“There is Something About this city. সেটা কি বলতো?” শহর ছেড়ে যাবার প্রশ্নে জানতে চায় 'প্রতিদ্বন্দ্বী'র সিদ্ধার্থ। দুঃসহ বেকারত্বের জীবনে থেকেও শহর ছেড়ে যেতে নারাজ সিদ্ধার্থ। বন্ধু শিবেনের ভাবনাতেও খুব একটা ব্যত্যয় নেই। উত্তরে সেও তাই বলে- “Life….Rotten Life…..কিন্তু তাও Life. অন্য সব জায়গা হয় dead, না হয় ধুঁকছে। ”
মহানগর সম্বন্ধে মানিকদার কি ভাবনা তা ঠাহর করা এতটা সহজ নয়। তবে এটুকু বুঝতে বোধহয় দ্বিধা থাকার কথা নয়, তাঁর এই শহরের প্রতি ভালোবাসা বা আবেগের কমতি ছিল না কোন অংশে। তাইতো, হাতের তালুর মতো চেনা শহরটার মানুষ, সমাজের প্রতিনিয়ত ও সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পালাবদল, প্রজন্মের চাহিদার প্রকাশভঙ্গিতে দিয়েছেন গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়।
'কলকাতা ত্রয়ী' বলতে মৃণাল সেনেরও তিনটে ছবির নাম আসবে। যথাক্রমে- 'ইন্টারভিউ'(১৯৭১) 'কলকাতা ৭১'(১৯৭২) আর 'পদাতিক'(১৯৭৩)। তবে আমাদের এই আলোচনা যে তাদেরকে ঘিরে নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।
চলচ্চিত্র জগতে যার পরিচয় 'পথের পাঁচালী'(১৯৫৫)-র মাধ্যমে, গ্রাম্য ন্যারেটিভে তার সুচারু নির্মাণশৈলী সম্বন্ধে কোন সমালোচকই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত নন। তাইতো তাঁর প্রথম, দ্বিতীয় (অপরাজিত, ১৯৫৬) আর পঞ্চম (অপুর সংসার, ১৯৫৯) চলচ্চিত্র নিয়ে সৃষ্ট 'অপু ত্রয়ী' বিশ্ব চলচ্চিত্রের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। এহেন পরিচালক শহুরে ন্যারেটিভে মানুষ, পরিবার এবং সম্পর্ককে পর্যবেক্ষণ করেন কিভাবে, তার প্রথম পরিচয় মেলে মহানগর(১৯৬৩)-এ। তবে সেখানে তাঁর চিত্রনাট্যে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল সম্পর্কের টানাপোড়েন, নারী-পুরুষের কর্মপরিসর, সহাবস্থান ও সমমর্যাদার সম্ভাবনার কথা। আদর্শ ও স্বার্থের সংঘাতে আদর্শই সেখানে জয়ী, ক্লাইম্যাক্সেও প্রতিধ্বনিত হয় সুগভীর আশাবাদ।
• কোথায় দাঁড়িয়ে এমন নাগরিক ট্রিলজি?
তবে রায় বাবুকে জানার শেষটা কোথায়? 'অপু ত্রয়ী'র ১০ বছর পেরোনোর পর ১৭ খানা ছবি আর অগণিত পুরস্কারের পালক তখন তার মুকুটে। তা সত্ত্বেও কেউ এতটা ভিন্ন শৈলী দেখাতে পারেন নিজের কাজে? মহানগরীর আখ্যান নয় শুধু এবার, নাগরিক জীবনের প্রতি সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ- সত্যজিৎ এলেন সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিকে।
সত্তর দশকের পুরুষতান্ত্রিক তারুণ্যকে প্রধান চরিত্র করে তাই নির্মিত হল 'কলকাতা ত্রয়ী', ছবিগুলো যথাক্রমে 'প্রতিদ্বন্দ্বী'(১৯৭০) 'সীমাবদ্ধ'(১৯৭১) আর 'জন অরণ্য'(১৯৭৬)। তিনটে সিনেমাতেই সাদৃশ্যের সংখ্যা প্রচুর- বিশেষত সমসাময়িক কলকাতার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর আর জীবনযাত্রার যথেষ্ট বাস্তবসম্মত চিত্রায়নে। বাংলা সময়টাই তখন টালমাটাল, প্রতিনিয়ত এখানে ঘটে চলেছে আদর্শের সংঘাত। দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর সামাজিক অসাম্য থেকে জন্ম নেয়া নৈরাশ্য তরুণ প্রজন্মকে চালিত করে বিভিন্ন সমাজবাদী এজেন্ডার শরণাপন্ন হতে, সন্ত্রাসের পথে নামতে। এই প্রজন্মের মনে তখন সিস্টেমের প্রতি ঘোর অবিশ্বাস, ঘৃণা আর আক্রোশ। পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে কলকাতা সেই 'বৈপ্লবিক চিন্তাধারা'রই পীঠস্থান যেন। তবে আমাদের তিনটে ছবিরই প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ, শ্যামলেন্দু কিংবা সোমনাথের মধ্যে কেউই কিন্তু সেই তথাকথিত চিন্তাধারার অনুপন্থী নয়।
