ম্য বঙ্কু শহরের বিদ্যালয়ে চাকুরি লাভ করিয়া শহরে আসিল। সে লিখিতে
ভালোবাসে। তাহার বড়সড় সাহিত্যিক হইবার বাসনা নাই। লিখিয়া আনন্দ পায়, তাই সে
লেখে। সে লেখে গ্রামের নদীটির গান, পুকুরধারের জংলা ঝোপে জোনাকির গুনগুন, মেঠো
পথের মনখারাপের সংলাপ, গ্রামের হাটের দরিদ্র মানুষের আলাপ। তাহার লেখা সে
সঙ্কোচবশত কাহাকেও দেখাইতে চাহে না। তথাপি একজনের চক্ষে পড়িল বঙ্কুর এই সারস্বত
সাধনা। মানুষটি যাচিয়া আসিয়া আলাপ করিল, বঙ্কুর সহিত অনেক গল্প করিল, তাঁহার
মনের প্রাণের অনেক কথা জানিয়া লইল, সাধিয়া সাধিয়া গোপন সাধ পেটের ভিতর হইতে
টানিয়া বাহির করিল। বঙ্কু এমন দরদী পাইয়া আপনাকে ঢালিয়া দিল, কহিল, “বন্ধু!
অ্যাতো ভালোবাসা তো আমাকে অদ্যাবধি কেহ দ্যায় নাই! আমি তোমারই হইলাম। তুমি
ছাড়িলেও আমি আর তোমায় ছাড়িব না!” বিদ্বান বন্ধু হাসিয়া কহিল, “আমিও যেন তোমাকে
ছাড়িতেছি? এমন গুণী বন্ধু প্রদীপ লইয়া খুঁজিলেও পাইব না!” বঙ্কু বলিল, “তুমি
সূর্য, আমি মাটির প্রদীপ। তোমার দিকে চোখ তুলিয়া তাকাইবার সাহস কাহারও নাই।
কিন্তু আমার উদ্দেশ্যে এক মুষ্ঠি ধূলা নিক্ষেপ করিলেও আমি নিভিয়া যাইব। তাই
খুরযুক্ত প্রাণিদের সভয়ে এড়াইয়া চলি, পাছে খুরের ধূলায় নিভিয়া যাই! ব্যাঙের কী
হাতির চলার পথে দাঁড়াইবার সাহস হয় ভাই? ব্যাঙের গর্তে টাকা থাকিলে না হয় টাকার
গরমে সে হাতিকেও লাথি দেখায়। কিন্তু সে হইল গল্পের কথা। আমার টাকাও নাই, দেহের
বলও নাই, বন্ধু-বলও নাই। আমি এই ভবে একেবারে একলাটি। মা গত হইয়াছেন গত বৎসর।
তিনি আমাকে উপার্জনশীল দেখিয়া দারপরিগ্রহ করাইয়া দিয়া যাইতে পারিলে শান্তি
পাইতেন। তাঁহার চক্ষে ব্যর্থ অপদার্থ হইয়াই রহিলাম। লুকাইয়া খাতার পৃষ্ঠা
ছাইপাঁশ লিখিয়া ভরাইয়া তুলিতেছি দেখিলে ক্ষুব্ধ হইতেন। আমার চাকুরি লাভ তিনি
দেখিয়া গেলেন না। স্বর্গ হইতে তাঁর অধম সন্তানকে লিখিয়া সফল হইতে দেখিলে হয়তো
শান্তি পাইবেন। এক্ষণে তোমাকে পাইয়াছি। তুমি যদি লেখাগুলি ছাপাইবার যোগ্য
হইয়াছে কি না, সময় করিয়া দেখিয়া দাও ও কোথায় কী করিতে হইবে বলিয়া দাও, তাহাই
করিব।” বন্ধু মুচকি হাসিয়া কহিল, “তোমাকে আর কিছুই করিতে হইবে না, যাহা করিবার
আমিই করিব। তোমার লেখাগুলি আমাকে দিও, সময় করিয়া দেখিয়া লইব। তাহার পর আমার
পরিচিত প্রকাশকদের নিকট ছাপাইবার ব্যবস্থা করিব।”
বঙ্কু বন্ধুকে অগাধ বিশ্বাস করিয়া তাহার দ্বাদশ বৎসরের লেখালিখির যাবতীয় সঞ্চয়
সসঙ্কোচে তুলিয়া দিল। বিনয়ে নুইয়া পড়িয়া কহিল, “মিছামিছি এসমস্ত পড়িয়া তোমার
