ভারতের প্রাদেশিক চিত্রকলার বিষয়ে বলতে গিয়ে
পূর্ববর্তী পর্বে থাংকা, মণ্ডল, ওরলি, কলমকারী, পটচিত্র, তাঞ্জর প্রভৃতি চিত্রকলার
বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলাম। আজ এই বিষয়েই আরও কিছু ভিন্ন ঘরানার চিত্রকলার সাথে
পরিচয় করাব।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বহু জাতি-উপজাতির
বাস। প্রতি জাতি ও উপজাতিদের মধ্যেই নিজস্ব ঘরানার চিত্রকলা বর্তমান। রঙ তুলির টানে
নতুন কিছু সৃষ্টির আকর্ষণ চিরন্তন, তাই এই বিষয় জাত- ধর্ম-প্রদেশ-দেশ কোনও কিছুরই গণ্ডীতে
আবদ্ধ না থেকে বিস্তৃত হতে থাকে স্বমহিমায়। হতে পারে সেই সব চিত্রকলা অপর কোনও চিত্রকলার
থেকেই উদ্ভুত এবং অনুকরণের ফলেই সৃষ্ট, কিন্তু তার মধ্যেই নিজেদের কল্পনা ও সংস্কৃতির
মেলবন্ধন ঘটিয়ে সেগুলি নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। প্রতি চিত্রকলাতেই তাই
পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট বর্তমান- তা সে আঁকার শৈলীতেই হোক বা সরঞ্জামেই বৈচিত্রেই হোক না
কেন।
- ফাদ বা ফাডঃ
ফাদ বা ফাড চিত্রকলার উৎস রাজস্থানে। রাজস্থানের আদিবাসী চিত্রকলার মধ্যে ফাদ বা ফাড চিত্রকলা প্রাচীনতম।
এই চিত্রকলাও মূলত একটি স্ক্রোল পেইন্টিং ধরণের; অর্থাৎ ১৫ ফুট বা ৩০ ফুট লম্বা ও ৫ ফুট চওড়া এবং মোটা কাপড়ে বা ক্যানভাসে
পরপর চিত্র আঁকা হয়। মূলত লোকদেবতা ‘পাবুজি’ বা দেবনারায়নকে
এই চিত্রকলার বিষয় করা হয়েছে। এইটি একধরনের ধর্মীয় স্ক্রোল চিত্রকলা। প্রাকৃতিক রঙের
বিশেষ করে সব্জির রঙের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয় । দেবতা পাবুজির বিভিন্ন কীর্তিকলাপ
এই চিত্রের মূল উপজীব্য।
- পিথোরা চিত্রকলাঃ
মধ্য গুজরাতেরর রথওয়া, ভিল ও ভিলালা উপজাতিদের মধ্যে এক বিশেষ
প্রকারের ধর্মীয় চিত্রকলা হল “পিথোরা” চিত্রকলা। বাড়ির ভেতরের তিনটি দেওয়ালে এই চিত্র
অঙ্কন করা হয়। সংসারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আনার উদ্দেশ্যে এই চিত্র অঙ্কন করা হয়।
এই চিত্রে প্রকৃতিকে অনুকরণের চেষ্টা করা হয় না। এটিকে শুধুমাত্র চিত্রকলা রূপে নয়,
ধর্মীয় আচাররূপেও গণ্য করা হয়ে থাকে। সাধারণত দেবতাকে তুষ্ট করতে বা কুশক্তিকে বিতাড়নের
উদ্দেশ্যে আঁকা হয়। সাদা বা রঙিন চকের গুঁড়োই এই চিত্রকলার মূল সরঞ্জাম রূপে ব্যবহৃত
হয়। গুজরাত ছাড়া মধ্য প্রদেশের উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যেও এই চিত্রকলার প্রচলন আছে। বিশেষত
বিবাহের সময়ই এই চিত্র অঙ্কন করে নব দম্পতির সুখী জীবনের কামনা করা হয়।
- ভিল চিত্রকলাঃ
মধ্যপ্রদেশ,
গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানের বেশ কিছু অঞ্চলে বসবাসকারী “ভিল” সম্প্রদায়কে মহাভারতের
বীর একলব্যের উত্তরসূরী রূপে গণ্য করা হয়। ভিল চিত্রকলাও মূলত ধর্মীয় আচার ভিত্তিক
