ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

আমার ছোটবেলার সরস্বতী পূজা -সুভাষ কর


ছো টবেলার সরস্বতী পূজার স্মৃতি মনকে নাড়া দেয় না বাঙালি হিন্দু পরিবারে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমি নিজেও তার ব্যতিক্রম নই। তবে প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, আমার ছোটবেলা মানে ষাটাধিক বছর আগের জীবনকাল। তাই পাঠককেও সেভাবে তৈরী হয়ে নিতে অনুরোধ রইল।

খুব মনে পড়ে স্কুলের পুজো, বাড়ীর পুজো আর সর্বোপরি পাড়ায় এই উদ্দেশ্যেই হঠাৎ গজানো ক্লাবের পুজোর কথা। হঠাৎ হুজুগে চার পাঁচ জন একত্র হয়েই ব্যস্, যেকোন একটা নাম দিয়ে সেই ক্লাবের নামে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করে ফেলতাম। কখনো ‘বিদ্যার্থী ক্লাব’, কখনো ‘ছাত্র সঙ্ঘ’, আবার কখনো বা ‘আমরা ছাত্রদল’ ইত্যাদি নানা নামেই সরস্বতী পূজা করেছি। পেছনে ফিরে দেখলে এখন আশ্চর্য লাগে যে, সরস্বতী পূজা ছাড়া ঐ ক্লাবগুলি থেকে আমরা দ্বিতীয় আর কোন কাজ করার কথা কোনদিন ভাবিওনি ! এক বছরের একত্রিত হওয়া একটা গ্রুপ প্রায়ই পরের বছরগুলোতে ভেঙে গড়ে নতুন রূপ নিত। আগেরবারের ঝগড়াঝাঁটি মনোমালিন্য সবকিছুর ক্ষোভ যেন গিয়ে পড়ত পরের বারে নতুন করে পরিকল্পিত বিদ্যাদেবীর আরাধনার ব্যবস্থাপনায়।

স্কুলের পুজোয় কখনোই তেমনভাবে জড়িত ছিলাম না। একে তো স্যারদের সতর্ক নজরদারি, তদুপরি দাদাদের সর্দারি (আমি বয়েজ স্কুলে পড়তাম, তাই দিদিদের সম্পর্কে কোন কথা বলতে অক্ষম)। তবে শুধু খিচুড়ি প্রসাদের লোভেই দুপুরবেলায় স্কুলে হাজিরাটা না দিলে চলত না। অনেক সময় প্রতিমা ও সাজসজ্জা দেখার বিষয়টাও উপেক্ষিত থেকে যেত; কিন্তু খিচুড়িকে এড়িয়ে যাওয়া? নৈব নৈব চ। মনে মনে মা সরস্বতীকে বলতাম, “দোষ নিও না মাগো, ঐদিকে ক্লাবের পুজো প্যাণ্ডেল যে খালি পড়ে আছে- তাই তোমার প্রসাদটুকু নিয়েই তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে যাচ্ছি”। সন্ধ্যেবেলায় স্কুলে আবার অভিভাবকদের নেমন্তন্ন থাকত। ওদের ভাগ্যে বরাদ্দ থাকত সামান্য ফল-প্রসাদ এবং সঙ্গে লুচি আর বোঁদে। খুব কম অভিভাবকই স্কুলে যেতেন, এবং অনেক উদ্বৃত্ত প্রসাদ পুজোর সাথে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বাঁটাবাটি হ’ত। পুজোর সাথে যুক্ত নয় এমন অনেক ছাত্র এবং তাদের কিছু বন্ধুবান্ধবও তখন লুচি-বোঁদের লোভে সেখানে জড়ো হ’ত, যদিও আমি নিজে কখনোই সেবিষয়ে প্রলুব্ধ হইনি। মাঝে মাঝে এই নিয়ে ঝামেলা হবার খবরও শোনা গেছে।

বাড়ীর পুজোতে পরিবারের সবাই মিলে অঞ্জলি দিতাম। শুধু বাবাকে কোনদিন অঞ্জলি দিতে দেখিনি। বাবা নীতিগতভাবে নাস্তিক ছিলেন। সবাইকে বলতেন, “পড়াশুনা ভালভাবে করলেই সরস্বতীর পূজা করা হয়ে যায়। চাল-কলা-কুল-ভাঙ্ এর ঘুষ দিয়ে তাঁকে খুশী করা যায় না। মা বিরোধ করে বলতেন- পড়াশুনা এবং পুজো দুটোই করতে হবে। বড় হয়ে ভাইবোনদের কেউ কেউ নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকলেও ছোটবেলায় মায়ের কথাকেই আমাদের কাছে ঠিক মনে হ’ত। 

