ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

গুল -সুমনা সাহা


শোক, বাপন, হিমুদের দলটা হৈ হৈ করে বেরোচ্ছিল ক্লাবঘর থেকে। এমন সময় খোকন পথ আটকে দাঁড়ালো। হিমু বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “একটা শুভ কাজে বেরোচ্ছি, ঠিক অপয়াটা সামনে এল!” বাপন ওকে চিমটি কেটে থামালো। বলল, “খোকন, এখন সর, জরুরি কাজে যাচ্ছি।” 
“কোথায় যাচ্ছিস তোরা? আমিও যাব।”
“এখন সময় নেই। ঝামেলা করিস না। সরে যা সামনে থেকে।”
“না, আমাকে বলো তোমরা কোথায় যাচ্ছ? আমিও যাব।” 
“নাতি মাথা গরম করাস না। ভাগ এখান থেকে।”
ব্যাস, আগুনে ঘি পড়ল। 
খোকন বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাইকে আঁচড়াতে কামরাতে আরম্ভ করে দিল। 
এই সময় প্রদীপদা ঢুকেই পরিস্থিতি বুঝে স্বভাবসুলভ আওয়াজ দিল, “চোওওপ!”
সবাই চুপ করল। খোকন হাঁফাচ্ছে। মুখের কষ বেয়ে লালা ঝরছে। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আমাকে নাতি বলেছে, আবার!” 
“কে বলেছে?”
“ঐ শালা অশোক।”
“খোকন, মুখ খারাপ করবি না বলে দিচ্ছি।”
প্রদীপদা বয়সে সবার চেয়ে বড়। সরস্বতী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। তাই সবাই প্রদীপদাকে মানে। 
“অশোক, নাতিকে নাতি বলেছিস কেন? সরি বল এক্ষুণি।”
সবাই হাসি চাপছে দেখে খোকন আবার ফুঁসে উঠতে যাচ্ছিল। প্রদীপদা চোখ টিপে বলল, “কি হল অশোক? সরি বল?”
অশোক মুখ ভেংচে বলল, “সরি নাতি।”
খোকন আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল অশোকের উপর।
অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির শেষে ওরা বেরলো আসন্ন ফুটবল ম্যাচের চাঁদা জোগার করতে ও আরও টুকিটাকি সরঞ্জাম কিনতে। প্রদীপ খোকনকে নিয়ে ক্যারম খেলবে ক্লাবে বসে, তাতে খোকন রাজি হল। 
খোকনের একটা পা ছোটবেলায় পোলিও হওয়ার পর থেকে শুকিয়ে গেছে। পায়ে অনেকদিন একটা লোহার খাঁচার মত বিশেষ জুতো পড়ে থাকত। এখন অমনিই লেংড়ে লেংড়ে হাঁটে। খোকনের বাবা বিরাট পয়সাওয়ালা লোক। পাড়ার সবকটা অনুষ্ঠানের পোটেনশিয়াল চাঁদা ডোনার। লোকটা চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারে যেমন মুক্তহস্ত, আরও কিছু ব্যাপারেও পাড়ার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। খোকনরা আট ভাইবোন। যেবার খোকন হল, ওর বড় দিদিরও ছেলে হল। ফলে একই দিনে খোকনের বাবার ছেলেও হল, নাতিও হল। সেই থেকে খোকনের নাম হয়ে গেল নাতি। তার বাবাকে তো সরাসরি কারুর কিছু বলার সাহস নেই। কিন্তু খোকনকে আড়ালে পেলে কেউ ‘নাতি’ বলে মজা করতে ছাড়ে না। খোকন যতদিন ছোট ছিল, না বুঝে কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু বড় হয়ে যখন ‘কোড’ নামের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে শিখেছে, ‘নাতি’ ডাক শুনলেই সে ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। ছেলেরা ‘নাতি’ ‘নাতি’ বলে ছুট লাগায় আর খোকন লেংচে লেংচে ছেলেদের পিছনে ধাওয়া করে, ধরতে তো পারে না তাদের, সেই দুঃখ পুষিয়ে নেয় অশ্রাব্য গালিতে। কিন্তু খোকনের গালাগালির থেকেও ভয়ঙ্কর খোকনের ঠাকুমার শাপ-শাপান্ত। সেই নিদারুণ অভিশাপের ভয়ে ছেলেপুলেদের মায়েরা ছেলেদের মাথার দিব্যি দেয়, “ওরে তোরা খোকনকে কিছু বলিস না। বামুনের বিধবা, বেলা-অবেলা মানে না, অমন শাপ দেয়, কেন তোরা ওর পিছনে লাগিস বল তো? বেচারার লেখাপড়া কিচ্ছু হল না। পা টা খোঁড়া। ওর মা’র মনে কত কষ্ট বল্ তো?” কিন্তু ছেলেরা মায়ের কথায় তাৎক্ষণিক সায় দিলেও খেলার মাঠে নেমে সব ভুলে যায়। এইভাবেই বড় হয়ে উঠেছে খোকন। তার আরও একটা গুণ আছে, যেটা তার ল্যাংড়া পা, নাতি ডাক সব কিছুকে ছাড়িয়ে এক অসামান্য কলাবাজিতে পরিণত হয়েছে। সেটা তার গুল মারার ক্ষমতা। এমন প্র্যাকটিকাল অভিনয় করে সে গুল মারে যে, সেই মুহূর্তে লোকে তাকে বিশ্বাস না করে পারে না। 

