ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ইতিহাস ও রহস্যের যুগলবন্দী– সূর্যতামসী - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


  • বইসূর্যতামসী
  • লেখককৌশিক মজুমদার
  • প্রকাশনীবুকফার্ম
  • পৃষ্ঠা২৩২
  • প্রকাশকালজুন, ২০২০
  • প্রচ্ছদকামিল দাস 
  • অলংকরণগৌতম কর্মকার


সূর্যতামসী

“ কোথাও পাখির শব্দ শুনি;
কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;
কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে
তবে।
অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে
অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়
বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;
এ কোন্ সিন্ধুর সুর:
মরণের
জীবনের?
এ কি ভোর?
অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু।

 কবি জীবনানন্দ দাস ( কাব্যগ্রন্থ সাতটি তারার তিমির)

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক, ১৮৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের এক মধ্যরাত্রে কলকাতার চিনেপাড়ায় একটি মৃতদেহ আবিষ্কার করে পুলিশকে খবর দেন তরুণ গণপতি চক্রবর্তী। পুলিশের তরফে তদন্তে নামেন আরেক তরুণ ডিটেকটিভ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। মৃতদেহের অবস্থা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন পুলিশ কর্মচারীরা। সর্বাঙ্গের রক্ত শুষে নেওয়া সাদা ফ্যাকাশে মৃতদেহের বুকে রক্ত দিয়ে আঁকা এক বিচিত্র চীনা সাঙ্কেতিক চিহ্ন। শব-ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রিয়নাথের সঙ্গে আলাপ হয় লন্ডন থেকে আসা এক রহস্যময় তরুণের, যার নাম সাইগারসন মোহেলস— কনসাল্টিং ডিটেকটিভ, যার মধ্যে পাঠক দেখতে পান কিংবদন্তী ডিটেকটিভ শার্লক হোমসের ছায়া ! এদিকে গণপতির কাছ থেকে এই মৃত্যুর কথা শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠেন তাঁর বন্ধু তথা কলকাতার প্রথম প্রাইভেট ডিটেকটিভ তারিণীচরণ রায়। ক'দিন পরেই, এঁদের সবার সামনে, করিন্থিয়ান থিয়েটারে মৃত্যু হয় দুই যাদুকরের! ঘনিয়ে ওঠে সেই যাদুর খেলা, যার শেষে সাফল্যের পাশাপাশি অপেক্ষায় থাকে মৃত্যু। তারই নাম সূর্যতামসী!

সাল ২০১৮, স্থান চন্দননগর। একটি মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় একই অবস্থায়। দেহে অজস্র কাটা চিহ্ন সমেত একটি চীনা সাঙ্কেতিক চিহ্ন বর্তমান। অতিপ্রাচীন এক চীনা হত্যা পদ্ধতি – লিং চি। হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ অফিসারের সাথে যোগাযোগ ঘটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ তুর্বসু রায়ের- লোকের ব্যক্তিগত জীবনে নজরদারি করাই যার কাজ এবং এই কাজ করতে গিয়ে তার প্রথম ক্লায়েন্ট হয়েছিলেন দেবাশিস গুহ অর্থাৎ সেই ব্যক্তি, যার ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ চন্দননগরে তাঁরই বাড়িতে আবিষ্কৃত হয়েছে। মৃত্যুর আগে দেবাশিস তুর্বসুকে একটা অস্পষ্ট ছবি হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলেন। তারপরেই বীভৎসভাবে হত্যা করা হয় দেবাশিসকে। তদন্ত অগ্রসর হলে জানা যায় , এক বিশেষ কারণে তুর্বসু'র কাছে পৌঁছতে চাইছিলেন দেবাশিস। কারণের মূল হল কলকাতার প্রথম প্রাইভেট গোয়েন্দা তারিণীচরণ রায় যিনি তুর্বসু রায়ের প্রপিতামহ।

এরপর শুরু হয় রহস্যে ঘনঘটা- দুটি পৃথক টাইম লাইনে। কি যোগসূত্র ছিল প্রায় একশ বছরের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি হত্যার মধ্যে? বাস্তব ও কল্পনার চরিত্রদের একসঙ্গে আনার 'ক্রস-ওভার' নামক পদ্ধতিটি ইদানীংকালের বাংলা সাহিত্যে প্রায়শঃই ব্যবহৃত হচ্ছে। যে কোনো এই ধরণের পিরিয়ড পিসের ক্ষেত্রে তথ্যনিষ্ঠার পাশাপাশি সেই বিশেষ আবহটিকে ফুটিয়ে তোলার গুরুত্ব এক্ষেত্রে অপরিসীম। 'সূর্যতামসী'-তে লেখক সেই কাজে ষোলো আনা সফল হয়েছেন। পড়তে পড়তে সব সময় মনে হয়েছে এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে গেছি সেই বিশেষ স্থান ও কালের কলকাতা নগরীতে। ইতিহাস, ঐতিহাসিক  বাস্তব ও কাল্পনিক চরিত্ররা, গোপন ষড়যন্ত্র, সিম্বোলজি, দুর্ধর্ষ চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, ফ্রিম্যাসন, নৃশংস হত্যাকান্ড এবং যাদুবিদ্যা – সবকিছুর মিশেলের সাথে লেখকের নির্ভার, স্বচ্ছন্দ গদ্য রচনা বইটির আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে। যেকোন গোয়েন্দা গল্পের মতই এই গল্পও প্রতি পাতার ভাঁজে রহস্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছে।

গৌতম কর্মকারের কিছু অলংকরণ দুর্ধর্ষ বললেও কম বলা হয়। বইয়ে আঁকা ছবিগুলো রহস্যের স্বাদ দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। মন কেড়ে নেওয়া এই ছবিতেও পাঠক বেশ কয়েক মুহূর্ত বুঁদ হয়ে থাকতে বাধ্য। কামিল দাসের আঁকা বইটির প্রচ্ছদ ও মুদ্রণও অসাধারণ। তাই পৃথকভাবে প্রশংসার দাবী রাখেন শিল্পীরা।

বইয়ের নামকরণ কবি জীবনানন্দ দাসের লেখা কবিতা ‘সূর্যতামসী’র অনুকরণে রাখার উদ্দেশ্য হয়ত এই রহস্যের দুর্বোধ্যতা বোঝাতেই। “সাতটি তারার তিমির”  কাব্যগ্রন্থ কবি জীবনানন্দ দাসের লেখা পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ) কলকাতা থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই কাব্যগ্রন্থের বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। এই কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম সূর্যতামসী। লেখক কৌশিক মজুমদারের গল্পের রহস্যও আপাতদৃষ্টিতে পাঠক ও গোয়েন্দার মনে দুর্বোধ্যতাই তৈরি করে।

সব মিলিয়ে বইটিতে এক জমজমাট রহস্য কাহিনী যা পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই ধন্দে পড়ে যান যে এটি আদৌ কাল্পনিক নাকি সত্যি ঘটনা। গল্পের সাথে উপরি পাওনা এই সব বিষয়ে গবেষণামূলক অসংখ্য তথ্য, যার থেকে অনুসন্ধিৎসু পাঠক অজানা আরও অনেক রহস্যের সন্ধান পেয়ে যাবেন। সাথে সাথে নিজেরাও রহস্যের অনুসন্ধানে ধাঁধাঁর জট খোলার চেষ্টাতেও সচেষ্ট হবেন। কি সেই ধাঁধাঁ?

“প্রিয়নাথের শেষ হাড়,

মুরের কাব্যগাথা,

গণপতির ভূতের বাক্সে,

তারিণীর ছেঁড়া খাতা।”

 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