“নানা ভাষা, নানা
মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে
দেখো মিলন মহান”
- অতুল প্রসাদ সেন
ভারতকে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের দেশরূপে
অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ ঘটেছে এই ভারতভূমিতে।
এর সাথেই এখানে বহুবিধ সংস্কৃতির মেলবন্ধনও দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে
ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকলার সন্ধান পাওয়া যায়। ভারত শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে সারা
পৃথিবীতে বিখ্যাত। ভারতীয় চিত্রকলাও নিজস্ব স্বকীয়তায় বলীয়ান হয়ে জগতে পৃথক স্থান অধিকার
করেছে।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পৃথক রীতির ও পৃথক আঙ্গিকে
চিত্রকলা রচিত হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক মতে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায়
ভারতীয় চিত্রকলার বিকাশ ঘটে থাকে। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয়
চিত্রকলার বিশেষ উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। বিখ্যাত
চিত্র সমালোচক ড. অশোক কুমার দাস মন্তব্য করেছেন - "The Mughal school of painting represents one of the most
significant phases of Indian art."
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের দীর্ঘকাল পরেও এর প্রভাব উত্তর ভারত, দাক্ষিণাত্য, রাজস্থান
ও পাঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী একটা ছাপ রেখেছিল। প্রায় প্রত্যেক মুঘুল সম্রাটই
চিত্রশিল্পে আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ। এর ফলে
ভারতীয় চিত্রকলা একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলার সাথে বিভিন্ন
বিদেশী চিত্রকলার সমন্বয় সাধন ঘটে। ভারতের প্রাদেশিক চিত্রকলার নিজস্বতা বজায় রাখার
পাশাপাশি বিদেশী চিত্রকলার অনুপ্রেরণায় ও সংমিশ্রণে ভারতীয় চিত্রকলা বিশেষ রূপ পরিগ্রহ
করে।
আজ ভারতের কিছু প্রাদেশিক চিত্রকলার বিষয়ে আলোচনা
করব।
- থাংকা চিত্রকলা:
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত
অঞ্চল জুড়ে এই চিত্রকলা প্রচলিত। থ্যাংকা শব্দের অর্থ "কোনো কিছু গোটানো"। একাদশ
শতাব্দী থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত থাংকা চিত্রকলা মূলত চীনা ও কাশ্মীরি চিত্রকলার
সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল। তুলো বা লিনেন কাপড়ের উপর আয়তক্ষেত্রাকার এবং জটিল বিন্যাসে
এগুলি আঁকা হয়। সাধারণত ঐতিহ্যবাহী বাণী,
তিব্বতীয় বা বৌদ্ধ দেব-দেবী, ধর্মীয়, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং ধর্মতত্ত্বের বিভিন্ন
বিষয় চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। চিত্রটি যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য চিত্রটি রেশমি
কাপড় দ্বারা বাধাই করে গুটিয়ে রেখে সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষণের এই পদ্ধতিতে থেকে
এই চিত্রকলার এই নামকরণ করা হয়েছে।
- মণ্ডল চিত্রকলা:
থাংকা ছাড়াও এই সমস্ত প্রদেশে মণ্ডল চিত্রকলার প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়। হিন্দুধর্মে ও বৌদ্ধধর্মে এই ধরণের চিত্রকলা আধ্যাত্মিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের
প্রতীক রূপে পরিগণিত হয়। বৃত্তাকারে অঙ্কিত এই চিত্রকলার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে জীবনের
শেষ নেই। তা অন্তহীন।
- ওরলি চিত্রকলা: ওরলি চিত্রকলা ভারতের প্রাচীনতম চিত্রকলার মধ্যে অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। মহারাষ্ট্রের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার সীমান্তে অবস্থিত “ওরলি” উপজাতির আঁকা এই চিত্রকলা ১০ম শতকের ভারতীয় বিভিন্ন গুহাচিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপজাতীয় মহিলারা বিশেষত বাড়ির বাইরের দেওয়ালে এই চিত্রকলা তৈরি করে থাকেন।