চিত্রকলার অন্তর্গত। অন্যান্য চিত্রকলার ন্যায় ভিল চিত্রকলাতেও দেশজ উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার
দেখা যায়। বাড়ির দেওয়ালে আঁকা এই চিত্রকলায়
সূর্য, চন্দ্র, প্রাণিকুল, উদ্ভিদ, নদী, দেব-দেবী প্রভৃতির আকৃতি চিত্রিত হয়। কিংবদন্তী
ঘটনাসমূহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষামুলক কাহিনী এই চিত্রকলার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা
হয়।
- কুরুম্বা চিত্রকলাঃ
পশ্চিমঘাট
পর্বতমালার কোলে অবস্থিত নীলগিরি অঞ্চলের উপজাতিদের দ্বারা সৃষ্ট একক ও ভিন্ন ধরণের
চিত্রকলা হল কুরুম্বা চিত্রকলা। নীলগিরির কুরুম্বা গ্রামের মন্দিরের রক্ষাকর্মীদের
পরিবারের পুরুষ বা পুরোহিতদের দ্বারা এই চিত্র অঙ্কন করা হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় আচারকে
চিত্রের সাহায্যে ফুটিয়ে তুলে লোকশিক্ষা দানই এই চিত্রকলার মূল উদ্দেশ্য। পরিবারের
মহিলারা এই চিত্রের চারপাশে বর্ডার ও মেঝেতে কোলাম এঁকে এর সম্পূর্ণতা দান করেন।
- মহীশূর চিত্রকলাঃ
কর্ণাটকের
মহীশূর রাজ্যের রাজারা এক বিশেষ প্রকারের চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যা বর্তমানে মহীশূর
চিত্রকলা নামে খ্যাতিলাভ করেছে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের অজন্তা গুহাচিত্রের অনুকরণে
সৃষ্ট এই চিত্রকলায় হিন্দু দেব-দেবীর বিভিন্ন আখ্যান বর্ণনা করা হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক
সামগ্রী থেকে রঙ ও কাঠবিড়ালীর লেজের লোম দিয়ে তৈরি তুলির ব্যবহার করে এই চিত্রগুলি
আঁকা হয়। আঁকার জন্য পুরনো কাগজের মণ্ড তৈরি করে তাঁর থেকে ক্যানভাস তৈরি করা হয়। অত্যন্ত
সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ রেখার ব্যবহারে নিখুঁতভাবে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়।
- সৌরা চিত্রকলাঃ
উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী
সম্প্রদায় সৌরাদের দ্বারা সৃষ্ট হওয়ায় এই চিত্রকলার নাম সৌরা চিত্রকলা। প্রকৃতির গৌরব
গাথা বর্ণনা করে এই চিত্র অঙ্কন করা হয়। অধিকাংশ চিত্রগুলি জীবনরূপী গাছ বা বনস্পতিকে
ভিত্তি করে আঁকা হয়, যার শাখা প্রশাখায় প্রাণিকূল ও মানব জাতির বাস দেখানো হয়। প্রকৃতির
সাথে মানুষের সুন্দর মেলবন্ধনকে এই চিত্রের মাধ্যমে বোঝানো হয়। ওরলি চিত্রকলার ন্যায়
এটিও জ্যামিতিক আকারের সমন্বয়ে সৃষ্টি হলেও এদের প্রকাশের ভঙ্গী পৃথক হয়। সৌরা চিত্রকলায়
প্রথমে চারপাশের মোটা সীমানা আঁকা হয়। তারপর ভেতরের চিত্র আঁকা হয়। নারী ও পুরুষের
আলাদা অবয়ব থাকেনা। এর বিস্তৃতি অনেক বেশি হয়।
- পিঙ্গুলি চিত্রকাঠিঃ
মহারাষ্ট্রের সিন্ধুদুর্গ জেলার পিঙ্গুলি গ্রামে