সেই দিনগুলোতে সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া বারণ ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্যি লুকিয়ে সেই নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলতাম। ধরা পড়লে ঠাকুমার বকুনি থেকে বাঁচা মুশকিল হ’ত। পুজোর দিন বাগ্দেবীর প্রতিমার সামনে নিজেদের কিছু বইখাতা ও কলম সাজিয়ে রাখার চল ছিল। যে বিষয়টা যার কাছে কঠিন লাগত, সেই বিষয়ের বইটাই সবাই সবচেয়ে আগে সেখানে এনে রাখত। বিশ্বাস ছিল, মা-সরস্বতীর আশীর্বাদে পরীক্ষায় ঐ বিষয়টির প্রাপ্ত নম্বরে উন্নতি ঘটবে। আমি ভূগোল-বইটা দিতাম, কারণ বিষয়টিতে একশতে চল্লিশের উপরে আমি কখনোই পেতাম না। ক্লাশ এইটের পর ভূগো‌ল পড়ার থেকে রেহাই পাবার ঠিক আগটায় শেষবার পঁয়তাল্লিশ পেয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেছলাম। জানি না সেটা মা-সরস্বতীরই আশীর্বাদেই সম্ভব হয়েছিল কিনা। মায়ের কথায় সরল বিশ্বাসে পুজোর পরদিন খাগের কলম দিয়ে বেলপাতায় “শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ” লিখে প্রতিটি বইয়ের পাতার ভেতরে যত্ন করে রেখে দিতাম। এছাড়াও সব ভাইবোনকে একটি খাতায় সাধারণ ঝর্ণা-কলম দিয়ে আলাদা করে একশ আটবার “শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ” কথাটি লিখতে হ’ত।

এবার আসি পাড়ার ক্লাবের পুজোয়। আগেই বলেছি উদ্যোক্তাদের কোন স্থায়ী চেহারা ছিল না। বছর বছর সক্রিয় সদস্যরা পাল্টে যেত। আমি বার তিনেক সক্রিয় থেকে পরে দূরে সরে গেছলাম; আর সেই তিন বছরও একেক বার এক একদল সঙ্গীদের সাথে। অন্যেরাও তাই। এর কারণ ছিল ছোট সীমিত জায়গার মধ্যে অত্যধিক সংখ্যার পুজো। সবাই চাইত, যে দলে সে থাকবে- সেখানে তার নিজের আধিপত্য বজায় থাকতে হবে, অন্ততঃ নিয়ন্ত্রণের অনেকটা রাশই যেন তার হাতে থাকে। এমনিতে ছোট জায়গায় কেউই কারো অচেনা বা অপরিচিত নয়, সেদিক থেকে কারো সাথে কাজ করতেই অসুবিধে ছিল না; কিন্তু সবার লোভটা থাকত কর্তৃত্বের। চাঁদা তোলার সময় বড়রা উপদেশ দিতেন- “তোরা এতগুলো পুজো না করে সবাই মিলে একটা পুজো করিস না কেন? আমাদেরও চাঁদা দিতে সুবিধে হবে, আর তোদের মোট চাঁদার পরিমাণও বেশী হবে”। তখন আসল দুর্বলতাটা চেপে গিয়ে সবাই বলত, “বড় পুজোতে অনেক ঝামেলা, কাকু (বা মেসো) !” চাঁদা তুলতে গিয়ে আরেকটা যে পরীক্ষার সম্মুখীন হতাম তা হ’ল- কিছু কঠিন বানান শুদ্ধ করে বলতে হ’ত। এর মধ্যে ‘সরস্বতী’, ‘বিদ্যালয়’, ‘পূজা’, ‘চাঁদা’, ‘আমন্ত্রণ’, ‘প্রার্থনা’ ইত্যাদি শব্দগুলো উল্লেখযোগ্য। না পারলে চাঁদার পরিমাণে তো মন্দ প্রভাব পড়তই, বকাঝকাও একেবারে কম জুটত না।

