ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

মৃণালিনী দেবীকে লিখিত চিঠিপত্রে অন্তরঙ্গ রবীন্দ্রনাথের খোঁজ -সুদীঘ্ন দাস


পৃ থিবীতে যাঁরা চিঠি লেখায় যশস্বী হয়েছেন তাঁদের সংখ্যা হাতেগোনা। সেইসকল ব্যতিক্রমী এবং দুর্লভ মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই একজন। তাঁর আশি বছরের দীর্ঘ জীবনে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে কত চিঠিই যে তিনি লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই! কেবল বাংলা ভাষায় লেখা রবীন্দ্র-পত্রের সংখ্যাই সাত সহস্রাধিক। প্রাপক সংখ্যা প্রায় সাতশ। সেযুগে ই-মেইল, স্মার্ট ফোন বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট তো আর ছিল না, স্বভাবতই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে চিঠি তাঁকে লিখতেই হত প্রতিদিন। একটা সময়ে এমনও হয়েছে, কোনো কোনো দিন গল্প কবিতা না লিখলেও কাউকে না কাউকে চিঠি তিনি অবশ্যই লিখেছেন। তবে চিঠিপত্র যে তিনি কেবল লিখতে হয় বলে লিখতেন, এমন না— ‘মনের জানালার ধারে বসে’ ভালবেসে লিখতেন। তাই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের হাতে পত্র আর নিছক ‘পত্র’ না থেকে হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য ‘পত্রসাহিত্য’!

তিনি মানতেন, ‘ভারহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস’ আর এটাও তিনি বেশ ভালমতো জানতেন যে ‘সেই রস পাওয়া এবং দেওয়া অল্প লোকের শক্তিতেই আছে’। সর্বোপরি তাঁর দৃষ্টিতে চিঠিপত্র কেন ‘স্বতন্ত্র’ সেই বিষয়ে আলো ফেলে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে একটি তারিখবিহীন চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, —
দূরে থাকার একটা প্রধান সুখ হচ্ছে চিঠি— দেখাশোনার সুখের চেয়েও তার একটু বিশেষত্ব আছে। জিনিষটি অল্প বলে তার দামও বেশী— দুটো চারটে কথাকে সম্পূর্ণ হাতে পাওয়া যায়, তাকে ধরে রাখা যায়, তার মধ্যে যতটুকু যা আছে সেটা নিঃশেষ করে পাওয়া যেতে পারে। দেখাশোনার অনেক কথাবার্ত্তা ভেসে চলে যায়— যত খুসি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় বলেই তার প্রত্যেক কথাটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায় না। বাস্তবিক মানুষে মানুষে দেখাশোনার পরিচয় থেকে চিঠির পরিচয় একটু স্বতন্ত্র— তার মধ্যে একরকমের নিবিড়তা গভীরতা একপ্রকার বিশেষ আনন্দ আছে।

১৮৮৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর, রবীন্দ্রনাথ যখন বাইশ বছরের যুবক, তখন সেকালের রীতি মেনে দেখাশোনা করে তাঁর সাথে বিয়ে হয় যশোরের ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী, দক্ষিণডিহির ফুলতলি গ্রাম নিবাসী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে দশ বছরের বালিকা ভবতারিণীর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আবহাওয়ায় যিনি হয়ে উঠলেন মৃণালিনী। যুবাকাল থেকেই অদ্ভুত রসবোধের অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিবাহের পরদিন কড়িখেলার আসর থেকেই নববিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে তিনি পাতিয়ে ফেলেছিলেন বন্ধুত্বসুলভ সহজ খুনসুটির সম্পর্ক। যার পরিচয় মৃণালিনী দেবীকে লিখিত তাঁর অনেক চিঠির পাতায় ছড়িয়ে আছে। তবে এর পাশাপাশি তাঁর চিঠিপত্রে একজন দায়িত্ববান স্বামীর মতন জীবনের গূঢ়, ভাবগম্ভীর কথা, উপলব্ধির কথা, উপদেশ-নির্দেশের কথা শোনাতেও কুণ্ঠিত হন নি তিনি।

