ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

হাড়হিম করা সত্য ঘটনার বিবরণ – রেলমানুষের তদন্তকথা (৩য় খণ্ড) -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


  • বই: রেলমানুষের তদন্তকথা
  • লেখক: তুষার সরদার
  • প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারী ২০২৩
  • প্রকাশনী: অভিযান পাবলিশার্স
  • পৃষ্ঠা – ১৮০ 
  • মূল্য: ৩৫০/- 

“গ

ভীর চমক ভীষণ জোরে ধাক্কা দেয় বুকে।
সেখানে মনিটরের মাঝামাঝি একটা মন্থর গতিশীল নীল রঙের আলোকরেখা তার স্বাভাবিক চঞ্চল ঢেউগুলো প্রায় সবই নিঃশেষে হারিয়ে ফেলে ভয়ংকরভাবে এক মূঢ় নিঃস্ব সরলরেখা হয়ে পড়েছে। রেখাটা নীল রঙের ...।
মৃত্যুর সূচক রং কি নীল! একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলাম...। কিন্তু এবার আমার সামনে যে এখন অনেক কাজ! আমার ভেঙে পড়লে তো একেবারেই চলবে না। ভেঙে পড়া থেকে অতি কষ্টে নিজেকে খানিক সোজা করতে করতে ডক্টর গুপ্তের দিকে ঘুরে তাকালাম।  

********

আমার ঘাড়ের পিছনে খুব ফিশফিশ করে যেন মইনুল বলে যাচ্ছিলেন-
'দেখলেন তো স্যার ... আপনি নিজের চোখেই তো এবার দেখলেন ওরা আমার পা-টাকে বাঁচানোর কোনোরকম চেষ্টা করার বদলে কোথায় কীভাবে অযত্নে সেটা ফেলে রেখে দিয়েছে... ওটা তো আমারই পা .... আমার পা-টাকে আমার কাছেই তো এনে রাখবে ... তা না রেখে সেই পা-টাকে এখনও পর্যন্ত ঘরের মেঝেতেই একপাশে যেমন-তেমন করে অযত্নে ফেলে রেখেছে ... এইজন্যই তো তখন আপনাকে অত করে বলছিলাম যে...'    - আঘাত ও অভিঘাত
-----


“সেই ঘরটার দেয়ালের গায়ে লাগানো আলোটা জ্বলছে না, হয়তো খারাপ আছে।  তার বদলে এখন অস্থায়ীভাবে আলগা তার জুড়ে সিলিং-এর মাঝামাঝি হুক থেকে কোনোমতে ঝোলানো একটা খুব ম্যাড়মেড়ে বাল্বের আলো জ্বলছে। সিলিং-এর হুক থেকে শুধু ফ্যান ঝোলানো হয়। ওখানে কোনো ফ্যান নেই কেন? এখানে ফ্যানের বদলে বাল্ব ঝুলছে। সিলিং-এর মাঝামাঝি হুক থেকে ঝোলানো আলোটা মাথার উপরে আছে বলে মাথার ছায়াতে কারও মুখ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না।

সেই আবছা আলোয় দেখলাম একদিকের দেয়াল ঘেঁসে একটা তক্তপোশের উপর বিবর্ণ ছেঁড়াখোঁড়া বিছানায় মরা চামচিকের মতো শীর্ণ কালো একজন বয়স্ক লোক দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সে মরা অবস্থায় ওইভাবে আছে। কিন্তু দেখলাম তার কোটরগত দুই চোখ যক্ষ্মারোগীর মতো জ্বলজ্বল করছে।
বুঝলাম ইনিই সেই মেডিক্যালি আনফিট হওয়া রেলকর্মচারী অখিলেশ সামন্ত।মৃত্যুপুরীর মাঝে

