
মা
নুষের জীবনে খুব সাধারণ অথচ অপরিহার্য দুটি বিষয় হচ্ছে সত্য ও মিথ্যা। জীবনে
এই দুটি বিষয়েরই প্রয়োজন আছে। অবিমিশ্র সত্য বা মিথ্যার সাহায্যে জীবন যাপন
অসম্ভব। প্রকৃত সত্য বা প্রকৃত মিথ্যা বাস্তবে আদৌ হয় কিনা তা বলা অত্যন্ত
কঠিন। ক্ষেত্র এবং সময় বিশেষে সত্য ও মিথ্যা এই দুটি বিষয়েরই সংজ্ঞা এবং
তাৎপর্যের পরিবৃত্তি ঘটে যায়। পরিস্থিতিভেদে মিথ্যা সর্বদাই কুটিল ও হানিকারক
হয় না অথবা সত্য সর্বদাই হিতকারক ও সরল হয় না।
নীতিবোধ ও সত্য অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কে বিদ্যমান। সত্যের সঙ্গে পুণ্যেরও খুব
ঘনিষ্ঠতা আছে বলে মনে করা হয়। সত্যবাদীরা মহাপুণ্যবান এবং মিথ্যাবাদীরা ঘোর
পাপিষ্ঠ বলে সর্বত্রই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সত্য, মিথ্যা, পাপ, পুণ্য এই
চারটি বিষয়ের কোনোটির ধারণাই সম্পূর্ণ ধ্রুবক নয়। পরিস্থিতিভেদে এই ধারণাগুলি
পরিবৃত্ত হয়ে থাকে।
ধরা যাক কোনো সহায়হীন পলায়নপর ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েকজন খুনি গুন্ডা
তার পশ্চাদ্ধাবন করে ‘ক’বাবুর গৃহের দিকেই আসছে। প্রাণভয়ে নিতান্ত আতঙ্কিত সেই
ব্যক্তি ‘ক’বাবুর গৃহে ঢুকে পড়ে আশ্রয় নিল। ব্যক্তিটির পিছু নেওয়া সেই নির্মম
খুনিরা এসে ‘ক’বাবুকে জিজ্ঞাসা করল, তিনি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন কিনা। সেই
মুহূর্তে কিন্তু সত্য, মিথ্যা, পাপ, পুণ্য ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রচলিত ধারণার
বিপ্রতীপে অন্য এক ধারণায় স্থিত হয়ে গেছে।
সত্য ও মিথ্যার এই বিচিত্র গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে গিয়ে আঙ্গিক
হিসাবে মহাভারতে বর্ণিত কয়েকটি প্রসঙ্গ অবলম্বন করা হয়েছে। এখানে যেসব
প্রসঙ্গের বা ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় পৌরাণিক ঘটনা এবং
প্রায় সকলেরই সেসব ঘটনা মোটামুটি জানা আছে। সেজন্য ওই ঘটনাগুলির খুঁটিনাটি বা
বিস্তৃত বিবরণ অপ্রয়োজনীয় বোধে এখানে দেওয়া হল না।
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের দ্রোণপর্ব। কৌরবপক্ষের দ্বিতীয় সেনাপতি আচার্য
দ্রোণের প্রবল বিক্রমে পাণ্ডবপক্ষ তখন গভীর বিপন্নতায় নিমজ্জিত। পাণ্ডবপক্ষীয়
কোনো বীরই রণাঙ্গনে আচার্যের ধ্বংসলীলা কিছুতেই রোধ করতে পারছেন না। এদিকে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ট ধনুর্ধর অর্জুনকে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয়
অস্ত্রগুরুর বিরুদ্ধে কোনো মারাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আন্তরিকভাবে অনিচ্ছুক
বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে তো পান্ডবদের পরাজয় অনিবার্য বটে। এমনিতেই কৌরব
বাহিনির তুলনায় পান্ডব বাহিনির সৈন্যসংখ্যা বেশ কম। আচার্যের এইরকম প্রচন্ড
ধ্বংসলীলা চলতে থাকলে এই দ্রোণপর্বেই পান্ডবপক্ষের পরাজয়েই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।
