ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ইতিহাসের আলোকে গ্রাম বাংলার অলিখিত ডাক্তার বাবা পঞ্চানন্দ ঠাকুর -সুমন মন্ডল


র্তমান একবিংশ শতকের পৃথিবীতে আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করে চলেছি যে মানুষ সর্বদাই নানান ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, শারীরিক রোগ, মানসিক অস্থিরতা ও আরো নানাবিধ সমস্যার সাথে প্রত্যহ মোকাবিলা করে চলেছে। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে মানুষ যে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে তা সম্প্রতি কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা হয়তো অনেকেই জানি যে মানুষের শরীরে যখন কোন দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধে, যখন কবিরাজবিদ্যা, ডাক্তার ও তার সমস্ত আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র সেই ব্যধিকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়, তখন গ্রাম বাংলার মানুষ আশ্রয় নেয় নানা দেব-দেবীর পদপ্রান্তে। বিশেষত এখানে বাংলার প্রান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলের নানান লৌকিক দেবদেবীর কথা বলতেই হয়। সাধারণ মানুষ অপূর্ব বিশ্বাসের উপর ভর করেই নানান আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে সেই দেবদেবীর মন্দিরে  রোগগ্রস্থ ব্যক্তির রোগ নিরাময় করে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাতেন। বাংলার এই সকল লৌকিক দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বাবা পঞ্চানন্দ ঠাকুর। লোকমুখে তিনি বাবা ঠাকুর বা পাঁচু ঠাকুর নামেও পরিচিত। শারীরিক অসুস্থতার কালে লৌকিক দেবদেবীদের উপর গ্রাম বাংলার মানুষের এই নির্ভরতা আসলে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিকে অনেকটাই রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশিষ্ট গবেষক Ernesto de Martino -এঁর ভাষায় “Culture as result of the victorious struggle of the health of the pitfalls of disease.” এই প্রবন্ধটিতে আমার মূল আলোচনার বিষয় হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার একজন অন্যতম লৌকিক দেবতা বাবা পঞ্চানন্দ যিনি বাংলার আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা প্রচলনের পূর্বেকার সময় থেকে আজও সমানভাবে মানুষের কাছ থেকে পূজা পেয়ে আসছেন বাংলাকে রোগমুক্ত বাসভূমি করে তোলার লক্ষ্যে।


ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ঐতিহাসিকতার দিক থেকে আমরা যদি এই লৌকিক দেবতাকে বিশ্লেষণ করতে যাই তবে দেখা যাবে যে বাবা পঞ্চানন্দ শিবের-ই এক লৌকিক রূপ,  যিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু কিছু এলাকায় বাবা ঠাকুর, বা বুড়োবাবা নামেও পরিচিত। আবার কারও মতে পঞ্চানন্দ শিব নন, তিনি শিবের পুত্র। অনেকটা দক্ষযজ্ঞ কালে জন্ম নেয়া বীরভদ্রের মতো। এছাড়া আরও একটি তত্ত্ব বিদ্যমান, রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রাচীন তথা জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা ধর্ম ঠাকুর। ঐতিহাসিকদের দাবি তিনি এই পঞ্চানন রূপের মাধ্যমে আর্য দেবতা শিবের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। মধ্যযুগের বেশ কয়েকটি মঙ্গলকাব্যেও এই পঞ্চানন্দ ঠাকুরের উল্লেখ রয়েছে। দ্বিজ দূর্গারাম রচিত পঞ্চাননমঙ্গল এগুলির মধ্যে অন্যতম। এই কাব্য পড়লে পঞ্চানন্দকে শিব ভাবতে ইচ্ছে করবে। এর সঙ্গীতাংশে যেমন উল্লেখ রয়েছে – “পঞ্চমুখে গান করে ত্রিলোচন”। এছাড়া তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব নামক কাব্যেও আমরা পঞ্চানন্দের উল্লেখ পাচ্ছি – “পঞ্চানন দেব প্রায় অশ্বত্থ তলায়/মধ্যমাঠে সরোবর তীর দেখা যায়”। এছাড়াও রুপারাম রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যেও বাবা পঞ্চানন্দের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ মধ্যযুগীয় সময়কাল বা তারও আগে থেকেই লৌকিক দেবতা হিসেবে পঞ্চানন্দ ঠাকুর গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে পূজা পেয়ে আসছেন।

