ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বাঘোদ্ধার -সুমনা সাহা



সা
ত দিনের কর্ণবিদারী মাইক তাণ্ডব আজ স্তব্ধ। কালি ঠাকুর ভাসান দিয়ে পাড়ার তরুণ প্রজন্ম, প্রগতি সঙ্ঘের ছেলেরা ক্লাব ঘরে বসে স্তিমিত আলোচনায় মগ্ন। এতদিনের অমানুষিক ধকল গিয়েছে, বিশেষত আজকের ভাসান ড্যান্সে নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার পর ‘দারু তো বনতা হ্যায় ইয়ার!’ কয়েক বোতলের নেশার এই মৌতাত বড় তৃপ্তির! বারুদ-গন্ধী বাতাসে হালকা কুয়াশা, ঠাণ্ডা পড়বে নাকি আর কয়েকদিন অপেক্ষা করবে, একথা ভেবেই আবহাওয়া কিঞ্চিৎ স্থির। দলের মধ্যে রাকা একটু আঁতেল। মানে ওদের ঘরে সংস্কৃতি চর্চা আছে খানিকটা, বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাও আসে নিয়মিত। ভাইফোঁটার সন্ধ্যায় কালচারাল ফাংশনের শেষপাতে এ-পাড়ার এমএলএ বাচ্চুদার ভাষণ ছিল। ওদের আলোচনা ঘুরেফিরে সেখানেই এসেছে। নারীমুক্তি, ধর্ষণ, শিশু পাচার, ওষুধে ভেজাল, রাজনীতি, দুর্নীতি থেকে পাক-নীতি, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতি সব হয়ে শেষকালে তিনি বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ নিয়েও দু’চার কথা বলেছেন। বিশেষত ‘বাঘ যাতে কেভ টাইগার বা সেবার টুথড টাইগারের মতো মিথোলজিকাল এনিম্যাল-এ পরিণত না হয়ে যায়, তাই বাঘ সংরক্ষণের দায় আমাদের সকলের’—বক্তব্যের এই শেষাংশটাই তাদের বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে। 
পাগা জড়ানো গলায় বলে, “হ্যাঁ রে রাকা, তুই তো মাইরি অনেক লেখাপড়া করেছিস। জঙ্গলের বাঘের দায় আমাদের কী করে হয় বল তো?”
“ধুর বা...জঙ্গল থাকলেই শিকারী আসবে। বাঘ মারবে। ঐ চোরা শিকারীদের বিরুদ্ধে এক জোট হওয়ার কথাই হয়তো...” রাকার মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে আসে, নেশার ঘোর লেগেছে। 
“তাহলে তো শ্লা জঙ্গল সাফ করে ফেললেই ঝামেলা খতম,” একটা খালি বোতলের মতো মাটিতে গড়িয়ে পড়ে পাগা।
“তোরও যেমন বুদ্ধি বোকা.চো..জঙ্গল কেটে ফেললে বাঘ কোথায় থাকবে বাওয়া?” খিক খিক করে হেসে ওঠে রাকা আর বাকি ছেলেরা।
“এইবার কিলিয়ার,” পাগা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, “সবাই একটা করে বাঘ যার যার বাড়িতে নিয়ে যাবে। পবলেম সলভ। এটাই আমাদের দায়িত্ব।”
ঢলাঢলি করতে করতে পাগা-রাকাদের দলটা ঘরের দিকে যাওয়ার তোড়জোড় করে। এমন সময় ঘোষাল কাকু সামনে এসে দাঁড়ায়। ইনি লোকাল থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ওসি ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার্ড। ছেলের দল অকেশনাল বেহেড হয়, ইনি রোজকার মাতাল। প্রত্যেকদিনই নেশা করে অনেক রাত্রে টলতে টলতে পাড়ায় ঢোকেন, মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ। তিন কুলে কেউ নেই। একমাত্র ভাইপো লণ্ডনে। ঘোষাল কাকু হুঙ্কার ছাড়েন, “অই শালা অপোগণ্ডর দল! কাম কাজ কিছু নাই? খালি মজা মারতাছস? থানায় তুইল্যা লইয়া যামু। থার্ড ডিগ্রি বুঝস্?”