এক দান ক্যারাম খেলার পর খোকন ক্লাব থেকে বেরিয়ে অশোকের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। অশোকের মা রান্নাবান্না সেরে ঠাকুরকে জল-নকুলদানা দিয়ে সবে ভাত বাড়বে, খোকন থমথমে মুখে এসে দাঁড়ালো, “কাকিমা, তোমাদের সবার খাওয়াদাওয়া হয়েছে তো?” 
“কেন রে বাবা? হয়নি, এই খাব। অশোক এলেই খাব। এই আসছি বলে গেল, এখনও এল না।”
“অশোক আর আসবে না গো কাকিমা!” এই বলে খোকন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। 
“ওমা! কী অলক্ষুণে কথা! কেন কী হয়েছে?”
“অশোক কাটা পড়েছে গো! রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের তলায়... আমি এই দেখেই ছুটতে ছুটতে এলাম!” খোকন ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে। অশোকের মা হঠাৎ টাল খেয়ে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেদিন রোববার, তাই অশোকের বাবা, ভাই সবাই বাড়িতে। বাবা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে। ভাই কাউকে কিছু না বলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড় লাগায়। খোকন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে রওনা দেয়, এখনই ঠাকুমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ পরেই অশোক বাড়ি ঢুকে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে “আজ নাতি আমার হাতে খুন হবে” বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়। অশোকের বাড়িতে কারো আর সেদিন খাওয়াই হল না। খোকনের এহেন প্র্যাকটিকাল জোক-এর ঠ্যালায় পাড়ায় সবাই অতিষ্ঠ। 

দেখতে দেখতে খোকন ৩২ বছরে পড়ল। খোকনের সব ভাইবোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা যে যার জগতে ব্যস্ত। খোকনের মা বছর দুয়েক হল চোখ বুঝেছেন। মা গত হওয়ার পর থেকে বাবাও ঝিমিয়ে পড়েছেন। ব্যবসাপত্র এখন ছেলেরাই দ্যাখে। শুধু খোকনের বুড়ি ঠাকুমা দিনরাত ঘ্যানোর ঘ্যানোর করেন, “আমাগো নাতিডার কী অইবো? কেডা দ্যাকপে ওরে? আমি আর কয়দিন? হেইডার মাথায় তো ভগবান বুদ্ধিশুদ্ধি দ্যায় নাই? কেডা অরে মাইয়া দিব?” যাকে পান তাকেই নাতির জন্য একটা মেয়ে দেখে দিতে বলেন। লোকে হাসে মুখ টিপে, তবুও মজা করার জন্য জিজ্ঞেস করে, “তা ঠাকমা, নাতির বয়স কত?”
“কুড়ি-বাইশ অইব।”
“কাম-কাজ কিছু করে?”
“ক্যান করা লাগব? হ্যার বাবার সম্পত্তি যা আছে, ক্যাডা খাইব? রাজপুত্তুর আমার নাতি। শুদু পাওখান এট্টু কমজোরি। তায় কী অইছে? পুরুষ মানুষ সোনার আংটি। ব্যাঁকা অইলেও সোনার দাম কমে না।”
“তা তো ঠিকই। আমি দ্যাখতাসি। সুন্দরী মাইয়া খোঁজ পাইলেই আপনেরে কমুয়ানে।”
খোকনের সমস্ত দৈহিক ও মানসিক শক্তি নব নব গুল আবিষ্কারে ক্রমশ বিকশিত হয়ে উঠেছে। কয়েকবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গুল মারার ফলে এখন পাড়ায় গুল মারা বিপজ্জনক। তাই সে সক্কাল সক্কাল চারটি ভাত খেয়ে দূরে চলে যায়। এক এক দিন এক এক পাড়ায়। মনের সুখে গুল মেরে সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে আসে। ঠাকুমা ভাত নিয়ে বসে থাকে। দাদারা কেউ কথা বলে না। বাবা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। খোকনের শুভাকাংক্ষী কেউ নেই সংসারে। 