মৃণালিনী দেবীর অকাল প্রয়াণ ঘটে ১৯০২-এর ২৩শে নভেম্বর রাতে। রবীন্দ্রনাথ তখন সবে একচল্লিশ পার করেছেন। কমবেশি কুড়ি বছরের সুস্থ সুন্দর দাম্পত্য জীবন ছিল তাঁদের। এই কালপর্বের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রী মৃণালিনীকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন তার মধ্যে ৩৬টি বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’ শীর্ষক সংকলনের প্রথম খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্র মানসের দলিল স্বরূপ এইসব চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র-সাহিত্যে অনাগ্রহী কোনো ব্যক্তিও আবিষ্কার করতে পারেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে— অন্তরঙ্গ, কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে। আলোচ্য প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরাও সেটিই করবার চেষ্টা করব।

শাহজাদপুরে (সাজাদপুর) জমিদারি দেখাশোনার কাজে গিয়ে পত্নী মৃণালিনী দেবীকে যে চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন জানুয়ারি ১৮৯০ তারিখে, অন্তত তাঁর স্ত্রী-কে লেখা এতাবৎ প্রাপ্ত এটিই প্রথম চিঠি। আর শিলাইদহ থেকে ১৯০২ সালে মৃণালিনীকে যে পত্র রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, স্ত্রী-কে লেখা সেটিই শেষ পত্র তাঁর। এর বাইরেও আরও চিঠিপত্র থাকতে পারে তবে তার হদিস এখনও পর্যন্ত আমরা পাই নি। এই সকল চিঠিপত্রে স্ত্রীর প্রতি বিভিন্ন সম্বোধন ব্যবহার করেছেন তিনি; যেমন: ‘ভাই ছোট বউ’, ‘ভাই ছুটি’, ‘ভাই ছোট গিন্নি’। সাধারণভাবে, এইরকম সম্বোধনের বাইরে স্ত্রী-কে ‘ছুটকি’ বলেও ডেকেছেন রবীন্দ্রনাথ! যা ওঁদের মধ্যেকার খুনসুটির সম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী। অনেক সময়ে পত্রের শেষে ‘সকলকে হামি দিয়ে’ চিঠি শেষ করেছেন। সমাপ্তিতে নাম স্বাক্ষরের সময় কখনও লিখেছেন ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, কখনও ছোট্ট করে ‘রবি’। ছয়টি পত্রের শেষে ‘তোমার রবি’ বলে স্বাক্ষর করেছেন। একটি পত্রের শেষে শুধু ‘তোমার—’ লিখে ছেড়ে দিয়েছেন। কে বলতে পারে, এই শূন্যস্থানে বসানোর মতন উপযুক্ত শব্দ হয়তো কেবল মৃণালিনীই জানতেন! যাই হোক, এইসব টুকরো টাকরা ঘটনার মধ্যে দিয়েই তাঁদের দুজনের মধ্যেকার অন্তরঙ্গতার সম্পর্কের সার্থক প্রকাশ ঘটতে দেখি।

