
ম
নস্তাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, “নিজের ছায়া মস্ত করে/ অস্তাচলে বসে
বসে/ আঁধার করে তোল যদি/ জীবনখানা নিজের দোষে” সেটি বর্জনীয় সর্বাগ্রে। জন্ম
হতে মৃত্যু পর্যন্ত পলে পলে এগিয়ে চলে মানুষ। এই শারীরিক মৃত্যুটি জন্মের
পরমুহূর্ত হতে শুরু করে যে কোনও বয়সেই সংঘটিত হতে পারে। 'তাই নিয়ে কি সবার
সঙ্গে ঝগড়া করে মরতে হবে!' না। 'যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ' এই সত্যে ভর
করে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ এক সমাজ গড়ে তুলতে হবে যেখানে শৈশব, কৈশোর,
যৌবন আর প্রৌঢ়ত্ব মানবসমাজে কাল নির্ধারিত কয়েকটি পর্যায় মাত্র। এর
কোনওটিই অন্যটির তুলনায় কম গুরুত্বের নয়। কালজয়ী যে অবিস্মরণীয় মন্ত্রটি
ফ্রান্সিস বেকনের লেখনী হতে নিঃসৃত হয়েছিল তার উল্লেখ দ্বারা বার্দ্ধক্য
বিজয়ী মানব ব্যক্তিত্বের উদ্বোধন সম্ভব, অবশ্যই, 'I will never be an old
man. To me,old age is always 15 years older than I am.'
শিশুর তুলনায় যুবা আর তদপেক্ষা প্রৌঢ় ব্যক্তির জীবনদর্শন অনেক বেশি পরিপক্ক।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুলের মাত্রা বহুলাংশে কম আর তথ্য বিকৃতি অর্থাৎ মিথ্যের
সুযোগ নেই বললেও চলে। সৎ পরামর্শের জন্য উচ্চ অথবা একই স্তরভুক্ত প্রৌঢ়কূল তাই
অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য; এটি অস্বীকারের পথ নেই।
জগৎজুড়ে 'বোঝাপড়া'র যে দর্শন কোটি কোটি মানুষ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন যুগে
যুগে,তার অতি সহজ সমাধান ঘটেছে বিশ্বকবির হাতে- “মনেরে আজ কহ যে / ভালমন্দ
যাহাই আসুক/ সত্যেরে লও সহজে।” কালের চক্রব্যুহে নবজাতকের জীবনের সমগ্র
পর্যায়ে এটি একটি মস্ত অবলম্বন, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
জীবনচক্রের চূড়ায় অবস্থিত শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণদের কল্যাণ বিষয়ে সচেতনতা ও
সহমর্মিতা গড়ে তোলবার জন্য পালিত হয় আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস (International
Day of Older persons)। এদিনটিতে নবীন সম্প্রদায় সাধ্যমত সময় কাটায়
দাদু-দিদাদের সঙ্গে, বৃদ্ধাশ্রমেও ভ্রমণ করে; শিশুরা বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়
ও প্রিয়জনদের সঙ্গে শুভেচ্ছাপত্র (Greetings Card )ও বিনিময় করে থাকে।
১৯৯০ সালের ১৪- ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ মহাসভায় আইনের ধারায় ১ লা
অক্টোবর তারিখটি চিহ্নিত হয় 'আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস' হিসেবে। সেই থেকে
দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে প্রতি বছর।
চিকিৎসাবিদ্যার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের আয়ুষ্কালের বৃদ্ধি ঘটছে।
অন্যদিকে, সমগ্র বিশ্বজুড়ে শিশুজন্মের হার হ্রাস পাওয়ায় নবীন অপেক্ষা প্রবীণ
জনসংখ্যার শতকরা ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে অস্বাভাবিকভাবে। সেক্ষেত্রে তাদের