প্রথম আর তৃতীয় চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট সিদ্ধার্থ ও সোমনাথ, দুজনেই স্নাতক - একটা চাকরির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো, সদা ছুটন্ত দুই জীব। কিন্তু ধুঁকতে থাকা অর্থব্যবস্থায় চাকরির হাহাকার প্রকট। দুটো সিনেমাতেই চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্যগুলি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং সময়োত্তীর্ণ। ইন্টারভিউ এর প্রশ্নে জেরবার হতবুদ্ধি যেকোনো যুবক আজকের দিনে বসেও সিদ্ধার্থ আর সোমনাথের জায়গায় নিজেকে অনুভব করতে এক প্রকার বাধ্য।
কিন্তু দ্বিতীয় চলচ্চিত্রে শ্যামলেন্দুর ছবিটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা ক্যানভাসে আঁকা। সে জীবনের সর্বত্র সফল এক মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ, ঈর্ষণীয় যার জীবনযাপন, কোম্পানির পরিচালক হওয়ার প্রতিযোগিতায় জিততে বদ্ধপরিকর।
তিনটা ছবিতেই (বিশেষত প্রথম দুটিতে) বেশ ভালোভাবে দেখতে পাই, পুরুষ প্রোটাগনিস্টদের জীবনে নারী চরিত্রসমূহের এর সাথে সম্পর্কের প্রভাব কতটা তীব্র। তাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তিস্বার্থ আর নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে পিষে যেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবুও প্রচেষ্টার খামতি নেই। কেননা নিজেদের বহু আকাঙ্ক্ষিত জীবনযাত্রায় একটু ঠাঁই খুঁজে নেওয়াটা তাদের সকলেরই উদ্দেশ্য।
• ফিরে দেখি আরো
একবার:
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন প্রথম ছবিটি। 'প্রতিদ্বন্দ্বী' (The Adversary)-র সিদ্ধার্থকে দেখেই মনে হয়, তার আশেপাশে কোনো নারীর উপস্থিতিই খুব একটা স্বচ্ছন্দে থাকতে দেয় না তাকে। হতে পারে সেই নারী কখনো বসের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে অভিযুক্ত, মডেল হওয়ার ইচ্ছা পোষণকারী সিদ্ধার্থের সুন্দরী বোন, কখনো আবার লাস্যময়ী যৌনকর্মী কিংবা স্বল্প দিনের পরিচিত বান্ধবী তথা প্রতিবেশিনী। রাস্তার ওপার থেকে অপরিচিত স্ত্রীলোককে দেখেও তার মেডিকেল কলেজের Lymphoid Tissues of the Breast এর ক্লাসের কথা মনে পড়ে যায়। মেটাফরের এরকম আরো বহু অদ্ভুত সমাহার অনন্য করে তুলেছে প্রতিদ্বন্দ্বীকে। সিদ্ধার্থের জীবনের সবচেয়ে সংকটময় আর চরম বিব্রতকর মুহূর্তগুলোতে হঠাৎ নেগেটিভ এফেক্ট প্রয়োগ করে যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক, তা এককথায় অনবদ্য। এই নেগেটিভ এফেক্ট সিদ্ধার্থের এই নেতিবাচক আর নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির রূপক যেন। ভাই আর বোনের সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী আদর্শের দোলাচলে সিদ্ধার্থ দ্বিধাগ্রস্থই রয়ে যায়, জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারেনা। বন্ধু শিবেনের কথা ধার করেই বলা যায়, সিদ্ধার্থ আদতে থিঙ্কার; যা করবে না, শুধু তাই ভাববে। নিজের এই সত্তাই সিদ্ধার্থের চিরন্তন প্রতিদ্বন্দ্বী। যার সাথে প্রতিনিয়ত তার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।
অন্যদিকে ‘সীমাবদ্ধ’(Company Ltd.)- এর শ্যামল আর তার স্ত্রীকে দেখতে পাই শ্যালিকা টুটুলকে আপ্যায়ন করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করতে। টুটুল (চরিত্রায়ণে শর্মিলা ঠাকুর), যে কিনা দুই সপ্তাহের জন্য থাকতে এসেছে দিদির বাড়িতে। বাড়িতে নিত্যদিনের পার্টি, ক্লাবে নাইট আউট, রেসের ময়দান আর জামাইবাবুর কেরিয়ারের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফটা দেখে এমন জীবন ঈর্ষণীয়ই মনে হয় টুটুলের। কিন্তু যখনই সে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়, পদোন্নতির মোহে এমন সফল মানুষের মানসিকতাও কতটা সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে যায়, এক লহমায় টুটুলের চোখে শ্যামল নেমে যায় অনেকটা নিচে। টুটুলের সেই আশাভঙ্গের দৃশ্য ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। সেই দৃশ্য থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শ্যামলেন্দুর উচ্চাভিলাষা, সাফল্য আর সামাজিক পদমর্যাদার প্রতি সে কতটা নির্মোহ এখন। শ্যামলের বিবেকের কাছেও অবশেষে মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায় তার তথাকথিত সাফল্য। সিনেমার শেষের সেই অনবদ্য দৃশ্য যাতে প্রায় কোন সংলাপই ছিল না, নিঃসন্দেহে এই ট্রিলজির অন্যতম মাইলফলক।