অন্য দিন হলে ছেলেরা পাশ কাটিয়ে চলেই যেত। ঘোষালের প্রলাপ শুনে শুনে এরা কৈশোর অতিক্রম করেছে। কিন্তু আজ একটু অন্যরকম দিন। আজ এরাও নেশায় চড়ে আছে। একজন ঘোষালকে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, “চোপ শালা বুড়ো ভাম।” ঘোষাল এত বড় অপমানে চুপ থাকার বান্দা নয়। সেও তেড়িয়া হয়ে এক চড় বসিয়ে দিল পাগার গালে। খেপে গিয়ে পাগা ঘোষালের ঘেটি ধরে নাড়া দিতেই টাল সামলাতে না পেরে বুড়ো রাস্তার উপর পড়ে গেল। বাকিরা হই হই করে উঠল, “আরে কি করিস বা... ছাড় না বেকার ঝামেলা যত্তো সব...।”
রাকা ঘোষালকে তুলতে গেল। কিন্তু বুড়োটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। নড়েও না চড়েও না। মোবাইল টর্চ জ্বালতেই দেখা গেল রাস্তার পাশে স্তুপাকার স্টোন চিপসের উপর পড়ে বুড়োর কপালের এক পাশ ফেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে, রক্তে ইতোমধ্যেই তার চোখ-মুখের এক ধার ঢেকে গিয়েছে। দেহে কোন সাড় নেই। কে জানে, বুড়োটা টেঁসেই গেল নাকি! ওদের নেশা তখন প্রায় ছুটে গেছে। উলটো দিক থেকে একটা বাইকের হেড লাইট এগিয়ে আসতে দেখেই ওরা যে যেদিকে পারলো দৌড় দিল। বাইকটা ঘোষালের কাছে এসে থামতে ওরা থানার বর্তমান ওসি পিন্টু সামন্তর বাজখাঁই গলা শুনতে পেল, “কোন্ শু...রের বাচ্চারা ঘোষালদার এই হাল করেছিস, সাহস থাকে তো সামনে আয়! ও ঘোষাল দা, কি হল? ওঠেন। টেঁসে গেলেন নাকি মাইরি? আপনি এখনো মরেননি। রিটায়ার করেছেন বলে কি ছেলেছোকরার হাতে মার খেতে হবে নাকি? আমি দেখে নেব সব কটাকে। ওঠেন, চলেন আমার সঙ্গে, আপনারে এট্টু ফাস্ট এড করায়ে আনি।” বাইকের স্টার্ট দেওয়ার শব্দে রাতের পাড়া কেঁপে ওঠে। পিন্টু সামন্ত হাঁক দিতে দিতে যায়, “তোদের হব্যানে, আসতেসি আমি। রিটার পুলুসের গায়ে হাত তোলা বাইর করবানে। থানায় নে যাব সব কটারে, দেখি কোন বাপ তোগো বাঁচায়? রুলের গুঁতোয় তোগো হাগা বন্ধ না করসি তো মুই পিন্টু সামন্ত না!” 

সবার নেশা মাথায় উঠেছে। পিন্টু সামন্ত একটি ডেঞ্জারাস মাল। ও যখন একবার শাসিয়েছে, ছাড়বে না সহজে। বুড়োটা যদি মরে যায়, কেসটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কোন ঠিক নেই। প্রচণ্ড আতঙ্কে ওরা দিশেহারা বোধ করে। পাগা, রতন, মুন্না, শ্যামল চারজনই রাকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ওই একটা দিশা বাতলাতে পারে। রাকা বলে “মাথায় কিছু আসছে না মাইরি। চল, বরং গণুদার কাছে যাই। বিপদে আপদে একমাত্র গণুদাই সব সময় পাশে থাকে।”
ঘুম চোখে দরজা খুলে এত রাত্রে গণুদা ওদের দেখে ভেবলে যায়, “কি অপকম্মো করেছিস?” 