পাড়ার যে পুজোতে আমি যুক্ত থাকতাম, সেটায় সাধারণতঃ তুলো আর বাঁশকাঠি দিয়ে পাহাড় ও মেঘের ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরী করে তার সামনে মা সরস্বতীর ছোট প্রতিমা বসানো হ’ত। বাজেট কম হওয়ায় ছাঁচের প্রতিমারই বন্দোবস্ত হ’ত- কাঠামোর প্রতিমার কথা ভাবনায়ই আসত না। সংশ্লিষ্ট কয়জনের বাড়ীর পুজোর আয়োজন থেকেই কিছু সামগ্রী ম্যানেজ করে এবং ঐ পুরোহিতদের মধ্যেই কাউকে ধরে-টরে পুজোটা কোনভাবে সারা হ’ত। একবার আমরা এক বন্ধুর প্রতিভার সদ্ব্যবহার করে প্রতিমার সামনে একটা ফোয়ারা তৈরী করেছিলাম। ঘর থেকে সংগৃহীত একটা পুরনো চোঙাকৃতি ঘরোয়া ‘এনেমা’- র চোঙটিতে জল ঢেলে, তার সাথে প্রথম দিকটায় পেঁপে গাছের একটা মস্ত লম্বা ফাঁপা ডাল এবং তারপর একটা রাবারের নল জুড়ে দিয়ে তার প্রান্ত সীমায় ‘এনেমা’- র সূচালো মুখটি কাজে লাগিয়ে সেই ফোয়ারার জন্ম দেয়া হয়। অবশ্যি সেটা দর্শক এলে চালু হ’ত, আবার দর্শক চলে গেলেই বন্ধ হয়ে যেত, কেননা আড়াল থেকে ঐ চোঙে জল ঢালা চালু না রাখলে ফোয়ারার জেগে থাকা সম্ভব ছিল না। বলা প্রয়োজন, তখন আমাদের শহরে ওয়াটার সাপ্লাই বলে কোন ব্যাপার ছিল না, তাই টেপ ওয়াটার থেকে ধারাবাহিক জল ব্যবহার ছিল দূর অস্ত !

অন্য পুজোগুলোর উদ্যোক্তারাও সামর্থ অনুযায়ী নানা কারিকুরি প্রদর্শনের চেষ্টা করত। সত্যি কথা বলতে কি, তথাকথিত ঐ ক্লাবের পুজোগুলো পাড়ার ছেলেদের কাছে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হ’বার কারণ ছিল নিজেদের পছন্দমত এই কারিকুরি দেখাবার একটা প্ল্যাটফর্ম পাওয়া। আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় ছিল- প্রায় কোন ক্লাব-পূজাতেই প্রসাদ বিতরণের কোন ব্যবস্থা থাকত না। একবার স্কুলে আরেকবার বাড়ীতে প্রসাদ নেবার পর কারোরই এর খুব একটা প্রয়োজনও পড়ত না। আর কিছু ছেলে, যারা স্কুলে পড়ত না, বা যাদের বাড়ীতে পুজো হ’ত না- তাদের আমাদের মধ্যেই কারো না কারো বাড়ীতে বা স্কুলে একটা গতি হয়ে য়েত।

স্মৃতিচারণার শেষ স্তরে এসে একটা খুব করুণ অভিজ্ঞতার কথা বলছি। শেষবার যখন পাড়ার সরস্বতী পূজায় যুক্ত ছিলাম, সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ করে পুজোর ছোট বাঁশের মণ্ডপটায় আগুন লেগে গিয়েছিল। মোমবাতির আলো থেকে অসাবধানতায় তুলোর পাহাড়ে কিভাবে যেন আগুন ধরে যায়। প্রতিমার কাছে তখন একটি বাচ্চা ছেলে ছাড়া আর কেউ ছিল না। সে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ভয়ে চীৎকারটুকুও করতে পারছিল না। আমার বাবা দূর থেকে আগুন দেখে দৌড়ে এসে মণ্ডপটি ভাঙচুর করে কোনভাবে আগুন নিভিয়েছিলেন। তাঁর হাতে-পায়ে অনেকটা জায়গা ঝলসে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর বাবা সুস্থ হ’ন। সেই থেকে আমি ও আমার ভাইবোন কেউ-ই আর পাড়ার কোন পুজোয় নিজেদেরকে যুক্ত রাখিনি।

এবার সম্পূর্ণ অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে এই স্মৃতিচারণা শেষ করব। বহু পরে বয়সে অনেক বড় হয়ে জেনেছি, সরস্বতী পূজা নাকি বাঙালির ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘প্রেম-দিবস’। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে যখন শরীরে মনে প্রথম কোন বিশেষ মনের মানুষ খোঁজার তাগিদ অনুভব করেছিলাম- ততদিনে নিজ সত্তায় সরস্বতী পূজার আকর্ষণ আর তেমনভাবে ক্রিয়াশীল ছিল না। হ্যাঁ, পরবর্তীতে অন্যদের ব্যবস্থাপনায় বাগ্দেবীর পুজোয় যোগ দিইনি এমন নয়, কিন্তু নেহাৎই বোকা ছিলাম বলেই বোধহয় মা সরস্বতী ‘‘ভ্যালেন্টাইন্স দেবী’ হয়ে তাঁর কৃপা বিতরণে কৃপণতা করেছেন। অবশ্যি আখেরে সেটা এই অধমের জন্যে ভাল কি মন্দ ফল নিয়ে এসেছে তা একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ✍️ ছেলেবেলার স্মৃতিচারণাটি বড়বেলার সকলের মন ছুঁয়ে যাবে! আরও এমন ধরনের লেখা পথের অপেক্ষায় আমরা সকলে।🙏

    উত্তরমুছুন