
গৌরচন্দ্রিকা
লিফোন দপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী মাধবকৃষ্ণ সাধুখাঁ অত্যন্ত সমজদার লোক।
সেই ইস্কুলের পড়ার সময়ে থেকে শুরু করে প্রতিটা কাজই সে যতটা সম্ভব ভেবেচিন্তে
তবে করেছে। তাদের আর্থিক অবস্থা এখন যথেষ্ট গরম। বারো বিঘার উপর ধানজমি। সংসারে
চারজন লোক। বাবা মা সে আর ছোটো বোন। সংসারের কাজে আগ্রহ তার ছোটোবেলা থেকেই।
জমিজমা চাষবাসের কাজ সেই দেখাশুনা করে। বাবার বয়সও হয়েছে, তার উপর হাঁপের অসুখে
কাহিল। ফলে মাধব অল্প বয়সেই সংসারের প্রধান।
পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সংসারের কাজকর্ম দেখাটা নেহাৎ বেকুবি হবে বলে সংসারের
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে পড়াশুনার কাজটা চালিয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই সে দেরিতে
স্কুলের দরজায় এসেছিল। তার উপর প্রায় প্রতি ক্লাসে একবছর করে দেরিও হয়েছে। ফলে
ক্লাস এইটে দুবারের বার যখন সে প্রায় সব বিষয়েই ফেল করল তখন তার গজানো গোঁফ
দাড়ি কামানো শুরু করতে হয়েছে। তাই কুড়ি বছরের মাথায় তিনবারের বার ফের ক্লাস
এইটের বন্ধ দরজা ফালতু ধাক্কাধাক্কি আর করবে না বলে সে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত
নিল।
এ ব্যাপারে তাকে সমর্থন অথবা বিরোধিতা করার তেমন কেউ ছিল না। ছোটো সংসার।
বৃদ্ধ বাবা-মা। আর আছে একটা ছোটো বোন। তাছাড়া সংসারের হাল তো তার কাছেই।
সংসারের সবাই মোটামুটি তার ওপরেই নির্ভরশীল। মাধব অত্যন্ত চালাক-চতুর ছিল। বছর
দুই পরে নানান সুলুকসন্ধান করে টেলিফোন দপ্তরের ক্যাজুয়্যাল কর্মী হিসাবে ঢুকে
পড়ার একটা সুযোগ সে বার করে ফেলল।
এই সুযোগটা পুরোপুরি বাগাতে গেলে দুটি জিনিসের প্রয়োজন ছিল। নগদ বেশ কয়েক
হাজার টাকা আর ক্লাস এইট পাশ একটা সার্টিফিকেট। প্রথমটা তার কাছে তেমন বড়ো কোনো
সমস্যা নয়। দ্বিতীয়টার ব্যাপারেই একটু দুশ্চিন্তায় পড়ল সে। তারপর খানিক
ভেবেটেবে দেড়হাজার টাকা পকেটে নিয়ে সন্ধের পর হেডস্যারের বাড়িতে গিয়ে কেঁদে পড়ল
-
‘একটা উপায় করুন স্যার। গরীবের ছেলের একটা চাকরি যদি হয়ে যায় আপনার দয়ায়,
তাহলে দুমুঠো খেয়ে পরে বাঁচতে পারব।’
হেডস্যার অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। বেশ দয়ালুও বটে। খুব কড়াকড়ি করা তাঁর ধাতে নেই।
মাধবের কাঁদুনিতে তিনি কিছুটা বিগলিত হলেন। একেবারে বাড়ির ভিতরে তাকে ডেকে নিয়ে
একটা ঘরে বসালেন -
‘তুই আমার পুরনো ছাত্র, বাবা মাধব। ছাত্ররা আমার ছেলের মতো। এসেই যখন পড়েছিস
আমার কাছে তখন তো একটা উপায় খুঁজে বার করতে হয়। তবে কিনা তুই দু’দুবার ক্লাস
এইটে ফেল, তাও আবার সব বিষয়েই ফেল! এবার আমি তো বড়ো সত্য-সংকটে পড়ে গেলাম
মাধব। কী যে করব ... কী যে করা উচিত আমার সেটাই তো ঠিক করতে পারছি না।’
সময় হয়ে গেছে বুঝে মাধব এবার দেড়হাজার টাকার বান্ডিলটা পকেট থেকে বের করে
হেডস্যারকে নিবেদন করে -
‘একটু দয়া করুন স্যার, নইলে এই চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে গেলে আমার জীবনটাই বৃথা
হয়ে যাবে। এটা যে আমার ফেমিলির
পেটের ভাত জোটার পোশ্ন স্যার।’
হেডস্যার খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর নোটের বান্ডিলটার দিকে তাকিয়ে
গ্রীষ্মকালের মাখনের মতো গলায় বললেন -
‘এতে কত আছে মাধব?’
