ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

পাহাড়ের কোলে প্রেমের পঞ্চবটী -দিব্যেন্দু ঘোষ


ত করে পাহাড় ডাকছে, চঞ্চল মন, পায়ের তলায় সর্ষে আর নিরন্তর জল, জঙ্গল, উপত্যকার হাতছানি, আজীবন যে প্রেমে লেপ্টে থাকা, বারবার ফিরে যাওয়া। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ভুলতে না পারা, তিস্তার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া আমি তাই বারবার নির্জন উপত্যকার কোলে গল্প লিখি, সবুজের মাঝে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি আর নাম-না-জানা পাখির ডাকে বিভোর হই। জড়িয়ে ধরে পাইন, নীল আকাশ উঁকি দেয় আর ফিনফিনে রোদ শরীরে বুলিয়ে দেয় প্রেমিকার স্পর্শ। ছবি আঁকা সুন্দর গ্রাম-ঠিকানার উদ্দেশে মন ছুটে গেছিল অনেক আগেই, শরীর পিছু নিয়েছিল আবার প্রেমিকাকে দেখতে পাব বলে। দার্জিলিং যাওয়ার পথে তিন মাইল মোড় থেকে বাঁয়ে ঘুরতে হবে। মিশকালো পিচরাস্তা ধরে কিছুটা যেতেই পাইন, ধুপির সারি। সবুজ পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে আশ্বিনের আলাপী রোদ। উঁকি দিচ্ছে নীল আকাশ, গোটা পথ জুড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার সিম্ফনি। আর পথের ধারে খাদের ধারে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি। মাঝে রাম্ভি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে ছোট্ট বাজার। কিছুটা গেলেই নতুন এক গ্রামের পাতানো সংসার। সিক্সিন। চারধারে পাখির কলতান। নেপালিদের গ্রাম। গ্রামের আলপথ বেয়ে হেঁটে চলে আমার প্রিয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। দূরে মাথার ওপর সবুজমেশা সিঞ্চল ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির গহিন অরণ্যের ফিসফিসানি। সিঙ্কোনার প্ল্যান্ট, পাহাড়ের ধাপে ধাপে অরগানিক ফসলের বাহার। আলু, ফুলকপি, মুলো, স্কোয়াশ সমেত নানা প্রকার শাকসব্জির সম্ভার। চারদিকে শুধুই নির্জনতা, অপার নির্জনতা ভঙ্গ করে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিল্লি আর এই নিয়েই সিক্সিনের সংসার। পাখি দেখার অন্যতম সেরা ঠিকানা। প্রায় ৫০টি প্রজাতির পাখির দেখা মেলে সিক্সিনে। কাছেই মংপু। সুরেল বাংলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর বাংলো, মংপু মনাস্ট্রি আর অনেকগুলো ট্রেকরুট। ভাললাগার সংসার আর নির্জনতার যাপন। সিক্সিন হোমস্টের ব্যালকনিতে আগেভাগেই রাত নামে। বেতের চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধু ধু নির্জনতা আর ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, দু-এক টুকরো পদ্য লিখি, আকাশের বুকে যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাতচরার গদ্য। ঠিক তখনই মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়ায়। আশ্চর্য এক ফুলের গন্ধ টুপটাপ ঝরে পড়ে সেই মেয়ের শরীর থেকে, নাভির নীচে শাড়ি, রুপোর নূপুর রিনিঝিনি বাজে, ঘন সবুজ রং-মাখা পায়ের সরু আঙুলে রুপোর আংটি ঝিকমিক করে। ভুরু, চোখ, নাক আর পেলব দুই ঠোঁটে বন্য সৌন্দর্য চিবুক পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ায়। আরও নীচে অগাধ রহস্য, ওই দূরে উপত্যকার কোলে যেমন রহস্য খেলা করে বেড়ায়।         

           কী নাম গো তোমার, মেয়ে? আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে, ওই সবুজের কোলে হুটোপুটি, ওই রোদভরা আকাশের নীচে খুনসুটি আর আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে একছুট্টে পেরিয়ে যাব এ-পাহাড় থেকে সে-পাহাড়?

