- বই - কারাগারে ১৮ বছর ( ১ম ও ২য় খণ্ড)
- লেখকঃ আজিজুল হক
- প্রকাশকাল – বইমেলা ১৯৯০ (১ম) / বইমেলা ১৯৯১ ( ২য়)
- প্রকাশনী – দেজ পাবলিশিং
- প্রচ্ছদ – অপরূপ উকিল
- মুদ্রিত মূল্য – ৩৫/- (১ম) / ৪০ /- (২য়)
- পৃষ্ঠা সংখ্যা – ১৬৫
আ
জ আমি কোনও পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখছি না। আজ এমন একটি বই
সম্পর্কে লিখছি যে বইটি এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। শুধু বইটিই নয় এই
বইয়ের রচয়িতাকেও পাঠকমহলের অন্তরালে রাখা হয়েছে। আমি শুধু একজন এমন মানুষ সম্পর্কে
সবাইকে জানাতে চাই যিনি সমাজ সংস্কারের নেশায় নিজের জীবনকে ছিন্নভিন্ন করতে পিছপা
হন নি। অথচ আজও রয়ে গেছেন সমাজ তথা দেশে ব্রাত্য।
একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার মনে হয় বই তিন প্রকারের
হয়। কিছু বই পড়ার প্রায় সাথে সাথেই মন
থেকে মুছে যায়। কিছু বই আমরা আত্মস্থ করি কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা স্মৃতিতে আবছা
হয়ে যায়। আর অত্যন্ত অল্প সংখ্যক কিছু বই থাকে, যা সারা জীবনের জন্য মনে এমন গভীর
ছাপ ফেলে দেয় যা ভুলে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় যা স্মৃতির মণিকোঠা থেকে
মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে অন্তর্আত্মাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।
এমনই একটি বই হল বিখ্যাত অথচ বিস্মৃত নকশাল নেতা আজিজুল হক রচিত “কারাগারে
১৮ বছর”। যেটি
পড়ার পর বেশ অনেকদিন আমার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছিল। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, মানসিক ও খানিকটা শারীরিক
ভাবেও অনুভূত হয়েছিল। আজও যখন বইয়ের কিছু কথা মনে পড়ে তখন স্বাভাবিক ব্যবহারে তার
ছাপ পড়ে। নকশাল আন্দোলনের এক জীবন্ত দলিল হল এই বইটি। লেখক এই বইতে নকশাল যুগে
কারাগার জীবনের কঠিন, কষ্টকর এবং
অবশ্যই নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক ইতিহাসকে
লিপিবদ্ধ করেছেন। বইয়ের শুরুতেই লেখক মুখবন্ধ লিখেছেন "আমার কৈফিয়ৎ" নাম দিয়ে।
তার খানিকটা অংশ আমি উল্লেখ করতে চাই।
কলম্বাস থেকে কলমবাজ! অধঃপতন, না, প্রগতি? ইজারাদাররা তার বিচার করবেন।চুলচেরা বিচার। শেষ কথাটা বলার মালিক একমাত্র ভবিষ্যৎ।অতীতকে ভবিষ্যতের হাতে তুলে দিতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। বর্তমান — যন্ত্রণাদায়ক। বর্তমান— দুঃসহ যন্ত্রণার বোঝা কাঁধে চাপিয়ে বার বার সেই সমস্ত মুশকিল আসান করেছে। অতীত বার বার ঘোষনা করেছে — "আমি ঘৃণ্য।" বর্তমান বলছে — "আমি মূর্তিমান বিপন্নকারী। যন্ত্রণাদায়ক!" ভবিষ্যৎ— "উজ্জ্বল।" অতীত থেকে ভবিষ্যতে পৌঁছনোর এই জটিল সংগ্রামই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। আদিম কাল থেকে মানুষ তার হাত আর মস্তিষ্ক নামক যন্ত্র দুটো ব্যবহার করেই নিজের এই অস্তিত্বটা টিঁকিয়ে রেখেছে।আর ক্ষমতা থাকলে হয়তো হাতে বেড়ী পরানো যায়, কিংবা অতিরুদ্ধ করা যায় কোনো কলম্বাসের! কিন্তু মস্তিষ্কে পরাবার মতো শেকল তো আজও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই …।
