ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

হৃদয়ের পৃষ্ঠা - ২ -তুষার সরদার


|| এক ||

বে ক্লাস সেভেনে পা দিয়েছি। তখনও আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধু ক্লাস সিক্সের গন্ধ মাখা রয়েছে– বিদ্যায় ও চেতনায়। নতুন সেশনে দিন পনেরো কুড়ি হল সেভেনের ক্লাস শুরু হয়েছে আমাদের। আমাদের স্কুলের নাম ছিল কাদিপুকুর জুনিয়র হাইস্কুল। অতি প্রত্যন্ত গ্রামে জুনিয়র হাইস্কুলের সংখ্যাই বেশি। এইসব স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্তই পড়ানো হয়। অর্থাৎ এই বছরটা ধরে আর দুবছর এই স্কুলে আমি পড়ব। তারপর হাইস্কুলে ভরতি হতে হবে।

আমাদের স্কুলটা কো-এড স্কুল। শুধু মেয়েদের স্কুল তখন কেবলমাত্র শহরেই ছিল। গ্রামের দিকে সব স্কুলই কো-এড স্কুল। আমাদের ক্লাসে সাত-আটজন মেয়ে পড়ে। তারা স্যারের এক পাশের দিকের দুটো আলাদা বেঞ্চে বসে। আমরা ছেলেরা বসি স্যারের সামনের দিকের বেঞ্চে। কারণে বা অকাররণে মেয়েদের দিকে মাঝে মধ্যে চোখ চলে যেতই। তবে আমার দৃষ্টি ঘোরাফেরা করত তাদের মেয়েলি চোখমুখ, দুটো পাশ-বিনুনি বাঁধা চুল, মেয়েলি ভাবভঙ্গি, খিলখিল হাসি। আর বড়োজোর তাদের মসৃণ গলা, ঘাড় আর সুডৌল দুটি হাত পর্যন্ত। 

এখনকার চটপটে ছেলেমেয়েদের পরিবেশ ও বিভিন্ন পরিস্থিতির কল্যাণে অথবা অকল্যাণে দশ-বারো বছর বয়সের মধ্যেই যৌনতার সবকিছু জানাজানি ও বোঝাবুঝি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সেসব সময়ের ছেলেমেয়েদের এত তীব্রগতি উন্নতি কল্পনাও করা যেত না। সেসময় ফ্রক পরা সহপাঠিনীদের বুক, নিতম্ব, উন্মুক্ত জঙ্ঘা অর্থাৎ পায়ের গোছ – এসব আমার দ্রষ্টব্যের তালিকার ধারেকাছেও আসেনি। ক্লাসে আমার প্রায় সব সহপাঠির মনোজগত সেরকমই ছিল বলে আমার ধারণা। সেজন্য সেদিনের ওই ব্যাপারটার এইরকম গুরুতর পরিণতির কথা শুনে সেদিন প্রায় সবাই আমার মতোই খুব অবাক হয়েছিল।

আমাদের ক্লাসে যেসব মেয়ে পড়ত তাদের মধ্যে চার পাঁচজন মেয়েকে বেশ ভালো মনে হত। তাদের সঙ্গে আমার বেশ ভালো ও সহজ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে কথাও হত। বাকিদের মধ্যে জনা দুই মেয়েকে আমার মোটেই পছন্দ ছিল না। সেই দুজনের মধ্যে অঞ্জলি নামের একটি মেয়েকে আমার একটুও ভালো লাগত না। তার সঙ্গে কথা আমার কখনও কোনো কথা হয়নি বা হত না।

অঞ্জলি শুধু আমার থেকে নয়, ক্লাসের প্রায় সবার থেকে বয়সে বেশ বড়ো আর খুব মোটাসোটা চেহারার ছিল। তার মুখটা ছিল গোলাকার আর একটু চ্যাপটা ধরনের। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার পর সে নাকি পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। তার পর কয়েক বছর সে বাড়িতে বসে কাটিয়েছিল। অঞ্জলির আবার পড়াশোনা করার ইচ্ছা জেগে ওঠায় তার বাবার প্রতিপত্তির জোরে এই স্কুলেই ক্লাস ফাইভে ভরতি হয়েছিল। গত বার্ষিক পরীক্ষায় অঞ্জলি চার বিষয়ে ফেল করলেও তাকে ক্লাস সিক্সে প্রমোশন দেওয়া হয়েছিল। কেন যে তাকে আমার এত বিরক্তিকর মনে হত তা তখন ঠিক বুঝতাম না, আজও না।

