স
রকারী চাকুরে বিনোদবাবু অবসর নেওয়ার পর যা টাকাপয়সা পেলেন, তাই দিয়ে আরও কিছু জমানো পুঁজি খরচ করে কলকাতার এক জমজমাট পাড়ায় ছোট একখানা ফ্ল্যাট কিনলেন। হাতের কাছে দোকান-বাজার ডাক্তার সব রয়েছে, নিশ্চিন্তে থাকা যাবে। একমাত্র ছেলে হায়দেরাবাদে চাকরি পেয়েছে। স্ত্রী রমাকে নিয়ে পুরনো ভাড়াবাড়ি ত্যাগ করে উঠে এলেন নতুন ফ্ল্যাটে। বিনোদবাবুর একটা বরাবরের অভ্যেস, পথের কুকুরদের বিস্কুট খাওয়ানো। লালু কালু ভুলু পাড়ার যত কুকুর ছিল বিনোদবাবুর বরাবরের বিস্কুট প্রাপক, সব্বাইকে আসার আগে প্রাণভরে বিস্কুট খাইয়ে চোখের জল মুছে নতুন পাড়ায় এলেন। আসার দশদিনের মধ্যেই বিনোদবাবুর নাহোক জনা দশেক অনুরাগী মিত্র জুটে গেল। এরা মানুষের মত বসন্তের কোকিল নয়, প্রকৃত মিত্র।
সরস্বতী পুজোর চাঁদা নিতে সেদিন বাড়িতে চড়াও হল জনা পাঁচেক ছেলে। তাদের কারো সঙ্গেই সরস্বতীর দূরদূরান্তের সম্পর্কও নেই। ১০০১ টাকার বিল ধরিয়ে দিল। বিনোদবাবু অবাক হয়ে বললেন, “সরস্বতী পুজোর চাঁদা এত টাকা? কোত্থেকে দেব? আমি রিটায়ার করেছি।”
“প্রগতি সঙ্ঘ-এর পুজো আজকের নয় কাকু”, মস্তান মার্কা একটি ছেলে অম্লান বদনে বলল, “পাড়ার সবাই জানে, সরস্সোতী পুজোটা আমরা গতবছর থেকে বড় করে আরম্ভ করেছি। ডিজে নাইট আছে। নবীন-পাচিন কালচার ফিউসান। কিছু করার নেই, ১০০০ টাকাই রেট।” রমার ইশারায় কথা না বাড়িয়ে বিনোদবাবু টাকাটা দিলেন।
এর চারদিন পরে। বিনোদবাবু গিয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে। সন্ধ্যের মুখে ফিরছেন। দেখলেন সরস্বতী প্রতিমা নিয়ে এসেছে সেই ‘প্রগতি সঙ্ঘ’-এর ছেলেগুলো। বিকট কানফাটানো শব্দে মাইক বাজিয়ে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি সহযোগে উদ্দাম নাচ চলছে। হঠাৎ কী মনে হল, বিনোদবাবু এগিয়ে গিয়ে ছেলেদের পাণ্ডাকে কাঁধ ঝাকুনি দিয়ে থামিয়ে বললেন, “এগুলো তোমাদের কালচার? মায়ের পুজো করবে, ভক্তিমূলক গান বাজানো যায় না?” ছেলেটা লাল চোখে তাকিয়ে বলল, “চোপ সালা বুড়ো ভাম। বেসি জ্ঞান দিতে এলে ধুতি খুলে হাতে ধরিয়ে দেব।” তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করলেন বিনোদবাবু। রমা শুনলে ভীষণ রাগ করবে। নতুন পাড়ায় এসে কেন বেকার ঝামেলায় জড়ানো? মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে এলেন বিনোদবাবু, পিছনে লেজ নাড়তে নাড়তে সঙ্গ দিল পাড়ার তিন-চারটি কুকুর।
এর মাসখানেক পরের কথা। একদিন দুপুরবেলা বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আর লোকজনের দৌড়াদৌড়ির আওয়াজ শুনে বিনোদবাবু ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন। সেই মস্তান ছেলেটা প্রাণ হাতে করে ছুটছে, আর ওর পিছু নিয়েছে চার-পাঁচটা নেড়ি কুকুর। নিশ্চয় ছেলেটা কিছু একটা করেছে, নাহলে পাড়ার কুকুর তো পাড়ার লোকের পিছনে লাগে না! বিনোদবাবু নিচে নেমে এলেন ব্যাপারটা সামাল দিতে। কারণ কুকুরগুলো তার কথা শুনবে। ইতিমধ্যেই কুকুরগুলো টানাটানি করে মস্তানের জামা-প্যান্ট কামড়ে ছিঁড়ে খুলে নিয়েছে। দিন দুপুরে পাড়া ভর্তি লোকের সামনে প্রায় ল্যাংটো হয়ে মস্তান দুই হাতে লজ্জা ঢেকে কাঁদছে। বিনোদবাবুর এক ধমকে কুকুরগুলো চুপ হয়ে গেল। শান্তস্বরে তিনি বললেন, “একটু দাঁড়াও, একটা ধুতি নিয়ে আসি।”
1 মন্তব্যসমূহ
শোধবোধ খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন