![]() |
টেরাকোটা মন্দির ভাস্কর্যে দুর্গা |
‘টেরাকোটা’ একটি লাতিন শব্দ। ‘টেরা’ শব্দের অর্থ মাটি, আর ‘কোটা’ শব্দের অর্থ পোড়ানো। শাব্দিক অর্থে পোড়ামাটির তৈরি সব ধরনের দ্রব্য টেরাকোটা হলেও, ব্যবহারিক অর্থে আমরা মূলত পোড়ামাটির ফলককেই টেরাকোটা বলে থাকি, যার ওপর খোদাই করে বা পেস্ট করে বিভিন্ন রকম অবয়ব বা নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর বা তারও আগে বিকশিত সিন্ধু-সভ্যতায় সর্বপ্রথম প্রচুর পরিমাণে টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া যায়।
|| দুই ||
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জেলা এবং বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র মিলিয়ে আমাদের সাবেক বঙ্গদেশে অলঙ্করণ সমৃদ্ধ প্রাচীন টেরাকোটা মন্দিরের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। বাংলায় মধ্যযুগে খ্রিস্টীয় সতেরো শতক থেকে উনিশ শতকের মধ্যে যে অসংখ্য ‘টেরাকোটা’ মন্দির তৈরি হয়েছিল, তার অনেকগুলিই ছিল পোড়ামাটির মূর্তি আর বিভিন্ন ফুলকারি নকশায় অলঙ্কৃত। পনেরো শতকের শেষাশেষি থেকে পোড়ামাটির ফলক দিয়ে ইঁটের মন্দিরের দেওয়াল সাজানোর প্রথা বেশ প্রচলিত হয়ে উঠতে থাকে। তখন সুলতানী আমলের শেষ পর্যায়। অবশ্য, মুসলমান শাসনাধিকার বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে পাল-সেন আমল থেকেই যে হিন্দুমন্দিরের দেওয়ালে পোড়ামাটি-ফলক বা ‘টেরাকোটা’ স্থান পেত, তার কিছু কিছু প্রমাণ এখন আমাদের হাতে আছে। সে-সময়ের বৌদ্ধ বা জৈন মন্দিরে মূর্তিফলক না থাকলেও পোড়া-মাটির ফুলকারি নকশা ও কিছু কিছু জীবজন্তুর স্পষ্ট চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।
কিন্তু ঐ সব মন্দিরের অধিকাংশই হয় মুসলমান-আক্রমণে, না হয় বাংলার আর্দ্র আবহাওয়া এবং সামুদ্রিক লবণাক্ত বায়ুর প্রভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। দীর্ঘকাল পরে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পরবর্তী সময়ে, এই ধরুন ষোলো-সতেরো শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার নিজস্ব ‘চালা’, ‘চাঁদনি’, ‘দালান’, ‘রত্ন’, ও ‘দেউল’ শৈলীর অজস্র মন্দির সারা বাংলা জুড়ে কম-বেশি গড়ে উঠতে লাগে— তার অনেকগুলিতেই পৃষ্ঠপোষকদের চাহিদায় টেরাকোটার নিপুণ কারুকার্য শোভা পেতে থাকে। এই ধরনের বহু মন্দির আজও বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরলে দেখতে পাওয়া যায়, যদিও দুঃখের বিষয় সেগুলিরও যথাযথ যত্ন নেওয়া হয় না।
এখানে একটু বলে নেওয়া দরকার, ‘টেরাকোটা’ কীভাবে তৈরি করা হয়। প্রথমে আঠালো মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ মিশিয়ে কাদামাটি প্রস্তুত করা হয়। এরপর ফলকে বসিয়ে খোদাই করে বা পেস্ট করে বিভিন্ন অবয়ব বা নকশা তৈরি করে কড়া রোদে ভালো করে শুকোতে হয়। কাদামাটি রোদে শুকিয়ে কিছুটা শক্ত হলে তাকে আগুনে পোড়ানো হয়। এভাবেই তৈরি হয় এক একটি টেরাকোটা, তারপর তা মন্দিরের গায়ে বসানো হয়।