 
       পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, কলকাতা, বর্ধমান, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও বাঁকুড়া এই সকল জেলাগুলিতেই এই লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ পূজিত হয়ে থাকেন। অঞ্চল ভেদে এই পঞ্চানন্দ ঠাকুরের পূজারীতি বা মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু আমি আমার আলোচনাটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি তাই এই জেলায় বাবা পঞ্চানন্দ কিভাবে পূজিত হন বা এখানকার মানুষের বিশ্বাসের সাথে তিনি কিভাবে জড়িয়ে গেছেন সেগুলি মূলত আলোচনায় উঠে আসবে।


লৌকিক দেবতা হিসেবে পঞ্চানন্দ ঠাকুর: বহুদিন ধরেই গ্রাম বাংলার মানুষ এই সকল লৌকিক দেবদেবীদের নানাভাবে, নানা কারণে, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে পূজার্চনা করে আসছেন। এক কথায় বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপন তথা সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে এই সকল লৌকিক দেব-দেবী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে কতিপয় গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা ছাড়া আর কেউই তেমনভাবে আলোচনায় আনেননি, তাছাড়া এই সকল লৌকিক দেব-দেবীরও যে একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে সে বিষয়টিকেও বহু গবেষক এড়িয়ে গেছেন। তাই সেই তাগিদ থেকেই এই লেখা।


  বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে ও বয়স্ক কয়েকজন ব্যক্তির সাথে আলোচনা করার পর কয়েকটি কথা বিশ্লেষণ করা দরকার। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু স্থানে পঞ্চানন্দ বাবা ঠাকুর নামে পূজিত। পঞ্চানন্দকে বর্তমানে আরন্যক দেবতা বলে মনে হয় না। কিছু উন্নত বর্ণহিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এঁকে বেশি দেখা যায়, দুর্গম অরণ্যাবৃত অনুন্নত সমাজে যে তিনি একেবারেই পূজিত হন না তাও নয় তবে কতটা বিরল।

      পঞ্চানন্দ কে সকল স্তরের ও বর্ণের হিন্দুরা শ্রদ্ধা করেন ও প্রায় সকলেই প্রয়োজন বোধে বা সময় বিশেষে পূজার্চনা করেন। বর্তমানে এর পাকা থান, মন্দিরাদি বহু জায়গায় দেখা যায়। বর্ণ ব্রাহ্মণরা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এর পৌরহিত্য করেন শাস্ত্রীয় ও লোকায়ত মিশ্রিত বিধান অনুযায়ী তবে অনুন্নত জাতির লোকেদেরও কোন কোন স্থানে এর পুরোহিত রূপে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে তাদের পূজা আচারে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

        দেবাদিদেব মহাদেবের সঙ্গে পঞ্চানন্দের দেহের গঠনগত ও বেশভুষার কিছু কিছু সাদৃশ্য দেখা যায় তবে পার্থক্য ও রয়েছে। এর বর্ণ লাল বা তপ্ত কাঞ্চন দেহ, স্থূল ও বলিষ্ঠ চোখ মুখের ভাব শিবের মতো সৌম্য নয় বরং অতি উগ্র। মাথায় জটা কানে কলিকা বা ধুতুরার ফুল তিনটি চোখ সবকটি প্রায় গোলাকার এবং রক্তাভ, নাক টিকানো দাড়ি নেই গোঁফ দুটি চওড়া, ও কান পর্যন্ত বিস্তৃত দেহ প্রায় নগ্ন, মাত্র কটি দেশে এক খণ্ড ব্যাঘ্র চর্ম ধারণ করেন বাবা পঞ্চানন্দ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, প্রহরণ হিসেবে কোন কোন স্থানে ত্রিশূল থাকে কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কিছু কিছু জায়গায় পঞ্চানন্দের ডান হস্তে ছোট লাঠি বা ছড়ি দেখা যায়। এর বাহন বহু প্রকার যেমন বামন, গোভুত, মামদো, ঘোটক, মৃগ ইত্যাদি। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় বাবা পঞ্চানন্দের দন্ডায়মান মূর্তির অপেক্ষা উচ্চাসনে উপবিষ্টমূর্তির প্রচলনই বেশি।

