বি বলেছিলেন,"কেবলি আরেক পথ খোঁজো তুমি; আমি আজ খুঁজি নাকো আর;/ পেয়েছি অপার
শূন্যে ধরবার মতো কিছু শেষে/ আমারি হৃদয়ে মনে..."। বিবর্তন হয়েছে। উন্নত
হয়েছে জীবন। চলার পথে গতি বাড়াতে এসেছে বন্দে ভারত। রাতের শহরে নিয়ন আলোয়
যানের মিছিল। ভোটের প্রচারে ঘর ঘর বিজলি। সব আছে। তবু যারা তাদের শৈশব বা কৈশোর
কাটিয়েছে নব্বইয়ে দশকে তাদের কাছে হ্যারিকেন সুপরিচিত। বিদ্যুতের একমাত্র
বিকল্প। গ্রামের সন্ধ্যা প্রদীপের সঙ্গে পাল্লা দিত। বারিফেরত বড়বাবু যাতে
সাবধানে বাড়ি আসতে পারে তার জন্য চৌকাঠ থাকতো হ্যারিকেন। জুতো সেলাই থেকে
চণ্ডীপাঠ সব কাজে হ্যারিকেন। নতুন বউয়ের মুখ দেখতো হারিকেনের আলোতে। দিদিমা
আক্ষেপ করতো,"আলোটা বাড়া। চাঁদ পানা মুখ যে দেখা যাচ্ছে না।"নাতি নাতনী তখন
সলতে বাড়াতে ব্যস্ত। ভাড়ার ঘরে তেল দেওয়া হতো। কথা গল্প আড্ডা মজার ভেতর রাত
যখন ভোর হয়ে যেত তখন আলোর অভাবে হারিকেনের আলো দপদপ করতে করতে নিভে গেল।
কাঁচের গায়ে কালো কার্বন।সেদিন এখন অতীত। পৃথিবীর গভীর যে অসুখ সে তো এই দূষণ।
হ্যারিকেন তার প্রভাব ছিল কম।তবু সে হারিয়ে গেলো।
শোনা যায়, ১৫০০শতাব্দীর পারস্যে নাকি ব্যাপক হারে হারিকেনের ব্যবহার বাড়ে।
তারও আগে নবম শতকে পার্সিয়ান অ্যালকেমিস্ট আলরাজি তার আল-আসরার বইতে হারিকেনের
বিবরণ দেন। যার নাম নাফাতাহা।তবে বঙ্গে হারিকেনের প্রচলন কিন্তু শুরু হয় মুঘল
রাজাদের হাত ধরে। যার চরম ও শেষ সীমা হলো নব্বই দশক। হারিকেনের যুগে গ্রামীণ
জীবন দুই ভাগে বিভক্ত- হ্যারিকেন আর চিমনি। হ্যারিকেন বড়োলোকের প্রতীক। তখন
বিদ্যুৎ গেলে আসার বালাই ছিলো না।তাই কেরোসিন সংগ্রহতে চলতো গ্রামীণ কূটনীতি।
গরীবের কার্ডে তেল তুলতো ধনীরা। গরীবের বাড়ীতে জ্বলতো চিমনি।গ্রামীণ
অর্থীনীতিতে হারিকেনের অনেক অবদান। মুদির দোকানে খড় ঢেকে বিক্রি হতো কাঁচ আর
সলতে। সংসারের খরচ কমাতে মহিলারা বার করলেন ফন্দি। সলতের জায়গায় এলো কাপড়ের
সলতে আর ফাটা কাঁচে জড়ানো হতো শক্ত কাগজ। বালি দিয়ে যত্ন করে সে কাঁচ
পরিষ্কার করা হতো। কাঁচের ওপর জমা কার্বনে চলতো ভুত ভূত খেলা। হ্যারিকেন জ্বললে
বাড়ির মহিলারা ব্যবহার করবে না দেশলাই। কাগজ পাকিয়ে উনন জ্বলতো হারিকেনের
আলোতে। অনেক সময় হ্যারিকেন নিভে গেলে গোলযোগ বেঁধে যেতো।
তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের লেখায় হ্যারিকেন এসেছে বারবার। সন্ধ্যার পরে উন্নত
জীবন বলতে হ্যারিকেন। ভালবাসা বিরহ থেকে শুরু করে শৈশবের ফিস্টি। সন্ধ্যে হলেই
হ্যারিকেন নিয়ে ছাত্ররা চলতো মাস্টারের বাড়ি। মাস্টারমশাই আদেশ দিতেন,সবাই
নিজের নিজের হ্যারিকেন আনবে। মায়েরা বিকাল থেকে হ্যারিকেন মুছে রেখে দিত।
বিকাল শেষে বাচ্চারা হ্যারিকেন দোলাতে দোলাতে পড়তে যেত। ফলে অনেক সময়