টেরাকোটা অলঙ্করণের বিষয়বস্তু প্রধানত পৌরাণিক। তার মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের জনপ্রিয় কাহিনীগুলিও ছিল। এছাড়া ছিল সেকালের সমাজজীবনের নানা প্রসঙ্গ, যুদ্ধ দৃশ্য, জীবজন্তুর মূর্তি, ফুল-লতাপল্লবের হরেকরকমের নকশা। এই সবকিছু মিলেমিশেই তৈরি হত টেরাকোটায় শিল্পিত কাহিনী বর্ণনার এক স্বতন্ত্র ধারা। মল্ল-রাজধানী বিষ্ণুপুরের শ্যামরায়ের ‘পঞ্চরত্ন’ (স্থাপিত: ১৬৪৩), কৃষ্ণরায়ের জোড়বাংলা (স্থাপিত: ১৬৫৫), মদনমোহন জীউর ‘একরত্ন’ (স্থাপিত: ১৬৯৪) প্রভৃতি মন্দিরে এইসব কাহিনীমূলক টেরাকোটা-সজ্জার বিপুল সমারোহ দর্শকের দৃষ্টিকে তাক লাগিয়ে দেয়।
|| তিন ||
দেখা যায়, মন্দিরগুলির বেশিরভাগের সামনের দেওয়ালে, প্রবেশপথের ওপরে নিচে পৌরাণিক ও মহাকাব্যিক কাহিনীগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, দেব-দেবীর বহু ফলক ও ‘প্যানেল’ সন্নিবেশিত। হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তির মধ্যে সব চাইতে আকর্ষণীয় হ’ল মহিষাসুর-মর্দিনী দুর্গার মূর্তি।
এসব মূর্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দশভুজা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অষ্টাদশভুজা, মাঝেমধ্যে চতুর্ভুজা ও অষ্টভুজাও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দশভুজা দুর্গা মূর্তির সংখ্যাই বেশি। এই মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গামূর্তির সঙ্গে কার্তিক গণেশাদি তাঁর পরিবার পরিজনের ফলকও যেমন দেখা যায়; তেমন আবার একক মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তিও যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়। বাংলার ঘরে ঘরে সপরিবার মহিষমর্দিনী দুর্গাপ্রতিমা প্রাচীনকাল থেকেই পূজিত হয়ে আসছে। মন্দির-টেরাকোটা-শিল্পীরা সেটাই প্রতিফলিত করেছেন তাঁদের কাজে।
কোনো কোনো সময়ে ভয়ঙ্কর সম্মুখ-সমরেরত রাম ও রাবণের মাঝখানে শুধুমাত্র মহিষাসুরমর্দিনী দশভুজার আবির্ভাব তাৎপর্যমণ্ডিত ঠেকে। প্রসঙ্গত, পুরাণ মতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনিতে কিন্তু দেখতে পাই, দেবীর অকালবোধন ও আরাধনা করেছেন রামচন্দ্র স্বয়ং। বাংলার মন্দির-অলঙ্করণে কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই লঙ্কার রণক্ষেত্রে এই অকালবোধনের দৃশ্য এখানকার মন্দির টেরাকোটায় দুর্লভ নয়। আর এমন দৃশ্য সম্ভবত কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘অকালবোধনে’র কথা স্মরণে রেখেই শিল্পী নির্মাণ করেছিলেন।
