
|| এক ||
স
ম্রাট বৃদ্ধ হয়েছেন। সম্রাট শত্রুদমন বৃদ্ধ হয়েছেন। অনেক দিন আগেই
সিংহাসন ত্যাগ করেছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য ভার
থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। তার পরেও শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না! দ্বন্দ্ব, কলহ,
যুদ্ধ, প্রানহাণির খবর নিয়মিত আসছে তার কানে। অস্থির হয়ে উঠছেন
সম্রাট শত্রুদমন। রাজ প্রাসাদে বসে শান্তির বাণী প্রচারের চেষ্টা চালিয়ে
চলেছেন। চাইছেন দিকে দিকে বয়ে চলা রক্ত নদীর স্রোতকে আটকাতে। কিন্তু পারছেন
না! কিছুতেই পারছেন না! নবীন রাজা অনিরুদ্ধ অত্যন্ত যুদ্ধবাজ। যুদ্ধ,
রাজ্যজয়, নির্বিচারে নরহত্যা যেন পরম শান্তি এনে দেয় তার মনে। অবশ্য সম্রাট
শত্রুদমন এব্যাপারে কোনো দোষ দেন না পুত্র অনিরুদ্ধকে। বংশের ধারা যে! কি করে
তাকে দমন করবে নবীন অনিরুদ্ধ? শত্রুদমন নিজেও কি পেরেছিলেন? বারে বারে তিনি
রক্ত নদীতে স্নান করেছেন। নির্বিচারে হত্যা করেছেন হাজার হাজার লাখ লাখ নিরীহ
নর নারীকে। দিগন্ত জোড়া সবুজ শস্য ক্ষেতকে রক্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে
পেয়েছিলেন অনাবিল আনন্দ।
কিন্তু আজ অনেক পরিবর্তন হয়েছে সম্রাট শত্রুদমনের।
চিত্তে, চেতনায়, মননে অনেকটাই পাল্টে গেছেন তিনি। হিংসা, দ্বেষ, যুদ্ধ ছেড়ে
ব্রতী হয়েছেন অহিংসার বাণী প্রচারে। চারিদিকে লোক পাঠিয়েছেন। পাঠিয়েছেন
শান্তির দূত। বারে বারে পাঠিয়েছেন। সম্রাট শত্রুদমন, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা
শত্রুদমন মানুষের দরবারে করজোড়ে আর্তি জানিয়েছেন যুদ্ধ পরিহার করতে,
হানাহানি পরিহার করতে, রক্তপাত পরিহার করতে। কিন্তু মানুষ যে হিংসার দাস।
লোভ, মোহ, ক্ষমতার দাস। কি করে সে পারবে হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, রক্তপাত
ভুলে যেতে? শত্রুদমন নিজেও কি পেরেছিলেন চরম আঘাত পাওয়ার আগে অহিংসাকে
অবলম্বন করতে? না পারেন নি। এমনকি ভাবতেও পারেন নি যে একদিন তিনি,
দোর্দন্ডপ্রতাপশালী সম্রাট শত্রুদমন অহিংসার পথ অবলম্বন করবেন! হানাহানি,
রক্তপাতের কথা শুনলে তার হৃদয় বিদীর্ণ হবে!