সীমাবদ্ধের মতোই ‘জন অরণ্য (The Middleman)' নির্মিত হয়েছিল মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস কে ভিত্তি করে। ছবির শুরু হয় পরীক্ষা কেন্দ্রের একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে যেখানে চলছে নকলের মহোৎসব। শিক্ষকরা মুখ বেজার করে ভীত ভঙ্গিতে পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছেন। কারো কারো মতে, খুব সূক্ষ্মভাবেই পরিচালক তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী ছাত্রদের দৌরাত্ম্য কে ইঙ্গিত করেছিলেন। গণ টোকাটুকির বাজারে ভালো পরীক্ষা দিয়েও প্রোটাগনিস্ট সোমনাথের কপালে জোটে কোন রকমে পাশ মার্কস; শুরু হয় হতাশার প্রহর গোনা। প্রেমিকার বিয়ে বেকারত্বের যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। চাকরি জোগাড়ে অক্ষম সোমনাথের তাই বাবা দাদার সাথে স্বাভাবিক কথোপকথনেও কষ্ট বোধ হয়। অন্যদিকে শুভাকাঙ্ক্ষী বৌদির উৎসাহ বন্ধুসুলভ আচরণ তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি জোগায়। বৌদির কাছেই নিজের দুঃখ-কষ্ট, আশা-প্রত্যাশা, অভিব্যক্তির প্রকাশ তার।
অজস্র নিষ্ফলা ইন্টারভিউ এর পর সোমনাথের দেখা হয় পূর্ব পরিচিত বিশুদা’র সাথে। দাদা সুলভ এই মেন্টরের পরামর্শেই সোমনাথ প্রবেশ করে ব্যবসার জগতে। বিনা পুঁজিতে তার কাজ হয়ে ওঠে Middle man এর; সোজা বাংলায় সোমনাথ যাকে বলে, দালাল।
কলার খোসায় পা পিছলে আছাড় খাওয়ার দৃশ্যটা কি তাহলে এই নৈতিক পদস্খলনকেই ইঙ্গিত করে? জানা নেই। তবে কালের ফেরে সেও ক্রমশ বুঝতে পারে, এই মিডলম্যানের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে ও স্বার্থক্ষয় করতে হবে অন্য কারুর। একজনের ক্ষতি না ঘটিয়ে অন্য কেউ কখনই লাভবান হতে পারেনা। ‘সীমাবদ্ধ’ এর মতো এই ছবিতেও ক্লাইম্যাক্স নিয়ে আসে প্রোটাগনিস্ট এর অভাবনীয় সাফল্য। তবে তার বিনিময়ে তাকে বিকিয়ে দিতে হয় নিজের নৈতিক মূল্যবোধকে। বন্ধুর বোনের দালালি করতে হয় তাকে নিজের ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায়, বাধ্য হয়েই একপ্রকার। সেখানে সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে, স্বেচ্ছায় করতে চায়নি সে কাজ। হয়তো সবটা তার ইচ্ছে মতোই হয়নি। কিন্তু শেষমেশ পেরেছে কি আদর্শ অনুসরণ করতে? আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থের জয়ই মুখ্য হয়ে উঠেছে এখানে।
আসলে সোমনাথ একা নয়। ‘কলকাতা ত্রয়ী’র প্রোটাগনিস্টদের কেউই ব্যক্তিস্বার্থের মোহ ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। সিদ্ধার্থ ভেবেছিল বিপ্লব ভালো, কারণ এতে করে তার চাকরির পথ সুগম হবে। শ্যামল নিজের পদোন্নতির নেশায় শ্রমিকদের ক্ষতির চিন্তা করতে দ্বিধাবোধ করেনি; অন্যদিকে সোমনাথ নিজের সংস্থান সুনিশ্চিত করতে দালালি করতে বাধ্য হয়েছে বন্ধুর বোনের। এরা কেউই হয়ত খুব বেশি সমাজবিরোধী নয়, কিন্তু এরা কেউ সৎসাহসীও নয়। আত্মকেন্দ্রিকতার দায় থেকেও মুক্ত রাখা যায় না এদের কাউকে।
সত্যজিৎ নিজে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারী ছিলেন, সে বিতর্কে যেতে চাই না। তবে, কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপই তার খুব একটা মনঃপুত ছিল না হয়তো। ব্যক্তির উন্নতিকল্পে বিশ্বাসী মানিকবাবুর ‘কলকাতা ত্রয়ী' তাঁর নিজ চিন্তাধারারই অস্পষ্ট চিহ্ন বহন করে সম্ভবত।
• তুলনায় যেতে
পারি কি ?