‘দেড়হাজার আছে স্যার।’
একটা মাঝারি শ্বাস ছেড়ে হেডস্যার মৃদু গলায় বললেন -
‘বড়োই অন্যায় কাজ হয়ে যাচ্ছে মাধব, একটা এত বড়ো একটা মিথ্যাকে সত্য বলে
চালানো! তবু তুই আমার পুরনো ছাত্র, সন্তানতুল্য। শুধু তোর মুখ চেয়ে কী করে যে
না বলব বুঝতে পারছি না।’
টাকার বান্ডিল্টা পড়ে ছিল অসহায় ভাবে। তাই দেখে সেটা তুলে নিয়ে ভিতরের ঘরে
গেলেন হেডস্যার। খানিকক্ষণ পর তিনি একটা ফাঁকা সার্টিফিকেট নিয়ে এলেন। মাধবের
সামনেই ছাপানো সার্টিফিকেটটার ফাঁকা অংশগুলো যত্ন করে পূরণ করলেন। স্বাক্ষর করে
স্ট্যাম্পও লাগালেন। তারপর মাধবের দিকে তাকিয়ে কোমলতর হাসলেন -
‘এটা একেবারেই দেওয়া চলে না কিন্তু। তবু এই তোর সার্টিফিকেট রেডি করে দিলাম।
শুধু তারিখটা বসালাম না। আজ তো বুধবার, দিন ভালো নয়। বাবা মাধব, শুভকাজে
যাচ্ছিস যখন আজকে আর তোর হাতে এটা দেব না। কাল শুভদিন আছে। তারিখটা কাল বসাব।
সার্টিফিকেটটা কালকে নিস। আরো একহাজার টাকা দিয়ে কাল সকালেই এটা নিয়ে
যাস।’
উদগ্রাহ (প্রথম অধিভাগ)
পরের তিন মাসের মাথায় মাধবকৃষ্ণ সাধুখাঁ টেলিফোনে দপ্তরের অস্থায়ী শ্রমিক
হিসাবে কাজে লেগে গেল। তখনকার দিনে সেই বড়োসড়ো বিশ্রীদর্শন কালো রঙের
পিলে-চমকানো শব্দ করা যন্ত্রটি কেবল মাত্র যথেষ্ট ধনী গৃহস্থের বাড়িতেই
শোভাবর্ধন করত। মাস দুই তিন কাজ করার পর সে অবাক হয়ে দেখল সে টেলিফোন দপ্তরে
নয়, আসলে সে সোনার খনিতে কাজ করতে এসেছে!
কী করে ডিপার্টমেন্টের তামার বা অ্যালুমিনিয়মের দামী কেব্ল কী ভাবে চুরি করে
কোথায় কেমন করে বেচে দিতে হয় ... কী করে সেই চুরি ধামাচাপা দিতে হয় ... কী করে
এরপর সম্পন্ন গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের খারাপ হওয়া টেলিফোন ঠিক করার
জন্য কেব্ল কেনার টাকা আদায় করতে হয় ... কী করেই বা সেই মাপের কেব্ল আবার
ডিপার্টমেন্ট থেকেই বিনা খরচে সংগ্রহ করতে হয় ... সেই কেব্ল লাগানোর পর
গ্রাহকের কাছ থেকে মিষ্টি খাবার দাবি করে আরেক দফা টাকা আদায় করতে হয়, -এই সব
‘কাজের ব্যাপার’ বুদ্ধিমান পরিশ্রমী ছাত্রের মতো মাধব হু হু করে সফল ভাবে শিখে
নিতে লাগল।
এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণ পর্বের ব্যস্ততার চাপে কত বছর পরে সে স্থায়ী কর্মচারী
হতে পারবে তার মাইনেই বা বছর বছর কত বাড়বে, এসব প্রশ্ন তার কাছে কোনো গুরুত্ব
পেলই না। ‘যখন হয় তখন হবে, - হবে তো কোনো এক সময়’ -এই ভেবে সে ওই ভাবনাটাকে
অন্যান্য কিছু সহকর্মীদের মতো সরিয়ে রেখে শুধু ‘কাজের ব্যাপারে’ মন দিল।
বছর চারেকের মধ্যে টেলিফোন দপ্তরের অস্থায়ী দিনমজুর মাধব সাধুখাঁ কিন্তু পাত্র
হিসাবে যথেষ্ট মহার্ঘ হয়ে উঠল। ঘটক বা পাত্রীর বাবারা তার বাড়িতে আনাগোনা শুরু
করে দিল। কিন্তু মাধবের ছোটো বোন এতদিন ‘বিয়ের যুগ্যি’ হয়ে পড়েছে। তার বিয়ে
দেওয়াটা আগে দরকার। প্রধানত লোক নিন্দার ভয়েই মাধব প্রথমে বোনের বিয়ের জন্য
চেষ্টা করতে লাগল।
সেটা করতে গিয়ে আর্থিক খরচের সম্ভাব্য পরিমাণের কথা হিসেবটিসেব করতে গিয়ে মাধব
আঁতকে উঠল। সেই সংকটে পড়ে গিয়ে তার এই বোধোদয় ঘটল যে মানুষ কন্যাসন্তানের জন্ম
দেয় নিতান্ত নির্বোধের মতো। এক্ষেত্রে তার বাবা সেই কম্মোটি করে বসে আছে। এখন
তার বাবার নির্বুদ্ধিতার দায়ভার এখন বইতে হবে তাকেই।
ইচ্ছামতো পুত্র বা কন্যা লাভের উপায় তো এখন আছেই। তখনও ছিল। এই পাঁজির কথাই
ধরা যাক না কেন। এতে ইচ্ছামতো পুত্র বা কন্যা লাভের কথা লেখা আছে। শুধুমাত্র
কবচ ধারণেই অব্যর্থ ফল। বিফলে মূল্য ফেরতের সম্পূর্ণ গ্যারান্টিও দেওয়া আছে!