অঞ্জলি ছিল স্থানীয় জমিদার বাড়ির মেজ তরফের মেয়ে। তার বাবা ছিলেন সেই স্কুলের পরিচালন কমিটির সেক্রেটারী। তখনকার দিনে সেক্রেটারীর মর্জিতে প্রধানশিক্ষক ছাড়া অন্য শিক্ষকদের নিয়োগ হত এবং চাকরি যেতেও পারত। সেজন্য আমি ক্লাসের ফার্স্টবয় হলেও আমাদের ক্লাসে বা সারা স্কুলে তার সম্মান আমার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। অঞ্জলি নিজেও এই ব্যাপারে সবসময় খুব সচেতন থাকত।

|| দুই ||


সেই জুনিয়র হাই স্কুলের আমার চার বছরের ছাত্রজীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর বিপদের দিনটির কথা বলছি। স্কুলে তখন দ্বিতীয় পিরিয়ডের ক্লাস হচ্ছিল। সেটা ছিল ভূগোলের ক্লাস। সেদিনের ক্লাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। একেবারে শেষের দিকে এসে ভূগোল স্যার প্রশ্ন করলেন -
‘ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নাম কী?’ 
তখনকার দিনে সদ্য সিক্স পেরোনো ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা কিন্তু নিতান্ত এলেবেলে প্রশ্ন নয়। ক্লাসে সকলের উদ্দেশে করা প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রচলিত নিয়ম ছিল যারা উত্তর দিতে চায় তাদের হাত উঁচু করতে হবে। এবার স্যার যাকে ডেকে উত্তর দিতে বলবেন শুধু সে-ই উত্তর দেবে। ভূগোল স্যারের সেদিনের ওই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য অল্প কয়েকটি হাত উঁচু হয়ে উঠল। অঞ্জলির হাতও উঁচু হয়েছে। তাকে যথোচিত এবং যথাপূর্ব সম্মান দিতে প্রথমে তাকেই উত্তর দিতে বলা হল। প্রথামাফিক সবাই উঠে দাঁড়িয়ে স্যারের প্রশ্নের উত্তর দেয়। কিন্তু অঞ্জলি উঠল না। বেঞ্চে বসে বসেই চেঁচিয়ে উঠল - 
‘এভারেস্ট!’ 
দুটো হাত ছাড়া অন্য হাতগুলো নেমে গেল। সেই দুটো হাতের মধ্যে একটা আমার ছিল। কেন এবং কী করে জানি না আমি হঠাৎ প্রথা ভেঙে উত্তর দিয়ে ফেললাম, বলে উঠলাম - 
‘ভুল! ভারতের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নাম কে-টু!’
ভূগোল স্যার আমার দিকে খরখরে চোখে তাকিয়ে বললেন - 
‘তোমাকে কিন্তু এখনও জিগ্যেস করা হয়নি! আর কার উত্তর ভুল হল সেটা বিচার করার দায়িত্ব কিন্তু তোমার নয়। যাহোক সঠিক উত্তরটা হবে কে-টু। এভারেস্ট পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ বটে কিন্তু সেটা ভারতে নয়, নেপালে অবস্থিত।’ 
সামান্য পরেই ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়তে ভূগোল স্যার বেরিয়ে গেলেন। স্যার বেরিয়ে যাবার পরই অঞ্জলি ফুঁসে উঠল আমার উপরে - 
‘তোকে এত পন্ডিতি করতে কে বলল?’ 
আমি পালটা জবাব দিলাম - 
‘কেউ মুখ্যুমি করলে সেটা বুঝি দোষের নয়?’
অঞ্জলি তখুনি জুতসই জবাব খুঁজে না পেয়ে ক্ষেপে গেল। আমি বেশ রোগামতো ছিলাম। সেটাই ইঙ্গিত করে চেঁচাল - 
‘তুই তো একটা শুঁটকি মাছ!’ 
ওর গোলাকার আর একটু চ্যাপটা ধরনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম - 
‘তবে তুই একটা আলুর চপ!’ 

এইসব শুঁটকি মাছ আর আলুর চপের বিতন্ডা শুনে কয়েকজন সহপাঠী হেসে উঠল। আমার কথা শুনে প্রথমটা অঞ্জলি থমকে গেল। তারপর কেন জানি না, কী ভেবে সে ফিঁক ফিঁক করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। এবার আমি অবাক হয়ে গিয়ে ভাবলাম সে কেঁদে ফেলল কেন। সে যেমন আমার চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ করে শুঁটকি মাছ বলেছে, আমিও তাকে সেভাবেই তো আলুর চপ বলেছি। এতে তার কাঁদার কী আছে?