প্রত্যেক দিন হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতের কথা শুনতে শুনতে
ধৈর্য হারালেন তিনি। ছাড়লেন রাজপ্রাসাদ। এমনকি রাজধানী পাটলিপুত্রকে
পরিত্যাগ করে রাজ্যের প্রান্তে এক জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে কুটির বানিয়ে বাস করতে
লাগলেন। বানপ্রস্থে প্রবেশ করলেন সম্রাট শত্রুদমন। রাজার বাসস্থান হলেও সেই
কুটিরে নেই কোনো বিত্ত বৈভবের চিহ্ন। অবশ্য প্রত্যহ খাদ্য পানীয় আসে রাজ
প্রাসাদ থেকে। কিন্তু রাজভোগের দিকে ফিরেও তাকান না তিনি। জঙ্গল থেকে সংগৃহীত
ফল, মুল, কন্দ দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন। সারাদিন তিনি আরাধনা করেন ইষ্ট
দেবতার। জপ তপ করতে করতে শত্রুদমনের দুচোখ দিয়ে বয়ে চলা অশ্রুতে তার কপোল
অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আপন মনে বলে ওঠেন, "বিশ্বাস করো রত্না আমি
তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। সেই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। ছিলনা কোনো লালসা। শত
সহস্র নারী আমাকে ঘিরে আবর্তিত হতো, তাদের দিকে আমি ঘুরেও তাকাতাম না। কিন্তু
আমি তোমাকে দেখতাম। অপলক দৃষ্টিতে তোমাকে দেখতাম। কারণ আমি যে তোমাকে
ভালোবাসতাম। আজও ভালোবাসি। কিন্তু আমি একটা ভুল করেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার
হাতের অস্ত্র, আমার রাজশক্তি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে। আমি ভুল
ভেবেছিলাম। আমি জানতাম না যে অস্ত্র কোনো শক্তি নয়। অস্ত্র কোনো কিছু গড়ে
তুলতে পারে না। অস্ত্র ধ্বংসের কারণ। অস্ত্র শক্তিহীনতার কারণ। মানবজাতিকে
আহত, জর্জরিত, রক্তাক্ত করার জন্য জন্ম হয়েছে অস্ত্রের। মানবজাতির উন্নতিতে
কোনোদিন কাজে আসেনি এই প্রাণঘাতী অস্ত্র। ভবিষ্যতেও আসবে না। যে অস্ত্র
রত্নাকে আমার কাছে আনতে পারেনা, সেই অস্ত্রের আমার কি প্রয়োজন? সেদিনই আমি
ত্যাগ করেছিলাম অস্ত্রকে। এ জীবনে আর কোনোদিন অস্ত্র ধরবো না। তুমি যেখানেই
থাকো রত্না, একটা কথা জেনে রাখো, আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। আজও
ভালোবাসি।"
|| দুই ||
সিংহাসনে বসে আছেন মগধেশ্বর। বিরাট বড় রাজসভাতে চলছে
রাজকার্য। অমাত্য, মন্ত্রী, সেনাপতি, নগরপাল যে যার আসনে বসে আছেন। আছে তাদের
দেহরক্ষীরা। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু শিকলে বাঁধা বিচারাধীন বন্দি।
রাজসভাতে বিচার চলছে তাদের। নগরপাল বর্ণনা করছেন তাদের অপরাধের কথা। বন্দি
অপরাধীর অধিকাংশই ভিনদেশী। তাদের অধিকাংশই পথ চলতি বনিকদের আক্রমণ করে। তাদের
পসরা লুঠ করে, তাদের সর্বস্বান্ত করে। কখনো কখনো তাদের হত্যাও করে। বিদেশ
থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রদেরও আক্রমণ করে এইসব দস্যুরা।
তাদের সঙ্গে থাকা মুদ্রা ছিনিয়ে নেয়।
সম্রাট শত্রুদমন মন দিয়ে শুনছেন তাদের অপরাধের কথা।
তারপর সিংহাসন থেকে নেমে অপরাধীর সামনে আসছেন। নিজের হাতে শাস্তি দিচ্ছেন
তাদের। সম্রাটের শক্তিশালী হাতে ধরা তরবারির আঘাতে নিমেষের মধ্যে অপরাধীদের
ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ছিটকে আসা রক্তধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে
সম্রাটকে। রক্তে স্নান করছেন তিনি। রক্ত স্নান করতে করতে 'হা হা হা' করে
গগনভেদী অট্টহাস্য করছেন। সম্রাটের হাসির সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন পারিষদ বর্গ।
সম্রাট যেন এক মজার খেলায় মেতে উঠেছেন। যেন রক্ত হোলি খেলছেন। ঠকঠক করে
কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছে একেক জন অপরাধী। মুহূর্তের মধ্যে মৃতদেহে পরিণত
হচ্ছে তারা।
শেষ হয় বিচার পর্ব। শাস্তি দান পর্ব। কিন্তু সম্রাটের
কোঁচকানো ভ্রু যেন সোজা হয় না! কিছুটা উদ্বেগের স্বরে মহা মন্ত্রীকে প্রশ্ন
করেন, "বলুন মন্ত্রী মশাই এর শেষ কোথায়? রাজ্যে ক্রমশ অপরাধের সংখ্যা
বাড়ছে। অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে অধিকাংশই আসছে অন্য রাজ্য থেকে। কেউ
কলিঙ্গ থেকে, কেউ বঙ্গদেশ থেকে, কেউ কামতাপুর থেকে। এতদিন ধরে এতজনকে
মৃত্যুদণ্ড দিলাম, তবুও এদের মনে কোনো ভয় নেই! এদের ভয়ে বনিকরা স্থলপথে
বাণিজ্য করতে যেতে পারছে না। ছাত্ররা বিশ্ব বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।
অধ্যক্ষরাও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছেন। ফলে রাজ্যের অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল
হচ্ছে।"
মহা মন্ত্রী বললেন, "অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হতে
হবে সম্রাট। সীমা সুরক্ষা আরো কঠোর করতে হবে। গুপ্তচর বাহিনীতে আরো চতুর, আরো
বিচক্ষণ কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে।"
সহমত হয়ে সম্রাট বললেন, "এগুলোর আশু প্রয়োজন। আপনারা
ব্যবস্থা করুন। আমি ভাবছি আমাদের এতো বড় রাজ্য, অথচ জল পথে বাণিজ্যের কোনো
সম্ভাবনা নেই। আমাদের রাজ্য ভুমিবন্দি। সমুদ্রতট থেকে বহুদূরে। অথচ কলিঙ্গ
রাজ্যে কত সমুদ্র বন্দর! ওদের সমুদ্র বন্দর যাতে আমরা কিছুটা হলেও ব্যবহার
করতে পারি তার ব্যবস্থা করতে হবে।"
মহা মন্ত্রী, "দেবেনা সম্রাট। ওরা কিছুতেই ওদের সমুদ্র
বন্দর আমাদের ব্যবহার করতে দেবে না।"
সম্রাট, "না দিলে ছিনিয়ে নিতে হবে। কলিঙ্গ রাজ্যের
সমুদ্রতট অঞ্চল আমরা লড়াই করে দখল করে নেব।"
সম্রাট এবং মহা মন্ত্রীর কথার মাঝেই, এক রাজ কর্মচারী
করজোড়ে সম্রাটকে জানালেন, "সম্রাট, সুদূর পশ্চিম থেকে এক ঘোড়া ব্যাপারী
এসেছে। তার সঙ্গে আছে অত্যন্ত সুঠাম, শক্তিশালী, দ্রুতগতি সম্পন্ন কিছু
ঘোড়া। সে সম্রাটকে তার ঘোড়া বিক্রি করতে চায়।"
সম্রাট, "সুদূর পশ্চিম দেশের ঘোড়া! শুনেছি সেই সব ঘোড়া খুব
তেজি হয়। দেশী ঘোড়ার থেকে অনেক জোরে দৌড়াতে পারে। এরকম ঘোড়া আমার দরকার,
সীমানা পাহারা দেওয়ার জন্য। ঘোড়ার ব্যাপারীকে রাজসভার ময়দানে আসতে
বল।"
হাতের ইশারায় রাজ কর্মচারীকে চলে যেতে বলে, মন্ত্রীদের
উদ্দেশ্য বললেন, "চলুন মন্ত্রী মশাইরা, দেখে আসি কেমন ঘোড়া এনেছে
ব্যপারী।"
ব্যাপারী তার দশটা ঘোড়াকে বেঁধে রেখেছে রাজসভার
ময়দানে। সম্রাট এক এক করে ঘোড়াগুলোকে দেখছেন, পরখ করছেন। ঘোড়াগুলোর পিঠে,
গলায় হাত বুলোচ্ছেন। দশটা ঘোড়াই বেশ পছন্দ হয়েছে সম্রাটের। সবকটা ঘোড়া
কিনে নিলেন সম্রাট। তবে সব থেকে শক্তিশালী, সব থেকে দ্রুতগামী ঘোড়াটাকে
রাখলেন নিজের জন্য। নিজের খাস আস্তাবলে।
নিজের প্রিয় ঘোড়ায় চেপে সম্রাট সকলের অলক্ষ্যে
সীমান্ত পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন। সুকৌশলী যোদ্ধা সম্রাট শত্রুদমন তার
দ্রুতগামী ঘোড়ায় চেপে কখনো কখনো ঢুকে পড়েন কলিঙ্গ সীমানার মধ্যে। অবশ্য
তখন তার পরনে থাকে না রাজ পোশাক। সাধারণ বনিকের ছদ্মবেশে সীমানা অতিক্রম
করেন। পথ ঘাট চেনার চেষ্টা করেন। কোন পথে কলিঙ্গ আক্রমণ করবেন সেটা
নিরীক্ষণ করতে থাকেন। কলিঙ্গের সীমান্ত পাহারাদার বা সেনাদের অস্তিত্ব টের
পেলে ফিরে আসেন।
প্রতিবারের মত এবারও বেশ ভোরেই ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে
পড়েছেন সম্রাট। নজর তার কলিঙ্গের দিকে। প্রবল গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে ঢুকে
পড়েছেন কলিঙ্গ সীমানার মধ্যে। পর্বত, কন্দর, গুহা, জঙ্গল ছাড়িয়ে এগিয়ে
চলেছেন। যেতে যেতে তার চোখে পড়লো এক সুন্দর বাগান। হাজারো রকমারি ফুল ফুটে
রয়েছে সেই বাগানে। রয়েছে ফলের গাছও। ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাগানে
ঢুকলেন সম্রাট। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেলেন এক
কন্যাকে। রূপসী কন্যার রূপের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায় সম্রাটের। কাছে গেলেন
কন্যার, জানতে চাইলেন তার পরিচয়।
|| তিন ||
কলিঙ্গ রাজ্যের রাজসভা। সিংহাসনে বসে আছেন রাজা গজপতি দিবাকর।
আছেন রাজ পুরুষগন। শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধশালী রাজ্য কলিঙ্গ। কৃষি, বাণিজ্য সব
দিক দিয়েই বেশ উন্নত। দিগন্ত জোড়া কৃষি জমিতে যেমন সোনার ফসল ফলছে। তেমনি
বিভিন্ন সমুদ্র বন্দর দিয়ে চলছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য। সামরিক দিক
দিয়েও বেশ শক্তিশালী এই কলিঙ্গ। দু লক্ষের বেশি পদাতিক, দশ হাজার অশ্বারোহী
এবং হাজার হস্তি বাহিনীতে সমৃদ্ধ কলিঙ্গের সামরিক বাহিনী। বিদেশী শত্রুরা যার
দিকে তাকাতেও ভয় পায়।
রাজ কার্য চলছে কলিঙ্গ রাজসভায়। এমন সময়ে রাজ সভায়
প্রবেশ করলেন মগধের রাজ দূত। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে তাকে আসন প্রদান করা
হয়। কিছুক্ষণ পর মহারাজ দিবাকর মগধের রাজদূতকে কথা বলার অনুমতি দেন।
মহারাজকে অভিবাদন জানিয়ে রাজদূত বলতে থাকেন, "মহারাজ,
আপনি শুনলে আনন্দিত হবেন যে আমি এক বৈবাহিক সম্বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
সেই সঙ্গে শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছি। এই বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপিত হলে মগধ এবং
কলিঙ্গের মত দুই শক্তিশালী দেশের মিলিত শক্তি এক মহাশক্তির সৃষ্টি করবে।
আমাদের নবীন সম্রাট, পরম শক্তিশালী, দেশ নায়ক, মহান যোদ্ধা শত্রুদমন কলিঙ্গ
রাজকন্যা রত্নার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ
করেছেন।"
রাজদূতের বক্তব্য শুনে মহারাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে
বললেন, "মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হতে আমি সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু এই বিবাহ