এই ধরনের উৎকৃষ্ট মূর্তির সন্ধান আমরা পেয়েছি কালনার (বর্ধমান) প্রতাপেশ্বর দেউলে (১৮৪৯ সালে রানী প্যারীকুমারী দেবীর পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পী রামহরি মিস্ত্রির হাতে তৈরি) এবং হদল-নারায়ণপুরের (বাঁকুড়া) রাধা-দামোদরের ‘নবরত্ন’ মন্দিরে (স্থাপিত: ১৮০৬)। প্রতাপেশ্বর মন্দিরে (১৮৪৯) মহিষমর্দিনী দেবীকে যুদ্ধরত রাম-রাবণের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। রামের দিকে সশস্ত্র বানরসেনা, অপর দিকে রাক্ষসবাহিনী। পুত্রকন্যারা এখানে অনুপস্থিত। এই দৃশ্য যেন যুদ্ধজয়ের জন্যে রামচন্দ্রের আকুল আহ্বানে বা আরাধনায় আদিশক্তি দুর্গার আবির্ভাব ও তাঁকে বরদানের মুহূর্তকে প্রতিবিম্বিত করে।
![]() |
সপরিবার দুর্গা (পঁচিশচূড়া মন্দির কালনা) |
পাল-সেন যুগের প্রস্তর-ভাস্কর্যে অমিল হলেও মধ্যযুগের মন্দির টেরাকোটায় অনেক ক্ষেত্রেই সপরিবার দুর্গার দেখা মেলে। টেরাকোটায় একই ‘মেড়’ বা চালার মধ্যে সপরিবার দুর্গা রয়েছেন বর্ধমান শহরের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে (উনিশ শতকের প্রথম ভাগ)। এর সিংহ ঘোড়ার আকৃতির, দুর্গার দু’টি হাত বাকি আটটি হাতের তুলনায় বড়। আবার মন্দির টেরাকোটাতেই দেখা যায়, মেড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবী ও তাঁর পুত্রকন্যাদের সাজানো হয়েছে আলাদা ভাবে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, এক চালের বাইরে এনে মূর্তি সাজানো আধুনিক শিল্পীদের অবদান নয়, এর প্রচলন হয়েছিল অনেক আগেই। বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় মন্দিরে যেমন পাচ্ছি এর প্রাচীন নিদর্শন, তেমনই বর্ধমান জেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আঠারো শতকের রঘুনাথ মন্দিরেও রয়েছে এর নমুনা। বর্ধমান জেলার কালনারই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পঁচিশচূড়া মন্দিরে (স্থাপিত: ১৭৫১) সপরিবার দুর্গা ও সঙ্গে জয়া-বিজয়ার মূর্তি আছে।
তবে প্রাচীন কোনো কোনো মন্দিরে একক মহিষমর্দিনী মূর্তিও পাওয়া গেছে। যেমন, গোকর্ণের (মুর্শিদাবাদ) চারচালা নরসিংহদেব মন্দির (স্থাপিত: ১৫৮৮)। এখানে একটি ক্ষয়িষ্ণু টেরাকোটা ফলকে পুত্রকন্যাবিহীন দেবী দশভুজার অপূর্ব একখানা মূর্তি দেখা যায়, যাকে টেরাকোটা-সজ্জার প্রথম যুগের নিদর্শন বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। উল্লেখ্য, নরসিংহদেবের মন্দিরের মহিষমর্দিনী দুর্গা মূর্তিটি বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গা মূর্তি। এছাড়া, বাংলাদেশের রাজশাহি জেলার পুঠিয়ায় মহিষমর্দিনী দুর্গার একটি বীরত্বব্যঞ্জক টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গেছে।
|| চার ||
পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অজস্র মহিষাসুর-মর্দিনী মূর্তির সমারোহ আমাদের একইসাথে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। শরৎকালে দেবীর অতিপ্রিয় আরাধনার মতো তাঁর মহিষনিধনরতা মূর্তি টেরাকোটা অলঙ্করণে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে। বিশেষ করে, চৈতন্যোত্তর যুগে (সামাজিক সচলতা বৃদ্ধি ও ধর্মীয় উদার পরিসর প্রশস্ত হবার ফলস্বরূপ) টেরাকোটার ভাস্কর্যে এটি একটি ‘মোটিফ’ (motif) রূপে গৃহীত হয়। অর্থাৎ, অন্যতম বর্ণনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন, কৃষ্ণলীলার মধ্যে গোপীদের ‘বস্ত্রহরণ’, ‘কালীয়াদমন’, ‘নৌকাবিলাস’, রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ ছাড়াও ‘মায়ামৃগের ছলনা’, ‘শূর্পণখার নাসিকাচ্ছেদন’ প্রভৃতি দৃশ্যের পাশাপাশি দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধের দৃশ্যও টেরাকোটা মন্দির-ভাস্কর্যের অঙ্গ হয়ে যায়।
মেদিনীপুর অঞ্চলের বহু মন্দিরে আমরা টেরাকোটা দশভুজা, অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গার ফলক লক্ষ্য করি। বিশেষত, উত্তর-পূর্ব ও মধ্য মেদিনীপুরের অনেক ইঁটের মন্দিরে এইরকম টেরাকোটা ফলক দৃশ্যমান। এর একটি লম্বা তালিকা তৈরি করা যেতেই পারে! দুর্গা টেরাকোটা প্যানেলগুলির মধ্যে অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর (মাংলই-শ্যামবল্লভপুর, পাঁশকুড়া, আনুমানিক উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ায়) একটি টেরাকোটা ফলক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্যানেলের ঠিক নিচেই ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের প্রসিদ্ধ ‘কমলেকামিনী’ দৃশ্য দেখতে পাবেন দর্শকেরা।
দশভুজা দুর্গার (সপরিবার ও একক) টেরাকোটার মধ্যে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় চেঁচুয়া-গোবিন্দনগরের (দাসপুর) রাধাগোবিন্দের ‘পঞ্চরত্ন’ মন্দিরে (স্থাপিত: ১৭৮১), লক্ষ্মীজনার্দনের ‘পঞ্চরত্ন’ মন্দিরে (দাসপুর, স্থাপিত: ১৭৯১), এবং চাউলির (খাটাল) শীতলানন্দ শিবের ‘আটচালা’ মন্দিরে (স্থাপিত: ১৮০৯)। কার্তিক গণেশাদি সহ চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনী দুর্গামূর্তির টেরাকোটা-প্যানেল আমরা লক্ষ্য করেছি বাগরুই (কেশপুর) গ্রামের মাইতিদের লক্ষ্মীবরাহের ‘নবরত্ন’ মন্দিরে। মন্দিরটি আনুমানিক উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত। এছাড়া, ব্রাহ্মণবসানের (দাসপুর) শ্রীধরের ‘আটচালা’ মন্দির (উনিশ শতকের কোনো এক সময়ে নির্মিত বলে অনুমান), ভট্টগ্রামের (গোয়ালতোড়) দামোদরের ‘আটচালা’ মন্দির (স্থাপিত: ১৮৬৬, এখানে ‘কমলেকামিনী’ দৃশ্যও আছে), লালগড়ের (বিনপুর) রাধামোহনের দ্বিতল ‘চাঁদনি’ মন্দির, সৌলান গ্রামের (দাসপুর) ভূঞাদের ‘নবরত্ন’ মন্দির (স্থাপিত: ১৮১৭, এখানেও কমলেকামিনী-দৃশ্য রয়েছে) সহ পশ্চিমবঙ্গের আরও অনেক মন্দিরে দুর্গার ‘টেরাকোটা’ ফলক লক্ষ্য করা যায়।