সময় ব্যয় করিও না।” বন্ধু লেখাগুলি দেরাজে রাখিল, বলিল, “দেখিয়া লইব সময়
করিয়া।”
দিন যায়। মাস যায়। বঙ্কুর লেখা বন্ধুর আর দেখিবার সময় হয় না। অথচ সময় বাহির
করিয়া দেখিতে হইবে, বন্ধুকে সে কথা দিয়াছে। অগত্যা বাধ্য হইয়াই বঙ্কুর সাহায্য
তাহাকে লইতে হয়, ইহা তাহার অভিপ্রেত নয়, তথাপি বঙ্কুর পীড়াপীড়িতে বিদ্যালয়ের
পরীক্ষার খাতাগুলি তাহাকে দিয়া দেখাইয়া লয়। গৃহিণীর তাড়নায় লেখাপত্র লইয়া
বসিবার উপায় আছে? অগত্যা বঙ্কু বন্ধুর সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী
ক্রয় করিয়া লইয়া আসে। বিদ্বান বন্ধু বঙ্কুকে বসিতে বলিতে ভুলিয়া যায়, কোনও বড়
তত্ত্ব চিন্তায় মগ্ন থাকে।
প্রকাশককে বঙ্কুর লেখা দেখাইয়াছে বিদ্বান, সে লাফাইয়া উঠিয়াছে, “আপনি এসমস্ত
এতদিন কোথায় লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন? এই পাণ্ডুলিপি আমিই লইলাম। বই বাহির হইলে
দেখিবেন, হই হই পড়িয়া যাইবে। একেবারে অন্য ধাঁচের লেখাগুলি। আপনি এতদিন আমাকে
দেন নাই কেন বুঝিতেছি না!” বঙ্কুর লেখা বিদ্বান বন্ধুর নামে বই হইয়া বাহির হইল।
বই আশাতীত বিক্রয় হইল। বিদ্বান বন্ধু বেশ কিছু অর্থও পাইলেন। প্রকাশক বলিলেন, “আরও লেখাপত্র আছে নাকি? বাহির করুন মশাই। পাঠকরা আপনার পরবর্তী গ্রন্থ পড়িবার
জন্য অতিশয় উদগ্রীব!” বিদ্বান মুচকি হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, খুঁজিয়া দেখিব।” গৃহে
ফিরিয়াই সে চলিল বঙ্কুর নিকট, “ভাই, কী আর বলিব? লজ্জায় এতদিন তোমাকে বলিতে
পারি নাই, তোমার সে লেখাগুলি প্রকাশক ‘বাজে লেখা’ বলিয়া বাতিল করিয়াছেন!” বঙ্কু
ম্লান মুখে বলিল, “তোমার আর কী দোষ তাহাতে?” বিদ্বান বঙ্কুর হাতদুটি ধরিয়া গাঢ়
স্বরে কহিল, “এইভাবে মন খারাপ করিও না বন্ধু। আমি তো আছি। তুমি আরও লেখ।” বঙ্কু
বলিল, কখন লিখিব? বিদ্যালয়ের কাজে ফুরসৎ পাইতেছি না। তাহার উপর তোমার কাজগুলিও
অল্পবিস্তর না করিয়া দিলে তোমারও অসুবিধা হইতেছে।”
দুইদিন পরে বিদ্বান আসিয়া প্রকাশককে বলিল, “পুরাতন লেখা খুঁজিলাম, কোথায় যে
রাখিয়াছি লেখার তাড়া, স্মরণে আসিতেছে না!” প্রকাশক উৎসুক মুখে বলিলেন, “বেশ তো,
নতুন করিয়া লিখুন।” বিদ্বান গম্ভীর মুখে বলিল, “বিদ্যালয়ের যে উৎকট চাপ, তাহাতে
মন শান্ত করিয়া লিখি কখন?” প্রকাশক বলিলেন, “আমি সব ব্যবস্থা করিয়া দিতেছি,
কর্তা-গিন্নিতে দার্জিলিং চলিয়া যান। বৌদিদিও খুশি হইবেন। পাহাড়ের ঠাণ্ডায়
আপনার মাথাও ঠাণ্ডা হইবে আর কুলকুল করিয়া ঝর্ণার মত লেখাও আসিবে!” বিদ্বান
হাসিয়া বলিল, “মন্দ নয় বটে!”