এইরকম অবধারিত উপায় থাকা সত্ত্বেও কেন যে তার বাবা এমন চূড়ান্ত অবিবেচনার
পরিচয় দিয়ে কন্যাসন্তানের জন্ম দেবার মত একটি অপকম্মো করে বসল সেই ভেবে সে
ক্ষুব্ধ এবং বিমর্ষ হয়ে পড়ছিল।
যাই হোক বোনের জন্য পাত্র খোঁজাখুঁজি শুরু হল। শেষ পর্যন্ত মাধবের যে পাত্র
পছন্দ হল তার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি চলনসই। তাদের দাবি-টাবি তেমন কিছু ছিল না।
কিন্তু মাধবের মতে তার প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে তার কোনো ভাই নেই। একটি মাত্র বোন
আছ, তাও আবার বিবাহিত।
পাত্রের যত বেশি ভাইবোন, বিশেষত ভাই থাকলেই ঝামেলা তত বেশি হয়। বোন থাকলে ভালো
হয়। বিয়ের পর তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। কিন্তু ভাই থাকলে ঝামেলাটা বাপের ঘরেই
থেকে যায় - বরাবরের মতো। তাই সেই পাত্রের ভাই না থাকাটা তার বিশেষ যোগ্যতা
হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। তাছাড়া পাত্রটির দেখতে মোটের উপর তেমন খারাপ
নয়।
অতএব আর্থিক দিক দিয়ে আরও ভালো একাধিক পাত্র পেয়েও বাতিল করে দিল মাধব। তাদের
চাহিদা-দাবিও বেশি। বাবা-মা একটু আপত্তি করেছিল। তাদের একমাত্র মেয়ে।
টাকাপয়সারও অভাব নেই। আরো ভালো পাত্র যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন এই সম্বন্ধটা তাদের
পছন্দ ছিল না।
কিন্তু মাধবের মতো বিচার বিবেচনা তাদের ছিল না। আর তখন সেই পরিবারে মাধবের মতই
হল চূড়ান্ত। তাই মা-বাবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ওই পাত্রের সঙ্গেই বোনের বিয়ে
দিয়ে দিল সে, এবং আশঙ্কিত খরচের চেয়ে বেশ কম খরচে বোনের বিয়েটা সারতে পেরে একটু
স্বস্তির হাঁপ ছেড়েছিল।
বোনের বিয়ের হবার মাসছয়েক কাটবার পর মাধবের বিয়ের ব্যাপারটা এবার নির্বিঘ্নে
ঘাই মারতে শুরু করল। অবশ্য মাধব দেখতে তেমন জুতের নয়। বেঁটে কালো চেহারা। মাথার
চুল অনেকটাই কমে গেছে লক্ষণীয় ভাবে। এটাকে মাধবকৃষ্ণ অবশ্য গর্বের ব্যাপার বলে
মনে করে, কেন না টাকা আর টাকের নাকি খুব ঘনিষ্ঠ মাখামাখি আছে।
দেখতে যাই হোক না কেন পাত্র হিসাবে মাধব বেশ ওজনদার। প্রায় বারো বিঘের মতো ধান
জমি, তাছাড়া দুটো পুকুর আছে। চূড়ার উপর ময়ূর পাখার মতো এই টেলিফোনের অফিসের
চাকরি, যার দৌলতে এর মধ্যেই পাকাবাড়ি তুলে ফেলেছে সে। মাধবের জন্য ভালো ভালো
পাত্রীর সম্বন্ধ আনবে বলে ঘটক জোর গলায় জানিয়ে দিল।
মাধব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখল তার আসল কথাগুলো ঘটককে এইবেলা আগেভাগে গুছিয়ে বলে
রাখা দরকার। সেইমতো ঘটককে একদিন নিরিবিলিতে ডাকল সে -
‘দেখ ঘটক কাকা, সম্বন্ধ নিয়ে আসার আগে আমার কথাগুলো ভালো করে শুনে
রাখো।’
‘সে তো জানি বাবা মাধব। অন্তত পঞ্চাশটি হাজার টাকা নগদ, কম করেও দশটি ভরি
...’