অন্য কোনো উপায় না থাকায় মহাভারতের প্রবলতম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে
অর্জুনকে না জানিয়েই দ্রোণবধের গোপন এক পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনাটি
করা হয়েছিল দ্রোণাচার্যেরই একটি বিশেষ কথার উপর ভিত্তি করে।
তিনি কথাপ্রসঙ্গে পাণ্ডবদের একসময় বলেছিলেন তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র থাকবে
ততক্ষণ তাকে যুদ্ধে পরাজিত বা নিহত করা কারও পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু
যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখ-সমরে অস্ত্রের আঘাতে মহাবীর দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রহীন করে
ফেলা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অতএব অন্যতর অমোঘ এক আঘাতের কথা ভাবা হয়েছিল।
অতর্কিত সেই আঘাতে যে কোনো মহাবীরের বিকলন সম্ভব।
শ্রীকৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন রণক্ষেত্রে ‘অশ্বত্থামা’ নামের একটি
রণহস্তীকে নিহত করে মধ্যমপাণ্ডব ভীম ‘অশ্বথামা হত’ হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করলেন
এবং পান্ডবপক্ষীয় সৈন্যরা সেই একই দাবিতে প্রবল ভাবে গর্জন করতে লাগলেন। সেসব
কথা শুনে দ্রোণাচার্য তাঁর পরম স্নেহের একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামা সত্যই
নিহত হয়েছে কিনা ভেবে গভীর আশঙ্কায় নিতান্ত ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তখন নিগূঢ়
বিশ্বাসে পরম সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের কাছেই সেই ভয়াবহ সংবাদ সত্য কিনা জিজ্ঞাসা
করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন সত্যসন্ধ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কখনও কোনো অবস্থাতেই
অনৃতভাষণ করবেন না, কখনই তা করতে পারেন না।
সবাই জানেন যে সে প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির ঠিক কী বলেছিলেন এবং তা বলার পর
কী কী ঘটেছিল। দ্রোণবধের পূর্ব পরিকল্পনামতো যুধিষ্ঠির তখন যে উত্তরটি অত্যন্ত
সুকৌশলে দিয়েছিলেন সেটি একেবারে সত্য বা মিথ্যা ছিল না। বলা যায় সেটি অর্ধসত্য
এবং অর্ধমিথ্যা ছিল। এই অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যাটি বলার জন্য শাস্তিস্বরূপ
পরমধার্মিক মহাসত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে একবার নরক-দর্শনের যন্ত্রণাভোগ করতে
হয়েছিল।
প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস অনুযায়ী যুধিষ্ঠির তাঁর জীবনে ওই একবারই মিথ্যা
বলেছিলেন এবং সেটি আবার অর্ধমিথ্যা ছিল মাত্র। কিন্তু মহাভারত রচয়িতার বর্ণনা
অনুসারে যুধিষ্ঠির আরও অন্তত তিন তিনবার সুস্পষ্ট মিথ্যাভাষণ এবং মিথ্যাপোষণ
করেছিলেন। সেগুলির প্রত্যেকটিই সম্পূর্ণ এবং প্রত্যক্ষ মিথ্যাকথন ছিল। এই
মিথ্যাগুলির কথা বিবেচনা করে দেখলে যুধিষ্ঠিরকে একজন যথেষ্ট পোক্ত মিথ্যাবাদী