রবীন্দ্রনাথের পাঁচটি সন্তানের জননী মৃণালিনী; মাধুরীলতা বা বেলা (প্রথম সন্তান ও জ্যেষ্ঠা কন্যা, জন্ম: ১৮৮৬), রথীন্দ্রনাথ (দ্বিতীয় সন্তান ও জ্যেষ্ঠ পুত্র, জন্ম: ১৮৮৮), রেণুকা (জন্ম: ১৮৯১), মীরা বা অতসীলতা (জন্ম: ১৮৯৪) এবং শমীন্দ্রনাথ (জন্ম: ১৮৯৬)। তাই যখন দেখি ‘স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন’ হিসেবে স্ত্রীকে লেখা পত্রাবলীতে, একদিকে তিনি স্ত্রী-কে আদর ও সন্তানদের স্নেহের পরশ পাঠিয়েছেন আবার অন্যদিকে দায়িত্ববান স্বামী তথা কর্তব্যপরায়ণ পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন— তখন মোটেই আশ্চর্য হই না। কারণ,এসব চিঠিপত্র পড়লে উপলব্ধি করা যায় যে, বিশালকায় ব্যক্তিত্ববান ‘মহামানব’ রবীন্দ্রনাথের গভীরে একজন স্বাভাবিক রক্ত-মাংসে গড়া, ঘরোয়া, ‘কাছের মানুষ’ রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। যিনি কখনও বিলেত থেকে ফিরতি পথে সন্তানদের জন্য কোন কোন উপহার নিয়ে যাবেন স্ত্রীর কাছে তা জানতে চেয়েছেন (‘শ্যাম’ জাহাজ,২৯শে অগস্ট, ১৮৯০): “দেশে ফেরবার সময় বাচ্ছাদের জন্যে কি রকম জিনিষ নিয়ে যাব বল দেখি”। কখনও বা আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংবাদে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার হিতাহিত চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন (সাজাদপুর, ২৬শে জুন, ১৮৯২):
এখানে কাল থেকে কেমন একটু ঝোড়ো রকমের হয়ে আসচে— এলোমেলো বাতাস বচ্চে, থেকে থেকে বৃষ্টি পড়চে, খুব মেঘ করে রয়েচে। গণৎকার যে বলেচে ২৭ জুন অর্থাৎ কাল একটা প্রলয় ঝড় হবার কথা, সেটা মনে একটু একটু বিশ্বাস হচ্চে। আমারইচ্ছে করচে কালকের দিনটা তোমরা তেতলা থেকে নেবে এসে দোতলায় হলের ঘরে যাপন কর ...।

সন্তানের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তারা যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, যথাযথ ভাবে মানুষ হয়ে ওঠে, সেই দুশ্চিন্তাও পিতা-মাতার মনের মধ্যেবাড়তে থাকে। একইরকম ভাবে তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর পাঁচজন পিতার মতন রবীন্দ্রনাথেরও যে যথেষ্ট উৎকন্ঠা ছিল, তা পত্নীকে লেখা ১৯০০ সালের ডিসেম্বরের একটি পত্র থেকে বেশ বুঝতে পারি:
ছেলেদের জন্যে সৰ্ব্বদা আমার মনের মধ্যে যে একটা উদ্বেগ থাকে সেটা আমি তাড়াবার চেষ্টা করি। ওরা যাতে ভাল হয় ভাল শিক্ষা পায় আমাদের সাধ্যানুসারে সেটা করা উচিত।

তবে এই ‘শিক্ষা’ নিছক প্রথাগত শিক্ষা নয়। ভারি ভারি বইয়ে মুখ গুঁজে নয় বরং বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা। যে কারণে, ১৮৯৮ সনে শিলাইদহ থেকে স্ত্রী-কে লিখিত একটি চিঠিতে তাঁকে বলতে শুনি, “আমি কলকাতার স্বার্থদেবতার পাষাণ মন্দির থেকে তোমাদের দূরে নিভৃত পল্লীগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসতে এত উৎসুক হয়েছি”। এমন আদর্শ পরিবেশ পরবর্তীকালে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। শিক্ষা বিষয়ে তাঁর চিন্তা সার্থকতা লাভ করেছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মধ্যে।
জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের একটা আলাদাই টান ছিল। সেটা তিনি সব সময়ে সচেতন ভাবে লুকিয়েও রাখতেন না। রথীন্দ্রনাথকে তিনি নিজের মনের ভাবনার অনুরূপে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই প্রত্যয়ের অনুরণন শুনতে পাই শিলাইদহ থেকে স্ত্রীকে লেখা ১৯০২ সালের একটি চিঠিতে:
রথীকে আমি উচ্চতর জীবনের জন্য আমি প্রস্তুত করতে চাই– সুতরাং নিয়ম সংযম এবং কৃচ্ছ্রসাধন করতেই হবে— যতই দৃঢ়তার সঙ্গে লেশমাত্র লঙ্ঘন না করে সে নিজের ব্রত সাধন করবে ততই সে মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠবে। ... বড় ideaর চেয়ে, পরমার্থের চেয়ে, মনুষ্যত্বের চেয়ে, এমন কি প্রেম এবং মঙ্গলের চেয়েও আমাদের ক্ষুদ্রতম ইচ্ছাগুলোকেই আমরা বড় দেখি ... কাজের ক্ষতি করে ব্ৰত নষ্ট করে প্রিয়জনদের মনে গুরুতর আঘাত দিয়েও আমাদের অতি তুচ্ছ ইচ্ছাগুলোকে লেশমাত্র খৰ্ব্ব করতে পারিনে। নিজের ইচ্ছাকেই এইরূপ জয়ী হতে দেওয়া এটা বস্তুত নিজেকেই পরাস্ত করা, নিজের উচ্চতন মনুষ্যত্বকে নিজের দীনতার কাছে বলি দান দেওয়া— এতে যথার্থ সুখ নেই কেবল গৰ্ব্বমাত্র আছে। ... এখন ছেলেদের নিজের হাত থেকে মঙ্গলের হাতে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করতে চাই— তিনি এদের ঐশ্বৰ্য্যের গৰ্ব্ব, ইচ্ছার তেজ, প্রবৃত্তির বেগ, দশের আকর্ষণ অপহরণ করে মঙ্গলের ভাবে এবং সুকঠিন বীৰ্য্যে ভূষিত করে তুলুন।