জীবনযাত্রা সাবলীল ও যথাযোগ্য মর্যাদাপূর্ণ করণের প্রয়াস নিতে
কালবিলম্ব না করাটিই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ আমি, আপনি এবং আমরা ঐ পথেই চলেছি।
আজকের নবজাতকের ভবিষ্যত একই অভিমুখে চলমান হবে, নিঃসন্দেহে।স্মরণে রাখা
ভাল,বর্তমানে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষের বয়স ষাটের ঊর্দ্ধে; অর্থাৎ প্রতি দশ
জনের মধ্যে একজন প্রবীণ। আর ২০৫০ সাল নাগাদ এটি দাঁড়াবে প্রতি পাঁচ জনে
একজন।
যাই হোক, প্রথমবার আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসটি পালিত হয় অক্টোবর১, ১৯৯১ সালে।
সহনশীলতা ও বার্ধক্যের অসহায়তার অপব্যবহার ধরনের কয়েকটি বিষয়ে সচেতনতা
বৃদ্ধির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়। সমাজ গড়ার কাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের আত্মদানকে
মর্যাদা জ্ঞাপন করতেও দিনটি স্মরণীয়। যুক্তরাজ্য ও কানাডায় পালিত 'ন্যাশনাল
গ্র্যান্ড প্যারেন্টস ডে' এবং চীনের 'ডাবল নাইন্থ উৎসব' আর জাপানের 'দ্য এজেড
ডে'- এর সঙ্গে সমতুল এই উদযাপন।
অন্যান্য বহু বিষয় ছাড়াও মুখ্য উপজীব্য ছিল প্রৌঢ় সংস্থাগুলি ও বার্ধক্য
সম্পর্কিত জাতিসংঘ গৃহীত প্রকল্পসমূহ।
প্রবীণদের অধিকার বিষয়ক সম্মেলন: প্রবীণদের অধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ গৃহীত প্রস্তাবনাটি অতীতের শিশুর বর্তমান
মানবাধিকার সংক্রান্ত জরুরী প্রস্তাবনাসমূহের অন্যতম। এটির মূল লক্ষ্য,তাঁদের
খণ্ডিত মানবাধিকারকে সুস্থ রূপদান ও ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের সংকটাপন্ন
মানবাধিকারকে পুন রুজ্জীবিত করা।এটির বিশেষত্বগুলি এরূপ:
১) এটি ষাট বছরের অধিক বয়সী জনগণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিশ্বব্যাপী
প্রবীণদের জন তাত্ত্বিক (Demographic) বৃদ্ধিই এর কারণ।
জাতিসংঘ কৃত শিশুদের কনভেনশনটির সাফল্যই এর প্রেরণা। শিশুদের অধিকার সম্বলিত
প্রস্তাবনাটি সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৮৯ সাল থেকে UNCRC (United
Nations Convention on the Rights of the Child) যেখানে তরুণ সম্প্রদায়ের
অধিকার বিষয়ে চিন্তিত সেখানে UNCROP(United Nations Convention on the Rights
of Older Persons) উদ্বিগ্ন সমাজের বর্ষীয়ান সম্প্রদায়ের আইনী অধিকার নিয়ে।
কারণ জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী,তাঁদের ন্যূনতম আইনী অধিকারের বিষয়টি
দিনকে দিন হয়ে উঠেছে অধিকতর ভয়াবহ।
২)CESCR (Committee on Economic, Social and Cultural Rights), হেল্প এজ
ইন্টারন্যাশনাল, এলিমিনেশন অফ ডিসক্রিমি নেশন এগেইনস্ট উইমেন, ইন্টারন্যাশনাল
লেবার অর্গানাইজেশন,বহু এন জি ও এবং রাজ্যগুলি মানবাধিকার সম্মেলনটিকে
সার্বভৌম উপায় বা অনুঘটক বিশেষ জ্ঞানে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
৩) আজকের সমাজে একদা শিশুর বার্ধক্য সংক্রান্ত জনতাত্ত্বিক পরিবর্তনকে
ঘিরে একটি প্রস্তাবনার আবশ্যকতা সৃষ্টি হয়েছে।