-----------------


“আমার কাছে যে আবেদনপত্র আছে তাতে আবেদনকারিণীর ফোটো দেওয়া আছে। চিনলাম, এই হচ্ছে আবেদনকারিণী অর্থাৎ রচনা ব্যানার্জি। একবার আমার অফিসেও একে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
রচনার চোখে চোখ পড়তে দেখলাম তার চোখে পুরু করে কাজল টানা। বিধবা হলেও প্রসাধনের প্রয়োজনে চোখে কাজল টাজল দিতে বাধা কোথায়? রচনার ওষ্ঠাধরে উজ্জ্বল কমলা রঙের লিপস্টিকের ছোঁয়া তাই জোর করে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলাম। অবশ্য দাখিল করা আবেদনমাফিক যে 'সহায়সম্বলহীন চল্লিশোর্ধ্ব নিতান্ত দরিদ্র বিধবা'র দেওয়া তথ্য যাচাই করতে তার বাড়িতেই এসেছি যেদিন, ঠিক সেদিনেই নিজের বাড়ির মধ্যেই থাকা অবস্থায় সেই 'নিতান্ত দরিদ্র বিধবা'র এই কাজল লিপস্টিকের বাড়তি এবং উচ্চকিত প্রসাধনের প্রয়োজনটা... ধুত্তোরিকা! এবার এই অকারণ কুটিলতার জন্য নিজের মনকে ধমকে একদম থামালাম।
কায়াহীনের ইশারা

----

“এই সদ্যযুবতি শুধু যে তার দেহে গভীর অগ্নিক্ষত বহন করছে তা নয়, নির্মম হুতাশন এর পৃথিবী একেবারে স্বজনশূন্য করে দিয়ে গেছে। যথেষ্ট বিপন্ন করে তুলেছে তার মানসিক স্বাস্থ্য ও অস্তিত্ব। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে সোমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম- 'কোনো দুর্ঘটনাকেই পাপ-পুণ্য দিয়ে বিচার করা যায় না সোমা। তাছাড়া পাপ-পুণ্য খুবই নড়বড়ে এবং আপেক্ষিক একটা ধারণা। ট্রেন বা বিমান দুর্ঘটনা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় যাঁরা পড়েন তাঁরা প্রত্যেকেই পাপী-তাপীর দল, একথা কি বলা যায়? আর সেইসব দুর্ঘটনার ঠিক পরেই যারা আহতদের শুশ্রুষা করার ছলে আহত বা নিহতদের টাকাপয়সা, মূল্যবান সামগ্রী অপহরণ করে তাদের কি তুমি তাহলে মহাপুণ্যবান বলতে পারবে? তুমি যে সেদিনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছ - এটা কখনোই কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নয়।' – ন হন্যতে হন্যমানে

ওপরে উল্লিখিত গল্পাংশগুলো সুপরিচিত লেখক তুষার সরদারের  লেখা বিখ্যাত তদন্তমূলক সত্য গল্প সংগ্রহ ‘রেলমানুষের তদন্তকথা’ -র তৃতীয় খণ্ডর থেকে সংগৃহীত। এর আগে এই গল্প সংগ্রহের দুই খণ্ডের বিষয়ে লিখেছিলাম। তৃতীয় খণ্ডটি অপর দুটি খণ্ডের মতই অসাধারণ ও রোমহর্ষক। কিন্তু এই এক বাক্যেই বই সম্পর্কিত ভাবনা বলা শেষ হয় না। লেখক ভুমিকায় লিখেছেন তদন্তসূত্রে রেল কর্মচারীদের পরিবার পরিজনের সাথে যোগাযোগকালে ঘটনাচক্রে তাঁদের হৃদয়ের একান্ত কাছে গিয়ে ভালোবেসেছেন। তাঁদের থেকে ভালোবাসার শিক্ষা পেয়েছেন। তাঁর গল্পের মধ্যে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই। যেখানে নিজের দায়িত্ব পালনের কেঠো কর্তব্য কর্ম টুকু করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। বরং বেশ কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক জটিল সমস্যায় নিজেকে জড়িয়েছেন এবং তার সুষ্ঠরূপে সমাধানও করেছেন। শুধুমাত্র কাগুজে কাজের গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে মানুষের জীবনের গভীর গোপন অন্ধকারময় স্থানে প্রবেশ করেছেন এবং ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করেছেন। একজন কর্তব্যপরায়ন কর্মচারীর ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর এক অনন্যসাধারন দৃঢ়, অনুভূতিশীল মানবিক চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে বারংবার। যা পাঠকদের মন ছুঁয়ে যায় অনায়াসে এবপ্নগ বই পড়ার পর একরাশ মুগ্ধতার রেশ রয়ে যায়। 