রবীন্দ্রনাথ কখনও চাননি রথীন্দ্রনাথ আলাদা কোনো সুযোগ সুবিধার মধ্যে বড়ো হয়ে উঠুন যা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার দূরত্ব রচনা করবে। আশ্রম বালকদের সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি।

অসুখ-বিসুখে যখন আমাদের শরীর ক্লান্ত আর মন বিষন্ন হয়ে যায় তখন আমরা নিকটজনের সান্নিধ্য প্রত্যাশা করি। তা না পেলেহৃদয়ে আকুলতা তৈরি হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর ব্যতিক্রম নন, তাঁরও একইরকম অনুভূতির সঞ্চার হতে পারে। ১৮৯০-এর অগস্ট মাসে এডেন অভিমুখে যাত্রা করবার সময়ে সাগর মধ্যে জাহাজের দুলুনিতে তিনি ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনদিন ধরে শয্যাশায়ী হয়ে যান, ক্রমাগত বমি, মাথা ঘোরা চলতে থাকে, কিছু খেতেও পারেননি। সেই সময়ে তাঁর মানসিক অবস্থা কি ছিল, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে একবারটি চোখের দেখা দেখতে কিরকম ব্যাকুলতা জেগে উঠেছিল— তার মর্মস্পর্শী পরিচয় পাওয়া যায় ২৯শে অগস্ট জাহাজে বসে মৃণালিনী দেবীকে লেখা একটি পত্রে। তিনি লিখেছেন:
রবিবার দিন রাত্রে আমার ঠিক মনে হল আমার আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে যোড়াসাঁকোয় গেছে। একটা বড়ো খাটে একধারে তুমি শুয়ে রয়েছ আর তোমার পাশে বেলি খোকা শুয়ে। আমি তোমাকে একটু আধটু আদর করলুম আর বল্লুম ছোট বৌ মনে রেখো আজ রবিবার রাত্তিরে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলুম– বিলেত থেকে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব তুমি আমাকে দেখতে পেয়েছিলে কি না। তার পরে বেলি খোকাকে হাম দিয়ে ফিরে চলে এলুম।

লাইনগুলি পড়ে তাঁদের মধ্যেকার চিরকালীন হৃদয়ের টান অনুভব করি।

১৮৯৯ সালের অগস্ট মাসে অত্যন্ত স্নেহের ভাইপো বলেন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণে মৃণালিনী যখন শোকস্তব্ধ, তখন রবীন্দ্রনাথ সামলে ছিলেন তাঁকে। সর্বদা স্ত্রীর কাছে থাকা সম্ভব হয়নি হয়তো, কিন্তু দূরে থেকেও হৃদয়ের ভার লাঘবের চেষ্টা করে গিয়েছেন। ১৯০০-এর নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন:
যদি নিজের দুর্ভাবনার কাছে তুমি এমন করে আত্মসমর্পণ কর তা হলে এ সংসারে তোমার কি গতি হবে বল দেখি? বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে— মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা ত নেই— শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।