বিদ্বান আসিয়া বঙ্কুকে বলিল, “দ্রুত মালপত্র গুছাইয়া লও। আমরা দার্জিলিং
যাইতেছি। সেখানে গিয়া ঠাণ্ডায় আয়েশ করিয়া তুমি লিখিবে।”
বঙ্কু একেবারে আকাশ হইতে পড়িল। “বলো কি? দার্জিলিং? কতদিনের স্বপ্ন! তা বৌদিদি
যাইবেন না? কেবল আমরা দুইজন? তা কেমন করিয়া হইবে? বরং তুমি আর বৌদিদি ঘুরিয়া
আইস।”
বিদ্বান বলিল, “তুমি আর কথা বাড়াইও না। আমরা দুইজনেই যাইব। তুমি লিখিবার ফুরসৎ
পাইতেছ না, শুনিবার পর হইতেই আমার যে কীরকম কষ্টবোধ হইতেছে, তাহা বুঝাইয়া বলিতে
পারিব না। তাই তো আর বিলম্ব না করিয়া দুইখানি টিকিট কাটিয়া আনিয়াছি। তোমার তো
কোনও সংসারের ল্যাঠা নাই। আমার গিন্নিকে বলিব বিদ্যালয়ের অফিসের কাজে কলিকাতায়
যাইতেছি। তিন-চারিদিনে ফিরিব।”
বঙ্কু কোন কথা কহিতে পারিল না। তাহার চক্ষু দিয়া দরদর ধারে জল পড়িতে লাগিল, সে
বন্ধুর হাত চাপিয়া ধরিয়া রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, “আমি কী এমন পুণ্য করিয়াছি যে
তোমাকে বন্ধু পাইলাম!”
বিদ্বান মুচকি হাসিল।
দার্জিলিং-এর মনোরম পাহাড়ি সৌন্দর্য বঙ্কুকে তাহার পিছনে ফেলিয়া আসা শান্ত
গ্রামখানি মনে করাইয়া দিল। লেখা যেন ঝর্ণার গতিতে ছুটিতেছে। ঝরঝর করিয়া,
প্রাণের আবেগে বঙ্কু লিখিয়া চলিল। বন্ধু এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়ায়, আর বঙ্কু
লেখে। মাঝে মাঝে বঙ্কুকে বন্ধু গরম চা আনিয়া দ্যায়, মোমো আনিয়া দ্যায়। বঙ্কুর
চোখে জল আসে। সে মনের আরামে প্রাণের শান্তিতে লিখিয়া চলে। একদিন একটি
ভ্রাম্যমাণ দল মহা হই চই বাঁধাইয়া বসিল। তাহারা বিদ্বানকে দেখিয়া সম্প্রতি একটি
বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক বলিয়া সনাক্ত করিয়াছে। তাহারা হোটেলের রিসেপশনেই তাহাকে
সম্মানিত করিতে চাহে। একদিন সকালে বঙ্কু একটি ঝর্ণার পার্শ্বে বসিয়া লিখিতেছিল,
আর বন্ধু তাহার আশেপাশেই ঘুরিতেছিল। অকস্মাৎ এই উৎপাত। বিদ্বানের হাত ধরিয়া
তাহারা টানিতে টানিতে লইয়া গেল ছবি তুলিবে বলিয়া। বিদ্বান হাসিয়া “এই আসিতেছি”
বলিয়া উহাদের সঙ্গে কিঞ্চিত দূরে গেলে বঙ্কু জীবনে প্রথমবার একটি পাপ করিল।
পার্শ্বে পড়িয়া থাকা বিদ্বানের ঝুলিতে আপন হস্ত প্রবেশ করাইয়া টানিয়া বাহির
করিল একখানি গ্রন্থ। তাহার উপরে জ্বলজ্বল করিতেছে বন্ধুর নাম, অথচ ইহার কথা সে
ঘুণাক্ষরেও বঙ্কুকে বলে নাই। পাছে বঙ্কু দুঃখ পায়! বঙ্কুর আবারও চক্ষে জল আসিল।