হঠাৎ অঞ্জলি তার বইখাতার ব্যাগটা ক্লাসরুমে ফেলে রেখেই দপদপিয়ে শুধু ক্লাস ছেড়ে নয় একেবারে স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা অনেকটা পল্লবিত হয়ে দুর্দান্ত এক খবরে পরিণত হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে খবর ছড়িয়ে পড়ল স্কুলের সর্বত্র। খবর চলে গেল সব ক্লাসে, টিচার্স রুমে, এমন কী হেডস্যারের কাছেও।

|| তিন ||

সে সময়ে ক্লাসের অ্যানুয়্যাল পরীক্ষায় দুবার ফেল করলে এখনকার মতো স্কুল থেকে বিদায় দেওয়া হত না। তার প্রত্যক্ষ কারণ ছিল স্কুলে ছাত্রছাত্রীর যথেষ্ট অভাব। তাই একাধিক বার ফেল করলেও পড়তে ইচ্ছুক ছাত্র বা ছাত্রীকে স্কুলে রাখা হত। তিনবার ফেল করলে তাকে পরের ক্লাসে প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হত। এই কারণে তিন-চার জন করে বেশ বয়স্ক ছাত্রকে স্কুলের সব ক্লাসেই দেখা যেত। তারা সবদিক দিয়েই যথেষ্ট পরিণত ও পরিপক্ক অর্থাৎ পাকা ঝুনো। ক্লাস এইটের সেরকম বয়স্ক একজন ছাত্র এসে আমাকে এক চোখ টিপে বলল - 
‘যা একখানা দিইচিস না বস্‌! কী দারুণ ভাবে বললি তুই! অঞ্জলি হল আলুর চপ! হে হে, অঞ্জলির আলুর চপ! হে হে, অঞ্জলির আলুর চপ! খুব জব্বর জায়গাতেই ঘা দিইচিস রে বস্‌!’ 
একই ক্লাসের আরেকজন বয়স্ক ছাত্র ফিচেল হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল - 
‘জিও! গুরু জিও! দেখে দেখে একেবারে ঠিক সেন্টার জায়গাতেই জোর ঝেড়ে দিইচিস মাইরি!’ 

আমি খুব অবাক হয়ে তাদের ওই অদ্ভুত কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ সে সুযোগ পেলাম না।

আমাদের স্কুলের দপ্তরি গোকুলদা শুকনো মুখে এসে আমার কাছে দাঁড়াল। গোকুলদা আমাকে খুব ভালোবাসে। নিরুপায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় বলল - 
‘টিচার্সরুমে হেডস্যার তোমাকে এক্ষুনি ডাকছেন।’
এতক্ষণ যেটা হয়নি, গোকুলদার মুখ দেখে কথা শুনে এবার সেটা হল - আমি ভয় পেলাম... খুব ভয় পেলাম এবং কারণ না জেনেই ভয় পেলাম। গুটি গুটি কাঁপা পায়ে টিচার্সরুমের দিকে চললাম। সেখানে তখন সারা স্কুল ভেঙে পড়েছে। আমাকে সেদিকে আসতে দেখেই কিছু ছেলে বলে উঠল - 
‘ওই যে আসছে! - আসছে!’ 
আমি কী যে করেছি তা একটুও না জেনে, না বুঝেও ভয়ের আরও গভীরে ডুবে যেতে লাগলাম।

