এই লেখাটি জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
তো সেই দিনের কথা, যেদিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি থামার পর আমি আর বুনি
গেলাম সেই বুড়ো বটের মাঠে। মিঠে একটা বিকেল ছিল বটে! বৃষ্টি হওয়ার পর ঠান্ডা
ঝিরঝির বাতাস বইছিল, আর ডাকছিল কোকিল।
আমি লুকোচুরি খেলতে খেলতে হঠাৎ
বুঝতে পারলাম আমি কীসে যেন পা দিয়ে ফেলেছি। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি বটগাছের ঝুরির
নীচে অসংখ্য ডিম। সেই ডিমগুলোর মধ্যেই কয়েকটাতে হয়তো ভুলবশত পা পড়ে গিয়েছিল। ডিমগুলোর আকার
পায়রার ডিমের মতো কিন্তু রঙ একটু লালচে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে দেখি সবুজ রঙের
ডাহুক পাখির মতো দেখতে একটা পাখি। পাখিটির
পিছু পিছু সবুজ রঙের ছোট ছোট ছানা গুলো ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।
আমার বুঝতে বাকি রইল না ওই ডিমগুলো
এ সবুজ পাখিটারই ডিম। আমার ভীষণ খারাপ লাগলো, সাত সাতটা ডিম আমি এভাবে নষ্ট করলাম!
এতক্ষণে আমার বোন আমার পাশে এসে
দাঁড়িয়েছে। সে তো আর একটু হলেই কেঁদে ফেলবে মনে হলো। বুনি সর্দি লাগা গলায় আমায়
বলল-“ওই পাখি তোকে অভিশাপ দেবে দেখিস! ”
আমি বললাম পাখির অভিশাপে মানুষের
কিছু হয় না।
তারপর সেদিন আরও অনেকে বুড়ো বটের
মাঠে খেলতে এসেছিল। আমি তাদের সাথে ক্রিকেট খেলেছিলাম। তারপর আমরা বাড়ি ফিরে আসি।
***********
মাঝরাতে টয়লেট করতে বাইরে বেরোলাম। আমাদের বাথরুমটা
ঘরের সীমানার একেবারে এক প্রান্তে। সত্যি ওই বয়সেও আমার ভূত-প্রেত জাতীয় কোনো
ভয় ছিল না। তাই আমি মা বাবাকে না জানিয়েই উঠে পড়তাম। পূর্নিমার চাঁদ তখন মধ্য
গগনে, হঠাৎ আমাদের গোয়ালঘরের সামনে
অস্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা হালকা সবুজ রঙের বিশালাকার পাখি। আমি তো খুব অবাক হয়ে
গেলাম। হাতে আমার আলো ছিল, কিন্তু আলো ফেলতেই আর পাখিটাকে দেখতে পেলাম না। আবার আলো
নিভতেই সে মূর্তিমান হয়ে যায়। বারংবার ব্যাপারটা ঘটতে লাগলো। আমি ঠিক করলাম, পাখিটার কাছে আমি যাবো।
কিন্তু যতই পাখিটার দিকে এগোই,মনে হচ্ছিল ততই সে পিছিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। খুব মজা তো!
পাখিটা দেখতে অনেকটা বুড়ো বটের মাঠে দেখা পাখিটার মতো। কিন্তু ওর আকার ছিল
উটপাখির মতো। এভাবে এগোতে এগোতে আমি একটা কাঁটা ঝোপের মধ্যে পড়লাম। সারা গায়ে
তখন আমার রক্তারক্তি কান্ড। আমি কোনোমতে উঠতে দেখি অচেনা পাখিটা তার ভয়ঙ্কর চঞ্চু
নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার গা হঠাৎ ছমছম করে
ওঠে। এ কী দেখছি আমি! আমার বদ্ধমূল ধারণা হলো ওই সবুজ পাখি তার বিশাল চঞ্চু
দিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলবে। আমি কোনো মতে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম।
এরপর থেকে আমি প্রায়ই সবুজ পাখির
স্বপ্ন দেখতাম, ভয়ানক ভয়ানক সেসব স্বপ্ন। এসব
স্বপ্ন আমি তখনও কাউকে বলিনি।
একদিন হঠাৎ বুনি বললো-“দাদা, চল বুড়ো বটের মাঠে যাই। ”
আমার তো ভয়ে গা শিউরে উঠলো।
নানারকমের বাহানা দিয়ে তাকে সেখানে যেতে
বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা।
কী বুঝতে পেরে সে বললো,“তোমাকে পাখিটা অভিশাপ দিয়েছে, তাই তো তুমি যেতে চাইছো না। আর ডিমগুলো ভেঙে কোন মুখে তুমি
যাবে! ”
আমার তাকে পিঠে এক কিল মারতে মন
হোলো। কিন্তু মারলাম না, তাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। সেও ভীষণ
ভয় পেয়ে গেল।
আমি বললাম কী করা যায় বলতো। সে
চটপট করে নিদান দিল।
*******
নিদান মতো আমি বুড়ো বটের পুকুরে
স্নান করতে গেলাম। ঘরে যদিও ওসব ঘটনা নিয়ে কিছু বলিনি। বুনিও আমার সঙ্গে
গিয়েছিল। ভালোভাবে চান করার পর বুড়ো বটের তলায় যেখানে ডিমগুলো ছিল সেখানে এলাম।
যদিও এখন সেখানে ডিম নেই, সেগুলো ফুটে নিশ্চয় বাচ্চা বেরিয়েছে। আমি সেখানে জায়গাটা ভালোমতো পরিস্কার
করে ধুপ জাললাম, আর একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে ওই বিশাল বুড়ো বটটা সাতবার প্রদক্ষিণ করলাম।
তারপর পাখিটার বাসার কাছে গিয়ে
ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। অবাক হয়ে দেখি
সেই সবুজ অচেনা পাখিটি বাসা থেকে বের হয়ে আসছে, সাথে তার ছোট ছোট ফুটফুটে বাচ্চা। আমাদের দিকে ও ঘাড়
ঘুরিয়ে তাকালো। তারপর আমার কাছে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসলো। কেন জানিনা আমার মনে হোলো
পাখিটি কাঁদছে!
কিছুক্ষণ বসার পর সে আবার
বাচ্চাদের নিয়ে খাবার খুঁজতে বের হলো। বুনি এতক্ষণ আড়ালে সব দেখছিল, ফিরে এসে বলল-“পাখিটি নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করে
দিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি। ”
আনন্দে আমার চোখে জল চলে এল। আমি
বুনিকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম-“তুই এসব জানলি কী করে?”
সে বললো কোন একটা বইয়ে সে নাকি
এটা পড়েছে। এরপর আর কোনোদিন অমন স্বপ্ন দেখিনি আমি।
তারপর কত বছর কেটে গেল। পাখিটার কথা আজও মনে পড়ে। পৃথিবীতে ওর মতো ক্ষমাশীল আর কি কেউ আছে!
0 মন্তব্যসমূহ