তিনটে চলচ্চিত্রের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা আনা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে জানা নেই। তবে ব্যক্তিগত পছন্দের গুরুত্বকে কখনো অস্বীকার করা যায় না। আর সেই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখেই, কিছুটা হলেও এগিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছি ‘সীমাবদ্ধ’কে।
কারণ যথেষ্ট আছে; যার প্রথম এবং অন্যতম, প্রধান চরিত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য অভিনয়। চোখের চাহনি, শব্দ উচ্চারণের প্রগলভতা এবং তার সাথে যে Angry Young Man লুক এনেছেন ভদ্রলোক, এই চরিত্রের সাথে তা যথার্থ মানানসই। পাশাপাশি চিত্রনাট্যে মেটাফর হিসেবে পাখির ডাক, কখনো কঙ্কাল কিংবা একদম শেষ দৃশ্যে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে শববাহকদের মুখে “রাম নাম সত্য হে” ধ্বনির প্রয়োগ চলচ্চিত্রকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। তিন চরিত্রের মধ্যে সিদ্ধার্থের আত্মোপলব্ধিই দর্শককে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করতে পারে বলে মনে হয়।
মজার ব্যাপার হলো, সিদ্ধার্থ চরিত্রে ধৃতিমান, শ্যামল চরিত্রে বরুণ চন্দ, সোমনাথের চরিত্রে প্রদীপ মুখার্জী- তিনজনেরই চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ এই তিনটে ছবির মধ্য দিয়ে। তিন অভিনেতাই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে অবদান রেখে চলেছেন এই শিল্পজগতে, অক্ষুণ্ণতার সাথে।
• কতটা গুরুত্ব পেল
নারী চরিত্র?
নারী চরিত্র পাঠ করতে হলে নাকি বারবার দেখতে হয় সত্যজিতের সিনেমা। তার বহু সিনেমায় তিনি তার উপযুক্ত নিদর্শন রেখেছেন। নারীর মন এবং মননকে যে মুনশিয়ানার সাথে তুলে ধরতে পারেন তিনি, ততটা মমত্বের সাথে খুব কম পরিচালকই পারেন। তাই তার বহু ছবিতেই নারী চরিত্র মুখ্য এবং নির্ণায়ক।
কিন্তু এখানেই ব্যত্যয় ‘কলকাতা ত্রয়ী'। এখানে নারী চরিত্রের গুরুত্ব বিদ্যমান। তবে এই যাত্রায় তিনি নারী চরিত্রকে সহযোগী হিসেবেই রেখেছেন শুধু, ব্যাকসিটে। কেবলমাত্র ‘সীমাবদ্ধ’ এর টুটুল চরিত্রই মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। তবে টুটুল কিন্তু কখনোই আরতি (মহানগর,১৯৬৩), অপর্ণা (অপুর সংসার, ১৯৫৯) বা চারুলতা (চারুলতা,১৯৬৪) নয়। তার চরিত্র যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা মুখ্য নয়।
পরিশেষে বলতে হয়, বারবার এই ট্রিলজির দিকে ফিরে দেখার অভিজ্ঞতাটা কিন্তু অনন্যসাধারণ। পরিচালক জীবনের এই পর্যায়ে এসে সত্যজিৎ বেশ ভিন্নধর্মী এক শৈলী রপ্ত করে ফেলেছিলেন। চরিত্রায়ন কিংবা গল্পের বাঁধনে তিনি বেশ হালকা একটা ধাঁচ বজায় রেখেছেন। আজকের দিনের বিভিন্ন সামাজিক এবং নৈতিক ঘটনাক্রমেও তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। প্রত্যেকটি কাজ যথেষ্ট বিন্যস্ত এবং গভীরতর বোধসম্পন্ন। কিন্তু দেখতে গিয়ে কখনোই ক্লান্ত বা বিষণ্ণ বোধ হয় না।
0 মন্তব্যসমূহ