৪) বয়সজনিত কারণে বঞ্চনা ও বিভিন্ন বিষয়ে অংশগ্রহণের অধিকার হ্রাসপ্রাপ্তি
কিম্বা অপ্রাপ্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রবীণগোষ্ঠীকে। এধরনের অধিকারগুলি চালু
ও সুরক্ষিত করে প্রবীণদের আদর্শ মানবাধিকারের সুযোগ দানের জন্য সম্মেলনে চলেছিল
টান টান বিতর্ক।
এমনিতে প্রতি দুজন ব্যক্তির মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়ো:জ্যেষ্ঠটি নিগ্রহের শিকার
হয়ে থাকেন। তাই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মানবাধিকার আইন
লঙ্ঘন করে যায়। এটি রাজ্য ও ব্যক্তির ভিতরে মানবাধিকারের মান রক্ষায় অপারগ।
তাই প্রস্তাবিত সম্মেলনটিকে 'প্রবীণদের বৈষম্যবিরোধী (anti discrimination)
সম্মেলন' বলে অভিহিত করবার পরামর্শ প্রাপ্তি ঘটে।
৫) এটি ICCPR (International Covenant on Civil and Political Rights), ICESCR
(Inter national Covenant on Economic, Social and Cultural Rights) ইত্যাদি
সাধারণ মান নির্ণয়কারী বহুমুখী মানবাধিকার সম্মেলনের সঙ্গে সমতুল নয়।
সম্মেলনের ভবিষ্যত: ম্যাড্রিড প্ল্যানটির দশ বছরের পর্যালোচনায় ষষ্ঠ অধিবেশনের চেয়ার পার্সন
অ্যালান কর্ডিনার বিবৃতিতে স্পষ্ট হয় যে ক্রমবর্দ্ধমান প্রতিনিধিত্ব ও
সভ্যসমাজের অবিসংবাদিত সোচ্চার অংশগ্রহণ জনগণের নিকট হতে আগত কিঞ্চিৎ বিস্তৃত
সম্মেলন আহ্বানের অনুরোধ দ্যোতিত করে।
২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক প্রবীণ নাগরিক দিবসের উপজীব্য বিষয়,"পরিবর্তনশীল
বিশ্বে প্রবীণ জনগণের সহনশীলতা"।
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই_ শুধু অন্তরে নয়, বাহিরেও। আজকের শিশুর
ভবিষ্যত সুরক্ষায় ও বর্তমানের বর্ষীয়ানদের যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষার বাসনা
চরিতার্থ করতে হলে সবার প্রথমে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে তাদের সমস্যা গুলিকে।
সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে হাতে হাত আর কাধে কাধ রেখে পদব্রজেই পৌঁছাতে হবে
সমাধানের কিনারায়।
সমস্যাগুলি প্রধানতঃ ছয় প্রকারের- শারীরিক সমস্যাবলী, মানসিক সমস্যাবলী, আবেগ সংক্রান্ত সমস্যাবলী, সামাজিক সমস্যাবলী, অর্থনৈতিক সমস্যাবলী এবং বিশেষ ধরনের সমস্যাসমূহ।
শারীরিক সমস্যাবলী: প্রৌঢ়ত্ব হল শারীরিক ক্ষয়ের পর্যায়। চক্ষু, দন্ত থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গে
কমজোরী হয়ে পড়ে মানুষ।শারীরিক সমস্যার প্রকৃতি নির্ভর করে মূলতঃ তিনটি
বিষয়ের উপর- প্রথমতঃ বংশগত বুনিয়াদ, দ্বিতীয়তঃ জীবনযাত্রার ধরন ও তৃতীয়তঃ
পরিবেশগত বা পারিপার্শ্বিক প্রভাবক।শারীরিক ক্ষয়ের বেশ কিছু কারণের মধ্যে
রয়েছে অনিয়মিত জীবন,অসম্পূর্ণ খাদ্যগ্রহণ, ভুল খাদ্য নির্বাচন, অপুষ্টি,
সংক্রমণ, নেশাসক্তি, অতিরিক্ত ভোজনে বদহজম, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, মানসিক চাপ,
অধিক পরিশ্রম, হরমোনের তারতম্য, গরম ও ঠান্ডা পরিবেশগত অবস্থা ইত্যাদি।
