা শ্মশান ইত্যাদির গল্প
বলব।তাহলে বলতে হত, এখানে মানুষের তুলনায় শ্মশান বেশি। কিন্তু আমি ভাগিরথীর
গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষ,তাদের সংস্কৃতি, তাদের ব্যথা-বেদনামাখা ইতিহাসের কথা
বলতে এসেছি। তাই এত সহজেই বলা যায় না।
ডায়মন্ড হারবার -কুলপিগামী কালো পিচঢালা সড়ক থেকে নেমে এক-দুটো মিনিট মন দিয়ে
হাঁটলেই আড়া আড়ি বিস্তৃত খোলামাঠের ওপারেই সুবিশাল নদীটি তার ঘোলা বিপুল জলরাশি
নিয়ে পাড়ে মাথা কুটে মরছে দেখা যাবে। শোনা যাবে তার বুকফাটা আর্তনাদের
'ছলাৎ-ছলাৎ' শব্দ।
মাঠের ধার ঘেঁষে,নদীর কিনারে কিনারে শাল,পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি
হেলে-দুলে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকে ফাঁকে এক-দুটো বসবাস আসন।সেইসব আসনে
বসে পর্যটকরা নদীর বয়ে যাওয়া দেখে,নদীর মাথা কোটা দেখে বা 'ছলাৎ' শব্দ শোনে।
যুগলরাও বিকেল-সন্ধ্যায় এসে মনের কথাগুলো ভাগ করে নেয় নিজেদের মধ্যে।
নদী সংলগ্ন মাঠটি পার করে আরেকটু এগুলেই নদীগর্ভে বিলুপ্তপ্রায় পুরনো
কেল্লার ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে। তিনটি কেল্লার এই একটিরই কিছু অংশ
প্রেমিকজনের মনের খোরাক জোগাড় করার দায়িত্ব নিয়ে ভাগিরথীর ঘোলাজল খাচ্ছে আর
বাকি দুটি 'কেল্লাফতে'। অজস্র গাছগাছালি আর ঝোপঝাড় পেরিয়ে সেই কেল্লায় যাবার
পথ। আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে পোড়াকাঠ। আমার বন্ধুটি বলল,”এই কাঠে পা দেবে না
যেন। ওদিক দিয়ে ঘুরে এসো”।
কিছুটা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করাতে বন্ধুটি বলল, “আসলে এই নদীর দুপাশেই অসংখ্য
স্থানে মড়া পোড়ানো হয়।আধপোড়া কাঠগুলো নদীর জলেই ফেলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন রকম
মড়ার পোড়া এইসব কাঠ তো! তাই বললাম এই কাঠ মাড়াবে না।”
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম পুরনো সেই কেল্লার ভেঙে যাওয়া পাথরের ওপরে।
মেরুদণ্ড সোজা করে,দু-চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলাম নদীর জলের ফিসফিসানি,তার
হৃদয়ের শব্দ।বন্ধুটি অদূরে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিল। সে এসে বলল, “তুমি নদী
দেখো,আমি একটা কাজ মিটিয়ে আসছি।”
আমি নদীর দিকে তাকিয়েই মাথা হেলিয়ে তার কথায় সায় দিলাম।
ম্যাপে নদীটিকে দেখেছি।ওদিকে কুলপি,কাকদ্বীপ ছাড়িয়ে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
ঘোলাজল,নীলজল সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।কত নদী-নালার জল,অন্নপ্রাশনের
থালা,বিয়ের ফুল,চিতার কাঠ আর পোড়াদেহের ভষ্ম এসে মিশে গেছে এই সুবিশাল
জলরাশিতে।তবু সে অপবিত্র হয়নি।পবিত্রই রয়ে গেছে।
ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি আকর্ষন করল একটি সুবিশাল জলযান। থরে থরে সাজানো
লাগেজ।পবিত্র জলরাশীর ওপর নির্দিধায় খেলা করছে। মুখ ঘোরাচ্ছে,ভ্যাঁ শব্দে
গর্জাচ্ছে,লম্বা সাইরেন বাজিয়ে নদীকে বলতে চাইছে, সাবধান! আমি যাচ্ছি।বেয়াদবি
না হয়।
হঠাৎ চরের দিকে তাকিয়ে দেখি এক বুড়ি নদীর চর থেকে কি সব কুড়চ্ছে। তারপর আঁতকে
উঠলাম।চিৎকার করে ডাকলাম।বুড়ির কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।কুড়িয়েই চলেছে। আমি
ব্যাগ রেখেই খালিপায়ে তড়িঘড়ি করে ছুঁটে গেলাম বুড়ি কাছে।বললাম,” আই,
ফেলুন,ফেলুন বলছি। এটা মড়া পোড়ানো কাঠ।ফেলে দিন।”
বুড়ি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।মাথা থেকে পা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
দেখল।কাঠটি বগলে চেপে ধরে বলল, “আমিও মড়া।”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম বুড়ি ধীরপায়ে বগলদাবা করে সেই আধপোড়া চিতাকাঠটি নিয়ে
পবিত্র নদীটির ধার ধরে এগিয়ে চলেছে।নদীর ঘোলাজল আলতোভাবে বুড়ি পায়ের গোড়ালি
ধুয়ে ধুয়ে দিচ্ছে।
হলুদ সূর্য ডুবে গিয়েছে ভাগিরথীর ওপারে হলদিয়ায়।লালিমায় নদীর জল শান্ত অথচ
চকচক করছে।মনটা বিষাদে ভরে উঠেছে।বন্ধুটি হাসতে হাসতে এসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,
“ কি, নদী দেখা হল! এবার চল,সন্ধ্যা হয়ে এল।”
আমি “হ্যাঁ” বলে বইখাতা,কলম ব্যাগে ঢুকিয়ে আরেকটিবার দু-চোখ বুজে নদীর দিকে
চেয়ে নদীর কান্না অনুভব করার চেষ্টা করলাম। অত:পর ফিরে যেতে লাগলাম নদীর কিনারা
ধরে।
আমরা এসে পড়লাম সেই মাঠের কাছে।জঙ্গল পেরিয়ে মাঠে এসে দেখলাম কত আলো জ্বলে
উঠেছে।চারিদিকে ঠেলা দোকান।যেন মেলা বসেছে। জঙ্গলের এক কোনে বাঁশগাছের পাতাগুলো
যেখানে নুয়ে পড়েছে সেখানে দুটি ল্যাংটা ছেলে একজন বুড়ির পাশে বসে আছে অধীর
আগ্রহে। বুড়ি কাঠ জ্বালিয়ে ভাত রাঁধছে।সেই কাঠের ধোঁয়া আকাশে বাতাসে মিলে-মিশে
একাকার হয়ে যাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