এক বিশেষ ধরণের চিত্রকলার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাচীন কথা বা গল্প আঁকা হয়। এই চিত্রকলা পিঙ্গুলি চিত্রকাঠি
নামে পরিচিত। এই প্রদেশের ঠাকার উপজাতির মানুষরাই প্রধানত এই চিত্রকলাকে প্রজন্মের
পর প্রজন্ম ধরে প্রচলিত করে রেখেছেন। এই চিত্রকলার বা এই শিল্পের বৈশিষ্ট হল এটি শুধুমাত্র
আঁকাই হয় না। শিল্পীরা প্রতিটি আঁকার সাথে গানও রচনা করেন। গানের মাধ্যমে চিত্রটির
বর্ণনা করে তার প্রচার করেন।
- পিচওয়াই চিত্রকলাঃ
- মঞ্জুষা চিত্রকলাঃ
বিহারের
ভাগলপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক চিত্রকলা হল মঞ্জুষা চিত্রকলা। ভাগলপুরের
বিষহরী পূজার সাথে জড়িত এই চিত্রকলা বিহার ব্যতীত আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের মনসা পূজার সাথেও
জড়িত। কিছু কিছু জায়গায় এই চিত্রকলা বিয়ের কালরাত্রির দিনেও আঁকা হয়। বহু প্রাচীন এই
চিত্রকলা প্রাচীন অঙ্গদেশে প্রসার লাভ করার ফলে একে আঙ্গিকা চিত্রকলাও বলা হয়।
- ক্ষুদ্রাকৃতি বা মিনিয়েচার চিত্রকলাঃ
মিনিয়েচার শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ
miniāre (to colour red) থেকে যার অর্থ লাল মেঠো সিঁদুর।
মধ্য যুগে ইউরোপের লাল মেঠো সিঁদুর দিয়ে পুস্তক বা পুঁথি চিত্র প্রচলন ছিল। এভাবে
হাতে লেখা পুস্তক বা পুঁথির অভ্যন্তরে স্বল্প পরিসরে যে ক্ষুদ্র আকৃতির চিত্র বা অনুকৃতি
করা হত সেটি মিনিয়েচার পেইন্টিং নামে পরিচিত। অর্থাৎ মিনিয়েচার
চিত্রকলা হল এমন এক ধরনের চিত্রকর্ম যাতে কোনো ধরণের বিষয়ে সম্যক বিবরণ দেয়া থাকে
না- ছোট ছোট চিত্র আঁকা থাকে। ভারতবর্ষে মোগল সম্রাট হুমায়ূন এই চিত্রকলার সমৃদ্ধি ঘটান। মুঘলরা ইরানি, পারসিয়ান, তুর্কি, চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারতের
হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ চিত্র শিল্পকলার মিশ্রণ ঘটিয়ে অপূর্ব ও অভিনব মুঘল মিনিয়েচার
উদ্ভব করেন। পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
হাত ধরে এই বিশেষ চিত্রকলা বাংলায় বিস্তার লাভ করে।
এই সমস্ত চিত্রকলা ব্যতীত আরও বহু প্রকারের চিত্রকলা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিভিন্ন পরিবারেও প্রচলিত আছে। প্রত্যেক প্রদেশের প্রত্যেক জাতি ও উপজাতির এবং অবশ্যই প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্বতায় ভরপুর সমস্ত চিত্রকলাগুলি স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। পরবর্তী কালে বিভিন্ন চিত্রকলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি। পাঠকের কাছে অনুরোধ রইল যদি কেউ নিজ অঞ্চলের কোনও অজানা অচেনা চিত্রকলা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করান, আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
0 মন্তব্যসমূহ