রাজেনবাবু আজ মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে এসেছেন। সঙ্গে বৌ আর একমাত্র মেয়ে চিত্রা। পরমা সুন্দরী মেয়ে, সুন্দর ছবি আঁকে, আলপনা দেয়, দেবদ্বিজে ভক্তিমতী, রান্নাবান্নাও শিখেছে। কিন্তু মেয়ের রূপ-যৌবন, প্রতিভা বা রাজেনবাবুর সম্পত্তি—কোনকিছুই পাত্রপক্ষকে গলাতে পারে না। চিত্রা কথা বলতে পারে না। স্বামী-স্ত্রী মেয়ের জন্মের পর থেকে কোন চিকিৎসাই করতে বাকি রাখেননি। কিন্তু কোনই ফল হয়নি। জ্যোতিষি বলেছেন, মেয়ের অনূঢ়া যোগ নেই। বিয়ে হবে। কিন্তু অঙ্গে খুঁত যুক্ত কোন ছেলেই হবে তার স্বামী। সেইদিন থেকে রাজেনবাবু শনি-মঙ্গল বার মন্দিরে আসেন, পুজো দেন আর যত কানাখোঁড়া ভিখারি দেখেন, সবাইকে ভিক্ষা দেন। কে জানে, কোথায় তার হবু জামাই ঘাপটি মেরে আছে! 
সেদিন ঘুরতে ঘুরতে খোকন চলে গেছে দূর এলাকার এক মন্দিরে। ঠাকুমার আদর-যত্নে, শুয়ে-বসে নিষ্কর্মা খোকনের চেহারায় জেল্লা খুলেছে। সে ভীড়ভাট্টা এড়িয়ে একটা গাছের নিচে ছায়া দেখে বসেছে। রাজেনবাবু দূর থেকে ভদ্র চেহারার খোকনকে দেখে কাছে এগিয়ে এলেন। চিত্রার মা বলল, “কী মায়া চোখে মুখে, দেখেছ?” তারা খোকনকে কুণ্ঠিত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “কেক-বিস্কুট খাবে?” খোকন আড় চোখে চিত্রাকে দেখেছে। ও ছলছলে চোখে বলল, “সকাল থেকে খাওয়া হয়নি। দাও, খাই।”
“সেকি? খাওয়া হয়নি কেন?”
“বাড়ি থেকে মেরে তাড়িয়ে দিল।”
“ওমা, কেন?”
“আমি খোঁড়া যে! কাজকর্ম কিছু করতে পারি না, দাদারা আমাকে খেতে দেয় না, মারে। আজকে বলল, আর বাড়িতে ঢুকবি না।” বলতে বলতে খোকন চোখের জল ফেলতে লাগলো। 
রাজেনবাবু আনন্দে স্ত্রীর হাত চেপে ধরলেন। চিত্রা বড় বড় চোখ করে চেয়ে রইল। 

খোকন আর বাড়ি ফিরল না। নাতির জন্য কেঁদে কেঁদে খোকনের ঠাকুমা একদিন দেহ রাখলেন। ওপাড়ার একজন সেদিন বলছিল, সে নাকি খোকনকে পরমা সুন্দরী বৌ আর ফুটফুটে ছেলে নিয়ে গাড়ি চেপে যেতে দেখেছে। শুনে সবাই হেসে বলল, “যাক বাবা! খোকন নেই। অনেকদিন পাড়ায় কেউ গুল মারেনি। তার ভ্যাকেন্সি পূরণ হল!” সে যতই বলে, “আমি সত্যি দেখেছি গো!” কেউ সেকথা বিশ্বাস করে না। 
               

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