|| চার ||

টিচার্সরুমে ঢোকার পর আমার সারা শরীর মৃতদেহের মতো আড়ষ্ট হয়ে গেল। প্রত্যেক টিচারই তীক্ষ্ণ কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শুধু ব্যতিক্রম হেডস্যার, তবে তাঁর চোখমুখ খুব থমথমে। হেডস্যার ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এবং আমার সমগ্র ছাত্রজীবনে দেখা অন্যতম সেরা শিক্ষক তিনি। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন - 
‘তোমাকে কেন এখানে ডেকে আনা হয়েছে জানো?
সেটাই তো প্রাণপণে জানতে চাই আমি! জানতে চাই আমি কী করেছি? কখন বা তা করেছি? জড়ানো স্বরে কোনোমতে বললাম - 
‘না স্যার।’
‘না স্যা-এ্যা-র!’ তীব্র ভাবে ভেংচে চেঁচিয়ে উঠলেন একজন শিক্ষক - ‘একেবারে ন্যাকা কেষ্টো হয়ে এখানে এলেন! এখনই এটাকে আচ্ছাসে একটা আড়ং ধোলাই...’ 
হেডস্যার তাঁর দিকে ঘুরে তাকাতেই তিনি থেমে গিয়ে বললেন - 
‘স্যরি স্যার!’
হেডস্যার এবার আমাকে বললেন - 
‘তুমি কি আজ কোনো অন্যায় কাজ করেছ?’
‘হ্যাঁ স্যার করেছি।’
‘কী করেছ?’
‘ভূগোল স্যার ক্লাসে আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর জিগ্যেস করেননি, তবু আমি তার উত্তরটা দিয়ে ফেলেছি।’ 
হেডস্যার ভূগোল স্যারের দিকে তাকাতে তিনি চাপাস্বরে হেডস্যারকে কিছু কথা বললেন। হেডস্যার এবার জিজ্ঞাসা করলেন - 
‘এটা ছাড়া আর কিছু অন্যায় কাজ কি তুমি করেছ?’ 
‘না স্যার।’

|| পাঁচ ||

আমার উত্তরের পর হেডস্যার আমাকে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন। কিন্ত তিনি কিছু বলার আগেই বাইরে একটা রব উঠল -
‘এই সরে যা – সরে যা!’
মেজো তরফের কর্তা অর্থাৎ অঞ্জলির বাবা সঙ্গে কয়েকজন লোক নিয়ে গটগটিয়ে টিচার্সরুমে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব ক’জন টিচার ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের বসার জায়গা করে দিলেন। জমিদারি প্রতাপে মেজোকর্তা বললেন - 
‘আই ওয়ান্ট টু নো রাইট নাউ হু ইজ দ্যাট ডার্টি ফেলো?’ 
একজন টিচার সাগ্রহে আমার দিকে আঙুল তুলে দু’পা এগিয়ে এসে বলে উঠলেন - 
‘ওই যে স্যার, ওই যে মালটি দাঁড়িয়ে আছে, ওটাই!’
জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে আমাকে আগাগোড়া কয়েকবার পোড়ালেন মেজোকর্তা। তারপর সরোষে হিস্‌হিস্‌ করে উঠলেন -
‘আমি চাই ওটাকে এখনই রাস্টিকেট করা হোক!’
হেডস্যার থমথমে মুখে গম্ভীর গলায় বললেন - 
‘রাস্টিকেট করার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতি মেনে সেটা এখনই করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আজকের করা অপরাধ সম্পর্কে অপরাধীর নিজের কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই। তবুও এখনই আমি ওকে ক্লাস থেকে সাসপেন্ড করছি, আনটিল ফারদার অ্যাডভাইস এই সাসপেনশন বলবৎ থাকবে।’ 
এবার তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন - 
‘তোমাকে ক্লাস থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাসপেন্ড করা হল। এর অর্থ, যতদিন না তোমাকে আবার স্কুলে আসতে বলা হবে ততদিন তুমি স্কুলে আসতে পারবে না। তোমার বাবার কাছে এব্যাপারে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। আজকে এখন স্কুল ছেড়ে তুমি বাড়ি চলে যাও। তবে তুমি একা যাবে না। স্কুলের দুজন ছেলে তোমার সঙ্গে তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত যাবে।’

এতক্ষণের বিভ্রান্তির মধ্যে যে ব্যাপারটা মোটামুটি স্পষ্ট বুঝে গেছি তা হল, আমাকে শুঁটকি মাছ বললেও অঞ্জলিকে কোনো কিছুই বলা আমার উচিত হয়নি। কেননা সে হচ্ছে এখানকার জমিদার বাড়ির মেয়ে। তার বাবা এই স্কুলের বিধাতা। হেডস্যারের নির্দেশমতো টিচার্সরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে শুনলাম মেজতরফের কর্তা হেডস্যারকে বলছেন - 
‘কী আশ্চর্য! এইটুকু ছেলে, দেখতেও তো বেশ ইনোসেন্ট লাগল, তবু অতটা বেশি নোংরা এবং অশ্লীল হল কী করে? আচ্ছা ওটার ফ্যামিলিও কি তাহলে খুব অশিক্ষিত আর অত্যন্ত লোয়্যার ক্লাসের?’ 
‘না। এই ছেলেটি যথেষ্ট শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের। ওর বাবা উচ্চশিক্ষিত এবং আমার মতোই তিনিও একজন স্কুলশিক্ষক।’

|| ছয় ||

মেজতরফের কর্তার বলা ‘নোংরা’ আর ‘অশ্লীল’ শব্দদুটো ধোঁয়াটে রঙের দুটো ভীষণ বলশালী পশু হয়ে পিছন থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল...আমার কচি ঘাড়ে তাদের দুর্গন্ধময় দাঁত বসে যেতে লাগল। আমি মনে মনে ভেঙে টুকরো হতে থাকলাম। 