         আমি তিস্তা গো, তুমি চেনো না আমায়? আমার হাত ধরো, নিয়ে চলো আমায়।  

       তিস্তার হাত ধরে পেরিয়েছি অনেকটা পথ, আমার সাধের উত্তরবঙ্গ, কত অজানা গন্তব্যে তিস্তা নিয়ে গেছে ঠিক পথ চিনিয়ে।

           জানতে ইচ্ছে করছে তো কে এই তিস্তা? সে না হয় বলব অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। পরদিন ভিড়ে ভরপুর দার্জিলিং যাওয়ার পথে ১৮ কিমি আগে এক নিরিবিলি হিলটপে পৌঁছে যাই তিস্তার হাত ধরে। দাওয়াইপানি ভুটিয়া বস্তি। পোশাকি নাম আববোটে দাওয়াইপানি ভুটিয়া বস্তি। তিস্তা গল্প বলছিল, চর্মরোগাক্রান্ত এক ইংরেজসাহেব এখানকার এক ঝর্নার জলে স্নান করতেই তিনি তাঁর চর্মরোগ থেকে মুক্তি পান। সেই থেকেই দাওয়াইপানি। মেঘমুক্ত আকাশে আদি অকৃত্রিম কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা চা-বাগান। পাহাড়ের কোলে বসানো আছে ছোট ছোট গ্রাম। মূলত ভুটিয়াদের বাস। এক দিকে চা-বাগানের ঢেউ। তাকদা, রঙ্গারুনের বিস্তার, অন্য দিকে নীল আকাশের নীচে কাঞ্চনজঙ্ঘার ফ্যামিলি অ্যালবামের হাতছানি। প্রতিটি বাড়ির কার্নিশে রংবেরঙের ফুল, পাহাড়ের ধাপে জ্যামিতিক নকশার খেতে অরগানিক ফসলের বাহার। টম্যাটো, স্কোয়াশ, বাঁধাকপি, আদা, হলুদ, দারচিনি, এলাচের চাষের বাহার। পাহাড়ের গায়ে বিশাল পাথরের বোল্ডারের খাঁজে ছোট ছোট গুহা। ওই নিরিবিলিতে তিস্তা্র পাশে বসে ওর চোখের দিকে তাকিছিলাম অনেকক্ষণ। দাওয়াইপানি থেকে রুংদুং খোলা, সেখান থেকে রঙ্গিত নদীর পাড়ে। রুংদুং খোলা মিশেছে রঙ্গিতে। দাওয়াইপানি বার্ডওয়াচারদের স্বর্গ। সিঞ্চুলা স্যাংচুয়ারির অন্তর্গত এই জায়গায় প্রায় ১২০টি প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। চারদিকে থোকা থোকা ফুটে থাকা ফুল আর অর্কিডের বাহারে শোভা পাচ্ছে প্রতিটি বাড়ির কার্নিশ। তিন পাহাড়ের মাঝের এই গ্রাম উত্তরবঙ্গ গ্রাম পর্যটনের সেরা ঠিকানা তিনচুলে। ঠিক বিপরীতে কালিম্পঙের পাহাড় আর মাঝে বয়ে চলা তিস্তার বহতা স্রোত, নীল আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার বাহার আর উষ্ণ আতিথেয়তা। লোপচু–পেশকের চা বাগান, তিনচুলে মনাস্ট্রি, পাখিদের ওড়াউড়ি তিস্তার হাত ধরে। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই গোম্বাদাঁড়া। কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিপাটি সংসারের অসাধারণ রূপ মনের মণিকোঠায় থেকে যায়। প্রায় ৭৫টি প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। পক্ষীপ্রেমীদের এ যেন স্বর্গরাজ্য।