এমন করিয়া সে তো ভালোবাসিতে পারে না! গ্রন্থটির প্রচ্ছদ উল্টাইতেই সূচীপত্র
দেখিয়া তাহার ভিরমি খাইবার জোগার, একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাইয়া বহু বৎসর ধরিয়া
লিখিত আপন লেখাগুলিই দেখিল, ক্রমে জলে চক্ষু ঝাপসা হইয়া আসিল। গ্রন্থখানি
রাখিয়া সমস্ত লেখা ছড়াইয়া ফেলিয়া নিতান্ত অন্যমনস্ক হইয়া সে হাঁটিতে আরম্ভ
করিল। কিন্তু মনে হইতেছে সে হাঁটিতে ভুলিয়া গিয়াছে। পা দুইখানি শৈশবের মতোই
টলমল করিতেছে, “মা, হায় মা, তুমি এক্ষণে কোথায়? তোমার অপদার্থ খোকা চলিতে গিয়া
পড়িয়া যাইতেছে, আসিয়া হাত দু’খানি ধরিবে না?” অকস্মাৎ পশ্চাদ্দেশে বিষম এক
ধাক্কা খাইয়া আর টাল সামলাইতে পারিল না, পার্শ্বের গভীর খাদে পড়িয়া গেল, পড়িতে
পড়িতে দেখিতে পাইল, বন্ধু উপরে দাঁড়াইয়া দেখিতেছে। বঙ্কু চিৎকার করিল, “বন্ধু,
আমাকে বাঁচাও!” বন্ধু তবুও দাঁড়াইয়া শান্তভাবে তাহাকে পড়িতে দেখিতে
লাগিল।
ইহার কয়েকমাস পরের কথা। বিদ্বান ধীরে ধীরে তাহার স্মৃতি হারাইতে লাগিল। থাকিয়া
থাকিয়া কী যেন দেখিয়া আতঙ্কে চিৎকার করিয়া ওঠে। গৃহে দ্বার দিয়া বসিয়া থাকে।
কাহারও সঙ্গে কথা কহে না। একসময় লোকে বুঝিল, দার্জিলিং হইতে বন্ধু হারাইয়া
ফিরিয়া আসিবার পর হইতে যে উন্মাদ রোগের লক্ষণ দেখা দিয়াছিল, তাহাই পূর্ণ
মাত্রায় প্রকাশ পাইয়াছে। বিদ্যালয়ের চাকুরি হারাইতে হইল। দুইটি নাবালক সন্তান
লইয়া স্ত্রী পিতৃগৃহে চলিয়া গেল। বিদ্বান বদ্ধ উন্মাদ হইয়া একদিন গাড়ি চাপা
পড়িয়া মরিল।
ওদিকে বঙ্কুর প্রাণ বাহির হইয়া ঊর্ধ্বে ধাবিত হইল। এক আলো-আঁধারির মধ্য দিয়া
সে যাইতেছিল। ইতোমধ্যে একদল দিব্যদেহধারী আসিয়া তাহাকে এক অতি রমণীয় লোকে লইয়া
গেল। সেই স্থলে রৌদ্রের খরতা নাই, রাত্রির অন্ধকার নাই। সর্বদা চন্দ্রের
উজ্জ্বল ধবল জ্যোৎস্নার ন্যায় এক আলোকিত আভা বিরাজ করে। বাতাসে সুগন্ধ ভাসিয়া
বেড়ায়। চতুর্দিকে কেবল ফুল, পাখির কূজন ও স্নিগ্ধতা। তাহার লেখার বেগ অত্যন্ত
বৃদ্ধি পাইল। সে দিস্তা দিস্তা লিখিয়া চলিল। যদিও তাহা কোথায় সংরক্ষিত হইতেছে,
তাহা বুঝিতে পারিল না, বুঝিবার প্রবণতাও হইল না। কেবল ইচ্ছা লইয়া সে ঘুরিয়া
বেড়াইতেছে। বলা ভালো, ভাসিয়া বেড়াইতেছে। দেহের ভার এস্থানে আদৌ
নাই।
একদিবস এক তীক্ষ্ণ চেঁচামেচিতে আকৃষ্ট হইয়া সে কর্ণ খাড়া করিয়া শুনিল, “ভাই
বঙ্কু, আমাকে বাঁচাও!” তাহার চেতনায় পরিচিতির সুর ধরা দিল, এ যে বন্ধুর স্বর!