স্কুল থেকে নিতান্ত অসময়ে এবং শুকনো মুখে বাড়ি ফিরতে মা খুব অবাক হলেন। আমি মায়ের কাছে যে কোনো ব্যাপারেই মিথ্যা বলতে সম্পূর্ণ অক্ষম ছিলাম। স্কুলে যা যা ঘটেছিল সবই বললাম। সব কথা শুনে তাঁর চোখে জল এল। আমাকে বুকে চেপে ধরে বললেন - 
‘এই সামান্য কারণে ওরা তোকে এতবড়ো শাস্তি দিল! ভাবিস না। তোর বাবা বাড়ি ফিরে আসুক। কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। তোর পড়াশোনা বন্ধ হবে না কিছুতেই।’ 
‘আচ্ছা মা, আমি অঞ্জলিকে যে কথা বলে ছিলাম সেটা কি নোংরা আর অশ্লীল ছিল? ওই কথাকে উনি নোংরা বললেন কেন? আর অশ্লীল কথাটার মানে কী মা?’
এবার মায়ের দু’চোখ ছাপিয়ে জল গড়াতে লাগল। আমার পরম আশ্রয়ে আমাকে ওই ভাবেই জড়িয়ে ধরে রেখে মা বললেন -
‘তুই কিচ্ছু অন্যায় বা খারাপ কথা বলিস্‌নি বাবা। যত অন্যায় আর খারাপ ওঁর মনের মধ্যে আছে। কিন্তু এসব কথা এখন থাক। তুই জামা প্যান্ট ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে পড়ার ঘরে যা।’
সন্ধ্যায় বাবা ফিরলেন। সব কথা বাবার কাছে আবার বললাম। এমন কী অঞ্জলির বাবা আমাকে উদ্দেশ করে শেষে যে কথা বলেছিলেন তাও বললাম। সবটা শোনার পর বাবা বললেন - 
‘কোনো একটা জায়গায় বড়োরকমের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু সেটা কোন জায়গা সেটা আইডেন্টিফাই করা দরকার।’     
বাবা চুপচাপ বসে আরও কিছক্ষণ ভাবলেন। তারপর মাকে ডেকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। নীচুগলায় বলা ওঁদের কোনো কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। খানিক পরে শুধু মায়ের গলা শুনতে পেলাম - 
‘প্রত্যেক মা সবচেয়ে বেশি করে জানে তার সন্তানকে। আমার ছেলে ওই অর্থে এভাবে বলতে পারেই না।’

|| সাত ||

চারদিন পর। সেদিন রবিবার ছিল। আমাদের স্কুল থেকে পাঠানো চিঠিটা এরমধ্যে বাবা পেয়েছিলেন। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাবা আমাকে নিয়ে আজ হেডস্যারের বাড়িতে দেখা করতে এসেছেন। আজকেই ঠিক হয়ে যাবে আমি এই স্কুলে পড়তে পারব কী না। এর মধ্যে বাবার সঙ্গে অন্য একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষকের এই ব্যাপারে কথা হয়েছে। সব বিবরণ শুনে তিনি আমাকে তাঁর স্কুলে নিতে খুব আগ্রহের সাথে রাজি হয়েছেন। আমি কিন্তু এই স্কুলেই থাকতে মনেপ্রাণে চাই। 

