ন তুন শিক্ষানীতি আসার পূর্বে তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা ‘সার্বজনীন’ ছিল, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নের প্রয়োজন আছে। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, ‘শিক্ষার অধিকার সবার’, ’শিক্ষা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার’। আদতেই কি তাই? আসল ছবিটা বোধহয় একটু আলাদা। যেমন স্টেশনের পাশে ঝুপড়িতে থাকা বছর দশেকের রাজু যে রোজ সকাল হলে হোটেলে বাসন মাজতে যায়, সে তো শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, সরকারী খাতাকলমে স্কুলছুট। এরকম হাজার হাজার রাজু রোজ যেভাবে গণতন্ত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সে দায় কার? রাষ্ট্রের? সার্বজনীন কোন উৎসবে যেমন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে, তেমনই শিক্ষার আনন্দে কি সবাই সমান ভাগ পাচ্ছে? কখনই পাচ্ছে না। ১৫০ কোটির ভারতবর্ষে তবে শিক্ষা কখনই ‘সার্বজনীন’ নয়।
এরকম ‘আধা-সার্বজনীন’ শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন সংযোজন হল নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি।
জাতীয় শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হল চিরাচরিত, প্রথাগত শিক্ষাকে আধুনিক যুগের
সাথে মানানসই করা, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বৈষম্য দূর করা ও প্রচলিত
শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নতিসাধন। শিক্ষাক্ষেত্রে এরকম উদ্যোগের সাথে আমরা
পরিচিত। ঠিক যেমন রাজা রামমোহন রায় প্রাচ্য শিক্ষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার
মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে শিক্ষা
ব্যাবস্থা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, দুর্নীতিগ্রস্থ। একপ্রকার ক্ষমতালোভী শ্রেণী
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তিনি
শিক্ষার শ্রেনীবিভাগ-প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, এর সীমারেখা মুছে দিলেন বাঙ্গালির
মন থেকে। এরপর শিক্ষার নবজাগরণে যোগ দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি পুঁথিগত
শিক্ষার সাথে মেলবন্ধন ঘটালেন সমাজ-প্রকৃতির। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন
সচেতন নাগরিক হয়ে, বিশ্ব-সংসারের একটি অংশ হয়ে ওঠা এবং সমাজের প্রতি তার
কর্তব্য পালন করা। জাতীয় শিক্ষানীতির মূল নীতিও ঠিক সেই কথা বলছে। সে বলছে যে
কোন তথাকথিত ডিগ্রির পেছনে ছোটার দরকার নেই, বরং শিক্ষা হোক সুন্দর ও
স্বতঃস্ফূর্ত। এই শিক্ষানীতি ‘মাল্টিপল এক্সিট’র কথা বলছে। অর্থাৎ পড়াশোনা করতে
করতে হাঁপিয়ে উঠলে, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নাও, তোমার জন্য সব স্কুল কলেজের
অবারিত দ্বার। এছাড়া পরীক্ষাভিত্তিক পড়াশোনা একদম নয়। পরীক্ষাভিত্তিক
পড়াশোনা একজন শিক্ষার্থীর মুক্তচিন্তায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা কখনই
কাম্য নয়। একজন শিক্ষার্থী তাঁর পছন্দের বিভিন্ন বিষয় পড়তে পারবে। অর্থাৎ
ইতিহাস পড়া ছাত্র সে নিজের উৎসাহে গণিত পড়তে পারবে। শুধু তাই নয়, পড়া শেষে সে
সাম্মানিক পত্রও (ডিগ্রি) পাবে। এই পদ্ধতিতে অনেক ছাত্র উৎসাহ পাবে বিভিন্ন
বিষয় অধ্যয়ন করার। তাতে, সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞান বা অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্বিক
উন্নতি হবে। ইতিহাসের ছাত্র গণিত বা পদার্থবিদ্যা পড়লে, দুই ক্ষেত্রেই তাঁর
জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। অনেকসময় এই দুই বিষয়ের জ্ঞান পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
বিশেষত গবেষণামূলক কাজে, বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হওয়া একান্ত দরকারি এবং তা
গবেষণার মান বৃদ্ধি করে। এছাড়া নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি কলেজে স্নাতক পড়ার
পাশাপাশি বিভিন্ন প্রযুক্তিমূলক কাজ (ইন্টার্নশিপ) ইত্যাদির কথা বলছে। এতে
ছাত্রছাত্রীরা শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, বরং হাতেকলমে সেই শিক্ষার ব্যবহারিক
দিকের সাথেও পরিচিত হতে পারবে। ভারত প্রগতিশীল দেশ। একটি দেশের উন্নতির অন্যতম
হাতিয়ার হচ্ছে, শিল্প প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি। স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে
প্রযুক্তিমূলক কাজ চালু করা বলা বাহুল্য যে শিল্প প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নবজাগরণ
আনবে এছাড়া স্নাতক স্তরের সময়সীমা বাড়িয়ে ৪ বছর করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে
শিক্ষার্থী সার্বিক ভাবে প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যালয় স্তরে, সাইন্স, আর্টস ও
কমার্স, এই তিনতে প্রথাগত পদ্ধতির অবসান ঘটছে। শিক্ষার্থী তাঁর পছন্দ মত বিষয়
পড়তে পারবে, এবং তা নিয়ে সে উচ্চশিক্ষার দিকে অগ্রসর হতে পারবে। সামগ্রিক ভাবে,
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি পুরাতন শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধিত সবরকম
ধ্যানধারণা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
তাহলে কি নতুন শিক্ষানীতি এমন একটি জিয়নকাঠি যা শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন
বৈষম্য দূর করার ক্ষমতা রাখে? প্রত্যেক প্রান্তিক মানুষকে সমান আধিকারী করে
তোলে? এই শিক্ষানীতি কি প্রত্যেক ৬-১৪ বছর বয়সী শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করবে?
