এই গল্পটি জুন ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
আদতে প্রাচীন মগধ অতি শুকনো দেশ ছিল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে ইরি ধানের সোনালী সমুদ্র আর বিস্তর বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে নীলচে-ধূসর আচলখানা মেলে ধরেছেন স্রোতস্বিনী গঙ্গা। পাটলিপুত্রের কাছে তার ডান হাতখানি এসে ধরেছেন সোন। সোনের ধারা বেয়ে বেনা ঘাসের নৌকাগুলো গঙ্গার সাথে একে একে এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে তাম্রলিপ্ত বন্দরের অভিমুখে। তাম্রলিপ্ত থেকে এই ঘাস কলিঙ্গ, অস্মক এমনকি সিংহল দেশে পর্যন্ত রপ্তানী হয়। মাদুর সহ বিভিন্ন গৃহস্থালির নানান উপকরন নির্মাণে তার বিস্তর ব্যবহার।
চারিদিকের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নানারকম চৈতালি ফসলের রঙে রঞ্জিত। সোনের ধারে একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের প্রান্তে একটি শতাব্দী প্রাচীন পাকুড় গাছ তার ঝুড়িগুলো নদীর জলে ডুবিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে। বেলা প্রায় দিপ্রহর। উজান বেয়ে পাটলিপুত্রের দিক থেকে একখানা তালপাতার ছাউনি দেওয়া নৌকা এসে ভিরলো গাছটির কাছে।
নৌকার ছই থেকে
পায়ে কৃতদাসের বেঁড়ি পরা এক বছর বাইশের যুবককে নিয়ে বেরিয়ে এলেন গদাধর
কবিরাজ। দাসের নাম রিপুদ্দমন।এই দৃশ্য এই
গ্রামের ঘাটটিতে নতুন নয়। এই নিয়ে পরপর তিনি তিনটি কৃতদাস নিয়ে ফিরলেন। কিন্তু আগের দুইজনই
পালিয়েছে। আর পালাবেইনা বা কেন, সারাদিন হাড়-প্রবাল-স্বর্ণ-তাম্র চূর্ণ করা ; বাঘ- নেকড়ে, বিষাক্ত সাপের ভয়কে দমিয়ে
রেখে জঙ্গল থেকে গাছ গাছড়া জোগাড় করে আনা, আর এইসব নানা ফরমাসের প্ররিবর্তে দুপুরে একমুঠো
ভাত আর রাতে এক মুঠো ভাজা আমন চাল, আর তার সাথে উপরি পাওনা সর্বক্ষণের সঙ্গী পায়ে আর গলায়
বেড়ি।
মগধরাজ ধননন্দের শাসনে কৃতদাস তো কোন ছাড়, বস্তুতপক্ষে জনসাধারণের
জীবনই হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত সস্তা। নিজের সুবিশাল সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য
প্রজাদের ওপর এত পরিমাণ করের বোঝা তিনি চাপিয়েছেন যে গরীব- মধ্যবিত্তরা ব্যঙ্গ
করে বলতো, “কৃতদাসের জীবন ঢেড় ভালো, খাজনা তো দিতে হয়না বাপু।“ একথা সর্বৈব মিথ্যা ঘোষণা
তো করতে পারিনে তবে একথা বলতেই পারিকৃতদাসে আর জনসাধারণের মধ্যে ওই পরাধীনতার
সামান্য তারতম্যটাই পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক পক্ষের পায়ের বেড়ি চোখে দেখা যায়
আর কারো বেড়ি অদৃশ্য।
আর্যবর্তের বৃজি এবং দক্ষিণের অস্মক ছাড়া আর যে সব ছোট
ছোট প্রজাতন্ত্রী রাজ্য কিছুদিন আগেও মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মধ্যে অন্যতম হিমালয়ের পাদদেশের
পিপ্ললিবন। মগধরাজ ধননন্দ এই পিপ্পলিবনের
ক্ষুদ্র ক্ষত্রিয় গোষ্ঠিকে পরাজিত করেন। বহু নারী পুরুষ বন্দি হয় দাস-দাসীর জীবন
বরণের নিয়তি নিয়ে। বহু নারীর স্থান হয় নগরের গণিকা গৃহে, বহু কর্মঠ পুরুষ কৃতদাস
হিসেবে নগরের বাজারে বিক্রি হয় গরু – ছাগলের ন্যায়।
সেইদিন পাটলিপুত্রের বাজারে নিজের বিশেষ