ওরা ঢিপাঢিপ করে গণুদার পায়ে পড়ে যায়, “বাঁচাও গণুদা। পিন্টু সামন্তর হাত থেকে।”
“আরে পা ছাড়। ভিতরে আয়। চেঁচাস না। আমার ছেলেটার জ্বর। ঘুমাচ্ছে। তোদের বৌদি কিন্তু বের করে দেবে। কি হয়েছে খুলে বল।” 
সব শুনে গণুদা গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর মুখে চুক চুক আওয়াজ তুলে বলে, “বুড়োটাকে মেরে ফেললি নাকি? মরে গেলে কিন্তু কেসটা খারাপ হবে। আর যদি এমনি কেতরে গিয়ে থাকে, আবার চাগিয়ে ওঠে, তাহলে কেসটা ধামাচাপা পড়ে যাবে। তার আগে কিছুদিন তোরা গা ঢাকা দিয়ে থাক। আমার লাটাগুড়িতে একটা রিসোর্ট আছে। তোরা ওখানে চলে যা। তবে এখন গেস্ট আছে কিনা, জানি না। দামু দা সামলায়। ওকে এসব বলা যাবে না। গেস্ট হাউসের পিছনে একটা গোডাউন আছে। তোদের ওখানেই লুকিয়ে থাকতে হবে। আমি গোডাউনের চাবি দেব। কিন্তু গা ঢাকা মানে গা ঢাকা। কোন ট্যাঁ ফুঁ নয়। দামুদাও যেন টের না পায়। গোডাউনের চাবি শুধু আমার কাছেই থাকে। ওটা এখন রদ্দি মালে ঠাসা। এমনি পড়ে থাকে। চিঁড়ে-মুড়ি জল টল সঙ্গে নিয়ে ওখানে ঢুকে পড়। মোবাইল সুইচ অফ রাখবি। নয়তো সাইলেন্ট। মনে রাখিস, কেউ যেন জানতে না পারে। এদিকের হাওয়া বুঝে আমি ফোন করব। তোরা কিন্তু বেরোবি না। আর কোন আওয়াজ করবি না। মনে কর, ঘোষাল কাকুর মতো তোরাও টেঁসে গেছিস। দ্যাখ্ পারবি কিনা। আমাকে বিপদে ফেলিস না!”
ওরা সমস্বরে বলে ওঠে, “একদম। পারবো, পারবো!”
গণুদা বলে, “ঠিক আছে, রঘু তোদের রিসোর্টের খানিকটা দূরে ছেড়ে দিয়ে আসবে। নাহলে এত রাত্রে এখন যাবি কি করে?” কৃতজ্ঞতায় ওরা আরেকবার গণুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। কি মনে হতে গণু আবার বলে, “তোদের সবার মোবাইলগুলো দে আমাকে। কে কোথা থেকে ফোন করবে, সব জানাজানি হয়ে যাবে।” ওরা মুখ চাওয়াচাউয়ি করে। কিন্তু এখন গণুদার কথা না শুনেও উপায় নেই। অগত্যা সবাই মোবাইল সুইচ অফ করে গণুদার জিম্মায় রাখে। রাকা শুধু মিনমিন করে ওঠে, “বাড়িতে খবর না পেলে চিন্তা করবে...,” গণু বলে, “ওটা আমার উপর ছাড়। দিনুকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেব তোরা দীঘা বেড়াতে গেছিস, দুয়েক দিনেই ফিরে আসবি। না না, আর দেরি করিস না! আমার আবার কাল সকালে পার্টির মিটিঙে যেতে হবে।” ওদের গাড়িতে তুলে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে ঘুমাতে যায় গণু, এক ফালি বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কোণে। ভগবান সব মিলিয়ে জুলিয়ে দ্যায়, নচেৎ ধরপাকড়ের খবরটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুক রাখার এমন উপযুক্ত কাঁধ জুটে যায়? ভাগ্যিস, অক্ষয় তৃতীয়ায় তিরুপতিতে পুজোটা দেওয়া হয়েছিল! 