প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। যে রাজা নিজের হাতে অপরাধীদের গর্দান নিয়ে, রক্তে
স্নান করে, পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে, তার মত নৃশংস ব্যক্তির সঙ্গে আমার
কন্যার বিবাহ দেব না। আপনি আমার বার্তা আপনার সম্রাটকে জানিয়ে দেবেন।"
রাজদূত, "মহারাজ আর একবার ভেবে দেখলে হত না? এই
প্রত্যাখ্যানের কি পরিণতি হতে পারে একবার ভেবে দেখুন। দুই শক্তিশালী রাজ্য
যদি রক্তক্ষয়ী লড়াইতে লিপ্ত হয়, তাহলে তার পরিণতি কি হতে পারে একবার ভেবে
দেখুন। লক্ষ লক্ষ প্রানহাণি হবে, হাজার হাজার গৃহে অগ্নি সংযোগ হবে, বিঘার পর
বিঘা জমির ফসল নষ্ট হবে। ধ্বংস, হাহাকার দুই রাজ্যের মধ্যেই দেখা দেবে! এই
মহা ধ্বংসের থেকেও কি এই বৈবাহিক সম্পর্ক খারাপ মহারাজ। ক্ষমা করবেন মহারাজ,
একজন রাজদূত হিসেবে নয়, একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে কথাগুলো বললাম। এরপর
আপনি যা ভালো মনে করবেন তাই হবে।"
রাজদূতের আশঙ্কাই সত্য হলো। আড়াই লক্ষ পদাতিক, পাঁচ
হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে কলিঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন যুদ্ধবাজ সম্রাট
শত্রুদমন। খবর পেয়ে প্রস্তুত হলেন কলিঙ্গ রাজ দিবাকর। দু লক্ষ পদাতিক, দশ
হাজার অশ্বারোহী এবং হাজার হস্তি বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রাজধানীকে
পেছনে ফেলে বেশ কিছুটা এগিয়ে এলেন কলিঙ্গ রাজ। যাতে যুদ্ধের আঁচ রাজধানীতে
না পড়ে। হাজার হাতির পদভারে বসে গেল মাটি। সৃষ্টি হলো নদী।
রাজা দিবাকর তার সেনাপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে পাঁচটা
মোর্চা তৈরি করে মগধ বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুল মোর্চার যুদ্ধ
পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে রাখলেন। যে মোর্চা প্রথমে সরাসরি যুদ্ধ করবে
মগধ বাহিনীর সঙ্গে। কিছু দুরে ডান দিকে এবং বাম দিকে দুটো করে মোর্চা তৈরী
করলেন। যুদ্ধ শুরু হলে ঐ চার মোর্চার সেনারা এসে ঘিরে ফেলবে মগধ সেনাদের।
সবার সামনে রাখলেন হস্তি বাহিনীকে। যাতে মত্ত হস্তি বাহিনীর গগনভেদী বৃংহণ
শুনে ভীত হয়ে পড়ে মগধ সেনা।
কলিঙ্গ সেনার রণ কৌশল জানতে পেরে মগধ সম্রাট পদ্ম
ব্যূহ রচনা করে এগোতে লাগলেন। সবার সামনে অশ্বারোহী বাহিনী। তার দুপাশে ধাপে
ধাপে সাজানো হয়েছে পদাতিক বাহিনীকে। ঠিক যেন এক একটা পদ্মের পাপড়ি।
শুরু হলো মহাসংগ্রাম। যুদ্ধের পাল্লা কখনো এদিকে হেলে,
কখনো ওদিকে। সাত মাস ব্যাপী চলা মহাযুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত হলেন কলিঙ্গ রাজ
দিবাকর। কেবল রাজাই নন, কলিঙ্গের শেষ সেনা পর্যন্ত প্রাণ বলিদান দিল এই
যুদ্ধে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো মগধ বাহিনীর। মগধের দু লক্ষ পদাতিক এবং সমস্ত
অশ্বারোহী সেনা প্রাণ হারালো। হাতে থাকা পঞ্চাশ হাজার সেনা নিয়ে কলিঙ্গ
রাজধানী আক্রমণ করলেন সম্রাট শত্রুদমন। সেখানেও হলো এক মরণপণ যুদ্ধ। দু
পক্ষের হাজার হাজার সেনা প্রাণ হারালো। ছবির মত সুন্দর কলিঙ্গের রাজধানীকে