‘ওসব তো আছেই। তার সঙ্গে সব রকম ফান্নিচার, মানে খাট-বিছানা, আলমারি, আলনা,
ডেশিং টেবিল এসব থাকবেই সে তো জানি। কিন্তু এগুলো পরের কথা। এসবের আগে কিছু কথা
আছে। এক নম্বর হল, মেয়ের কোনো ভাই থাকলে চলবে না। একলা মেয়ে হলেই খুব ভালো। যদি
একান্তই তা না হয় তাহলে একখানা বোন থাকলেও চলবে। মানে দু’বোনের বেশি হলে বা ভাই
থাকলে সে সম্বন্ধ এনো না। দু’নম্বর হল বিষয় সম্পত্তি যথেষ্ট জোরদার আছে এমন
সম্বন্ধই আনবে।’
শুনতে শুনতে ঘটক হাঁ হয়ে গেছিল। তবে অনেক ঘাটের জল খাওয়া লোক সে। সবটা বুঝে
নিল তারপর মুখের হাঁ বন্ধ করে ফিচেল হাসি হেসে বলল -
‘বুঝিচি বাবা মাধব বুঝিচি। স্ত্রী ভাগ্যে বড়োরকমের লক্ষ্মীলাভ চাই তোমার। তাই
হবে - ওই রকম সম্বন্ধই আনব আমি।’
মেলাপক (দ্বিতীয় অধিভাগ)
অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত ঘটক সফল হল। লতিকা নামের এক পাত্রীর ক্ষেত্রে
দুটি শর্তই পূরণ হল, পাত্রীরা দুই বোন। লতিকা বড়ো। পাত্রীর বাবা যথেষ্ট
সম্পন্ন, এমন কী মাধবদের তুলনায় বেশি সঙ্গতিসম্পন্ন গৃহস্থ।
সব দেখে বুঝে মাধব খুব দিলখুশ হয়ে সম্মতি দিয়ে দিল। যদিও লতিকার চেহারা ভারীর
দিকে। খাটো চেহারা বলে দেখতে আরো বেশি ভারী লাগে। গায়ের রঙ কালো। একটু দাঁত
উঁচু। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই মাধবের বিবেচ্য শর্তের মধ্যে ছিলই না। সুতরাং
সম্বন্ধটা পছন্দ হয়ে গেল তার। তারপর যথাসময়ে শুভদিনে বিয়েটা হয়ে গেল।
বিয়ের পরদিন গা-ভর্তি গয়না, বহুবিধ দানসামগ্রী আর প্রভূত সম্পত্তির ভবিষ্যত
উত্তরাধিকার নিয়ে লতিকা শ্বশুরবাড়িতে এসে পৌঁছুল। দেখতে যেমনই হোক লতিকা কিন্তু
ভারী ভালো আর খুব নরমসরম স্বভাবের মেয়ে ছিল। সে জন্য লতিকার বাবা-মা দুজনেই এই
সরল নম্র জ্যেষ্ঠা কন্যাটিকে বিদায় দিতে গিয়ে খুব দুশ্চিন্তার কান্না
কেঁদেছিল।
ফুলশয্যার রাতে নিয়ম রীতি পালনের পর প্রতিবেশি বৌ-ঝিরা সব বিদায় নিলে দরজায়
ছিটকিনি আটকে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে মাধব বিছানায় এল। বিয়ের রাত থেকে শুরু করে এই
দেড় দুদিনে লতিকা মাধবকে যতটুকু বুঝেছে তাতে সে যথেষ্টই ভীত আড়ষ্ট হয়ে বিছানার
এক কোণে খুব জড়সড় হয়ে বসেছিল।
বিছানার মাঝখানে জুত হয়ে বসে একটা বিড়ি ধরালো মাধব। সাগ্রহ রজনীগন্ধার সুবাসের
মধ্যে একমুখ দুর্গন্ধময় বিড়ির ধোঁয়া নিক্ষেপ করে সেই মধুযামিনীতে প্রথম যে
কথাটি সে তার নববধূকে উদ্দেশ করে উচ্চারণ করল, তা ছিল একটা প্রশ্ন -
‘তোমার গায়ে যা গয়না দেখা যাচ্ছে সবই কি সোনার?’
লতিকা ঘোমটা শুদ্ধু আস্তে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো।
‘কোনো গিলটি করা মাল গয়নাগুলোর মধ্যে চালিয়ে দেয়নি তো?’
লতিকা আবার মাথা নেড়ে না জানালো।
‘মুখে হ্যাঁ-না বলতে কি তোমার গাল ব্যথা করে, নাকি জিভ ঘোরে না? নাকি তুমি
বোবাকালা? তা কত ভরি সোনা হবে সব শুদ্ধু?’
‘আ- আমি সেটা ঠিক জানি না, তবে মায়ের মুখে শুনেছি বারো তেরো ভরির মতো
হবে।’
‘হুঁ, - আর ব্যাংকের খাতায় তোমার বাবার এখন কত টাকা রাখা আছে জানো?’
‘না।’
‘জানা উচিত ছিল। বড়ো মেয়ে হিসেবে বাবার এসব টাকা-পয়সার ব্যাপার তোমার জেনে
রাখা উচিত ছিল। এবার বাপের বাড়ি গিয়ে এসব ব্যাপার ঠিকমতো জেনে আসবে। যাক্,
তোমার মামার বাড়ির অবস্থা এখন কেমন?’
‘একদম ভালো নয়। বড়ো মামীমা, ছোটোমামা খুব কাঁদছে আমার জন্য’ - গলা একটু কেঁপে
গেল লতিকার - ‘আর আমি চলে আসার আগে বাবার খুব শরীর খারাপ দেখে -’
‘ধেৎ তেরিকা! ওসব কথা কে শুনতে চেয়েছে? আমি বলছি তোমার মামাদের বিষয় সম্পত্তি
এখন কতটা আছে?’
‘আমি ঠিক জানি না। তবে শুনেছি অনেক আছে।’
‘তোমার মামা-মাসী মিলে মোট-ক’জন?’