দাঁত পড়ে যাওয়ার কারণে চোয়ালের আয়তনের হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটে; চিবুকটি ক্রমশঃ
কুচকানো পেন্ডুলামের আকৃতি ধারণ করে; চোখের পলক থলির আকার নিতে থাকে এবং নীচের
পলকের উপর উপরেরটি ঝুলে পড়ে,প্রায়।চোখদুটি নিস্তেজ ও দীপ্তিহীন লাগে।
অশ্রুগ্রন্থির দুর্বলতার কারণে দৃষ্টি প্রায়শঃ-ই জলপূর্ণ লাগে। বাচনের উপর
প্রভাব ফেলে দাঁতের গঠনগত দৌর্বল্য এবং কিছুক্ষেত্রে তোতলামির আবির্ভাব ঘটে।ঘাম
কম হয়; তবে ত্বক প্রচুর ছোপ দ্বারা রঞ্জিত হয; চুল ধূসর ও পাতলা হয়। নখ হয়
পুরু ও শক্ত। হাত, কব্জি,মাথা ও নীচের চোয়াল হয় চোখে পড়বার মত। হাড়গুলি হয়
শক্ত অথচ ভঙ্গুর; তাই সহজেই ভাঙনের ন্যায় ঘটনাগুলি ঘটে।
স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তনের একটি লক্ষ্যণীয় প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কের উপরে।
প্লীহা, যকৃত এবং নরম অঙ্গগুলির ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটে। দৈহিক ওজনের অনুপাতে
হৃৎপিণ্ডের ওজন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। কোলেস্টেরল ও ক্যালসিয়াম জমে জমে
ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে কোমলতা ও নমনীয়তা।
এহেন সমস্যাসমূহের ফলস্বরূপ বয়স্করা প্রায়শয়ই হৃৎপিণ্ড বিষয়ক ও অন্যান্য
ছোটখাট রোগে ভুগতে থাকেন।
দুর্বলতার কারণে নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও দৈহিক তাপমাত্রাও প্রভাবিত হয়। তাই
জলবায়ুর সামান্যতম পরিবর্তন প্রবীণরা খুব বেশি অনুভব করেন। পরিপাকজনিত সমস্যা
ও অনিদ্রায় কষ্ট পান তাঁরা। আর দাঁতের সমস্যায় ভালোভাবে চিবাতে কিম্বা
গলাধঃকরণ করতেও পারেন না।
জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৈকল্যে বিপদের অনুভব অতি ধীরে হওয়ার কারণে দুর্ঘটনাপ্রবণ
হয়ে পড়েন এবং ঐ একই কারণে মানসিক সামর্থ্য কম হওয়ায় কর্মক্ষমতাও হ্রাস
পায়। আর চক্ষু ও কর্ণদ্বয় প্রভাবিত হয় ব্যাপক ভাবে।
দৃষ্টিশক্তি হ্রাসে কাছের জিনিসটি একদমই প্রায় দেখতে পান না।
প্রৌঢ়ত্বের বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে হ্রাস পেতে থাকে তারুণ্যের শারীরিক
স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি। ৪৫-৫০ বয়স নাগাদ স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে শুরু হয়
নার্ভের বৈকল্য; তৎসহ মাথা ঘোরা, মানসিক অস্থিরতা, উগ্র মেজাজ এবং অনিদ্রা হয়
নিত্য সঙ্গী।স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সহজেই হয়ে পড়েন ক্লান্ত। প্রেরণার অভাবে
নতুন দক্ষতা অর্জনের বিষয়ে তারা আগ্রহী হন না, বরং নিরুদ্যম বা নিশ্চেষ্ট হয়ে
পড়েন।সর্বোপরি চিকিৎসকের নিকট যাতায়াত টি একটি গত-বাঁধা নিয়মমাফিক কাজের
মধ্যে পড়ে যায়।
মানসিক সমস্যাবলী: ৮০ শতাংশ প্রবীণ স্মৃতিশক্তির দৌর্বল্য, পরিবর্তনে
অসহনীয়তা,স্থান-কাল-পাত্রে সংশয়, বিশ্রাম হ্রাস,অনিদ্রা, বিচার-বিবেচনার
হ্রাস, দৃষ্টি-ভ্রম, সীমাহীন হতাশা, রাগ দ্বারা পরিশ্রান্ত ও প্রতিরোধপ্রবণ
হয়ে চুড়ান্ত পর্যায়ে শয্যাশায়ী হন।রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়
