ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

অপরাজিত (২০২২): বাঙালির সোহাগ চাঁদ... -অভিষেক ঘোষ


প্রথমেই বলি, সিনেমাটি আমার যথেষ্ট নড়বড়ে লেগেছে। এই নড়বড়ে ব্যাপারটি ঠিক কেমন? ধরা যাক, ভগবানের বিশাল এক ভক্ত আপনাকে ভগবানের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে আরম্ভ করলেন। সেক্ষেত্রে ফুল-মালা-চন্দন আর ধূপ-ধুনা-বন্দন - এর অতিরিক্ত কিছু আপনি নিশ্চয় আশা করতে পারেন না। অন্ধ ভক্তি এক মরীচিকা, কান ধরে ঘুরিয়ে মারে। অমন ভক্তি বিশেষ থেকে নির্বিশেষের দিকে কিছুতেই যেতে দেয় না, তার কারণ সামনে দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ভগবানের দুই পা। আর উপরে তাকালে তো কথাই নেই, শ্রীমুখ আর তা ঘিরে জ্যোতির্বলয় চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। ফলে ভক্ত পথে বেরোলে পা টলমল করে, চোখে দেখা যায় না; তবে অনুভব করা যায়, তিনি নিজে হাঁটছেন না, স্বয়ং ভগবান তাঁকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমাদের 'অপরাজিত' তেমনি একটি ছবি। এই ছবিতে ('সিনেমা' বলা একটু মুশকিল!) নায়ক জীতু কামাল থেকে শুরু করে, পরিচালক অনীক দত্ত - সকলের ঘাড়েই 'কর্তার ভূত' ভর করে আছেন! তবুও কিছু দৃশ্যে পুনর্নির্মাণ বেশ চমকপ্রদ লাগে, ঠাকুর পুজো বেশ আবেগাপ্লুত করে, সবচেয়ে বড়ো কথা স্টারবর্জিত বাংলা ছবি দিয়েও মরা বাজারে সিনেমাহল ভরিয়ে তোলে; এও কি কম কথা নাকি! অর্থাৎ ভক্তটি সম্পূর্ণ চোখ বুজে নেই, তিনি এক চোখ বুজে আরেক চোখে পিটপিট করে বাজার মেপে নিয়েছেন।


এই সিনেমার গল্প নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই। এই ছবি মোটেও সত্যজিৎ রায়ের বায়োপিক নয়, কিন্তু উদ্দেশ্য 'তাঁকে' তুলে ধরা তথা শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান। যদি সত্যিই সত্যজিৎ-কে তুলে ধরার প্রয়োজন আজ পড়ে, তবে বলতেই হবে এ তাঁরও দুর্ভাগ্য, আমাদেরও। ছবিটা আমাদের সত্যজিৎ চেনাতে গিয়ে অসংখ্য অবান্তর দৃশ্যের ক্লান্তিকর সমারোহ এনে হাজির করে। আমরা প্রথমার্ধে প্রায় ভুলেই যাই, এটা 'পথের পাঁচালী'র মেকিং-এর গল্প নিয়ে বানানো ছবি। সেখানে ফিল্ম সোসাইটি পত্তন (জ্ঞান-ফলানো লম্বা দৃশ্য), বিদেশি গানের রেকর্ড শোনা, চোস্ত ইংরেজিতে স্ত্রী ও সাহেবদের সাথে কথা বলা, পরিচিত স্টিল ছবির মতো অপরাজিত-র পোজ দেওয়া, পিয়ানো বাজাতে বাজাতে স্বরলিপি নোট করা, এমনকি শিস দেওয়া - সব পরপর দেখাতে হয়। কিন্তু কেন? ওম্মা! না দেখালে আপনারা জানবেন কী করে যে, তিনি বউ ছাড়া কারো দিকে একেবারেই তাকাতেন না, তাঁর জীবনে ও কেরিয়ারের উত্থানে স্ত্রীর বিরাট ও সদর্থক ভূমিকা ছিল, তিনি সব - মানে স-অ-অ-ব পারতেন, ফিল্ম বানাতে গিয়ে ভাবনায় ভাবনায় তাঁর রাতে ঘুম হত না (মানে আমি/আপনি বানালে, যেমনই বানাই, টেনশন-ফ্রি হয়ে, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবো)! কথা হচ্ছে, এসবের দরকার ছিল না। অবশ্য এসব করে চোখ-কান বুজে থাকা বাঙালিদের মধ্যে যদি আসল মানুষটাকে জানার, বোঝার, শেখার আগ্রহ বিন্দুমাত্রও তৈরি হয়; তবে বলব, হ্যাঁ একটা কাজের কাজ হয়েছে।