এই খণ্ডের কয়েকটি গল্প অবশ্য তদন্তমূলক না বলে তাঁর কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতা বলা যায়। বাকি গল্পগুলির প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের চমক তৈরি করে। পৃথিবী যে কত বিচিত্র মানুষের সমাহারে রচিত তার প্রমাণ এই গল্পগুলি। স্বামী স্ত্রী থেকে শুরু করে ভাই বোনেদের বিভিন্ন জটিল সম্পর্কের বিভিন্ন বিচিত্র কর্ম কাণ্ড ও ব্যবহার পড়ে বিস্ময়ে অবাক হতে হয়। মনুষ্যরূপী অমানুষ যে আমাদের মাঝেই থাকে তারও জীবন্ত দলীল এই বইয়ের কিছু গল্প। বিশেষভাবে কিছু গল্প অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। যেমন ‘কায়াহীনের ইশারা’, ‘ন হন্যতে হন্যমান’, ‘একটি মৃত্যু ও দুটি নারী’, 'মহারাজের অন্তর্ধান', 'আঘাত ও অভিঘাত', 'চোখের রহস্য সন্ধানে',  ‘মরণের পায়চারী যেখানে’ এবং অবশ্যই ‘মৃত্যুপুরীর মাঝে’। ডার্ক জঁ গোত্রভুক্ত গল্পগুলি ভাবতে বাধ্য করে যে মানুষের মনুষ্যত্ববোধ আজ কত অধঃপতিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন রসের গল্পে সম্পর্কের জটিলতা, গোপন অপরাধ, মানসিক বিকৃতি, যৌন ঈর্ষা, খুন, আপনজনকে ঠকিয়ে সম্পত্তি লোপ করার চেষ্টা, হিংস্রতা, অমানবিকতা, কাপট্যের পাশাপাশিই এসেছে মমতা, উদারতা, লোভহীনতা, প্রেমের মত বিষয়গুলি। কয়েকটি গল্প অত্যন্ত রোমহর্ষক হয়ে উঠেছে। লেখার শুরুতে উল্লেখ্য গল্পাংশ থেকেই গল্পের বিভিন্নতা, লেখকের ভাষা প্রবাহ ও রোমাঞ্চের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পাওয়া যায়।     

 “পারিবারিক বিপর্যয়” এই অতি সাধারণ শব্দবন্ধ যে প্রকৃত পক্ষে কত আতঙ্কময় হতে পারে তার প্রমাণ লেখক লিখিত “মৃত্যুপুরীর মাঝে” গল্পটি। পৃথকভাবে এই গল্পের উল্লেখ করার কারণ হল এই গল্প পড়ার পর অনেকটা সময় পাঠক বেশ একটা অস্বাভাবিকতায় আছন্ন হয়ে থাকবেন। বাস্তব যে সব সময়ই কল্পনার থেকে রোমাঞ্চকর হয়, তার প্রমাণ এই গল্প।  লেখকের সাবলীল অথচ সুন্দর বর্ণনাময় লেখনীকে কুর্নিশ জানাতে হয়। 

গল্পের প্রচ্ছদ ভাবনায় নতুনত্ব নেই কারণ সম্ভবত আগের খণ্ডগুলির সাথে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ইদানিংকালের পাঠক লেখার সাথে সাথে সুন্দর, অর্থপূর্ণ ও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের দিকেও নজর রাখেন। তাই এব্যাপারে অন্য চিন্তাভাবনা করার অনুরোধ রইল।  এছাড়া এই খণ্ডে বেশ কিছু বানান ভুল ও প্রিন্টিং ভুল নজরে এল যা পূর্বের বইগুলোতে একেবারেই ছিল না।  আশা করব পরবর্তী মুদ্রণে প্রুফ রিডিং-এর ক্ষেত্রে প্রকাশনী আরেকটু যত্নশীল হবেন।           

এই বইটি লেখকের এই সিরিজের শেষতম বই বলে উল্লেখ করেছেন। শেষের গল্পটিও লেখা হয়েছে ওনার চাকরি জীবনের শেষের দিনের ঘটনা নিয়েই। ফলে বই শেষ হবার পর বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় আরও কিছু কাহিনী যদি পড়তে পারতাম। বই শেষের পরেও এই রেশ তৈরি করে একরাশ মুগ্ধতা ও লেখকের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

Document

পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ গৃহবধূ। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা। বর্তমানে স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশে এসে সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভাববোধ থেকে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণের অবলম্বনরূপে লেখার শুরু। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও লেখা পড়তে ক্লিক করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