আমি তো তাহাকে কোনকালেও ছাড়িব না বলিয়াছিলাম! সে ভাসিতে ভাসিতে বহু যোজন দূরত্ব
নিমেষে অতিক্রম করিয়া এক চাপ চাপ অন্ধকার লোকের সম্মুখে পৌঁছাইয়া সেইদিকে সভয়ে
চাহিল। শব্দ সেই স্থান হইতেই আসিতেছে। বাতাস সেই স্থলে অতিশয় ভারি, দুর্গন্ধ
যুক্ত। অনেক চেষ্টা করিয়াও সে সেই শব্দের উৎসে পৌঁছাইতে পারিতেছে না। কিন্তু
বন্ধু বিপদে পড়িয়াছে। তাহাকে রক্ষা করিতে হইবে। দ্বাররক্ষীদের সে কহিল, “আমাকে
ভিতরে লইয়া চলুন, বন্ধু বিপদে পড়িয়া আমাকে স্মরণ করিতেছে।” দ্বাররক্ষীরা বধিরের
ন্যায়। তাহারা বঙ্কুর কথায় কর্ণপাত করিল না। অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। আর্ত চিৎকারও
ক্রমে ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে। দূর হইতে ভাসিয়া ভাসিয়া দুই দিব্য দেহধারী আসিয়া
বঙ্কুর সূক্ষ্মদেহ ধরিয়া চিমটাইয়া টানিয়া লইল, “চলিয়া আসুন মহাশয়! ওই স্থান
আপনার নিমিত্ত নহে। আপনার বর্তমান স্থানের ভোগ সমাপ্ত হইলে অন্য লোকে পাঠাইয়া
দিবে। ওই নিম্ন লোকের জীব অতিশয় ক্লেশ ভোগ করিয়া পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ
করিবে মেঘ হইতে বৃষ্টির ন্যায়। উহাদের সহিত সংযোগ করিতে পারিবেন না।” বঙ্কুর
সূক্ষ্মদেহের সূক্ষ্ম চক্ষে আবারও জলের মতো কিছু আসিল, সে কহিল, “আর কি দেখা
হইবে না, বন্ধুর সহিত?” দিব্যপুরুষেরা হাসিল, “না তাহার সম্ভাবনা নাই। আপনাদের
লোক এতদূর ভিন্ন যে উহা সম্ভব হইবে না। দেখা-সাক্ষাৎ, মান-অভিমান, দেনা-পাওনা,
অপরাধ ও তজ্জন্য অনুতপ্ত হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা—ইত্যাদি যাবতীয় দ্বন্দ্ব পৃথ্বী
লোকেই মিটাইয়া লইতে হয়। তৎপশ্চাত অন্য লোকে আসিয়া পড়িলে ঐসকল আর মিটাইয়া লইবার
উপায় থাকে না। আপনার বন্ধুকে তাহার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে অশেষ যাতনা
সহিয়া। এমতাবস্থায় অপরাধের স্মৃতি বিদ্যমান থাকিলেও মর্ত্যে পৌঁছাইয়া নূতন দেহ
লাভ করিয়া তাহা বিস্মৃত হইবে ও আপন মন্দ ভাগ্যের জন্য বিধাতাকে অভিযোগ জানাইতে
থাকিবে আর দুঃখ ভোগ করিতে থাকিবে। আপনিও অধিক ঊর্ধ্বে পৌঁছাইলে মর্ত্যলোকের
সর্বপ্রকার স্মৃতির সহিত বন্ধুর স্মৃতিও ভুলিবেন। তৎপরে আনন্দ অনুভব করিতে
থাকিবেন।” সেই দেবদূতগণের কথায় বঙ্কু একটি সিদ্ধান্ত করিল, “এক্ষণে যখন আমাদের
উভয়ের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে, এই অবস্থায় আমাদিগের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়া