আমরা যখন 'M.S. Dhoni: The Untold Story' বা, 'Sachin: A Billion Dreams' অথবা, '83' দেখতে বসি, আমরা কিন্তু কাঁদব বলেই বসি। আবেগে ভাসার দাবি নিয়েই বসি। কিন্তু এটাও কি ওই গোত্রের ছবি? মনে তো হয় না। 'পথের পাঁচালী'র মতো কালজয়ী সিনেমার নির্মাণের নেপথ্য কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্রের চিত্রভাষা এত আবেগ-তাড়িত, বিশ্লেষণে অক্ষম ও অনিচ্ছুক, রীতিমতো ছক কষে স্মৃতিভারাতুর হলে চলে না। এখন কথা হচ্ছে, ছবিটা একেবারেই পাতে দেওয়ার মতো না হলে, এত কথা বলতাম না। শুনেছি কবিতার একটা লাইনও যদি ভালো হয়, তবে তা ছাপার যোগ্য। সেখানে ছবির বেশ কয়েকটা দৃশ্য বেশ মন ছুঁয়ে যায়! যেমন, তারসানাইয়ে 'পথের পদাবলী'-র আবহ সঙ্গীত তোলার দৃশ্য, কফিহাউসে তর্কে মগ্ন আমজনতার পুরস্কার-জয়ী অপরাজিত রায়কে দেখে সহর্ষ করধ্বনি (তারই মধ্যে একজন মহিলাকে দেখি, যিনি না-চেনার অভিনয় করেন ও হাততালি দিয়ে পাশের জনকে প্রশ্ন করেন - 'কে ইনি?' - এও বাঙালির স্বভাব বই কি!), জাহাজের দৃশ্য - এগুলি চমৎকার ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, অশীতিপর চুনীবালা দেবীর চরিত্রে ননীবালা দেবী হয়ে যিনি অভিনয় করেছেন, তাঁর শেষ দৃশ্যটি। সেখানে পরলোকগতা ইন্দির ঠাকুরণ সেজে বহুক্ষণ মরার মতো পড়ে থেকে ডাকাডাকি করায় অভিনেত্রী হঠাৎ উঠে বসে বলে ওঠেন, "কই কেউ কাট বলে নি তো? আমি সেই কখন থেকে দম আটকে..."! দৃশ্যটা অসাধারণ! অথচ কোনো-কোনো দৃশ্য কীভাবে গৃহীত হয়েছে, তা যেন এড়িয়ে যাওয়া হল - চিত্রগ্রহণ ও নির্দেশনা নয়, গুরুত্ব পেল দৃশ্যটির পুনর্নির্মাণ! যেমন সর্বমঙ্গলা (পড়ুন - সর্বজয়া) চরিত্রটি আল্টিমেটলি কীভাবে কন্যা-শোকে কাঁদার অভিনয়টি বিশ্বাসযোগ্য করলেন, সেই প্রক্রিয়াটি এড়িয়ে যাওয়া হল। কাশফুলের মধ্যে অপুর ইতিউতি চাউনি ধরার দৃশ্যটি গোঁজামিল দিয়ে তোলা হল! দুর্গার চরিত্রে অনুশা বিশ্বনাথ, দুর্গার বাবা হরিহরের চরিত্রের অভিনেতার উপস্থিতি তৃপ্তিদায়ক হল না। হর কুমার গুপ্তা-কে বেশ ভালো লাগল। বিধান রায়-কে অনেকটা জায়গা দেওয়া হল অকারণে, কিন্তু মানতেই হবে সেরা অভিনয়টা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই করলেন, তারপর অঞ্জনা বসু। জীতু কামাল বেশ আকর্ষণীয়, তবে মাথায় রাখতে হবে সত্যজিতের কণ্ঠ কিন্তু আরেকজনের - চন্দ্রাশিষ রায়ের - কোনো কোনো দৃশ্যে তিনি কণ্ঠদানে অনবদ্য। ছবির স্বপ্নদৃশ্যটি জঘন্য ও মেদবিশেষ; সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথকে না ঢোকালেই চলছিল না? ছবিতে প্রচুর 'কাটস্' গোলমেলে, কিন্তু আলোর ব্যবহার বেশ ভালো কিছু দৃশ্যে। ছবিটা সাদা-কালোয় বানিয়ে অনেক খরচ ও ঝামেলা বাঁচিয়েছেন পরিচালক, বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। তবে তাঁর নন্দনতত্ত্বে আরো জোর দেওয়া উচিত ছিল, সেখানে অনেক খামতি থেকে গেছে (টাকে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়াও তার মধ্যে একটি)। দুর্গার ডায়লগ ডেলিভারি কেমন অদ্ভুত শোনালো! প্যাঁচার vfx-টা আরো ন্যাচারাল হলে ভালো হতো। প্রচুর দৃশ্য জাস্ট বাদ দেওয়া যেত - দেড় ঘন্টার টানটান ছবি হতে পারত। ক্যামেরা প্রয়োগে আরো ভাবনার দরকার ছিল! কিন্তু সবচেয়ে বড়ো গোলমালটা স্বয়ং সত্যজিৎ-পুত্রই বাঁধিয়ে রেখেছেন! অপরাজিত রায়ের বাড়ির কাজের লোকটির নাম প্রহ্লাদ (শঙ্কুর গল্প মনে পড়বে), অথচ বাকি শতকরা ৯৯ ভাগ নাম যাচ্ছেতাইভাবে বদলে দেওয়া হল - ফলে আসল-নকলের ফারাক ধূসর হয়ে গেল! 'আম আঁটির ভেঁপু' যদি 'তাল পাতার বাঁশি' হয় মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু 'Bicycle Thieves' যদি দুম করে 'Bicycle Rider' হয়ে যায়, তাহলে বলতেই হয় 'না বানালেই পারতেন!' কারণ এতে সবটুকুই এলোমেলো হয়ে যায়। সায়নী ঘোষের অভিনয়ে কেমন 'হইচই'-এর গ্ল্যামার লেগে গেছে, তাই তাঁকে মানতে একটু অসুবিধা হলেও, তিনি নিজে ভালোই মানিয়ে নিয়েছেন মনে হল। অনীক বাবুর কাছে শেষে একটাই প্রস্তাব - আপনি ভূত-ভগবান-দশচক্র ছেড়ে এবার আমাদের সময় নিয়ে, আমাদের বর্তমান সংকট নিয়ে কিছু বানান তো দেখি, না হয় নাম-ধাম পালটে দেবেন। দেখুন, অল্পেতে খুশি আমরা হই না! আপনারও কি ইচ্ছে করে না, সিনেমার 'দামোদর শেঠ' হতে?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