             হাজার পাখির কোলাহল আর তিস্তার রূপে মোহিত হয়ে কখন যেন ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছি, খেয়ালই নেই। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল তিস্তা আর আমরা ধরলাম সেই টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে চিরচেনা দার্জিলিঙের পথ। বাতাসিয়া লুপ, ভিড়ে থিকথিক ম্যাল, কেভেন্টার্স, ভুটিয়া বস্তি, চৌরাস্তা, মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে আদি-অকৃএিম কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ রূপের জাদু চিরকাল মনে থেকে যাবে। এই নিয়েই দার্জিলিং। তেনজিং নোরগে মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, পদ্মজা নাইডু চিড়িয়াখানা পেরিয়ে তিস্তার হাত ধরে এক নতুন ঠিকানায়। রাস্তার বাঁ দিক ধরে এলেই দেখা মিলবে ঢেউখেলানো দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির বাগান। ছোট ছোট চায়ের গুমটি। এখানেই নানান বাগানের চা বিক্রি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এখান থেকেই শুরু লেবং। ব্রিটিশদের পুরনো রেসকোর্স, সুপ্রাচীন চায়ের বাগান ছাড়িয়ে লেবং। লেবং বাজার পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালে থাকার দারুণ ব্যবস্থা। দূরের আকাশে মুকুট পরে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসিমুখ নিত্য সঙ্গী। প্রতিটি বাড়িতে রঙিন ফুলের মেলা, পাহাড়ের ধাপে ধাপে অরগানিক ফসলের বাহার, সঙ্গে কমলালেবুর হলদে আবেশের মুগ্ধতা আর হিমালয়ের তাজা হিমেল বাতাস। এ এক অন্য দার্জিলিং। চেনা, তবুও অচেনা। তিস্তার মুখেই শুনলাম ফুরুনগাঁওয়ের কথা। কালিম্পঙের কাছে অচেনা এক পাহাড়ি গ্রাম। এখানে পাকা ফসল খেতে আসে ময়ূরের দল। সবুজ পাহাড়ে ধাপ কেটে চাষ। আর সেই ফসল খেতে সাত সকালে হাজির হয় দলে দলে ময়ূর। সূর্য সবে আলো ছড়াতে শুরু করেছে, তার আগেই ময়ুরের দল ভিড় করে এখানে। ফুরুন গাঁওয়ে হোমস্টেতেই রাত কাটালাম, সঙ্গে তিস্তা।

             ফুরুনগাঁওয়ে প্রকৃতি যেন সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা সকলেই ভুটিয়া। তাঁদের একমাত্র পেশা চাষবাস। গ্রামেই ধাপ কেটে চাষ করেন তাঁরা। ধান থেকে শুরু করে এলাচ, স্কোয়াশ সব রকম সবজির চাষ। সেটাও অরগ্যানিক পদ্ধতিতে। পার্পল সানবার্ড, বার্ন সোয়ালো, বি হিটারের মতো পাখির ঝাঁকও খুঁজে নেয় অফবিট ঠিকানা। ফুরুনগাঁও থেকেই ঘুরে এলাম জলসা বাংলো, ইচ্ছেগাঁও, রোশিখোলা। রংপো, রোলেপ, রংলি, আগমলোকও বেড়িয়ে আসি তিস্তার সঙ্গে। রাতের আকাশে ফুরুনগাঁও থেকে কালিম্পংকে অসাধারণ লাগে। শুধু তাকিয়ে থাকা, পাশে তিস্তা আর তার নরম স্পর্শ। আলোআঁধারির প্রেম।

             পরদিন চলে যাই মিসনতার। কয়েকটি নেপালি পরিবার নিয়ে কালিম্পঙে গড়ে উঠেছে একটি ছোট গ্রাম মিসনতার। এই লেপচা গ্রামের মূল সৌন্দর্য চারিদিকে জঙ্গল আর ঝিঁঝিঁর ডাক। মনোরম নৈশব্ধ আর তিস্তার উপস্থিতি আমাকে মোহিত করে রাখে। সঙ্গে খরস্রোতা নদী। এই নদীতে বারো মাস জল থাকে। এই নদীতে মাছ ধরতে ধরতে দুপুর কোথা দিয়ে যে কেটে যায়। লেপচা পরিবারগুলি এই গ্রামকে তাঁদের নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। আরও এক ছোট্ট নেপালি গ্রামে ঢুঁ মেরেছিলাম। রিশিহাট। নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়াং সোনাদা ঘুম হয়ে পৌঁছে যেতে হয় এই ছোট্ট নেপালি গ্রামে। দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরে ছোট পাহাড়ি গ্রাম রিশিহাট। বিভিন্ন ফুলের রঙিন সমারোহ, সঙ্গে নাম না জানা বিভিন্ন পাখির কলরব। নির্মল এক প্রশান্তি যেন জড়িয়ে রেখেছে রিশিহাটকে। তিস্তাই আমাকে খুঁজে দিয়েছিল পাহড়ের কোলে এক গোপন আস্তানা। খারকাগাঁও। নিস্তব্ধতা, কোলাহলমুক্ত এক অনাবিল জীবন যেখানে যাপন করে পরম নিশ্চিন্তে। তিস্তাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা দিন থেকে যাই খারকাগাঁওয়ে। পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট আস্তানা খারকাগাঁও গ্রামে। যেখানে ঘুমন্ত বুদ্ধর ভোরের রঙে চোখ মন শান্তিতে ভরে যায়।