 
গণুদার গাড়িতে ওরা ভোরের আগেই পৌঁছে যায় লাটাগুড়ি। রঘু খানিক দূরে গাড়ি রেখে ওদের সঙ্গে সঙ্গে আসে। চাবি দিয়ে গোডাউন খুলে ওদের ঢুকিয়ে বাইরে থেকে চাবি লাগায়। তারপর পাল্লা ভাঙা জানলার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চাবিটা ছুঁড়ে দেয় ভিতরে। দূর থেকে ওর গাড়ির চাকার শব্দ মিলিয়ে যেতে ওরা টের পায় জঙ্গলের সূচীভেদ্য নৈঃশব্দ। ভয়ে, উদ্বেগে এতক্ষণ একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় কেটেছে। এখন হঠাৎ শহরের বাইরে এক পোড়ো গোডাউনে অখণ্ড নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারের মধ্যে পাঁচ জনই নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। অনেকদিনের বন্ধ গোডাউনের বদ্ধ স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ভাসছে একটা বিশ্রী গন্ধ। সারাদিনের টেনশন, মদের নেশা, জার্নির ধকল সব মিলিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচটি প্রাণি মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ে।  

অবশেষে ভয়ানক কালো রাত্রিটি পেরিয়ে সকালের আলো ফুটলো। সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠল শরীরের ব্যথা ও খিদের বোধ। আর সেই সঙ্গে এক বিদঘুটে বিশ্রী গা গুলিয়ে ওঠা গন্ধ। বহুদিনের পরিত্যক্ত ও মানুষের অব্যবহৃত গোডাউনে দুর্গন্ধ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই দুর্গন্ধের সঙ্গে সহাবস্থান করা থানায় গিয়ে পিন্টু সামন্তর মার সহ্য করার থেকে কম নয়। কিন্তু এখন এসব কথা ভেবে লাভ নেই, কারণ আর অলটারনেটিভ কিছু নেই। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাথাও একটু একটু করে কাজ করতে আরম্ভ করেছে আর তখনই ব্যাপারটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, তীব্র প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করে এই গোডাউনে কয়েকদিন কাটানো কোন অতিমানবের পক্ষেও সম্ভব নয়। যদিও চাবি তাদের ছুঁড়ে দিয়ে গেছে, কিন্তু বাইরে থেকে খুলবে কে? তাহলে উপায়? আপাতত জল বেরোবার নালার সামনে গিয়ে ওরা পেচ্ছাপ করে। তারপর মুড়ি জল খাওয়ার আয়োজন করে। এরপর বড়-বাইরের ব্যাপারটা আছে। অতএব লাথি মেরে দরজা ভাঙতে হবে, অথবা জানলার ভাঙা পাল্লাটাকে বলপ্রয়োগে আরও ভেঙে ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ টাইপের ব্যাপার ঘটিয়ে এই গারদ থেকে বের হতে হবে। মুড়ি জল খেতে খেতেই ওরা লক্ষ্য করে ঘরের এক কোণে স্তুপাকার বস্তায় একটা কম্পন উঠেছে। সেই সঙ্গে দুর্গন্ধটা যেন নড়ে চড়ে উঠেছে খানিক। সঙ্গে মৃদু ঘ্র্যা ঘ্র্যা শব্দ। বস্তার আড়াল থেকে হলদে কালো ডোরা মতো ওটা কি মাইরি? সমস্ত প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হয়ে পাঁচ মস্তান ‘ওরে বাবারে’ বলে আর্ত চিৎকার দিয়ে, এক অপরকে জরিয়ে টড়িয়ে হুড়োহুড়ি করে দরজার দিকে দৌড় লাগাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে ফাঁসির আসামীর মতো চেয়ে দেখে, একটা আস্ত বাঘ ঘরের কোণে শুয়ে আছে, নিঃশ্বাসের তালে তালে তার শরীরটা একটু একটু কেঁপে উঠছে। ওদের দিকে তাকিয়ে বার কয়েক চোখ পিট পিট করলো বাঘা মামা। আকস্মিকতার অভিঘাত শান্ত হলে ওদের কেমন সন্দেহ হয়। এটারও কি ঘোষাল কাকুর মতো অবস্থা নাকি? ওরা উঠে বসে বাঘ মামার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ যায় ওর শরীরের অন্যান্য অঙ্গে। রাকা বলে, “দ্যাখ, ওর দুটো পা-ই জখম। দেখছিস, রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে। বাঘটার মনে হয় খিদে পেয়েছিল। খাবারের খোঁজে গ্রামে এসেছিল। গ্রামের লোকজন টাঙ্গি ছুঁড়ে মেরেছে। ওর দুই পা ভেঙে গেছে। মনে হয় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এইখানে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বেচারার আমাদেরই মতো অবস্থা। কিম্বা আমাদের থেকেও খারাপ। বাঘটা হয়তো ঘোষাল কাকুর মতো বুড়ো হাবড়া। দেখছিস, কানগুলো কেমন ঝুলে পড়েছে? নিশ্চয় শিকার করে খাওয়ার মতো বল নেই দেহে।”
বাঘটা মনে হয় রাকার কথার সমর্থনেই বলল, “ঘ্রেয়াও!” 