- কলমকারি:
অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা প্রদেশে কলমের সাহায্যে এক প্রকারের সূক্ষ্ম, মূলত
প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় কাহিনীর উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট চিত্রকলা প্রচলিত আছে। কলমের সাহায্যে
এই চিত্র অঙ্কন করা হয় বলে একে “কলমকারী” বলা হয়। কলমের সূক্ষ টানে এই চিত্রকলা আঁকা
হয়।
- কলমেঝুঠু:
কেরালাতে এক বিশেষ প্রকারের চিত্রকলা দেখতে
পাওয়া যায়। এই চিত্রকলায় মাটিতে দেব-দেবীর চিত্র অঙ্কন করা হয়। চিত্র অঙ্কনের জন্য
পাঁচ প্রকারের রং ব্যবহার করা হয়। এটি "কলমেঝুঠু" চিত্র নামে প্রচলিত। বিভিন্ন
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাধারণত মন্দির প্রাঙ্গণে এই চিত্রকলা আঁকা হয়।
- পটচিত্র:
বাংলা ও উড়িষ্যার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যশালী চিত্রকলা হল “পটচিত্র”। উড়িষ্যার
রঘুরাজপুরে এই বিশেষ পটচিত্র চিত্রকলার সৃষ্টি হয়। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আজও একজন
সদস্য এই শিল্পে নিযুক্ত থাকেন। ভগবান জগন্নাথ এই বিশেষ চিত্রকলার মূল বিষয় হিসাবে
পরিগণিত হয়ে থাকেন।
প্রাচীন বাংলাতেও এই চিত্রকলার প্রচলন শুরু হয়। মূলত পৌরাণিক কাহিনী, দেব-দেবীর
চিত্রসম্বলিত এই চিত্রকলা পাটের কাপড়ের উপর সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে কলকাতার কালীঘাট
অঞ্চলে এক বিশেষ ধরণের পটচিত্রের প্রচলন হয়। কালীঘাটের কুমোর সম্প্রদায়ের হাত ধরে কালীঘাটে
পটচিত্রকলার প্রচলন হয়। প্রথম দিকে কেবল
দেবদেবীর মূর্তি আঁকা হত, পরে তাতে নানান সামাজিক ঘটনাবলীর দৃশ্যরূপও যোগ হয় যেমন-
কোথাও নটি, বাবু, নাটকের দৃশ্য, গুরুঠাকুর, মেছুনি, নর্তকী, কামাখ্যার পুরুষদের ভেড়া
বানানো ইত্যাদি। তারকেশ্বরের মহান্ত আর এলোকেশীকে নিয়েও আঁকা হয়েছে বহু সংখ্যক পট।
কালো কালির ড্রয়িং থেকে পটুয়ারা রঙিন পট আঁকতে আরম্ভ করলেন, পরে বিলিতি জলরঙেরও ব্যবহার
শুরু হয়।
- গোন্দ চিত্রকলা:
ভারতের বৃহত্তম উপজাতি হল গোন্দ বা গোঁদ জনজাতি। এঁরা মূলত মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী
সম্প্রদায়ের হলেও বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিসগড় ও উড়িষ্যাতেও বাস করেন। বহু উজ্জ্বল
রঙের ব্যবহারে গোন্দ চিত্রকলা সৃষ্টি হয়। এতে প্রধানত উদ্ভিজ ও প্রাণীজ আকারের বহুল
ব্যবহার থাকে।
- চিত্তারা চিত্রকলা:
কর্ণাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উত্তরাঞ্চলের
দিভারু জনজাতির সৃষ্ট চিত্তারা চিত্রকলা। জ্যামিতিক আকারের সাহায্যে সূক্ষ্ম জালিকা
সম্বলিত এই চিত্রকলা ধর্মীয় অনুষ্ঠান সহ বিভিন্ন শুভ অনুষ্ঠানেও আঁকা হয়। আঁকার মধ্যে
প্রধানত প্রকৃতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
- চেড়িয়াল চিত্রকলা:
বর্তমান তেলঙ্গানার চেড়িয়াল অঞ্চলের
প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা হল চেড়িয়াল চিত্রকলা। বহু প্রজন্ম ধরে পারিবারিক উত্তরাধিকার
সূত্রে এই চিত্রকলাকে আঁকা হয়ে আসছে। এই চিত্রকলা কাপড়ে বা কাগজে স্ক্রোল আকারে আঁকা
হয়। এই ৪০-৪৫ ফুট স্ক্রোলগুলিতে ভারতীয় পুরাণের কাহিনীকে রঙিন নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয়।
প্রতিটি স্ক্রোলে প্রায় ৫০ টি চিত্র থাকে।
- তাঞ্জর চিত্রকলা:
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর থানজাভুরের স্থানীয় চিত্রকলা ‘তাঞ্জর’ বা ‘থানজাভুর’
চিত্রকলা নামে পরিচিত। ভারতের অন্যান্য প্রাদেশিক চিত্রকলার ন্যায় এই চিত্রকলা শুধু
ধর্মীয় চরিত্রই অঙ্কন করেনা; এটি সম্ভবত ভারতের একমাত্র লোকচিত্র কলা যেখানে বীরত্বের
কাহিনী বর্ণনা করা হয়। থানজাভুরের সেনানায়ক ও বীরদের গাথা বর্ণনা করার সাথে সাথে শ্রীকৃষ্ণের
লীলাকাহিনীও বর্ণনা থাকে এই ধরনের চিত্রকলাতে। কাঠের পাতের উপর অত্যন্ত উজ্জ্বল রঙের
সমাহারের সাথে সাথে এতে বিভিন্ন ধরনের পাথর ও সোনার পাত বসিয়ে কাজ করা হয়।
0 মন্তব্যসমূহ