দ্রমাসে প্রকৃতিতে বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে শরৎকাল আসে। 'নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা' থেকে শুরু করে কাশবন ও শিউলিফুলের শোভা মনকে ভরিয়ে দেয়। বসন্তকালের মতো প্রেমাবেগ সৃষ্টিকারী না হলেও শরৎকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবেদনও বাঙালির মনে ব্যাপক।
তবে শরৎকালকে নিয়ে বাঙালির প্রধান আবেগ মূলতঃ দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক। বছর ঘুরে মায়ের আবাহনের ভাবনা ও কর্মোদ্যোগ যেন তাকে প্রায় অর্ধোন্মাদ করে তুলে। বহু আগে থেকেই শুরু হয় নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা থেকে শুরু করে পুজোর বিশেষ কয়টি দিনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি কতকিছুরই না প্রস্তুতি! উৎসাহীরা দূরে বেড়াতে যাবার প্রোগ্রামও করেন। সবমিলিয়ে চলতে থাকে একটা অনিয়ন্ত্রিত আবেগ- যা বাঙালিকে যেন কতকটা স্ব-আরোপিত অতিরিক্ত আর্থিক দায়বদ্ধতার মধ্যে ঠেলে দেয়। এমনটা কিন্তু নয় যে, আর্থিক দিক দিয়ে অসমর্থ বা স্বল্প-সমর্থ কিছু পরিবারের কর্তা/ কর্ত্রীর মনে মাঝেমাঝে এ নিয়ে কোনও বিপরীতধর্মী প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয় না। তাদের অনেকেই ভাবতে বাধ্য হ'ন- 'মাত্র এই কয়টা দিনের পরিসরেই অতিরিক্ত খরচের এত চাপ নেব কি করে? মাসটা বা বছরটা তো অনেক বড়; সামনের দিনগুলোতে সংসারটা ঠিকঠাক চালানো যাবে তো?' কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এর একটা সহজ উত্তরও ওরা চটপট পেয়ে যান। কে যেন তাদেরকে আগে থেকেই তৈরী একটা সমাধান বা সান্ত্বনার, যাই বলা যাক, যোগান দেন। তারা তখন সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে নতুন করে আবার ভাবতে থাকেন- 'এইরকমটাই তো চিরকাল ঘটে এসেছে ও চলবে, তাই এর বাইরে কিছু ভেবে এতটুকু লাভ নেই'।
আসলে তো বাঙালির এই দুর্গোৎসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুভশক্তির জয়ের এক প্রতীকী উৎসব। দুর্গাপুজোয় এই নির্যাসটাই তো আসল। গৃহস্থ বাড়ীর ছোট ছোট পুজো, এমনকি কিছু ধনী পরিবারের বহু পুরনো ঐতিহ্যবাহী কিছু পুজোর ক্ষেত্রে এই নির্যাস কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। বিপরীতে 'সার্বজনীন' ছাপ্পা মারা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়াপ্রাপ্ত বড় বড় ক্লাবগুলো মিলে প্রতিবছর এক বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে দেবীর যে তথাকথিত 'আবাহন' করে থাকেন, তাতে এই নির্যাসের লেশমাত্র অনুশীলন থাকে না। শ্রীমৎ ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে:
".... পরিত্রাণায় সাধুনাং, বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং,
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।"
যে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসতে পারে তা হ'ল- বাস্তবে এই পুজোকে কেন্দ্র করে সমাজের কয়টা লম্পট, চোর-বদমাস কিংবা নারীর অসম্মানকারী কোন গুণ্ডার দমন সম্ভব হয়? বরং উল্টোটাই ঘটে। চাঁদা তোলার নামে নানা হুজ্জতি, আনন্দফূর্তির ছলে বিবিধ নষ্টামি ইত্যাদি চলতেই থাকে। প্রতিবাদ করলে সামাজিক হেনস্থা এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়। কদাচিৎ যদি কোথাও কোন বড় গণ্ডগোল ছাড়া দুর্গোৎসব কেটে যায় (বাস্তবে যা খুবই বিরল) তবে তা খবরের শিরোনাম হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমে ঘটা করে লেখা হয়- 'নির্বিঘ্নে কাটল এবারের পুজো'। বর্তমানে ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থানে জর্জরিত এই ভারতবর্ষে গীতায় প্রতিশ্রুত ধর্মের পুনঃ সংস্থাপনকারী সেই আত্মশক্তির জাগরণের অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন আমাদের আজ এমনই দুর্ভাগ্য !
আরেকটা অপ্রিয় সত্যি হ'ল পুজোর অর্থনৈতিক মন্দ প্রভাব। আপাতদৃষ্টিতে বাজার যতই গরম থাকুক, মাসাধিক কাল ধরে লাগামহীন কেনাকাটার যতই ঘটা চলুক, দুর্গাপুজোর এই বিপুল ব্যয় দেশের, বিশেষ করে বাংলার অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে যায়- কারণ এই ব্যয়ের সিংহভাগটাই 'Unproductive'। বিশাল বিশাল প্যাণ্ডেল তৈরী, প্রতিমা তৈরীতে প্রতিযোগিতামূলক ব্যয়বহুল বৈচিত্র্যময় অলংকরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অছিলায় নামী ব্যাণ্ডের আসর বসানো ও দামী শিল্পীদের টেনে আনা ইত্যাদির বিনিময়ে লাখ লাখ টাকার অপব্যয়- এসব কি না করলেই নয়? শক্তির আবাহন কি শুধুমাত্র বাহ্যিক আড়ম্বরেই প্রকাশিত হয়? সহজ সরল সংক্ষিপ্ত আরাধনা কি দেবী গ্রহণ করেন না? না দেবীর সন্তুষ্টি হয় না?
অনেক ক্লাবকেই অবশ্যি পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয়ভাবে শিশু-কিশোর-নারী পুরুষ- দের যুক্ত করে সাধ্যিমতো সুন্দর সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করানোর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়, যা সত্যিই প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়। কিন্তু নানা কোণ থেকে চাপানো 'প্রতিযোগিতা'- র দাপটে ওদের সেই উদ্যোগ ম্লান হয়ে যায়। এই বাংলায় মুফতে মোটা অঙ্কের সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবগুলির পরস্পরকে টেক্কা দেবার প্রবণতায় বলাবলি করার নমুনা হ'ল- "এবার ওরা টলিউডের অমুক শিল্পীকে আনতে চলেছে, তাই মান বাঁচাতে এখন আমাদেরকেও বলিউডের তমুককে এনে দেখিয়ে দিতে হবে"। এজাতীয় উদভ্রান্তির দর্শন বাঙালিকে ক্রমশঃ সামাজিক অধঃপতনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আর বাস্তবে আমরা বাঙালিরা জাতিগতভাবেও ক্রমে পিছিয়ে পড়ছি।
একথা অনস্বীকার্য যে, বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল এবং এর পরিবর্তন ঘটানো খুবই দুরূহ। তবুও কি আশা করা যায় না যে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বাঙালি হয়তো কোনদিন এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাইবে? নিজেদের অনিয়ন্ত্রিত উন্মাদনাকে যুক্তির লাগামে নিয়ন্ত্রিত করে শুধু নিজেরাই উপকৃত হবে তাই নয়, সারা দেশকেও সঠিক দিশা দেখাবে?
0 মন্তব্যসমূহ