পাগা বলল, “তুই ঠিকই বলেছিস। নইলে এতক্ষণ ব্যাটা এরকম চুপ মেরে বসে থাকে? চোখের সামনে পাঁচটা জোয়ান ছেলে, ঝাঁপিয়ে পড়ে খেয়ে নিত না, বল্?” 
রতন বলল, “নারে, সব বাঘ কিন্তু ম্যান ইটার হয় না। আমরা ওকে যতটা ভয় পাচ্ছি, ওর ভয়টাও তার চেয়ে কিছু কম নয়!” 
শ্যামল বলল, “এখন তাহলে কি করবি?” 
রাকা বলল, “দ্যাখ, বাঘের সঙ্গে এক ঘরে যখন রাত কাটিয়ে ফেলেছি, শালা কপালে বিপদ যা ছিল কেটে গেছে। এখন আমাদের বন দপ্তরে খবর দিতেই হবে। ওরা এসে ঘুম পাড়ানি ইঞ্জেকশন দিয়ে মামাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। আহত মামার চিকিৎসা হওয়া উচিৎ।”
শ্যামল বলল, “আমি জানলা গলে বেরোই, বুঝলি? তোদের পক্ষে এই স্পেস দিয়ে বডি বের করা সম্ভব না। পারলে এক আমিই পারব। বাইরে বেরিয়ে দরজা খুলে দেব, তারপর তোরা বেরোবি, ঠিক আছে?”
শ্যামলের ডাক নাম প্যাঁকাটি, ওর ওজন চল্লিশ কেজি। সুতরাং ওর কথায় যুক্তি আছে। সবাই ওকে ঠেসেঠুসে জানলা দিয়ে একরকম বাইরে ছুঁড়ে দিল। শ্যামল বাইরে থেকে দরজার চাবি খুলে দিতেই ওরা পাঁচ জন বাইরে বেরিয়ে এসে আবার চাবি লাগিয়ে দিল। “মামা থাক এখন এখানে,” পাগা বলল, আবার বাঘটাকে দেখতে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো। পিছন ফিরে বলল, “মামা কেমন করুণ চোখে তাকাচ্ছে মাইরি! দেখবি আয়।” ওরা সবাই দেখল, সত্যিই, বাঘটা যেন মিনতি করছে, “আমাকেও বাইরে বের কর বাপু!” কিন্তু নড়তে পারছে না বেচারা। 
হাঁটতে হাঁটতে ওরা গ্রামের ভিতর এসে পড়েছে। একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে সামনের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে ওরা। চা-ওয়ালা সবে উনুন ধরিয়ে চা বানাবার উদ্যোগ করছে। ওরা ফিসফিস করে আলোচনা করছে। পাগা আর মুন্না চায় কোন ঝামেলা না বাড়িয়ে ফিরে যেতে। কিন্তু শ্যামল, রতন আর রাকা অসুস্থ বাঘটার প্রতি একটা দায় ফিল করছে। ওরা ঠিক করে, বন দপ্তরে যাবে। পাগা বলে, “যদি জিজ্ঞেস করে, আপনারা ওখানে কী করছিলেন, কী বলবি?” এই সময় চা-ওয়ালা ওদের মধ্যে এন্ট্রি মারলো, “গেরামে পরশু বাঘ বেইরেছেল। সেটা ঘায়েল, কোথায় গা ঢাকা দেছে, কেউ জানে না। এজ্ঞে আমনারা কোত্থেকে আস্তেছেন?” ঘাবড়ালে চলবে না। রাকা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “আসলে আমরা এদিকের একটা ফরেস্ট বাংলোয় আসছিলাম। পথে আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গ্যালো। সারারাত্রি হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের পথে একটা গোডাউনে এসে রাত্রে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম, ওখানেই একটা বাঘ রয়েছে!” চা-ওয়ালার দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে ছানাবড়া হয়ে গ্যাছে। অনেকক্ষণ তার বাক্য সরে না। তারপর তড়াক করে এক লাফে চলে আসে ওদের মাঝখানে। বাসন মাজা ছেলেটিকে ডেকে বলে, “এই বাবুদের সাথে আমার একখান ফটো উঠা দিনি! আমনারা