       এরপর একদম অন্যদিকে চলে যাই। নির্ভেজাল সৌন্দর্যে ঘেরা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম মিমবস্তি। শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। কালিম্পং থেকে অনেকটা নেমে আসা। মিমবস্তির ওপর চা বাগানের সৌন্দর্য আর অদূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি। চারিদিকে বাহারি ফুলের সুবাস এবং নাম না জানা পাখির কাকলিতে মিমবস্তি তখন যেন স্বর্গোদ্বার। তিস্তাই বলল উত্তরবঙ্গের একমাত্র আপেল বাগানের কথা। ফিকালেগাঁও। সাংসে খাস মহলের মধ্যে এই গ্রামে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করা যায়। ফিকালেগাঁও থেকেই সহজে যাওয়া যায় মনসুন, তিস্তা, বার্মিক, সাংসের, গ্যাংটক বা সিল্ক রুট। নিউ জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ৮৭ কিলোমিটার দূরে অজানা, অখ্যাত এক গ্রাম ঝেঁপি। জনবসতি থেকে একটু দূরে নির্জনে এক টুকরো শান্তির ছোঁয়া লেগে আছে গ্রামের সর্বত্র। এখানে সকালের ঘুম ভাঙে অজানা পাখির কুজনে ও ফুলের গন্ধে। ঝেঁপি থেকে আমরা চলে যাই জামুনি। চারিদিকে গাঢ় সবুজ চা বাগানে ঘেরা মনমাতানো একটা গ্রাম। গ্রামে কিছু লেপচা, গুরুং জাতির বসবাস। এখানে মানুষেক জীবিকা বলতে চা, বিভিন্ন চাষ ও পশুপালন। নাম না জানা বিভিন্ন ফুল আর অর্কিডে ভরে উঠেছে গোটা গ্রাম। সঙ্গে রয়েছে পাখিদের কলতান। এক অন্যরকম অনুভূতির সাক্ষী থাকতেই আমায় নিয়ে জামিনি যায় তিস্তা।               

          হিমালয়ের কোলে মেঘে ঢাকা আরও একটা ছোট্ট গ্রাম চিবো। কালিম্পং থেকে চার কিলোমিটারের কিছুটা বেশি দূরত্বে, ৪১০০ ফুট উচ্চতায় এই গ্রামটির সঙ্গে এখনও আম-টুরিস্টদের বেশি জানাশোনা হয়নি। তিস্তা না থাকলে এই সব গ্রাম চেনাই হত না। ভাললাগার উত্তরবঙ্গের আনাচে কানাচে যে কত মনখুশির পসরা সাজানো, তা কি আর জানতে পারতাম। চিবোতে অবশ্য থাকার জায়গা একটিই রিসর্ট, ‘চিবো ইন’। পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো ছোট-ছোট কাঠের কটেজ। সেখানের নির্জনতায় দুটো দিন যে কীভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। কটেজের বারান্দায় দুটো বেতের চেয়ার পেতে বসে থাকি অনন্ত সময়।