‘তিনজন।’
তাহলে? মাধব হিসেব করে দেখল দাদা-শ্বশুরের মৃত্যু হলে সম্পত্তির চার ভাগের
একভাগ ওদিক থেকে পাওয়া যাবে। ঠিক কতটা কী বিষয় সম্পত্তি সেখানে আছে সেটা পরে
কথায় কথায় ঠিকঠাক জেনে নিতে হবে।
অতঃপর পুষ্পগন্ধে মাতোয়ারা সেই মধুনিশিতে নববধূর কাছে মাধবের প্রয়োজনীয় সমস্ত
জ্ঞাতব্য বিষয় জানা শেষ হয়ে গেল। এইসব জরুরি প্রয়োজনের বাইরে ছাড়া অন্য কোনো
রকমের আলাদা বক্তব্যও তার ছিল না। বিড়িতে শেষ সুখটানটি দিয়ে গলগলে ধোঁয়া ছাড়তে
ছাড়তে মাধব বিড়ির পোড়া টুকরোটা মেঝেতেই ছুঁড়ে ফেলল।
তার পরেই সম্পূর্ণ বিনা ভূমিকায় বিছানার এক কোণে বসে থাকা আড়ষ্ট শঙ্কিত লতিকার
উপর নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে মাধব আচমকা হামলে পড়ে তাকে সজোরে হিঁচড়ে টেনে
বিছানার মাঝ বরাবর নিয়ে এল এবং একটি অতি নির্মম চন্ড ধর্ষণ সবলে ঝটপট সেরে নিয়ে
কান্নাতুর ও যন্ত্রণাকাতর লতিকার দিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে উলটো দিকে ঘুরে
শুয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল। কারণ কাল খুব সকালেই তাকে উঠতে হবে। কাজে বেরোতে হবে। বিয়ের উটকো ঝামেলায়
পড়ে চার চারদিন কাজে যায়নি সে। অনেক টাকার বাঁহাতি রোজগার গলে গেছে তার। আরও
ক্ষতি এড়াতে কালকেই তাকে কাজে বেরোতেই হবে।
ধ্রুব (তৃতীয় অধিভাগ)
মাধব না ভেবেচিন্তে কখনও কাজ করে না। সে জানত বিয়ে মানে বাচ্চা হওয়া। তবে
মাধবের বাবা-মা যে ভুল করেছিল মাধব সেটা কখনই করবে না। কন্যাসন্তান সে কোনোমতেই
নেবে না। বংশরক্ষা ও সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য সে শুধু পুত্রসন্তানই নেবে।
পাঁজির উপর মাধবের অগাধ বিশ্বাস। সে জানে অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিতের দল মিলে এই
পাঁজি লেখে, তার পর ছাপানো হয়। পাঁজির বিজ্ঞাপনের আসল ব্যাপারটা একেবারেই বোঝে
না সে। তার ধারণা পাঁজিতে যা কিছু ছাপা হয়, অতি বৃহৎ লালমূলার বীজ থেকে শুরু
করে মোহিনী বিদ্যা এবং ডাকিনী বিদ্যার বই অথবা পুত্রেষ্টি কবচের কথা সবই
পণ্ডিতেরা মিলেই লিখেছে। তবেই তা পাঁজিতে ছাপা হয়েছে।
পাঁজি ঘাঁটাঘাঁটি করত সে। সেখানেই পেয়ে গেল তার অভীষ্ট লাভের অব্যর্থ
উপায়, একশত ভাগ গ্যারন্টিসমেত। শুধু তাই নয়, বিফলে সম্পূর্ণ মূল্য ফেরতের
প্রতিশ্রুতিও দেওয়া আছে। বিয়ের ঠিক আগেই একদিন মাধব কাজের ফাঁকে বেরিয়ে পড়েছিল।
পাঁজিতে দেখা যজ্ঞেশ্বরানন্দ মহারাজের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে নির্দিষ্ট জায়গায়
গিয়ে হাজির হল সে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও যজ্ঞেশ্বরানন্দ মহারাজের চেম্বার বা
সাইনবোর্ড জাতীয় কিছু তার চোখে পড়ল না।
এদিকটায় দোকানপাট তেমন নেই যে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেবে। খানিক দূরে রাস্তার
পাশে একটা বিড়ি-খৈনির একটা জীর্ণ তাপ্পিমারা সরু দোকান দেখা গেল। সেখানে একটা
টুলের উপর পা তুলে বসে একটা ক্ষয়াটে চেহারার, গর্তে চোখ ঢোকা লোক ঝিমাচ্ছিল।
তার পরনে ময়লা ধুতি, ছেঁড়া গেঞ্জিটা ঘামে হলদেটে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা,
কপালের সিঁদুরের লম্বা টানা দেওয়া। এই লোকটা হয়তো মহারাজের কোনো হদিশ দিতেও
পারে ভেবে মাধব সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল। লোকটা টুল থেকে পা নামিয়ে
নিয়ে খৈনির ছোপ লাগা দেঁতো হাসল -
‘আমিই হচ্ছি খেপীর সেই অধম সন্তান শ্রী শ্রী যজ্ঞেশ্বরানন্দ মহারাজ ত্রিকাল
চূড়ামণি। সংক্ষেপে ত্রিকাল মহারাজ বলে সবাই ডাকে।’
‘আজ্ঞে নমস্কার। ইয়ে - মানে খেপী কে? আপনার মা নাকি? তাঁর খ্যাপামি সারাবার
চিকিৎসা পত্তর কিছু করেটরে ...’
‘হা রে অজ্ঞান নর! আমার খেপীকে চিনলি না? মাতা জগৎকালী।’ - দু’হাত বুকের কাছে
জোড় করে ঊর্ধ্বআঁখি হয় সে -
‘এই নতুন অবোধ সন্তানকে এইবারের মতো ক্ষমা করিস মা!’
