সবুজ ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে বয়ে চলা বাতাসের ঢেউ অথবা ছোট্ট একটি ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু যেমন উদীয়মান প্রথম সূর্যরশ্মির প্রতিফলনে জ্বলজ্বল করে উঠে, ঠিক তেমনি রাতের আকাশে স্নিগ্ধ চাঁদের জ্যোৎস্না, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া শিউলি ফুলের গন্ধ; নির্জন দুপুরের শরৎ আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা অথবা নদী তীরে বেড়ে ওঠা কাশফুলের গুচ্ছ বয়ে নিয়ে আসে জগন্মাতা জ্যোতির্ময়ীর আগমন বার্তা।
চিন্ময়ী দেবী, অনাদি, নিত্যা হয়েও অসুর পীড়িত দেবতা রক্ষণে আবির্ভূতা। তিনি এক এবং অভিন্ন হয়েও বিভিন্ন রূপে প্রকাশিতা এ যেন রসায়ন বিজ্ঞানে আলোচিত মৌলের বহুরূপতা বৈশিষ্ট্যরই প্রতিফলন।
কখনো ত্রিগুণাত্মিকা ব্রহ্মাণী, নারায়ণী, অথবা মহেশ্বরী রূপে প্রকাশমান আবার কখনো ত্রিগুণাতীত পরব্রহ্মময়ী সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশ রূপা আদিশক্তি সনাতনী। ঠিক যেন পদার্থ বিজ্ঞানে উল্লেখিত শক্তির নিত্যতা সূত্রেরই সমীকরণ; আমার সৃষ্টি নেই, ক্ষয় নেই, আমি মহাবিশ্বে ধ্রুবক, শুধুমাত্র এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়ে কালের প্রবাহকে সঞ্চালনা করি।
তিনিই দাক্ষায়ণী সতী, গিরিনন্দিনী পার্বতী, আদিশক্তি মূর্তিধারী মহামায়া দুর্গা, আবার ঋষি কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নী।
নবদুর্গা নামে পরিচিত শক্তির দেবী যে নয়টি ভিন্ন রূপ এবং গুনে প্রকাশিত যেমন-শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ড, স্কন্দমাতা,কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী।
হয়তো পদার্থ বিজ্ঞানের যান্ত্রিক, আলোক, শব্দ, তাপ, চৌম্বক, তড়িৎ, পারমাণবিক, রাসায়নিক, এবং সৌর শক্তির মতো নবশক্তিরই বহিঃপ্রকাশ যার সাহায্যে মহা বিশ্বের যেকোনো ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
মহাশক্তির অংশবিশেষ কাত্যায়নী, দেবী দুর্গার ষষ্ঠতম বিশিষ্ট রূপ যিনি নবরাত্রি উৎসবের ষষ্ঠতম দিনেই অর্থাৎ মহালয়ার ষষ্ঠতম দিন পূজিত হয়ে থাকেন।
দেবী মানবদেহের শক্তিচক্রের মধ্যে আজ্ঞা চক্রে অধিষ্ঠিত, যদিও বেশ কঠিন তবে অসম্ভব নয়, যোগ সাধনার মাধ্যমে এই চক্র গুলো জাগ্রত করে পরব্রহ্মময়ীর সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া যায়।
তন্ত্র এবং যোগ সাধনে আজ্ঞা চক্রের অবস্থান মানবদেহের দুই ভ্রু এর মাঝেই উল্লেখ করা হয়েছে, দুটি দল বিশিষ্ট এই চক্রের বর্ণ শুভ্রনীল। এই চক্র দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে আমাদের দিব্যদৃষ্টি,মানসিক গঠন,ইচ্ছা শক্তি, আধ্যাত্মিকতা এবং মনের সমস্ত চিন্তা। সৃজনশীল কাজ, ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা, এসব কিছু এখান থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকে। দ্বিপার্শ্বীয় ভাবে প্রতিসম মানব শরীরের যদি উল্লম্ব ছেদ এবং আজ্ঞাচক্র দ্বারা অনুভূমিক রেখা টানা যায় তবে আধুনিক শারীরবিদ্যা এবং শারীরস্থান হয়তো উক্ত তথ্যকেই সমর্থন করবে।
দেহে অবস্থিত ষষ্ঠ চক্র ভেদ করেই চেতনাকে সপ্তম চক্রে তথা সহস্রার চক্রে নিয়ে যেতে হয় আর এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণ এবং এর মাধ্যমেই যোগ সাধনায় আধ্যাত্মিক চেতনার উন্নতি ঘটানো তথা সিদ্ধি বা মোক্ষ লাভ করা সম্ভব।
ভিন্ন ভিন্ন চক্রে দেবী বিভিন্ন রূপে অবস্থানরত, দেহের নিম্নাঙ্গ থেকে চক্রগুলো হলো - মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান,মণিপুর,অনাহত,বিশুদ্ধ,আজ্ঞা,ও সহস্রার চক্র।
পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবিপক্ষের সূচনা, মহালয়ার মাধ্যমেই প্রারম্ভ হয়ে যায়।