        তিস্তাই বলে ওঠে, কিছু লিখতে তো পারো, আমাকে নিয়ে।

        বেশ মনে ধরে কথাটা, এই নির্জনতা, এই অরণ্যানি, এই পাহাড়, এই মনোরম উপত্যকা, এখন লিখব না তো আর কবে লিখব। লিখে ফেলি তিস্তাকে নিয়ে এক প্রেমের গল্প। সে গল্প না হয় অন্য কোনওদিন শোনাব। তিস্তা পড়ে দারুণ খুশি। এক অজানা পাহাড়ি মেয়ে, তাকে নিয়েও কেউ কিছু লিখতে পারে, সে ভাবতেও পারেনি। আমার ঠোঁটে আলগোছে চুমু দিয়ে পালিয়ে যায় তিস্তা। আমি আরও প্রেমে পড়ি পাহাড়ি মেয়েটার।

              ছোট রঙ্গিত নদীর তীরে ছোট একটা গ্রাম বিজনবাড়ি। রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই গ্রামের আসল আকর্ষণ রঙ্গিত নদী। গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে খরস্রোতা নদীটি। আর সেই নদীর ধারেই গড়ে উঠেছে ছোট ছোট হোমস্টে। পাহাড় ঘেরা গ্রামের মাঝে নীল জলে ডুব দিতে কিন্তু বেশ লাগে। তিস্তা তো বেজায় খুশি। লেপচাজগৎ আগে গেছি। তাই এবার আর যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তবুও তিস্তার জোরাজুরি, ওর নাকি দারুণ লাগে। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে লেপচাজগৎ। লেপচাজগতে ‘মেঘ গাভীর মতো চরে। পাইনে ঘেরা এই পাহাড়ি জনপদ মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যায় একরাশ কুয়াশায়। মূলত লেপচা অধ্যুষিত গ্রাম, তাই নাম লেপচাজগৎ। গ্রামকে ঘিরে রয়েছে ওক, পাইন, রডোডেনড্রনের সমাহার। দার্জিলিং থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তিস্তাকে নিয়ে সহজেই হারিয়ে যাই  কুয়াশা-মাখা প্রকৃতির কোলে। তিস্তাই চেনাল দার্জিলিং পাহাড়ের একেবারে আনকোরা এক জায়গা ছোটা মাঙ্গোয়া। মাঙ্গোয়া পাহাড়ের চূ়ড়ায় ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ছোটা মাঙ্গোয়া। চা বাগান, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কমলালেবুর বাগান, পাহাড়ি নদী, ফুলে ঢাকা রাস্তা আর একরাশ নির্জনতা, মানে অপার ভাল লাগা। ছোটা মাঙ্গোয়ায় খুব কাছ থেকে দেখা পাহাড়ি জীবন। তাঁদের সহজ সরল মানসিকতা মন ছুঁয়ে যায়। ওই পাহাড়ি জীবনে আধারিত আরও এক লেখা লিখে ফেলেছিলাম ছোটা মাঙ্গোয়ায় বসে। সে গল্পও বলব অন্য একদিন। তিস্তা না থাকলে কিছুই সম্ভব হত না। তিস্তাকে নিয়ে অল্প-চেনা আরও এক পাহাড়ি গ্রামে পরম নির্জনতার আশ্রয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম অপার শান্তি। বেনদা। কালিম্পঙের কাছেই পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা উপত্যকায় তৈরি হয়েছে গ্রামটি। ছোট ছোট কটেজে থাকার ব্যবস্থা। অফুরন্ত ফুল আর তাদের নরম শোভায় আচ্ছাদিত বেনদা।

               উত্তরবঙ্গে বহুবার গেছি, আবারও যাব। এখনও পাহাড়ের কোলে কত অজানাকে জানা হয়নি, তিস্তাকে ভাল করে জানা হয়নি, তাই আবার যেতে হবে। সমতল থেকে অল্প দূরে পাহাড়, জল, জঙ্গল এমন পরম আদরে হাতছানি দিয়ে ডাকে, আমি উপেক্ষা করতে পারি না। তিস্তার ডাক কানে বাজতে থাকে অবিরত। কর্মব্যস্ততার জীবন থেকে ছুটি পেলেই ছুটব, তিস্তাকে কথা দিয়েই ফিরে আসি।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