দুলুনিতে তেল পড়ে যেতো। মাস্টারমশাই সমাধান করে দিতেন। একটা হারিকেনে দুজন
পড়বে। তাতেও মারামারি।যার হ্যারিকেন সে আলো দেবে না। শেষমেশ যার হ্যারিকেন নেই
সে অন্যর আলোর ছায়াতে পড়বে। অন্যদিকে দুষ্ট ছেলে হ্যারিকেনের কল নামিয়ে
ঘুমিয়ে পড়ল।আর মাস্টারমশাই দেখতেই পিঠে পড়লো লাঠি। পড়ার শেষে অভিভাবকরা
নিতে আসতো হ্যারিকেন নিয়ে। মাস্টার হুংকার দিত,"কে?" শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর
আসতো,"আমি মাস্টারমশাই। পিন্টুর বাবা"। হ্যারিকেনটা মুখের উপর তুলে ধরতে
পিন্টুর বাবা। চিনতে পেরে মাস্টারমশাই বলতেন,"বসুন"। হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে
পড়ত সবাই। রাতের আলো বলতে তখন চাঁদের জ্যোৎস্না আর অমাবস্যার রাতে জোনাকি।
ছেলেবেলায় সেগুলি কৌটোতে ভরে রাখা হতো। নাম দিতাম "টর্চ"।
চন্ডিতলার গল্প। চা মুড়ি তেলেভাজা। বুধবারের যাত্রাপালা। সবাই গোল হয়ে বসে
শুনত। মাঝখানে হ্যারিকেন।পাশে রেডিও। পোকা আসতো। কেউ বলতো,"আলো টা কমা"। কেউ
বলতো,"কমাতে হবে না"। ঝগড়া। যার হ্যারিকেন সে নিয়ে চলে গেলো। অন্ধকারে বসেই
সবাই যাত্রা শুনলো। দিদিমা ছেলের বাড়ি যাবে। রাতে ছাড়বে গরুর গাড়ি। গাড়ির
সামনে ঝুলানো হ্যারিকেন। নতুন বিয়ের পালকি বনের ভেতর দিয়ে যাবে। সঙ্গে সেই
হ্যারিকেন। বাংলার অঙ্গ ছিল হ্যারিকেন। হ্যারিকেনের তাপে সেরে যেত হাঁটুর বাত।
কাঁচের ওপর রাখা হতো কাপড়। কাপড় তেতে গেলে সেঁক দেওয়া হতো। ঠান্ডায় বুকের
মাঝে আগলে রাখার রোমান্স হ্যারিকেন। সদ্য যুবতী হারিকেনের আলোয় তার ভালবাসার
চিরকুট পড়তো গোপনে। হ্যারিকেন কমিয়ে কোলবালিশ চেপে ইচ্ছে করতো ঘনিষ্ঠ হবার
বাসনা। বাড়ীতে চোর এলে হ্যারিকেন নিয়ে পালাতো। বেচে বিড়ি খাবে। সবই এদের
বলতো ছিঁচকে চোর। কবির টেবিলে হ্যারিকেন জ্বলতো সারা রাত। হারানো শব্দের
সন্ধানে উঠানামা করতো হ্যারিকেনের সলতে। বিরক্ত গভীর হলে নিভে যেতো আলো।
হ্যারিকেন এখন ইতিহাস। হ্যারিকেনে লুকিয়ে প্রান্তিক জীবন। সাবেক বঙ্গ।এখন তো
হ্যারিকেন খেলনা, শোপিস। বোলপুরের সনাজুরির হাটে বিক্রি হয় হ্যারিকেন প্রতীকী।
লোকে কেনে। নিয়ে যাবে বাড়ীতে। ছোটরা জানবে এই হ্যারিকেন কেটেছে তার বাবা
দাদুদের জীবন যৌবন। অথচ এই হ্যারিকেন হাতে রানার দৌড়েছে একদিন।তাকে চিঠি দিতে
হবে।সেই ডাকপিয়নের চরম বন্ধু ছিল সেদিন এই হ্যারিকেন। "হাতে লন্ঠন করে ঠনঠন
জোনাকিরা দেয় আলো"।
1 মন্তব্যসমূহ
মুছে যাওয়া দিন : হ্যারিকেন নিবন্ধ টি পড়ে খুব ভালো লাগল । তন্ময় কবিরাজ অনেক যত্ন করে নিবন্ধটি লিখেছেন । এ যেন সেই যুগের সেই সময়ের স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন ।আজ হ্যারিকেন অচল ।কিন্তু এক কালে এই হ্যারিকেন দিয়েই জীবন চলত । আহা সে কালে একটা ডায়লগ ও ছিল , হাতে হ্যারিকেন । সে এক স্মৃতি।
উত্তরমুছুন