নিজের নড়বড়ে টুলটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লোকটা। তারপর সেটা মাধবের দিকে একটু এগিয়ে
দিয়ে নিজে ইটের ঠেকনা দেওয়া একটা ভাঙা ব্যাটারির বাক্সের উপর সাবধানে বসল
-
‘বোস, ওখানে বোস্ তো মায়ের বোকা ছেলে! কী জন্য এসেছিস তুই খেপীর কাছে বল? আর
কত টাকার পুজো চড়াবি সেটা বল।’
‘আজ্ঞে, আমি তো আজ খেপীর- ইয়ে, মা কালীর পুজো দিতে আসিনি, মানে আপনার কাছেই
এসে ছিলাম একটা বিশেষ দরকারে।’
‘ধুর্ ব্যাটা আবদ্ধ নর! আমি তো নিমিত্ত মাত্র। যা কিছু করার তার সব কিছু ওই
খেপীই আমাকে দিয়ে করায়।’
‘আজ্ঞে আমি ওই ইচ্ছামতো পুত্রলাভের ব্যাপারে এসে ছিলাম।’
‘এ আর এমন কী কথা? শত শত নরের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছি আমি। তোরও পূর্ণ
হবে।’
খুশি হয় মাধব, খুব খুশি হয়। শত শত নরের মনোবাঞ্ছা এখানে পূর্ণ হয়েছে?
এক্কেবারে সঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছে সে! কিন্তু কতটা কী খরচ হবে সেটা এবার
জানতে হবে -
‘আজ্ঞে মহারাজ, এবার দয়া করে খরচাপাতির ব্যাপারটা যদি একটু...’
‘পুত্রেষ্টি কবচের শক্তির তুলনায় দক্ষিণা তেমন কিছুই না রে বোকা ছেলে।
পুত্রেষ্টি কবচ মোট তিন প্রকার হয়। এই কবচের মূল্য বলে কিছু হয় না রে।
‘শক্তিশালী’ কবচ- দক্ষিণা চারশত একটাকা, ‘মহাশক্তিশালী’-দক্ষিণা সাতশত
একটাকা, আর ‘অতি মহাশক্তিশালী’- দক্ষিণা এক হাজার একটাকা মাত্র। তবে আমার
একান্ত উপদেশ এই যে, সুনিশ্চিত অব্যর্থ ফল লাভের জন্য ‘অতি মহাশক্তিশালী’ কবচই
প্রশস্ত। কারণ এই কবচ ভূম্যাদিদোষ সকল মূলগত ভাবে খন্ডনের ও নিবারণের ক্ষমতা
রাখে।’
‘সেসব কী জিনিস মহারাজ? মুলোর কথা শুনলাম যেন। মুলোচাষ করার কোনো ব্যাপার আছে
নাকি?’
‘না রে মায়াবদ্ধ জীব, না! মুলোটুলো কিছু নয়। ওসব অতি গূঢ় গুহ্যতত্ত্ব। সংসারী
নরের জ্ঞান-বোধের বাইরে। আমার মতো দীর্ঘকাল সাধনপথে থাকলে তবেই ওসব বোঝা যায়।
যাক্ ওসব কথা, গতকালই এক মহাযোগ ছিল। সারারাত্রি যজ্ঞ-হোমাদির প্রচন্ড
পরিশ্রমের ফলে মাত্র একখানা ‘অতি মহাশক্তিশালী’ পুত্রেষ্টি কবচ বানাতে পেরেছি।
যদি সেই কবচ চাস্ তো ...’
মাধব বোকার মতো সেই সুবর্ণসুযোগ সুযোগ হারায়নি। একহাজার একটাকা দক্ষিণা দিয়ে
সেই ‘অতি মহাশক্তিশালী’ কবচই নিয়ে এল সুনিশ্চিতভাবে পুত্রলাভের জন্য। পরদিনই
মাধবের মা নববধূ লতিকার হাতে সেই কবচ বেঁধে দিয়েছিল।
‘অতি মহাশক্তিশালী কবচের অব্যর্থ প্রভাবে এক বছরের মাথায় পুত্রসন্তানের জন্ম
দিল লতিকা। কবচের অনিবার্য শক্তির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে অন্যান্য সকলের মতো
মাধবও চমৎকৃত হল। নিশ্চিন্তও হল সেই সঙ্গে তার বংশরক্ষা আর শ্রাদ্ধকর্মের
ব্যাপারে আর কোনো বাধাই রইল না। মা জগৎকালীর কবচলব্ধ বলে মাধব ছেলের নাম রাখল -
শ্যামাদাস।
আভোগ (চতুর্থ অধিভাগ)
একবছর পর একদিন ছুটির সকালে মাধবের মনে হঠাৎ এক গুরুতর কথার উদয় হল। কথাটা
হচ্ছে - এক ছেলে ছেলে নয়। এর মধ্যে মাধবের একতলা বাড়ি দোতলা হয়েছে। বাথরুমের
মেঝে ও দেওয়ালে টালি বসেছে। দামি রঙের ছোঁয়ায় পুরো বাড়ি চমকাচ্ছে। ছর্ ছর্
করে মাধবের মাথায় ঝরে পড়ছে মা লক্ষ্মীর অসৎ দাক্ষিণ্য।
লতিকা রান্নাঘরে কিছু করছে।
মাধবের মা নাতিকে পাহারা দিচ্ছে। টলমল পায়ে একটু একটু হাঁটতে শিখছে শ্যামাদাস।
ছুটির দিনে বারান্দার এক ধারে বসে শ্যামাদাসকে দেখতে দেখতে মাধবের মনে ওই
আপ্তবাক্যটির উদয় হল।
একটি মাত্র ছেলে, ভগবান না করুন যদি খারাপ কিছু ঘটে যায় - ঘটে যেতেই পারে,
তাহলে পিণ্ডদান আর বংশরক্ষা কে করবে? অতএব আর একটি পুত্র তার চাই। আর ত্রিকাল
মহারাজ থাকতে এ ব্যাপারে মেয়ের জন্ম হয়ে যাবার কোনও ঝুঁকি নেবার কথাই ওঠে