কোনও দরিদ্র মেধাবী ছাত্রকে মাধ্যমিকের পর টাকার অভাবে বিজ্ঞান ছাড়তে বাধ্য
করবে না? না! নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এসব কিছুই করবে না। যে আঁধার সে আঁধারই
থাকবে। বরং এই নতুন নিয়মে অনগ্রসর, পিছিয়ে পরা মানুষ আরও পিছিয়ে পরবে। যেমন,
কোন এক পিছিয়ে পরা পরিবারের মেয়ে, যে তাঁর পরিবারে প্রথম কেউ যে কিনা
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তাঁর জন্য ৪ বছরের স্নাতক তো বিলাসিতা! কারণ তাঁর
মূল লক্ষ্য হচ্ছে অন্নসংস্থান, পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। সে অচিরেই পড়াশোনার মূল
স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, বেছে নেবে অন্য কোন পেশা যাতে হয়ত দৈহিক
পরিশ্রম অনেক বেশি। কিন্তু পড়াশোনা করলে হয়ত সে তুলনামূলক সহজ ভাবে রোজগার করতে
পারত। তাছারাও, শিক্ষার উন্নতিকরণের সাথে সমানুপাতিকভাবে বাড়বে শিক্ষার দাম। যে
দেশের ৬০% মানুষের আয় বার্ষিক ২০ হাজার টাকার নিচে, সে দেশে স্বাভাবিকভাবেই
‘দামী’ শিক্ষার খদ্দের হবে হাতেগোনা। রাষ্ট্র যে শিক্ষার দাম ধার্য করবে, তা
হবে আকাশছোয়া। স্কুলে পড়াশোনা করার থেকেও হোটেলে কাজ করা, মজুরি করা ইত্যাদি
সহজসাধ্য বিকল্প বলে মনে হবে। এতে করে, স্কুলছুটের সংখ্যা কমবে না বরং অনেক
অংশেই বাড়বে। পাঠক্রমের বাইরে যে অন্যান্য কাজ করার কথা বলা আছে, ভারতের কয়েকটা
বড় শহর ছাড়া অন্য কোথাও তার কোনও সুযোগ সুবিধা নেই। অর্থাৎ গ্রাম বা
আধা-গ্রামের শিক্ষার্থীরা সরকারী হিসেবে নতুন শিক্ষানীতির সুবিধাভোগী হয়েও
আসলেই বঞ্চিত থেকে যাবে। এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। চাকরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য
তৈরী হবে। চাকরীর উচ্চপদগুলি শহরের সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেনীর দ্বারা অধিকৃত হবে।
বিদ্যালয় স্তরে বিভিন্ন নতুন বিষয় পড়ান চালু করার সুপারিশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু
পারদর্শী শিক্ষক কি মজুত আছে, বিদ্যালয়ের সেই পরিকাঠামো আছে? উপযুক্ত শিক্ষক ও
পরিকাঠামো না থাকায় বন্ধ হয়ে যাবে অনেক বিদ্যালয়। প্রচুর শিক্ষার্থী
কিন্তু উপযুক্ত বিদ্যালয় মাত্র কয়েকটি, শুরু হবে দুর্নীতি। প্রযুক্তির ব্যবহারে
পিছিয়ে পরা ছাত্রছাত্রীরা আরও পিছিয়ে পরবে। শিক্ষার আলো হয়ত দেশের প্রত্যেকটা
অন্ধকার কোনায় আর পৌছতে পারবেনা।
বিশ্ব প্রতি মুহুর্তে এগিয়ে চলেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের
শিক্ষাব্যবস্থা খুব উন্নত নয়। মেধাবী ছাত্ররা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি
দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের মাটিতে লালিত চারাগাছেরা বিদেশের সারে মহীরূহতে পরিণত
হচ্ছে। উন্নত দেশগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এই শিক্ষাব্যবস্থার
সার্বিকভাবে উন্নতিকরণের প্রয়োজন আছে। নতুন যেকোনো আইন বা নীতি কখনই ১০০ শতাংশ
ঠিক বা বেঠিক হতে পারে না। জাতীয় শিক্ষানীতি নামক মুদ্রারও দু-পিঠই রয়েছে। এই
শিক্ষানীতি হয়ত শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে যা আমাদের দেশকে
অন্যান্য প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সমকক্ষ করে তুলবে কিন্ত তা কি প্রকৃত অর্থে
সার্বজনীন হবে? নাকি হোটেলে কাজ করা রাজুরা আজীবন এই পেশাকেই বেছে নেবে? শিক্ষা
কি আদতেও সবার হাতের নাগালের মধ্যে হবে? ভারতবর্ষের প্রত্যেকটা বাচ্চা কি
শিক্ষার অধিকার পাবে- এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। যদি কোন বাচ্চা শিক্ষার
অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়, তার ভবিষ্যতের দায় কার ওপর বর্তায়?
শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব না হলেও প্রচলিত শিক্ষার কিছু কিছু
অংশের সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। এই নতুন শিক্ষানীতি তা সাধন করতে কতটা সফল
হবে তার উত্তর শুধুমাত্র সময়ই দিতে পারবে।
0 মন্তব্যসমূহ