       পঞ্চানন্দ মূলত শিশুরক্ষক দেবতা বলেই প্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ। বাঙালি ভক্তদের বিশ্বাস ইনি তুষ্ট থাকলে সদ্য প্রসূত শিশু এবং গর্ভস্থ ভ্রূণ রক্ষা পায়। শিশুদের রিকেট রোগ ও ধনুষ্টংকার ইঁনি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় উভয়ই করে থাকেন। শুধু তাই নয় বহু পল্লীতে গৃহপালিত পশু-পক্ষীর যাবতীয় রোগের অপহর্তা বিশ্বাসেও তিনি পূজিত হন। অন্যান্য কারণে পূজা হলেও শিশু বা ভ্রূণ রক্ষার্থে পঞ্চানন্দের পূজা সংখ্যায় অধিক। অনেকে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রোগ নিরাময় করে দেবার

 উদ্দেশ্যে বুড়োবাবা বা পঞ্চানন্দের কাছে মানত বা মানসিক (mental vow) করে থাকেন। ভক্তদের বিশ্বাস বুড়ো বাবা তাদের প্রার্থনা শুনবেন এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বা শিশুকে সারিয়ে তুলবেন।  আসলে তৎকালীন সময়ে ডাক্তারি বা কবিরাজি শাস্ত্রের সেভাবে উন্নতি না হওয়ার 


কারণে বাবা পঞ্চানন্দের মতো লৌকিক দেবতার উপর মানুষের অগাধ বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল।


সামগ্রিক আলোচনার পর তাই একথা বলাই যায় যে বাবা পঞ্চানন্দ বা বাবা ঠাকুর, বা বুড়ো বাবা যে নামেই আমরা তাঁকে অভিহিত করি না কেন, সে সময় তিনি গ্রাম বাংলার একজন অলিখিত ডাক্তার হয়ে উঠেছিলেন। তার কাছে মানত বা পূজা দেওয়ার পর থেকে মানুষ ইতিবাচক ফল লাভ করেছিল বলেই তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস সময়ের সাথে সাথে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাই হোক না কেন সেই সকল অলৌকিক ঘটনার বিশ্লেষণে নাই বা গেলাম, কিন্তু একথা ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে কেবল মানুষের অপূর্ব বিশ্বাসকে অর্জন করে একজন তথাকথিত লৌকিক দেবতা আজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় একেবারে শাস্ত্রীয় দেবদেবীর মতোই সমান মর্যাদার সাথে পূজিত হয়ে চলেছেন, এমনকি শহরাঞ্চলেও বাবা পঞ্চানন্দের নানান মন্দির স্থাপিত হয়েছে যেখানে তিনি নিত্য পূজিত। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও যন্ত্র সভ্যতার কালেও আমরা তাই দেখি বাবা পঞ্চানন্দ, মা শীতলা, ওলাইচন্ডী, মাকাল ঠাকুর, আটেশ্বর বা বনবিবির মতো এই সকল বাংলার লৌকিক দেবদেবীর প্রতি মানুষের শরণাগতি। আর এই কারণেই বাবা ঠাকুর বা পঞ্চানন্দ সহ এই সকল লৌকিক দেব দেবী যে বাঙালির সংস্কৃতির সাথে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।

তথ্যসূত্র:

প্রবন্ধটি লিখতে গিয়ে আমি কতগুলি মূল্যবান গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি সেই গ্রন্থ গুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল।

Niyogi, Tushar Kanti, 1987, Aspects of Folk Cults in South Bengal, Anthropological Survey of India, Calcutta 700016
Dey, Lal Behari, 1878, Bengal’s Peasant Life, Macmillan and Co. Ltd
বসু, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ, ১৯৮৭, বাংলার লৌকিক দেবতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০০৯
Jana, Thakurdas, “Rituals and Diseases: Bengal’s Folk Deities in the Distribution and the Preservation of Sickness”, Academia
https://www.khaskhobor.com/offbeat/the-significance-and-story-of-panchanan-thakur/,

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. পড়লাম। দারুন তথ্য সংগ্রহ ও তাঁর সম্প্রচার। লেখকের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি।

    উত্তরমুছুন