না।
গেল সে আবার সেই খৈনি দোকানি বা শ্রী শ্রী যজ্ঞেশ্বরানন্দ মহারাজ ত্রিকাল
চূড়ামণির কাছে আর একটি সেই ‘অতি মহাশক্তিশালী’ কবচ আনতে। মহারাজ মাধবের
উদ্দেশ্য শুনে মৃদু হাস্যসহকারে বললেন, মাধবের ইচ্ছা আবারও পূর্ণ হবে। কিন্তু
এর মধ্যে অনেক জাগতিক এবং মহাজাগতিক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
রাহু বক্রী হয়েছে, ফলে শনিদেব অতি কুপিত হয়েছেন। এই কারণে বৃহস্পতি মুখ
ঘুরিয়ে আছেন। সেজন্য এখন কালসর্পযোগ চলছে। তাছাড়া সেই ভূম্যাদি দোষটোষ ইতিমধ্যে
নাকি আরও প্রবল হয়েছে। সে ক্ষেত্রে খেপীর আদেশে সেসব দোষ খন্ডন করে অব্যর্থ
ফললাভের জন্য পুত্রেষ্টি কবচের শক্তিও আরও অনেক বাড়াতে হয়েছে।
তিরাত্রি উপবাসী থেকে গুহ্য তন্ত্র-মন্ত্রাদির সাহায্যে বাড়তি শক্তির যে কবচ
তৈরি হয়েছে সেটা হল ‘সুপার অতি মহাশক্তিশালী’ পুত্রেষ্টি কবচ। অমূল্য এই কবচের
দক্ষিণা পনেরো শত এক টাকা মাত্র। মাধব দামের চিন্তা একেবারেই না করে সেটাই নিয়ে
এসে লতিকার হাতে বেঁধে দিল। পুত্রসন্তান হবার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নেবে না
সে।
অতএব লতিকাকে আবার গর্ভবতী হতে হল। গর্ভসঞ্চারের ব্যাপারটা মাধবের গোচরে আসার
তিনদিনের মধ্যেই প্রফুল্লচিত্তে ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় পুত্রের নাম ঠিক করে ফেলল -
তারাদাস। নামটা লতিকাকে বলে তার মতামত জানতে চাইল -
‘কী গো, মেজো ছেলের নাম পচন্দো হয়েছে তো?’
ফুলশয্যার সেই কর্কশ নিষ্ঠুর রাতের পর থেকেই লতিকা ক্রমশ খুব ভালোভাবে বুঝে
গিয়েছিল তার কোনো রকম ইচ্ছা -অনিচ্ছা, পছন্দ -অপছন্দের একতিল মূল্য নেই
মাধবের কাছে। স্তিমিত গলায় শুধু সে তার মাতৃহৃদয়ের শঙ্কা ব্যক্ত করেছিল
-
‘ছেলে জন্মাবার আগে সেই ছেলের নাম রাখলে না কী অমঙ্গল হয় বলে শুনেছি।’
‘এই জন্যই বলে মেয়েলোক চোদ্দোহাত কাপড়েও কাছা দিতে পারে না।’ - অত্যন্ত রুষ্ট
হয় মাধব। পরিবারের কেউ তার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে এটা তার চিন্তার অতীত -
‘সেই মেয়েলোকের বুদ্ধি আর কদ্দূর যাবে? কোন শাস্তোরে লেখা আছে শুনি যে ছেলের
জন্মো হবার আগে ছেলের নাম দিতে নেই? - অ্যাঁ! বলি কোন সুমুন্দির বাচ্চার কাছে
তুই শুনিচিস এসব কথা?’
লতিকা ভয়ে একেবারে চুপ মেরে যায়। এই নীরব সহন তাকে অনেকবার গুরুতর পরিণামের
হাত থেকে বাঁচিয়েছে। মাধবের মুখ দেখতে যত খারাপ, শুনতে তার চেয়ে অনেক খারাপ।
তাছাড়া মাধবের শুধু মুখ যে চলে তা নয় - হাতও চলে!
ক্রমশ লতিকার প্রসবের দিন এগিয়ে এল। এই অবস্থায় দ্বিতীয়বারের পোয়াতি লতিকাকে
ডাক্তার দেখানো অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্যমাত্র মনে করে মাধব সেই বাজে খরচটা
সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছিল। অবস্থা দেখে লতিকার বাবাই সব খরচ দিয়ে মেয়েকে ডাক্তার
দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। তবুও গর্ভিনী মায়ের উপযুক্ত ধারাবাহিক খাদ্যের অভাবে
লতিকা বেশ কিছুটা শীর্ণ হয়ে পড়েছিল।
এমন সময় মাধবদের অফিসে কয়েকজন কর্মীর কিছু দিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোনো কাজে
যাবার জন্য চিঠি এল হেড অফিস থেকে। কলকাতার বাইরে কাজে গেলে প্রাপ্তিযোগ বেশি
বলে মাধব সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজে যাবার জন্য নাম লিখিয়ে দিল। তারপর বাড়িতে ফিরে
এসে সে কথা জানাল। লতিকার কোনো বিষয়ে কিছু বলার থাকতে পারে না বলে সে চুপ করে
থাকল। মাধবের মা দ্বিধাগ্রস্ত হল -
‘এখন বউমার এই অবস্থায় তুই বাইরে যাবি বাবা? কখন কী অসুবিধা হয়ে যায় না
যায়!’