দেওয়া যাইতে পারে কি? আমি তাহার বন্ধু ছিলাম, এইক্ষণ পর্যন্তও সেই অনুভব
রহিয়াছে। বন্ধুও অনুতপ্ত। অতএব আর একটি সুযোগ কি আমরা পাইতে পারি না?” দেবদূতগণ
হাসিলেন। পরস্পরের দিকে চাহিলেন। তাহার পর কহিলেন, “ইহাই পার্থিব মায়া। মায়ার
অধিকৃত এলাকা ছাড়াইয়া অনেকদূর চলিয়া না যাওয়া অবধি মায়ার হাত হইতে নিস্তার নাই।
আপনার মানসিক অবস্থা বুঝিতে পারিতেছি। আপনাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়া দিব।
কিন্তু সর্ব ক্ষেত্রেই একটি নিয়মের মধ্য দিয়াই যাইতে হয়। এই সূক্ষ্ম দেহে
কালোকে সাদা করিয়া ফেলিবার পথ নাই। কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করিতেই হইবে, উহাতে রাজী
আছেন কি?” বঙ্কু আর তর্ক করিতে চাহে না। সে বন্ধুকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার
জন্য মরীয়া হইয়া কহিল, “আপনারা যে পদ্ধতিতে আমাদিগকে মিলাইয়া দিবেন, আমি
তাহাতেই রাজী।” এই কথা বলিবামাত্র তাহার বোধ লুপ্ত হইতে লাগিল। সূক্ষ্ম দেহের
মস্তিষ্ক ঘোলাটে হইয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আসিল। তাহার চেতনা লোপ
পাইল।
হরিহরপুরের মিত্রদের জমিদার বাড়ির সন্তানহীনা গৃহিণী বহু ব্রত-উপবাস করিয়া
অধিক বয়সে একটি পুত্র সন্তান লাভ করিলেন। জমিদার বাড়িতে আনন্দের হাট বসিয়া গেল।
গ্রাম শুদ্ধ মানুষ ভোজ খাইলেন। জমিদার তাহার আদরের পুত্রের সর্বপ্রকার আবদার
মিটাইতে সদাই তৎপর থাকেন। হস্তে খড়ি হইতে না হইতেই সে ছন্দ মিলাইয়া ছড়া লিখিতে
আরম্ভ করিয়াছে। একদিন নালায় পড়িয়া সর্বাঙ্গে কর্দম লিপ্ত কুঁই কুঁই ক্রন্দনরত
এক অনাথ সারমেয় শাবক দেখিয়া দয়ার্দ্র হইয়া তাহাকে পোষ্য করিবার ইচ্ছা প্রকাশ
করিল। তাহার ইচ্ছা পূর্ণ হইতে বিলম্ব হইল না। সারমেয়র ভাগ্য ফিরিয়া গেল। তাহার
জন্য সোনার কণ্ঠবন্ধনী আসিল। তাহার ভোজনে দুধ, মাংস প্রভৃতি উৎকৃষ্ট খাদ্য
বরাদ্দ হইল। জমিদার নন্দনের একান্ত অনুগত হইয়া পোষ্যটি সর্বদা তাহার সর্ব বস্তু
অতন্দ্র প্রহরা দিতে লাগিল। ঊর্ধ্বলোক হইতে দেবদূতরা একদিন উহাদের চুপি চুপি
দেখিয়া গেলেন। একান্ত অনুরুদ্ধ হইয়া, নিয়ম ভাঙিয়া তাহারা যে ব্যবস্থাটি
করিয়াছিলেন, তাহার সিদ্ধি কিরূপ হইয়াছে, তাহা দেখিবার সূক্ষ্ম আকাংক্ষা
জাগিয়াছিল।
সারমেয় জন্মের আয়ু মনুষ্য অপেক্ষা কম। অতএব জমিদার নন্দনের সারমেয়টি একদিন