হেডস্যারের বাড়ির বাইরের উঁচু বারান্দায় হেডস্যার, বাবা ও আমি বসে আছি। আমাকে একটু দূরে বসতে বলা হয়েছে। ওঁরা এই ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। এমন সময় দেখা গেল আমাদের ক্লাসটিচার চন্দ্রনাথবাবু সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন। ওঁর এই গ্রামেই বাড়ি। উনি হেডস্যারের প্রাক্তন ছাত্রও বটে। হেডস্যার তাঁকে ডেকে বললেন - 
‘এই যে চন্দর শোনো, এখানে একবার উঠে এসে এখানে বোসো। তুমি তো এর ক্লাসটিচার। এই মেধাবী ছেলেটাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে দিতে আমার মন চাইছে না চন্দর। তুমি এব্যাপারে কী বলো?’
‘স্যার, এই ছেলেটা এই বয়সেই সম্পূর্ণ স্পয়েলড্‌ হয়ে গেছে। অশ্লীলতার আর যৌনতার সব পাঠ এই বয়সেই ও নিয়ে ফেলেছে। মেজোবাবুর মেয়েকে সেদিন যেরকম জঘন্যভাবে নোংরা অশ্লীল কথা বলল তাতেই এটা ক্লিয়ার যে, এর জীবনে আর লেখাপড়া বলে কিছু হবে না।’
‘তুমি ওর ক্লাস টিচার হয়ে এভাবে বলছ চন্দর!’
‘আমি আপনাকে লিখিতভাবে দিতে পারি স্যার যে ওই ছেলেটা ওর জীবনে কোনোদিন মাধ্যমিকের গন্ডিও টপকাতে পারবে না। তবে একটা কথা, আপনি হেডস্যার হিসেবে যা করবেন তাতেই আমার সমর্থন থাকবে। তবে সেটা আপনার ছাত্র হিসেবে, ওই স্কুলের একজন শিক্ষক হিসেবে নয়। আমি এখন আসছি স্যার।’ 

আমার হৃদস্পন্দন আরও বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষুব্ধ ভ্রূকুটিত চন্দ্রস্যার বারান্দা থেকে নেমে চলে গেলেন। হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন -
‘শোন্‌, আমি নিজে মনে করি না তুই খারাপ ছেলে হয়ে গেছিস বা তোর আর লেখাপড়া হবে না। সেজন্য তোকে স্কুলেই রাখার সিদ্ধান্তেই থাকলাম। তবে আরও দিনপাঁচেক পর থেকে তুই স্কুলে আসিস। তার মধ্যে আমি সব টিচার আর সব ক্লাসের স্টুডেন্টদের বুঝিয়ে বলে দেব কেউ যেন তোকে এই ব্যাপারে আর কোনো কিছু না বলে। আর তোর সম্বন্ধে আমার ধারণা যে একটুও ভুল নয় সেটা ঠিকঠাক প্রমাণ করার দায়িত্ব থাকল কিন্তু তোর - তোর একার।’

সাতদিন পর থেকে আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছিলাম। না, কোনো প্রান্ত থেকে কোনো অসুবিধা বা অস্বস্তি আমাকে তেমন বিব্রত করেনি। মা, বাবা ও হেডস্যারের আশীর্বাদে স্কুলের বাকি দুবছরে দুটো ক্লাসেই আমার এক নম্বর জায়গাটা আমি ধরে রাখতে পেরেছিলাম।


|| আট ||

ছোটো বড়ো আলো আর আঁধারে ভরা কতদিন, কতমাস, কতবছর কেটে গেছে তার পর। কিন্তু আজও এই পরিণত বয়সে এসেও চোখ বুজিয়ে দেখলে স্পষ্ট দেখতে পাই সেদিনের সেই বিভ্রান্ত, ত্রস্ত, কম্পমাণ কিশোরটিকে... অসংখ্য তীক্ষ্ণ কঠিন পেকে ঝুনো হওয়া দৃষ্টির বিষাক্ত শলাকা বিঁধে যাচ্ছে তার কচি দেহে... মাথা নীচু করে নিতান্ত অসহায় ভাবে সে দাঁড়িয়ে কাঁপছে একপাল হিংস্র শিক্ষিত মানুষের সামনে... যারা মনে মনে তার ভয়কাতর বিস্ময়দিগ্ধ অস্তিত্বে জোর করে মাখাতে চাইছে পরিপক্ক কুটিল যৌনতার নোংরা থকথকে তরল... নিজেদের মনের অসমতল স্ফীতোদর আয়নায় তাকে যথেচ্ছ বিচার করছে... যথেচ্ছভাবে করতে চাইছে তার কঠোরতম শাস্তিবিধান...। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও লেখার, জীবনকে দেখানোর। পরিণত বয়সে এসে যখন সেই সুললিত শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে, তখন হয়তো সবার স্মৃতিতে এমন কিছু ভাস্বর হয়ে ওঠে, যা তার পরিণত মননকেও নাড়া দিয়ে যায়। সময় চলে যায়, কিন্তু কিছু মুহূর্তের ভীতি, আতঙ্কের রেশ, সেই অনুভূতি থেকে যায় ঠিক আগের মতনই।

    উত্তরমুছুন