হুগলি জেলায় যেসব মন্দির আছে, তার মধ্যে আঁটপুরের (জাঙ্গীপাড়া) রাধাগোবিন্দের আটচালা মন্দিরে (স্থাপিত: ১৭৮৬) সপরিবার ও একক— দুই ধরনের দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তিই দেখতে পাওয়া যাবে। এছাড়া দ্বারহাট্টার (হরিপাল) আটচালা বিশিষ্ট রাজরাজেশ্বরের মন্দিরেও (স্থাপিত: ১৭২৮) দশভুজামূর্তি-ফলক আমরা লক্ষ্য করে থাকি। এই জেলারই বালি-দেওয়ানগঞ্জের (গোঘাট) জোড়বাংলা রীতির ‘নবরত্ন’ মন্দিরের গায়ে সপরিবার দুর্গার সুদৃশ্য টেরাকোটা-ফলকগুলি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মন্দিরের প্রবেশপথের উপরভাগের প্যানেলে দেবী দুর্গা এবং তাঁর সন্তানসন্ততির মূর্তি রয়েছে। সম্ভবত এটি টেরাকোটায় নির্মিত দেবী দুর্গার সবথেকে বড় প্যানেল। দেবী দুর্গা এবং চার সন্তানের প্রত্যেকেই অবস্থান করছেন পৃথক পৃথক প্যানেলে। দুর্ভাগ্যবশত, সঠিক সংরক্ষণ না হওয়ায় মন্দিরটি আজ ভগ্নপ্রায়। পশ্চিমবাংলার এরকম আরও বহু জেলার ইঁটের মন্দিরে টেরাকোটা প্যানেলের মধ্যে এ ধরনের বহু ফলক পাওয়া যায়।
|| পাঁচ ||
বাংলার মন্দির টেরাকোটায় দুর্গার (সপরিবার ও একক) অবস্থান কার্যত এক প্রথায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল— বিশেষ করে, খ্রিস্টীয় আঠারো ও উনিশ শতকীয় মন্দিরে। সতেরো শতকের মন্দিরে যদিও এই দুর্গা ‘টেরাকোটা’র তেমন সন্নিবেশ লক্ষ্য করা যায় না। যাই হোক, বাংলার টেরাকোটা অলঙ্করণ যে লোকসংস্কৃতি ও লোকশিল্পের এক বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত, তা বলাই বাহুল্য। এগুলির মধ্যে সাধারণ মানুষের সহজ-সরল ধ্যান-ধারণার অকৃত্রিম প্রকাশ ঘটেছে।
টেরাকোটা মন্দিরগুলিও তেমন ‘চালা’, ‘চাঁদনি’ ইত্যাদি লোক-স্থাপত্যেরই নিদর্শন। এগুলির মধ্যে বিরাট কোনো অভূতপূর্ব পরিকল্পনা নেই। সাধারণ মানুষের বসবাসের জন্যে খড়ের চালাঘর যেমন বহু প্রাচীনকাল থেকে নির্মিত হয়ে আসছে, তেমনই গ্রাম-দেবতার বসবাসের জন্যেই এহেন মন্দির স্থাপত্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ক্রমশ, সমকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত ও তার প্রভাবে পরিবর্তনশীল লোকভাবনা সাদামাটা মন্দির-টেরাকোটা-শিল্পের প্রকাশে নানান রূপান্তর ও সৌকর্যের প্রবর্তন ঘটিয়েছিল।
সবশেষে বলতে হয়, টেরাকোটা শিল্পকর্মের রূপ-লাবণ্যের সূক্ষ্ম ধারা বাঙালি জীবনের ফেলে আসা দিনের সৌকর্যকে মোহময় করেছে। ধর্মীয় স্থাপত্য ও শিল্পকলার রূপকে রসিক পর্যবেক্ষক খুঁটিয়ে দেখলে জীবনবোধের এক তন্ময় জগতের সন্ধান পাবেন— পুজোপাঠ, আরাধনা, নমাজ, প্রার্থনার ধর্মীয় অবগুণ্ঠন পেরিয়ে তা অন্যতর জগতে নিয়ে যায়। ঢাক, ঘণ্টার শব্দ, ধূপধুনো, আতরের গন্ধের মধ্যে যে অবলোকন, তা স্থাপত্য-অলংকরণ ও মূর্তিতত্ত্বের অন্তর-বাহির পরম্পরাকে ছুঁয়ে যায়। তাই পেরিয়ে আসা কয়েক শতকে বাঙালির মন্দিরশিল্প ভাবনায়, সমাজ-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের হদিশও অনুভব করা যায়। শিল্পরূপের খোঁজে তৈরি হয় আমাদের আত্মপরিচয়ের কাহিনি।
1 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন