ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বাংলার বনেদী বাড়ির দুর্গাপূজার মিষ্টি -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 
দেবী শক্তির আরাধনায় অষ্টমীর ভোগ নিবেদন  (চিত্র সৌজন্যঃ নিজস্ব)

বা
ঙালি জীবনে উৎসব অনুষ্ঠানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আহারের বিশাল সমাহার। যে কোনও উৎসব উদযাপনে খাওয়া-দাওয়া একটি প্রধান অংশ দখল করে থাকে। আর উৎসব যদি হয় দুর্গাপূজা আহার ব্যঞ্জন যে মাত্রাতিরিক্তভাবে আসরের মধ্যমনি হবে তা বলাই বাহুল্য। দেবী দুর্গার আগমনে বাতাসে শিউলির গন্ধ, আকাশে নীল পেঁজা মেঘের ভেলা, নরম হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে কাশের ছোঁয়া, ধুপ -ধুনোর গন্ধ, ঢাকের বাদ্যির সাথে সাথে বঙ্গ রসনা উমামায়ের ভোগেরও যেন স্বাদ পেতে শুরু করে দেয়। অর্থাৎ বাংলার সর্ববৃহৎ উৎসবেও আহার ব্যঞ্জন অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে থাকে। পূজা উপলক্ষ্যে ধনী গরীব নির্বিশেষে প্রায় প্রতি বাঙালি বাড়িতেই পৃথকভাবে বিশেষ বিশেষ ব্যঞ্জনের দেখা মেলে। বাংলার বিভিন্ন বনেদী বাড়িগুলিতে এখনও দুর্গাপূজা বেশ ঘটা করে উদজাপিত হয়। পূজার পাঁচদিন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের ব্যঞ্জনাদি প্রস্তুত করা হয় ও দেবী শক্তিকে নিবেদন করা হয়। বিভিন্ন বাড়ির ভিন্ন ভিন্ন পদ পূজা উপলক্ষ্যে বিখ্যাত হয়ে আছে। যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির ‘পদ্মলুচি’ ও ‘পকান্ন’, ঠাকুরবাড়ির ‘দামোদা’, চোরাবাগান চ্যাটার্জী বাড়ির ‘নিরামিষ চিংড়ি মালাইকারী’, দত্তবাড়ির ‘লেডিকেনি’, সুবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির ‘পুঁই চিংড়ি’, রাণী রাসমনির বাড়ির ‘পেরাকির পায়েস’, শিবপুর রায়চৌধুরী বাড়ির ‘কদলী পায়েসান্ন’, শেওড়াফুলি রাজবাড়ির ‘ রাজেশ্বরী’ প্রভৃতি। নামের বাহারের সাথে সাথে অত্যন্ত সুস্বাদু এই সমস্ত আহারে পাওয়া যায় ঐতিহ্যের ছোঁয়া। পূজার দিনে তাই নিত্যদিনের খাবারের স্থানে যদি এই সব প্রায় বিলুপ্ত খাবারের কয়েকটি বানিয়ে ফেলা যায় তাহলে মন্দ কি! আজ রইল এমনই দুটি রান্নার হদিশ। 


শেওড়াফুলি রাজবাড়ির পূজার মিষ্টিঃ


প্রায় ২৯০ বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা শেওড়াফুলি রাজবাড়ির পূজা। এখানে দেবী একাই আসেন। রাজা মনোহর রায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে আঁটিসাড়া গ্রামের একটি পুকুর খনন করে অষ্টধাতুর মাতৃমূর্তি উদ্ধার করেন। সেইবধি এই রাজবাড়িতে পূজা হয়ে আসছে। ১৯৪১ সালের ১৫ই জ্যৈষ্ঠ গ্রামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মূর্তি স্থাপন করা হয়। সর্ব্বমঙ্গলারূপী মায়ের কারণে এই অঞ্চলের নাম সর্ব্বমঙ্গলাপল্লী নামেই পরিচিত হয়ে যায়। কথিত আছে দেবীর স্বপ্নাদেশেই এই বাড়ির ছাগবলি বন্ধ হয়ে যায়। শেওড়াফুলি রাজবাড়িরই একটি বিশেষ ব্যঞ্জন হল “রাজেশ্বরী”।   

রাজেশ্বরীঃ


উপকরণঃ  

১. নারকোল কোড়া – ১৫০ গ্রাম
২. পাটালি বা আখের গুড় – ১৫০ গ্রাম
৩. খোয়া ক্ষীর – ১০০ গ্রাম 
৪. এলাচ গুঁড়ো – ১ চা চামচ
৫. জল – ১০০ মিলি
৬. ময়দা – ১০০ গ্রাম 
৭. নুন – সামান্য
৮. ঘি – ২৫০ মিলি

প্রণালীঃ

১. কড়াইতে নারকোল, ৫০ গ্রাম গুড়, এলাচ গুঁড়ো, খোয়া ক্ষীর একসাথে মিশিয়ে মধ্যম আঁচে পাক দিতে হবে। পাক ততক্ষন অবধি দিতে হবে যতক্ষণ না সমস্ত উপকরণ ভালো করে মিশ্রিত হয়ে যায়। নামিয়ে ঠাণ্ডা করতে দিতে হবে। 
২. বাকি গুড় ও প্রয়োজনমত জল মিশিয়ে ফুটিয়ে রস তৈরি করে নিতে হবে। 
৩. ময়দা, নুন ও জল মিশিয়ে গোলা মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। মিশ্রনের ঘনত্ব যেন মধ্যমমানের হয়। 
৪. কড়াইতে ঘী গরম হলে নারকোলের পুরের ছোট ছোট বল তৈরি করে ময়দার গোলায় ডুবিয়ে ছাঁকা ঘি তে ভাজতে হবে। 
৫. বাদামী করে ভাজা হয়ে গেলে রসে ডুবিয়েই তুলে নিতে হবে। গরম গরম পরিবেশন করতে হবে।


হাওড়া শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পূজার মিষ্টিঃ  


সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মুঘল সম্রাট  ঔরঙ্গজেবের থেকে শিবপুরের রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী হাওড়ার বেশ কয়েকটি গ্রামের মালিকানা পান। সেই গ্রামগুলির মধ্যে শিবপুরও ছিল। শিবপুরের বর্ধিষ্ণু পরিবার হিসাবে সেই সময় থেকেই পরিচিত রায়চৌধুরী বাড়ির বরকর্তা  রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর শিশুকন্যা নিজেদের বাগানে ‘পদ্মাবতী’ নাম্নী এক মেয়ের সাথে নিত্য খেলা করত। কৌতূহলবশত একদিন পদ্মাবতীকে দেখতে গিয়ে রামব্রহ্ম জানতে পারেন ঐ নামের কন্যাটিকে একমাত্র তাঁর কন্যাই দেখতে পায়। মেয়ের মনের ভুল বলে ভেবে নিলেও বাগানের নরম মাটিতে ছোট ছোট পায়ে ছাপ দেখে বুঝতে পারেন ঘটনার অলৌকিকত্ব। সেই রাতেই স্বপ্নাদেশে দেবী শক্তি দেখা দিয়ে পদ্মাবতীর পরিচয় দেন। সেই ১৬৮৫ সাল থেকেই নিজেদের বাড়ির দালানে দুর্গাপূজা শুরু হয়। মূলত দেবী চণ্ডীর এই পূজা স্থানীয়ভাবে “সাঁঝের আটচালা” নামে পরিচিতি পেয়ে আসছে। মূর্তি প্রতি বছর পূজার দালানেই তৈরি করা হয়। দশমীতে পুজোর শেষে পুজোর ঘট ও মায়ের মুকুটের বিসর্জন হয় না। ওই মুকুট ও জলভরা ঘট চলে যায় অনতিদূরের রায়চৌধুরীদের পরিবারিক মন্দির ব্যাতাই চণ্ডীর মন্দিরে। নিরামিষ বা আমিষ দুই প্রকারের ভোগের সাথেই এক বিশেষ ধরণের মিষ্টি মাকে নিবেদন করা হয়। তা হল “ কদলী পায়েসান্ন” বা কলার বড়ার পায়েস।

কদলী পায়েসান্নঃ


উপকরণঃ 

১. কাঁঠালি কলা – ২ টি 
২. নারকোল কোড়া  - ১০০ গ্রাম
৩. গুড় – ১০০ গ্রাম 
৪. ময়দা – ৫০ গ্রাম 
৫. দুধ – দেড় লিটার 
৬. গোবিন্দভোগ চাল (ভেজানো) – ২৫ গ্রাম 
৭. কাজু, কিশমিশ, পেস্তা, আমন্ড – ৫০ গ্রাম 
৮. তেজপাতা – ২ টো 
৯. ছোট এলাচ – ৩ টি   
১০. ঘি – ৩০০ মিলি 
১১. নুন – সামান্য 


প্রণালীঃ

১. কড়াইতে নারকোল ও গুড় এক সাথে পাক দিয়ে নরম পুর বানিয়ে ঠাণ্ডা করতে হবে। 
২. কলা চটকে তার মধ্যে নারকোলের পুর, এক চিমটে নুন, ময়দা ও অল্প দুধ মিশিয়ে গাঢ় মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে। 
৩. কড়াইতে ঘি গরম হলে ছোট হাতায় অল্প অল্প করে মিশ্রণ নিয়ে বড়ার আকারে ভেজে নিতে হবে। 
৪. অন্য পাত্রে দুধে এলাচ ও তেজপাতা মিশিয়ে ভালো করে ফুটিয়ে গাঢ় করে নিতে হবে। 
৫. এর মধ্যে জল ঝড়ানো ভেজানো চাল মিশিয়ে কম আঁচে চাল সেদ্ধ হওয়া অবধি ফোটাতে হবে। চাল সেদ্ধ হয়ে এলে এর মধ্যে বাকি গুড় ও বাদাম কিশমিশ মিশিয়ে জ্বাল দিতে হবে। 
৬. দুধ সহ সমস্ত উপকরণ গাঢ় হয়ে ক্ষীরে পরিণত হলে আঁচ বন্ধ করে আলতো হাতে কলার বড়া মিশিয়ে নিতে হবে। ঠাণ্ডা করে পরিবেশন করতে হবে।       

সকল পাঠকবৃন্দর জন্য শারদীয়ার আগাম প্রীতি ও শুভেচ্ছা। দেবী শক্তির কৃপায় সকলের জীবন হয়ে উঠুক আনন্দময়।  

Document

পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ গৃহবধূ। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়ায় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে আগ্রহ ও ভালোবাসা। বর্তমানে স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিদেশে এসে সেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অভাববোধ থেকে তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণের অবলম্বনরূপে লেখার শুরু। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও লেখা পড়তে ক্লিক করুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