ছারখার করে দিলেন শত্রুদমন। একজনও জীবিত রইলো না। রাজকন্যা রত্নাকে খুঁজে বের
করে জোর করে একটা ডুলিতে তোলা হলো। রাজকন্যাকে খোঁজার পথে প্রাণ গেল সমস্ত
পুরনারীর। নিজের অনিচ্ছাতেই রাজকন্যা মগধে চললেন, পেছনে ফেলে রেখে জনমানবহীন
রাজ প্রাসাদকে।
ফিরে চললেন মগধ সম্রাট। পেছনে চলেছে বেঁচে থাকা ত্রিশ
হাজার সেনা। শত্রুদমন এসেছিলেন আড়াই লক্ষের বেশি সেনা নিয়ে। ফিরে যাচ্ছেন
মাত্র ত্রিশ হাজার সেনা নিয়ে। এতো মগধ সেনার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত ভাবেই
এরমধ্যে মগধে পৌঁছে গেছে। তবে কি মগধেও শুরু হয়ে গেছে হাহাকার? ঘরে ঘরে
উঠেছে কান্নার রোল? ভাবতে ভাবতে শিউরে ওঠেন শত্রুদমন। কলিঙ্গতে অবশ্য কোনও
হাহাকারের শব্দ নেই। কে করবে হাহাকার? নরনারী নির্বিশেষে প্রাণ হারিয়েছে মগধ
সেনার হাতে। একজনও জীবিত নেই! একটা জনবহুল উন্নত রাজ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে
দিয়েছেন সম্রাট শত্রুদমন। পথে যেতে যেতে সম্রাট দেখছেন পথে পড়ে আছে হাজার
হাজার লাখ লাখ মৃতদেহ। যেন মৃতদেহের স্তূপ, নাকি মৃতদেহের পাহাড়? তারা কি
কলিঙ্গের মানুষ? নাকি কলিঙ্গের সেনা? নাকি মগধের সেনা? বোঝা যাচ্ছে না! কিছুই
বোঝা যাচ্ছে না! মৃতদেহ দেখতে দেখতে ক্রমশ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে সম্রাটের চোখ।
মাসের পর মাস পড়ে থাকা লাখ লাখ মৃতদেহে পচন ধরছে। যত এগোচ্ছেন তত নাকে আসছে
পচা মানুষের গন্ধ। পচা মানুষের আঁশটে গন্ধে মাথা ঘুরছে সম্রাটের। তার যুদ্ধ
জয়ের আনন্দ ক্রমশ যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে মৃত মানুষের স্তূপে।
হাতির পায়ের চাপে তৈরি হওয়া যে নদী গ্রীষ্মের
দাবদাহে শুকিয়ে গিয়েছিল, লাখো মানুষের রক্তে সেই নদী আবার টৈ টুম্বুর হয়ে
উঠেছে। রক্ত নদীর তীর ধরে ফিরে চলেছেন সম্রাট। রক্ত নদী যেন হাতছানি দিয়ে
তাকে ডাকছে, বলছে অন্তত একবার রক্ত নদীতে স্নান করতে। লাখ লাখ মৃত মানুষ যেন
আঙুল তুলে তাকে প্রশ্ন করছে, "কি পেলে সম্রাট? আমাদের মৃতদেহের স্তূপের ওপর
দাঁড়িয়ে তুমি কোন বিজয় পতাকা উত্তোলন করলে? বলো সম্রাট বলো। উত্তর দাও।
আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও। আজ যে তোমার কৈফিয়ত দেওয়ার পালা।"
উত্তর খুঁজছেন সম্রাট। আকুল হয়ে খুঁজছেন। কিন্তু কোনো
উত্তর নেই যে তার কাছে! দু হাতে চেপে ধরেছেন নিজের মাথা। বন্ধ করেছেন দু
চোখ।
"জয় সম্রাট শত্রুদমনের জয়" অবাক হয়ে চোখ খুললেন।
ঘুরে তাকালেন। দেখলেন এক অবগুন্ঠনবতী নারী তার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। রথ
থামিয়ে দু হাত জড়ো করে সেই অবগুন্ঠনবতীর দিকে এগিয়ে গেলেন।
আবার সেই নারী বলে উঠলেন, "জয় মহান যোদ্ধা, চক্রবর্তী সম্রাট
শত্রুদমনের জয়। আমার প্রণাম গ্রহণ করুন রাজন। আপনি মহান যোদ্ধা, মহান
সম্রাট। আপনার স্থান ভগবানের পরেই। না না আপনিইতো ভগবান। আপনিই আমাদের
বিধাতা। আপনার ইচ্ছার উপরেই নির্ভর করে আমাদের জীবন মরণ। আপনার ইচ্ছাতে স্থির
হয় আমাদের অন্তিম কাল।"
সম্রাট বিনম্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "আপনি আমার থেকে কি
চান মা?"