ঔষধী ঘি বিক্রি করে বেশ ভালো রকম অর্থ
উপার্জনে সক্ষম হয়েছিলেন গদাধর কবিরাজ,
তাই উৎফুল্ল মনে দাসের হাঁটের দিকে যেতেই এই
ছেলেটিকে পছন্দ হয় এবং তাকে দাস হিসেবে কিনে আনেন। গ্রামে প্রভুর ফরমাস পূরণের
লক্ষ্যে জন্য দোকান-বাজার ঘুরে সে জানতে পারল তার আগের দাসদের পালিয়ে যাওয়ার কথা।
কিন্তু তার কাছে এই দাসের জীবন ধননন্দের কারাগারের অত্যাচারের তুলনায় যেন স্বর্গ।
একসময় হঠাৎ করেই মনিবের অত্যাচারে ভাটা পরলো। বেড়ি খুলে গেল, আর মনিব আদেশ করলেন এখন থেকে তার কাজ হবে শুধুমাত্র বাগানের ঘৃতকুমারীর পরিচর্যা ও সময় মতো প্রভূর ঔসধ নির্মাণের কক্ষের দেড়গজ গভীর চৌবাচ্চার পোশ্য কাকড়াবিছে গুলিকে আরসোলা টিকটিকি ইত্যাদি ধরে ধরে খাওয়ানো। কবিরাজ মশাই নাকি এক বিশেষ ধরনের ঔষধি ঘি নির্মাণ করবেন, যার জন্য ওই দুটি অপরিহার্য উপাদান। গৃহস্থালির বাকি কাজের জন্যে দৈনিক তিন আনা মজুরি ধার্য করে হরেরাম মুদির বোবা ছেলেটাকে নিযুক্ত করেছেন কবিরাজ মশাই। প্রভূর এইরূপ পরিবর্তনে খুসি হলেও মনের কোনে একটু সন্দেহ থেকেই যায়। ইতিমধ্যে প্রায় এক মোন ঘি এবং আধ মোন মোম আনিয়েছেন মনিব। বৈশাখী অমাবস্যা আসন্ন। কৃষ্না ত্রয়োদশীতে গোধূলি বেলায় মনিব তার ঝোলা নিয়ে ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “আগামী অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ। আমার মহৌষধী তৈরির আদর্শ সময়। তার জন্য কিছু উপকরণ আনতে যাচ্ছি দেহরী নগরে। আমি ফিরে আসার আগে সমস্ত কিছু গুছিয়ে রাখবি, যেমনটি বলেছিলাম। কিছু যেন ভুল না হয়। “ এরপর ঘাটের দিকে রওনা দিলেন। দূর থেকে সে দেখলো তার মনিবের নৌকা উজানে যাত্রা করলো।
মনিবের আদেশ মতো ঘৃতকুমারীর
পাতা, ঘী, মোম, কাঠ সব ঔষধি নির্মাণের কক্ষে সাজাতে থাকে সে। কাঁকড়া
বিছেগুলো চিমটা দিয়ে চৌবাচ্চা থেকে ধরে ধরে বিশাল কাঁচের বয়ামে রাখে। বিশাল
কড়াইখানা ঘরের মধ্যেই নির্মিত বিশাল উনুনে বসায়। সবকিছু শেষ করে সে মনিবের আদেশ
মতো সামান্য ফলাহার সেরে সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ঘরের দাওয়ায়
বসে। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায়না, একপ্রহর – দুইপ্রহর করে রাত্রি তখন প্রায় শেষের দিকে। কি যেন ভেবে সে
মনিবের ঘর থেকে লাল মখমলে মোড়া একখানা তালপাতার পুথি নিয়ে বারান্দার প্রদীপের আলোয়
ধরে, আর পুথির লেখাগুলো সামান্য পড়েই গা গুলিয়ে ওঠে তার ; পায়ের তলার মাটি যেন এক
লহমায় সরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটু ধাতস্থ হয়ে ভালো করে পুথিটি পড়ে আর বুঝতে
পারে যে সে আসলে কবিরাজের মহৌষধী ঘী এর প্রধান উপকরণ। যার প্রস্তুতি প্রকৃয়ায় তাকে
সহস্র জীবন্ত কাকড়াবিছের সাথে ফেলা হবে ওই
বিশাল কড়াইয়ে। আর যখন বিছের কামড়ে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগের জন্য ছটফট করবে তখন
তাকে ফোটানো হবে বাকি উপকরণ সহযোগে, যার অধিকাংশ নামই তার অজানা। আস্তে আস্তে তার কাছে তার আগের
দাসদের নিরুদ্দেশের রহস্য স্পষ্ট হলো। গত কয়েকদিনে তার ওপর মনিব এর ঐরূপ সদয়
আচরণের কথা ভাবতেই তার নিজেকে বলির পাঠা
বলে মনে হয়।
