
লকবাবু এই ভিড় ট্রেনে কামরার শেষ মাথায় এক কোণে উইন্ডো সিট পেয়ে কত
জন্মের পুণ্যের ফল ভোগ করছে তাই ভাবতে ভাবতে জানলার দিকে তাকান, ঘন্টাখানেক আগে
বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশটা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে, হালকা হালকা বাতাস আসছে দূরের
সবুজ মাঠ আর নীল আকাশ থেকে।
পরের স্টেশনে প্রায় সব মানুষই নেমে যায়, সিটে বসে থাকা মানুষ ছাড়া পুরো
কামরাটাতে গুটিকয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ পুলকবাবুর নজর পরে কামরার উল্টো
মাথায়, একটা বাচ্চা ছেলে হাততালি দিয়ে নাচতে নাচতে ডিগবাজি খেতে খেতে কামরার
এদিক ওদিক করছে।
শতছিন্ন ময়লা জামা পরা বাচ্চাটা কামরার শেষ মাথায় ডিগবাজি দিতে দিতে
পুলকবাবুর দিকে আসলে পুলকবাবুর বাচ্চাটাকে কেমন চেনা চেনা লাগে, যত কাছে আসে তত
বাচ্চাটার মুখটা চেনা চেনা লাগে তার। খুব কাছে আসলে তার কপালের ভাঁজ আরও
সুস্পষ্ট হয় — "অপু!"
ছেলেকে ভিক্ষা করতে দেখে মাথা ঠিক থাকেনা পুলকবাবুর। সিট থেকে উঠতে গিয়ে উঠতে
পারেনা, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা হাঙরের মতো চেয়ে রয়েছে সিটটার দিকে,
পুলকবাবু এইভাবে নিজের জায়গা ছেড়ে দেবেন?
চেঁচিয়ে ডাকতে চেয়ে ছেলেকে ডাকতে পারেননা পুলকবাবু, পাঁচটা লোকে কি বলবে? এই
সুটেড বুটেড লোকের ছেলে ঐ ভিখারি! কেউ যেন তার মুখ চেপে ধরে রাখে ভিতর থেকে
বাইরে থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে।
মনে মনে ভাবে পুলকবাবু "অপু! অপু এখানে কী করছে? অপু কেন ভিক্ষা করছে আমার
ছেলে হয়ে! ওর মা তাহলে ওকে এই শিক্ষা দেয় আমি বাড়ি না থাকলে? অত গরীব
ফ্যামিলিতে আমার বিয়ে করাটাই ভুল হয়েছে। আমার অপুকে আর মামার বাড়ি পাঠাবো
না, কিন্তু ওর তো এখন স্কুলে থাকার কথা —"
এইসব ভাবতে ভাবতে পুলকবাবু দেখে ডিগবাজি শেষ করে অপু ভিক্ষা করতে করতে তার
দিকে আসছে, ছেলেকে শতছিন্ন ময়লা জামাকাপড় পরে ভিক্ষা করতে দেখে চোখে জল আসে
পুলকবাবুর। পুলকবাবুর পাশের জনের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে অপু। অশ্রুসিক্ত চোখে
কাঁপা কাঁপা হাতে পুলকবাবু ছেলেকে ছুঁতে চায়।
— "বাবু কিছু দাও না, বাবু।"
ডিগবাজি খাওয়া বাচ্চাটার ডাকে ঘুমের ঝিমুনি ভেঙে যায় পুলকবাবুর, চমকে উঠে
বাচ্চাটার করুণ মুখের দিকে চেয়ে দেখে এ তো অপু নয়। অপু কেন হতে যাবে এ!
বাচ্চাটার হাতটা তার হাঁটু থেকে সরিয়ে দিয়ে পুলকবাবু বলে — "কী করছিস? গায়ে
হাত দিচ্ছিস কেন? প্যান্টটা নোংরা হয়ে যাবে না?"। পকেট থেকে রুমাল বের করে
ঘামটা মুছে জানলার দিকে তাকিয়ে হালকা নিশ্চিন্তের হাসি হাসে পুলকবাবু।
কিছুক্ষণ পুলকবাবুর দিকে হা করে চেয়ে থেকে নিরাশ হয়ে বাচ্চাটা ভিক্ষা করতে
করতে চলে যায় দূরে, পরের স্টেশনে নেমে পরবে অন্য কামরায় উঠে ডিগবাজি খেয়ে
খেয়ে ভিক্ষা করার জন্য।
পুলকবাবু ফোন করে স্ত্রীকে "অপু স্কুল থেকে বাড়ি এসেছে? "
"হ্যাঁ এইতো আসলো একটু আগে, দেখো না আজও পিটি ক্লাসে জামা প্যান্ট নোংরা করে
কাদা লাগিয়ে বাড়ি ফিরেছে।"
0 মন্তব্যসমূহ