‘কী আর অসুবিধা হবে শুনি? তোমরা তাহলে আছ কী করতে? তোমরা যা করার করবে। তাছাড়া
ওর বাবা তো ডাক্তার বদ্যি কীসব যেন করেছিল। এখন তার কোনো দায়িত্ব নেই? তাকে খবর
দেবে। আমাকে যেতেই হবে কাজে। আমি না গেলে চলবে না।’
আসন্নপ্রসবা লতিকাকে রেখে নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন মনে মাধব কাজে চলে গেল। মাধব
চলে যাবার চারদিন পর লতিকা একটি সন্তানের জন্ম দিল, - সেটি কন্যাসন্তান। লতিকা
এবং অন্যান্য সবাই যত না অবাক হল নিতান্ত অব্যর্থ কবচের শোচনীয় ব্যর্থতায়, তার
চেয়ে অনেক বেশি আতংকিত হয়ে পড়ল। আতংকে সবচেয়ে বেশি সিঁটিয়ে গেল মূল এবং একমাত্র
অপরাধী লতিকা।
কীর্তনাবসান
তেইশ দিন পরে মাধব ফিরল। তবে বাড়িতে ঢোকার আগেই সেই চরম দুঃসংবাদটি শুনে ফেলল।
পাড়ার কাকিমা সম্পর্কের এক
মহিলা তাকে পথে দেখতে পেয়ে খুশি গলায় জানাল -
‘ফিরলি বাবা মাধব? খুব ভালো খবর আছে! মা ষষ্টীর দয়ায় তোর মেয়ে আঁটকুড়ো নামটা
এবার ঘুচল বাপ! যমের মুখে ছাই দিয়ে শতেক বচ্ছর আয়ু হবে তোর। ফুটফুটে মেয়ের বাপ
হইছিস তুই!’
প্রচণ্ড ক্রোধ আর বিস্ময়ে দাপাতে দাপাতে মাধব বাড়ি ঢুকল। বারান্দায় কাঁধের
ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে সে গর্জে উঠল -
‘কী করে মেয়ে হল শুনি? কী করে হয়? ত্রিকাল মহারাজের দেওয়া সুপার অতি
মহাশক্তিশালী কবচ আনলাম! গতবারে এর চেয়ে কমজোরী কবচেই ছেলে বেরোলো! এবারে তার
চেয়ে অনেক জোরালো কবচ বাঁধা সত্ত্বেও কী করে মেয়ে বেরোলো?’
মাধবের বাবা-মা সমেত অন্যান্য সবাই মাধবকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু তাতে কিছু লাভ হল না। উদগ্র বন্য মহিষের মতো গর্জাতে লাগল সে। তারপর ভয়ে
আধমরা হয়ে থাকা লতিকার দিকে আঙুল তুলে হুংকার দিল -
‘তুই! তুই মাগি যত নষ্টের মূল! নিশ্চয়ই কবচ ধারণে কোনো অনাচার বা গোলমাল
করেছিস তুই। তাই আমার এমন সব্বোনাশ হয়ে গেল! এর জন্য তুই দায়ী! নাহক আমাকে কত
হাজার টাকা ফালতু খরচের গাড্ডায় ফেললি তুই!’
একটু দম নেবার মতো ভাব করে কয়েক মুহূর্ত থামে মাধব। তারপর পরবর্তী পর্যায়ের
গর্জন শুরু করে -
‘বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে। অশৌচটা কেটে গেলেই তুই তোর মেয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে
যাবি হারামজাদী! তোর আর তোর মেয়ের মুখ দেখতে চাই না। তোর বাপের বাড়ি চলে যাবি।
মেয়ের বিয়ের খরচের জন্যে আলাদা টাকার ব্যবস্থা যদি করে আনতে পারিস তবেই এমুখো
হবি। না হলে কোন দিন গলাটিপে ধাড়ি-বাচ্চা দুটোকেই শেষ করে দেব! আমার পনেরোশো
একটাকার কবচ হাতে হাতে ক্ষতি করালি। লক্ষ্মীছাড়ি, এক্ষুনি তোকে দূর করে দিতে
পারলে তবে আমার শান্তি হয়। তোর জন্য ...’
মাধবের একটানা চিল চিৎকারে ভয় পেয়ে লতিকার অবোধ শিশুকন্যা কেঁদে উঠেছিল। তাকে
বুকে তুলে নিয়ে তার কান্নার বর্মের আড়ালে লতিকা হু হু করে কাঁদছিল, গোপনে,
নতমুখে। মাত্র কুড়ি দিন বয়সের আত্মজা কান্না দিয়েই তার মাকে সযত্নে রক্ষা করছিল
তখনকার মতো, কেন না লতিকাকে কান্নার মত খুব বিশ্রী ন্যাকামি করতে দেখলে
মাধবকৃষ্ণ সাধুখাঁ রেগে যায় - ভীষণ রেগে যায়।
0 মন্তব্যসমূহ