সূর্য ভগবান তখন পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছেন।
হঠাৎই বাড়ির বাইরে কতোগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। সে তড়িঘড়ি পুথি যথাস্থানে রেখে
এসে নিজের যায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো । ভোর হয়েছে ৷ মনিব ফিরে এসেছেন , তবে একা আসেননি তার সাথে
সাতজন পালোয়ান গোছের লোক। মনে মনে সে একটা কথাই বললো, “পাষন্ড”।সে বুঝতে পারলো পালানোর
চেষ্টা বৃথা। অর্থাৎ মনিবকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা যে সে তার পরিকল্পনা জানে, তাহলেই বিপদ। আর সে জানে
মনিব পরদিন অর্থাৎ বৈশাখী অমাবস্যার সূর্যগ্রহণের আগে তার কোনো ক্ষতি করবেন না।
মনিব রিপুদ্দমনকে আদেশ দিলেন সে যেন তার
মনিবকে বিরক্ত না করে, কারণ সে ক্লান্ত। আর সে যেন তার সঙ্গী এই পালোয়ানদের ভাত
রেধে খেতে দেয় আর ঘরের কাজগুলো গুছিয়ে রাখে।
আগামীকাল অমাবস্যা, সূর্যগ্রহণ ; যা করার এইবেলাই করতে হবে। ক্ষ্যাত্রিয় সে। মরতে সে ভয় পায়না, কিন্তু এরকম মৃত্যুর কথা ভেবে তার মনেও ভয়ের উদয় হলো। তার সাথে জেগে উঠলো প্রতিশোধ আর দুষ্টের দমনের অঙ্গীকার। হাতির পায়ের তলায় পিষে মরতেও রাজি সে, কিন্তু এই পাষন্ডের হাতে কিছুতেই প্রাণ সমর্পণ করবেনা। সে মনে মনে ফন্দি এটে নিয়েছে। মনিব নিজের শয়নকক্ষে যেতেই সে ঔষধের কক্ষে গিয়ে সমস্ত আফিম নিয়ে এসে দুধের সাথে ভালো করে মিশিয়ে রাখলো এবং ভাতের পরে ওই দুধ খেতে দিলো পালোয়ানদের। বেশ তৃপ্তি করে খেলো সবাই। আফিম মেশানো দুধ গলায় ঢালার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমের দেশে যাত্রা করলো। এরপর সে মনিবের ঘরে ঢুকে অকৃতজ্ঞ পাষন্ড বুড়োটার হাত -পা-মুখ বেঁধে ফেললো। এবং তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওই কাকড়াবিছের চৌবাচ্চায় ফেললো এবং পুনরায় বিশাল কাঁচের বয়ায়টি খালি করে দিলো ওই চৌবাচ্চায়। বুড়ো কবিরাজ যন্ত্রণায় গোঙাতে লাগলো। নিজের প্রস্তুত করা মৃত্যুজালে বন্দী হয়ে ছটফট করতে থাকলো।
একছুটে ঘাটে এসে নৌকার দড়ি খুলে স্রোতের টানে
নৌকা ভাসিয়ে চড়ে বসলো রিপুদ্দমন। গন্তব্য ঠিক করলো তাম্রলিপ্ত এবং তারপর বেনা
ঘাসের মাল্লার কাজ নিয়ে কলিঙ্গ কিংবা
অস্মক, অথবা সিংহল।
ক্রমে কালের নিয়মে নগরগুলির যে শুধু আকার- আকৃতি
শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে তাই নয়, কারো কারো নামের
পরিবর্তন ও ঘটেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে মগধের তৃতীয় দেওয়াল চম্পা নদী। কিন্তু সকল পরিবর্তনের সাক্ষী,বহন
করেচলেছেন পরম স্নেহময়ী গঙ্গা। সাক্ষী হয়ে আছেন এইরকম নানান জানা-অজানা, বাস্তব
অবাস্তবের।
কৃতজ্ঞতা
স্বীকার – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ঐতিহাসিক উপন্যাস 'গৌড় মল্লার' এবং মহাশ্বেতা দেবী রচিত ঐতিহাসিক গল্প ‘রোমথা’ থেকে অনুপ্রাণিত।
2 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর লাগল গল্পটা। ইদানিংকালে চটজলদি শেষ হয়ে যাওয়া অনুগল্পের ভীড়ে বেশ অন্যরকম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ উৎস ই-পত্রিকা ❤️
উত্তরমুছুন