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে সেই নারী বললেন, "আপনি নিমেষের মধ্যে
লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন নিতে পারেন। ইচ্ছা হলেই আপনি পৃথিবীকে ধ্বংস করতে
পারেন। আপনার অসীম শক্তি, অপার ক্ষমতা, আপনি সর্বশক্তিমান! আপনার কাছে আমার
আবেদন খুব সামান্য, খুব তুচ্ছ। আপনি যেমন লাখো নিরীহ মানুষের প্রাণ নিতে
পারেন, তেমনি নিশ্চয়ই প্রাণ ফিরিয়ে দিতেও পারেন। দিননা সম্রাট আমার শিশু
পুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে। আমার স্বামী ছিলেন কলিঙ্গ সেনা। এই যুদ্ধে তিনি
বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে তিনি অখন্ড স্বর্গ লাভ
করেছেন। তার প্রাণ ভিক্ষা চাই না। কিন্তু আমার পাঁচ বছরের শিশু পুত্র যুদ্ধ
কাকে বলে জানে না, বোঝে না। অথচ তাকেও আপনার সেনারা ছাড়েনি! মুক্তি দেয়
নি!" কথ বলতে বলতে চাদরের ভেতর থেকে এক শিশুর মৃত দেহ বের করে আনলেন সেই
নারী। করুণ আর্তি জানাতে থাকেন সম্রাটকে, "দিন সম্রাট, আমার পুত্রের প্রাণ
ফিরিয়ে দিন। আপনার এতো শক্তি, এতো ক্ষমতা, আমাকে এইটুকু দান, এইটুকু ভিক্ষা
দিতে পারবেন না?"
সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন সম্রাট। হাঁটু গেড়ে
মাটিতে বসে পড়েছেন। দু হাত শূন্যে তুলে তিনি আর্তনাদ করছেন, "হায় ঈশ্বর! এ
আমি কি করলাম! কেন করলাম?" তার দুচোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অশ্রুধারা।
অবশেষে রাজ প্রাসাদে ফিরলেন সম্রাট। তার মধ্যে নেই
কোনো বিজয়ীর আস্ফালন। সম্রাটের মাথা ঈষৎ ঝুঁকে রয়েছে। দৃষ্টি মাটির দিকে।
মনে হচ্ছে যেন কোনো পরাজিত বিধ্বস্ত সেনা গৃহে ফিরছে। সম্রাটকে দেখে জয়ধ্বনি
উঠলো। সেদিকে ফিরেও তাকালেন না। কোনো রকম প্রতিক্রিয়াও জানালেন না। বিচক্ষণ
অমাত্য বুঝতে পেরে সম্রাটের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, "জয় বিজয়ী সম্রাট
শত্রুদমনের জয়। সম্রাট আপনি এক মহাযুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। দুঃখিত হবেন না
সম্রাট। শোকাতুর হবেন না। যে সব সেনা যুদ্ধে বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছে তারা অখন্ড স্বর্গ লাভ করেছে। ক্ষত্রিয় সেনার জন্ম হয় বীরগতি প্রাপ্তির জন্য। আর
যে সব নাগরিক নিহত হয়েছে, সেটা তাদের নিয়তিই ছিল। বিধির বিধান কে খণ্ডন করবে
সম্রাট? আপনি যে উদ্দেশ্যে যুদ্ধ যাত্রা করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য
পুরোপুরি সফল হয়েছে। আপনি রাজকন্যা রত্নাকে কলিঙ্গ থেকে মগধে আনতে
গিয়েছিলেন। শত বাধা স্বত্বেও তাকে নিয়ে মগধে ফিরেছেন। উল্লাস করুন সম্রাট।
বিজয় উৎসবে মেতে উঠুন।
অমাত্যের কথায় সম্রাট মানসিক শক্তি পেলেন। কোমর বন্ধ
থেকে টেনে বের করে তরবারিটা শূন্যে তুলে ধরলেন। হাসি ফুটে উঠলো সম্রাটের
মুখে। মৃদু হাসি ক্রমে অট্টহাস্যের রূপ নিল। আবার যেন নিজেকে ফিরে পেলেন
সম্রাট। সম্রাটের সাথে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করলো রাজকন্যা রত্নার ডুলি।
এগিয়ে এলো রাজ কর্মচারীরা ডুলি খোলার জন্য। বরন ডালা হাতে এগিয়ে এলেন
পুরনারীগন। ডুলি খুলে সবাই দেখতে পেল ডুলির মধ্যে পড়ে আছে রাজকন্যার মৃতদেহ।
সব হারানোর শোকে, দুঃখে কখন রাজকন্যা প্রাণ ত্যাগ করেছেন কেউ টের
পায়নি!
সম্রাট যেন শুনতে পেলেন, লাখো কণ্ঠের সেই
প্রশ্ন, "এই মহাযুদ্ধ জিতে কী পেলে সম্রাট?"
0 মন্তব্যসমূহ