বলে নিঃসন্দেহে ভেবে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে মিথ্যাকথনের অপরাধের জন্য
নরক-দর্শনের পরিবর্তে নরকবাসই তো যুধিষ্ঠিরের যথাযথ শাস্তি ছিল।
প্রথমত একচক্রা নগরীতে চারভাই এবং মা কুন্তীসমেত নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে
মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যুধিষ্ঠির এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘদিন বাস
করেছিলেন। সে যুগে ভিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে দরিদ্র ব্রাহ্মণদের জীবিকার্জন
প্রচলিত ছিল বলে যুধিষ্ঠিরাও তাই করতেন। সেই সময়ে ভিক্ষাদাতাদের কাছেও গিয়ে
তিনি দিনের পর দিন দরিদ্র ব্রাহ্মণ হিসেবে মিথ্যা পরিচয় ক্রমাগত দিয়ে
গেছেন।
দ্বিতীয়ত দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় গিয়ে ক্ষত্রিয় হয়েও সেখানে যুধিষ্ঠির নিজেদের
ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন এবং ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ
করেছিলেন। ক্ষত্রিয় রাজারা দ্রৌপদীকে বিবাহের শর্ত হিসেবে নির্ধারিত উপায়ে
মৎসচক্ষুর লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলে ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন অন্য সম্প্রদায়কে সেই
লক্ষ্যভেদে আহবান জানালেন, ‘ব্রাহ্মণ’ যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমেই অর্জুন
ব্রাহ্মণ হিসাবে সেই লক্ষ্যভেদে অগ্রসর হয়েছিলেন। এগুলি প্রত্যক্ষভাবে অন্যের
পক্ষে হানিকারক না হলেও স্পষ্টতই যুধিষ্ঠিরের সম্পূর্ণ মিথ্যাচারণ।
তৃতীয়ত যুধিষ্ঠিরের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য মিথ্যাচারণ হল অজ্ঞাতবাসকালে
মৎসরাজ বিরাটের কাছে আদ্যন্ত মিথ্যাকথন। দ্রৌপদীসহ ভাইদের সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির
সেখানে নিজেদের নাম সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছিলেন ও মিথ্যা বৃত্তিগত পরিচয়
দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় দীর্ঘ এক বছর ধরে বিরাটরাজের গৃহে সে মিথ্যাকে তিনি
সযত্নে লালন করে গেছেন। ভাইদেরও সেই মিথ্যাকে অবলম্বন করতে নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
এই তিন তিনটি পূর্ণমিথ্যাচারের জন্য পরবর্তী কালে যুধিষ্টিরের কোনোরকম
শাস্তিবিধানের কোনো উল্লেখ না থাকলেও শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কথিত সেই
অর্ধমিথ্যাটির জন্য শাস্তিবিধানের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ একাধিকবার পূর্ণমিথ্যা
কথনেও যুধিষ্টিরের কোনো অপন্যায় ঘটেনি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে মাত্র একবার
অর্ধমিথ্যা কথনেই শস্তিযোগ্য অপন্যায় ঘটে গেছে। অথচ রণে ও প্রণয়ে মিথ্যা কথনে
কোনো অপরাধ ঘটে না এমন শাস্ত্রবাক্য বিদ্যমান। তবে কি মহাভারত রচয়িতা তাঁর
মহাগ্রন্থে স্ববিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করেছেন?