তো সামান্য লোক লন বাবু, এরপর আমনাদের নিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ হবে!” চা-ওয়ালা কিছুতেই চায়ের দাম নিল না। সে ভালোই হলো। টাকাপয়সা শর্ট আছে, কলকাতা ফিরতে হবে। একে ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে ওরা বন দপ্তরের সন্ধানও পেয়ে গেল। সেখানে বলল, “লোকাল থানায়ও ইনফর্ম করতে হবে। সঙ্গে আর্মড পুলিশ লাগবে।” থানার অফিসার-ইন-চার্জ খুব খুশি হয়ে ওদের পিঠ চাপড়ে দিলেন, বললেন, “তোমাদের তো খুব সাহস! তা, এই বাঘকে কিভাবে পেলে? খুলে বলো তো!” রাকা ধীরে সুস্থে বলল, “আমরা এখানে রিসোর্টে এসেছিলাম। সকালে বেরিয়ে চারপাশটা দেখছিলাম, তখনই বাঘটাকে দেখি। পায়ে জখম দেখে বুঝতে পারি, ও ক্ষতি করবে না, তারপর আপনাদের খবর দেওয়ার কথা মাথায় এলো।”
“আই সি। তা এই রিসোর্টে কেন?”
“এটা আমাদের এক দাদার, তার গাড়িতেই আসছিলাম, পথে গাড়ি বিগড়ে গ্যালো, আমরা হেঁটে হেঁটে পৌঁছলাম, রাত্রে আর রিসোর্টের কেয়ারটেকারকে বিরক্ত করিনি।” 
এরপর যা হলো, সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। পুলিশ ও বনদপ্তরের মিলিত বিরাট ফোর্স সদলবলে হাজির হলো সেই পরিত্যক্ত গোডাউনে। বাঘ মামাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হলো। অফিসার বললেন, তোমরাই এই কাণ্ডের হিরো। তোমরা মামার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ো, ছবি তোলা হোক।” বাঘকে জালে পুরে ওঠানোর সময় টানাটানিতে ডাই করে রাখা বস্তার একটা ফেঁসে গিয়ে বেরিয়ে এল খানিকটা সাদা গুঁড়ো পদার্থ। হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল সম্পূর্ণ এলাকায়। একটা বিরাট ড্রাগ পাচার চক্রকে ধরবার জন্য অনেকদিন ধরে পুলিশের উপর মহল থেকে চাপ ছিল, মেঘ না চাইতে জলের মতো এই গোডাউন থেকে বের হলো চল্লিশ বস্তা ড্রাগ। বিহার থেকে আসা এই সমস্ত চোরাই মাল আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে নেপালের বর্ডার পেরিয়ে নানা বাঁকা পথ ধরে ইউরোপ পাড়ি দেয়। অফিসার নিউ জলপাইগুড়ি থানায় যোগাযোগ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গণুকে তুলে আনার নির্দেশ দিলেন। পরদিন প্রায় সবকটা কাগজে বাঘের সঙ্গে পাঁচ বন্ধুর ছবি বের হলো। তাদের মানবিকতা ও সাহসের প্রশংসায় সংবাদ মাধ্যম পঞ্চমুখ। একটি বাঘ উদ্ধার করতে গিয়ে তারা ড্রাগ উদ্ধারও করে ফেলেছে। বাচ্চুদার লেকচার সফল করে পাঁচ অপদার্থ যুবক সত্যি সত্যি দায়িত্ব নিয়ে একটি বাঘকে তার নিজের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পেরেছে। ঘোষাল কাকু আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তারা ফল নিয়ে হাসপাতালে কাকুর সঙ্গে দেখা করতে গেল। কাকুও সব শুনেছে এর মধ্যে। ওদের দেখেই বলে উঠল, “তোরা তো মহান কাম করছস! যারে কয় এক্কেরে বাঘোদ্ধার! এই না হইলে ঘোষালের ভাইপো!”     

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