রোগে ভুগিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইল। জমিদার নন্দন এখন যুবাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন।
তথাপি তিনি তাহার পোষ্যের শোকে মুহ্যমান হইলেন। জমিদারী ব্যবস্থা ইদানিং কালে
আর নাই। কিন্তু পিতৃপুরুষের রাখিয়া যাওয়া সম্পদের অভাব নাই। বিলাত হইতে ডিগ্রী
লইয়া আসিয়া সে প্রখ্যাত সংস্থায় কর্ম লইয়াছে। তথাপি সাহিত্য কর্মেই আশৈশব
প্রীতি ও উহার চর্চায় অধিক সময় দেওয়ার অক্ষমতা হেতু বিমর্ষ বোধ করে। অতএব এক
দিবস কর্মে ইস্তফা দিল ও নিজস্ব ছাপাখানা সমেত সুবৃহৎ কর্মশালা খুলিয়া সুসজ্জিত
অফিসে বসিয়া প্রকাশনা ব্যবসা আরম্ভ করিল, স্বয়ং লিখিত পুস্তকাদি সেই প্রকাশনা
হইতে বাহির হইতে লাগিল। ইহাতে গৃহের লক্ষ্মী গৃহেই থাকিল। প্রকাশনা জগতে সৎ
প্রকাশক হিসাবে সুনামও হইল। কয়েকজন কর্মহীন যুবকের কর্মসংস্থান করা হইল। অতঃপর
এক দিবস মলিন বেশে এক কিশোর কর্মপ্রার্থী হইয়া আসিল। অন্যান্য কর্মচারীরা তাহার
সম্পর্কে খোঁজ লইয়া জানিল, ছেলেটি চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে, কিশোর
সংশোধনাগারে কয়েক বৎসর কাটাইয়া বাহির হইয়াছে। উহাকে কোনমতেই কর্মে বহাল করা যায়
না। কিন্তু জমিদার নন্দনের কিশোরকে দেখিবামাত্রই মায়া পড়িয়াছে। সে কহিল, “ভালো
মন্দ মানুষ আমিও কম চিনি না!” সে কহিল, “বিশ্বস্ততার সহিত কর্ম করিবি তো?” সেই
অনাথ কিশোর আসিয়া মালিকের পদে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। এমন প্রশ্রয় সে কাহারও কাছে
পায় নাই। কয়েক বৎসর পরে সে মালিকের অতিশয় প্রিয়পাত্র হইয়া তাহার ছায়াসঙ্গী হইয়া
ফাইলপত্র বহিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফিরিতে লাগিল। এক দিবস দেবদূতেরা আসিয়া চুপি চুপি
তাহাদের দেখিয়া গেলেন। তাহাদের শান্তি নাই। নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হইলেই এই
দুইটি জীবাত্মাকে তাহাদের ফিরাইয়া দিতে হইবে। ঊর্ধ্বলোকে নিয়ম ভাঙিলে শাস্তি বড়
কঠোর। তবুও তাহারা ইহা ভাবিয়া শান্তি অনুভব করেন যে, উহাদের কর্মক্ষয়ের
ব্যবস্থাটি করিয়া দিতে পারিয়াছেন। এক সুযোগ বুঝিয়া, ইন্দ্রদেবের উত্তম মেজাজের
দশায় তাহার কাছে এই নূতন প্রজেক্টের বিষয় উত্থাপন করিয়া আপনাদের আরও উন্নত লোকে
প্রমোশনের ব্যবস্থা করিয়া লইবেন আশা রাখিতেছেন। আশা সর্ব লোকেই বলবৎ।
0 মন্তব্যসমূহ