মানুষ অজেয়, অজেয় তার সহমর্মিতা, তার ভালোবাসা। তারই ইতিবৃত্তের নাম ইতিহাস। এই সহমর্মিতার নিদর্শন— এই লেখার প্রকাশ।লেখাটা যখন পুলিশের মহাফেজখানায় যাবার জন্য অপেক্ষা করে বিছানার তলায় আত্মগোপন করেছিল, সেই সময় দেবদূতের মতো একজনের আবির্ভাব। তিনি চব্বিশ ফুট উঁচু পাঁচিল আর নিরাপত্তার বেড়া পার করালেন। পৌঁছে দিলেন যথাস্থানে। অন্যান্য সব লেখার মতোই 'কংসের কারাগারেই' এর জন্ম। এর আত্মপ্রকাশের ইতিহাস গোপন প্রস্তুতির ইতিহাস। তাই গোপনীয়তার গ্লানি তো এতে থাকতেই পারে।
বিগত শতাব্দির ষাটের দশকের
মাঝামাঝি থেকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির
(মার্কসবাদী) নেতৃত্বে ভূস্বামী তথা
বুর্জোয়া শ্রেনীর বিরুদ্ধে নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের প্রথম সারির
নেতা ছিলেন আজিজুল হক। নকশাল আন্দোলনের প্রধান সংগঠক চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর
তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান। সি.পি.আই(এম.এল)– এর বহু বিতর্কিত
ব্যক্তির হত্যা সহ বিভিন্ন অভিযোগে তিনি কারারুদ্ধ হন। দীর্ঘ আঠেরো বছর জেলের অভ্যন্তরে
কাটানোর যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা তিনি করেছেন এই বইয়ে। সেই
অস্থির সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে
প্রকাশ পেয়েছে দলীয় নেতাদের মুখোশের আড়ালের ক্ষমতালোভী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
নির্দ্বিধায় ব্যাক্ত করেছেন তৎকালীন ক্ষমতাশীল শাসকের অঙ্গুলিহেলনে নির্বিচারে
গণহত্যাসহ বহুবিধ পাশবিক অত্যাচারের বিবরণ। রয়েছে অকথ্য শারীরিক তথা মানসিক
অত্যাচারের কথা। লাঠির ঘায়ে সকালের ঘুম ভাঙ্গা, পচা খাবার জোর করে গলাধঃকরণ করানো, রাতের পর রাত মানসিক অত্যাচার
থেকে শুরু করে চোখের সামনে সতীর্থদের খুন হয়ে যাওয়া দেখার বর্ণনা পড়ে শিউরে উথতে
হয়। বইয়ের কিছু কিছু অংশ এতটাই ভয়াবহ যে পড়ার পর সুস্থ বুদ্ধির পাঠকের স্নায়ু অবশ
হতে বাধ্য। অত্যাচারিত হয়েছেন এমন কি নিরপরাধ কবিতা লেখার জন্যও সহ্য করেছেন মানসিক
যন্ত্রণা।
আজীবনের জন্য পঙ্গু। তবু কলম ত্যাগ করেন নি। এই
বই জেলখানায় বসেই লেখা শুরু করেন যা ‘আজকাল’ পত্রিকার সম্পাদক অশোক গুপ্তের নজরে
আসে। তিনি ও তাঁর গুটিকয় সাংবাদিক উদ্যোগী হয়ে এই লেখা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশ করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে পঙ্গু – অথর্ব অবস্থায় সারা শরীরে অত্যাচারের
ক্ষত চিহ্ন নিয়ে মুক্তি পেলেও রয়ে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। কিন্তু রচনা করেন এক
জলন্ত সময়ের জীবন্ত ইতিহাস।
- অখণ্ড বই – কারাগারে ১৮ বছর
- দেজ পাবলিশার্স কলিকাতা
- মূল্যঃ ৩০০/-
- পৃষ্ঠা – ২৭৯
বইটি ১৯৯০ / ১৯৯১ সালে ক্রমান্বয়ে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল । সেই সময় লেখকের কথানুসারে এটির তৃতীয় খণ্ড লেখা চলছিল, কিন্তু পরে তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ হয়নি। পরবর্তী কালে ২০১৫ সালে দেজ পাবলিশার্স এটির অখণ্ড মুদ্রণ প্রকাশ করে যা বর্তমানে উপলব্ধ আছে। শুধু পড়ার জন্যই নয় এই বই সংগ্রহে রাখার মতও অবশ্যই।
0 মন্তব্যসমূহ