১৯০১-এ তাঁদের আরেক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুতেও গভীর শোক পেয়েছিলেন মৃণালিনী, এই মৃত্যুও অন্তর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে। হৃদয়ের সেই ব্যাথা কাটিয়ে উঠতেও সহায় হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কি শোক ছিল না? অবশ্যই ছিল। নিকটজনদের বিচ্ছেদ যাতনা তাঁকেও তো কম সইতে হয় নি। ১৪ বছর বয়সে মা-কে হারানো দিয়ে যার শুরু। কিন্তু তবুও সেই শোককে কখনও জীবনপথের অন্তরায় হয়ে উঠতে দেননি। ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে লেখা একটি চিঠিতে এই গুণ আয়ত্ত করবার মন্ত্র মৃণালিনীকে শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ—
সংসারে চেষ্টা যে যতই করুক অবস্থা ভেদে তার ফল নানারকম ঘটে থাকে— সে কেউ নিবারণ করতে পারে না, অতএব আমরা কেবল কৰ্ত্তব্য করে যাব এইটুকুই আমাদের হাতে— ফলাফলের দ্বারা অকারণ নিজেকে উদ্বেজিত হতে দেব না। ভালমন্দ দুই অত্যন্ত সহজে গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করতে হবে— ক্রমাগত পদে পদে রাত্রিদিন এই অভ্যাসটি করতে হবে ... ।

কৃপাময় ঈশ্বর তাঁকে “শোকের দ্বার দিয়া মঙ্গলের পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবেন”— রবীন্দ্রনাথ এই গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। শোকের, দুঃখের সার্থকতা সেখানেই।

সহধর্মিণীর কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা কী ছিল, কীভাবে তিনি তাঁদের যৌথ জীবন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেকথা জানা যায় ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে কলকাতা থেকে মৃণালিনীকে লেখা কবির পত্র পড়ে, —
আমাকে সুখী করবার জন্যে তুমি বেশি কোন চেষ্টা কোরো না— আন্তরিক ভালবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য তোমাতে আমাতে সকল কাজ ও সকল ভাবেই যদি যোগ থাকত খুব ভাল হত— কিন্তু সে কারো ইচ্ছায়ত্ত নয়। যদি তুমি আমার সঙ্গে সকল রকম বিষয়ে সকল রকম শিক্ষায় যোগ দিতে পার ত খুসি হই— আমি যা কিছু জানতে চাই তোমাকেও তা জানাতে পারি— আমি যা শিখতে চাই তুমিও আমার সঙ্গে শিক্ষা কর তাহলে খুব সুখের হয়। জীবনে দুজনে মিলে সকল বিষয়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অগ্রসর হওয়া সহজ হয়— তোমাকে কোন বিষয়ে আমি ছাড়িয়ে যেতে ইচ্ছা করিনে— কিন্তু জোর করে তোমাকে পীড়ন করতে আমার শঙ্কা হয়। সকলেরই স্বতন্ত্র রুচি অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে— আমার ইচ্ছা ও অনুরাগের সঙ্গে তোমার সমস্ত প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ মেলাবার ক্ষমতা তোমার নিজের হাতে নেই– সুতরাং সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র খুঁৎ খুঁৎ না করে ভালবাসার দ্বারা যত্নের দ্বারা আমার জীবনকে মধুর— আমাকে অনাবশ্যক দুঃখকষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করলে, সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে।

চিঠির এই বয়ান থেকে বেশ বোঝা যায় যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনীকে পেতে চেয়েছিলেন জীবনের সহযোগী ও সহকর্মী রূপে। প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে যাঁরা হয়ে উঠবেন একে অপরের পরিপূরক। এমনকি সস্ত্রীক বিলেত ভ্রমণের স্বপ্নও যে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (হয়তো এমন ভাবনার পশ্চাতে দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর সাহচর্যের সবিশেষ প্রভাব ছিল), তার স্পষ্টইঙ্গিত পাই ১৮৯০ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ‘ম্যাসালিয়া’ জাহাজ থেকে ‘ছোট গিন্নি’ মৃণালিনীকে লেখা একটি রবীন্দ্রপত্রে—
আমাদের জাহাজটা এখন ডান দিকে গ্রীস আর বাঁ দিকে একটা দ্বীপের মাঝখান দিয়ে চলেছে। দ্বীপটা খুব কাছে দেখাচ্চে— কতকগুলো পাহাড়, তার মাঝে মাঝে বাড়ি, এক জায়গায় খুব একটা মস্ত সহর ... সমুদ্রের ঠিক ধারেই নীল পাহাড়ের কোলের মধ্যে শাদা সহরটি বেশ দেখাচ্চে। তোমার দেখতে ইচ্ছে করচেনা ছুটকি? তোমাকেও একদিন এই পথ দিয়ে আসতে হবে তা জান? তা মনে করে তোমার খুসি হয় না? যা কখনো স্বপ্নেও মনে কর নি সেই সমস্ত দেখতে পাবে।

অবশ্য সে স্বপ্ন তাঁর আর পূর্ণতা পায় নি। তবে কবির জীবনপথের নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী হয়ে ওঠবার প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন মৃণালিনী। জীবনের সবক্ষেত্রে, এমনকি শান্তিনিকেতনে আদর্শ-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মতন একটি ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ কাজে যখন সব আত্মীয়স্বজনেরা বিমুখ, তখনও মৃণালিনীই তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বামীর প্রয়োজনে হাসিমুখে খুলে দিয়েছেন গায়ের এক-একটি গয়না। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, শেষ পর্যন্ত হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন হার ছাড়া তাঁর কোনও গয়না অবশিষ্ট ছিল না।কে বলতে পারে, মৃণালিনী আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথের আশ্রম-বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা হয়তো আরও সার্থক হতে পারত।

আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীকে যে সকল পত্র লিখতেন, তার উত্তর কিছু পেতেন কি? স্ত্রীর পত্রের প্রত্যাশা তিনি অবশ্যই করতেন— তাঁর পত্রের মধ্যে থেকেই সেটা জানা যায়। ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে স্ত্রী-কে লেখা পত্রে কবিকে লিখতে দেখি: “বড় হোক ছোট হোক ভাল হোক মন্দ হোক একটা করে চিঠি আমাকে রোজ লেখনা কেন? ডাকের সময় চিঠি না পেলে ভারি খালি ঠেকে।” তবে সবসময়েই যে তাঁর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে তা-ও নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেহত না, সেটা স্ত্রীকে লিখিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের অনুযোগ থেকেই স্পষ্ট। শিলাইদহ থেকে অভিমানী রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: 
আজ থেকে নিয়ম করলুম চিঠির উত্তর না পেলে আমি চিঠি লিখব না। ... তুমি যদি হপ্তায় নিয়মিত দুখানা করে চিঠিও লিখতে তা হলেও আমি যথেষ্ট পুরস্কার জ্ঞান করতুম। এখন আমার ক্রমশঃ বিশ্বাস হয়ে আসচে তোমার কাছে আমার চিঠির কোন মূল্য নেই এবং তুমি আমাকে দু ছত্র চিঠি লিখতে কিছুমাত্র কেয়ার কর না।

স্ত্রীর চিঠি না পেয়ে কখনও সখনও তিনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন: “ডাকের সময় ডাক এল— খান তিনেক চিঠি এল— অথচ তোমার চিঠি পাওয়া গেল না।” স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসায় কতটা গভীরতা থাকলে এমন মর্মস্পর্শী ব্যাকুলতা ঝরে পড়ে তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। যদিও স্বামীকে ক্কচিৎ কদাচিৎ উত্তর পাঠাতেন মৃণালিনী। খুব প্রয়োজন পড়লে কিংবা রবীন্দ্রনাথ খুব জোরাজুরি করলে তবেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে চিঠি লিখতেন। এই বক্তব্যের সমর্থন কবির চিঠিতেই রয়েছে: “যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত।” দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথকে লিখিত মৃণালিনীর চিঠিপত্রের সন্ধান এখনও পর্যন্ত আমরা পাই নি। পেলে অন্তত স্বামীর প্রতি স্ত্রীর হৃদয়ের ভাবের কিঞ্চিৎ নাগাল পাওয়া গেলেও যেতে পারত! তাঁদের পারস্পরিক ভালোবাসার, শখ্যতার ও অন্তরঙ্গতার পূর্ণতর ছবিটি আঁকা সহজ হত।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