দৈবী মহিমাকীর্তন, মানুষিক মহত্বের দেবত্বে উত্তরণের বিবরণ, অসাধারণ
চরিত্রচিত্রণ, মহাকাব্যিক জটিলতা এবং সর্বোপরি কালজয়ী সাহিত্যগুণ, সবদিক দিয়েই
মহাভারত শ্রেষ্ট মহাকাব্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সেই কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যে
স্ববিরোধিতার মত অতি নিম্নমানের অসঙ্গতি বর্তমান থেকে গেল? ঘটনাগুলির গভীরতা
যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারলে এই তথাকথিত ‘অসঙ্গতি’ কে এক তাৎপর্যপূর্ণ
সুসঙ্গতি বলে প্রতিভাত হবে।
একটু তলিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যাবে ওই অর্ধমিথ্যাটির সঙ্গে অন্য তিনটি
পূর্ণমিথ্যার একটি মূলগত পার্থক্য আছে। ওই পূর্ণ মিথ্যাগুলি কথিত হয়েছিল
যুধিষ্ঠির তথা পাণ্ডবদের আত্মপরিচয় গোপন করার জন্য এবং পুনর্বার দ্বাদশ বৎসরের
বনবাস এড়াবার জন্য। কুরুক্ষত্রের রণভূমিতে যুধিষ্ঠিরকে নিজমুখে
অর্ধমিথ্যাটি বলতে হয়েছিল তীব্র সংকটে পড়ে – যুদ্ধে সম্ভাব্য পরাজয় এড়াবার
চেষ্টা করতে গিয়ে। আর শুধু এজন্যই যুধিষ্ঠিরকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। তাঁকে করতেই
হয়েছিল নরক দর্শন! অথচ এমন ধারণাই সাধারণ্যে বহুল প্রচলিত রয়েছে যে
আত্মরক্ষার্থে মিথ্যাকথন গুরুতর অপরাধ নয়।
এই আপাত-স্ববিরোধিতার আড়ালে এক গভীর মহান জীবনাদর্শের বাণী নিহিত আছে। যখন
শুধুমাত্র আত্মপরিচয় গোপন করতে গিয়ে যখন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হল সেক্ষেত্রে
সত্য-বিচ্যুতি যতটা গভীর, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর তাগিদে মিথ্যা
ভাষণের ক্ষেত্রটিতে সেই বিচ্যুতি অনেক বেশি গভীর, তাই শাস্তিযোগ্য। সত্যনিষ্ঠ
বলে প্রতিষ্ঠিত কারো পক্ষে সত্যের সহজ পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধের তুলনায়
সত্যের কঠিন পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার অপরাধ অনেক বেশি। যুধিষ্ঠিরের মতো একজন চরম
সত্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত ব্যক্তির যুদ্ধে পরাজয়ের ভয়ে এই সত্য-বিচ্যুতির অপরাধ
মহাভারতকার কিছুতেই ক্ষমা প্রদর্শন করতে চাননি।
অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েও এই মহৎ তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। পূর্ণ
মিথ্যাভাষণগুলি আত্মগোপনের জন্য কথিত হয়েছিল, কিন্তু তা কারো কোনো প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষ ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্য কথিত হয়নি। সেই মিথ্যাভাষণের ফলে কারও ক্ষতিসাধন
হয়ওনি। সেজন্য সেগুলিকে পাপ বলে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে
যুধিষ্ঠিরের এই অর্ধমিথ্যা ভাষণটি প্রত্যক্ষভাবে কৌরব সেনাপতি মহারথী
দ্রোণাচার্যের নিশ্চিত ধ্বংসসাধনের সুনিশ্চিত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল –
তাই তা পাপ বলে গণ্য হয়েছিল। ‘ধর্মরাজ’ অভিধার খোলসটির আড়ালে যুধিষ্ঠির শুধু
মিথাভাষণই নয় অন্যরকমের অতি জঘন্য ও গভীর অসৎ উদ্দেশ্যমূলক অধার্মিকতার অনেক
কাজই করেছিলেন। কিন্তু সেসব অন্য কাহিনি। বারান্তরে সেইসব প্রসঙ্গ পাঠকের কাছে
নিবেদনের ইচ্ছা রইল।
'উৎস'তে প্রকাশিত লেখক তুষার সরদারের অন্যান্য লেখা (পড়তে লাল অক্ষরে ক্লিক করুন) -
ছোটগল্প
- সমাধান (প্রকাশকাল- জুলাই ২০২৩)
- বোধনদের বৃত্তান্ত (প্রকাশকাল- সেপ্টেম্বর ২০২৩)
- বেচার জিনিস (প্রকাশকাল- অক্টোবর ২০২৩)
0 মন্তব্যসমূহ