যদিও আমরা সকলেই এটি শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা হিসেবেই জানি, প্রসঙ্গত খুব সংক্ষেপে হলেও উল্লেখ করতেই হয় এই "অকাল" এবং "বোধন" শব্দ দুটির বিস্তার এবং বিশ্লেষণ, অকাল অর্থাৎ "অসময়ে" এবং বোধন অর্থাৎ "জাগ্রত" করা বা ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা। কিন্তু কেন দেবীকে অসময়ে জাগ্রত করা হলো একথা কমবেশী সকলেই আমরা জানি। রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করে দেবী সীতাকে লঙ্কেশ্বর রাবণের লঙ্কা থেকে উদ্ধার করার জন্যই শ্রীরামচন্দ্র অসময়ে অর্থাৎ শরৎকালে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে মহামায়া দেবী দুর্গার পূজো করেছিলেন। অথচ রাবণের দ্বারা দেবী পূজিত হতেন বসন্তকালের চৈত্র মাসে শুক্লপক্ষে। যা সাধারণত বাসন্তী পূজো নামেই পরিচিত।
আমাদের মনুষ্য জীবনের একটি দিন-রাত যেমন সংঘটিত হয় চব্বিশ ঘণ্টায় অর্থাৎ আহ্নিক গতির উপর ভিত্তি করে, তেমনি দেবতাদের দিন-রাত সংঘটিত হয় পৃথিবীর হিসাবে একবছর সময়ে অর্থাৎ বার্ষিক গতির উপর ভিত্তি করে।
মাঘ থেকে আষাঢ় এই ছয় মাস সময় দেবতাদের কাছে দিন কারণ ঐ সময়ে সূর্যের উত্তরায়ন ঘটে, আবার শ্রাবণ থেকে পৌষ এই ছয় মাস দেবতাদের কাছে রাত কেননা এই সময়ে সূর্যের দক্ষিণায়ন ঘটে।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে শরৎকাল দেবীর নিদ্রার সময়। এই তথ্য শুধু মাত্র অকালবোধন বুঝতে সাহায্য করে তাই নয় বরং এটাও বোঝা যায় প্রাচীন মুনি ঋষিদের আহ্নিকগতি-বার্ষিকগতি, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন এবং সময় সংক্রান্ত ভৌগলিক জ্ঞান তথা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার জ্ঞান কতটা গভীর ছিল।
হিমালয়ের পাদদেশেই অবস্থিত একটি আশ্রমে কাত্য পুত্র মহর্ষি কাত্যায়নের বাস। তার শিষ্যের নাম ঋষি রৌদ্রাশ্ব।
মহর্ষি কাত্যায়ন আদিশক্তি মহামায়াকে নিজের কন্যা রূপে লাভ করার জন্য কঠিন তপস্যা করতে শুরু করেন এবং তপস্যায় সন্তুষ্টা হয়ে দেবী, ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য বর প্রদান করেন এবং সঙ্গে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেন কল্পঅন্তে এক পরাক্রমশালী অসুরের উদ্ভব হবে যিনি মহিষাসুর নামে খ্যাত হবে এবং এই অসুরের তাণ্ডবলীলায় ত্রিলোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে জগৎ পরিত্রাণ হেতু মহিষাসুরকে বধ করতে দেবী আবির্ভূত হবেন এবং সেই কল্প হতেই জগৎ-সংসারে দেবী, কাত্যায়ন কন্যা কাত্যায়নী রূপে পরিচিত হবেন।
যথাসময় উপস্থিত হলে মহিষাসুরের আগমন ঘটলো, ব্রহ্মার তপস্যায় রব প্রাপ্ত হলো, নারী ব্যতীত কোনও শক্তি দ্বারা তিনি পরাজিত হবে না।
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল দাপিয়ে ভুবন অতিষ্ঠ করে তুললো মহিষাসুর, কিন্তু কর্মফল অনুযায়ী দম্ভ, অহংকার এবং মূর্খতা বশত নারী রূপ ধারণ করে ঋষি রৌদ্রাশ্বের তপস্যা ভঙ্গ করে নারী দ্বারা নিধনের অভিশাপ প্রাপ্ত হলো।
নিয়তির লিখন যেমন খণ্ডন করা যায়না তেমনি কর্মফল ভোগ করার থেকেও নিস্তার পাওয়া যায়না সে যতো বড় মানব-দানব-তপস্বী-সুর-অসুর বা মহারথীই হোক না কেনো।
পূর্ব নির্ধারিত ভবিষ্যদ্বাণী সফল করার সময় এলো, মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এবং সমস্ত দেবগণের শরীর থেকে নির্গত তেজ পুঞ্জীভূত হয়ে সৃষ্টি হলো এক নারী কায়া, আদ্যাশক্তি আবির্ভূতা হলেন কাত্যায়নী রূপে, সফল হলো ঋষি কাত্যায়নের আদ্যাশক্তিকে কন্যা রূপে পাবার বাসনা।
ষষ্ঠী,সপ্তমী,অষ্টমী,নবমী, তিথিতে দেবী মহর্ষিগণ এবং সমস্ত দেবগণের দ্বারা পূজিত হয়ে মহিষাসুর বধ করেছিলেন।
তিনিই মহিষাসুরমর্দ্দিনী, তিনিই দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে রক্ষাকারী তথা দুর্গমাসুরকে নিধনকারী, "দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা" দেবী দুর্গার অভিন্ন প্রতিমা স্বরূপা আবার ব্রজগোপীদের দ্বারা উচ্চারিত -
"ওঁ কাত্যায়নী মহামায়ে মহাযোগিন্যধীশ্বরী।
নন্দগোপসূতং দেবী পতিং মে কুরুতে নমঃ।।" মন্ত্রে
তিনিই পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে লাভ করার জন্যে ব্রজগোপীদের দ্বারা পূজিতা কাত্যায়নী।
0 মন্তব্যসমূহ