গুনতে হয় জীবনের অন্তিম দিন সংখ্যা।
কিছুক্ষেত্রে সংযুক্ত হয় কতিপয় শারীরবৃত্তীয় গোলযোগ যেমন তীব্র বদহজম,মাথা
ঘুরে অপ্রকৃতিস্থ হওয়া, ছোটখাটো স্ট্রোক, স্মৃতি বৈকল্য, খিটখিটে
স্বভাব, সন্দিগ্ধচিত্ততা ইত্যাদি।
আবেগের সমস্যা: মানসিক সামর্থ্যের বৈকল্য ধীরে ধীরে পরাধীন বানায় তাকে।নিজ সামর্থ্য ও
বিচার-বিবেচনার উপর ভরসা হারিয়েও কনিষ্ঠদের উপর নিয়ন্ত্রণের রাশটি ধরতে চান
শক্তভাবে। সমস্ত প্রকার পারিবারিক ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে জড়িয়ে
থাকতে চান আগের মতোই।
প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে
থাকেন নবীনরা। এটি প্রাচীনদের মধ্যে সৃষ্টি করতে থাকে সম্মান ও গুরুত্ব হরণের
অনুভূতি।
সঙ্গী হারাবার ঘটনাটি বার্দ্ধক্যে আরেক সমস্যা।সঙ্গীর মৃত্যুতে একাকীত্ব ও
বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
সামাজিক সমস্যাবলী: কর্মহীনতা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের মৃত্যু আর শারীরিক কারণে সামাজিক
কর্মকাণ্ডেযোগ দিতে না পারায় সামাজিক জীবনযাত্রাটি হয় সংক্ষিপ্ত ও অধোগামী।
সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় গৃহ।একদা অংশগৃহীত সামাজিক
ক্রিয়াকলাপ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে, হয়ে পড়েন একাকী ও বিচ্ছিন্ন। ছোট,বড়
রোগের আক্রমণে হতে হয় জনসঙ্গবর্জিত।ফলশ্রুতি সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও
হতাশা।
অর্থনৈতিক সমস্যাবলী: হতাশা,নিঃসঙ্গতা, রোগ, অনুতাপ আর একাকীত্বের কালবেলায় সংযুক্ত হয় কর্ম এবং
সম্পত্তি নাশের ন্যায় অবশ্যম্ভাবী ঘটনাগুলি।চাকুরী হতে অবসরের কারণে আয় কমে, ক্রম বর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়
সংকুলানের জন্য প্রাপ্ত ভাতাটুকু যথেষ্ট নয়।যৎসামান্য আয়ে তারা পরিবারের
মূল রুজি-রোজগারের কান্ডারী হতে পর্যবসিত হন সাধারণ পরনির্ভরশীল সদস্যে।
অদৃষ্টের পরিহাসে যদিও প্রভিডেন্ট ফান্ডের সমস্ত টাকাগুলি সারাজীবন ধরে
সম্পত্তি সৃষ্টিতে, ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করতে ও পরিবারের যাবতীয় খরচের
যোগান দিতে ব্যয় করে ফেলেছেন! নিজেদের রোগের সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা বা নিরাময়
সৃষ্টি করে আরও বেশি অর্থনৈতিক সমস্যা।
শিশুর যত্ন ও পারিবারিক ব্যবসায়ে অতিরিক্ত আদর অভিজ্ঞতার খনি এই অভিভাবকেরা।
নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রবীণদের উচিত নিজের ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও তার
সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক শুভভাব ত্বরান্বিত করার কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত
হওয়া।
বিশেষ ধরনের সমস্যাসমূহ:
- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বাহ্যিক কম্পনের প্রতি মানুষের হাসি ও উপেক্ষার ন্যায় বিকৃত আচরণ অসভ্যতার নামান্তর, বলা যায়।
- অতি সামান্য উচ্চতা সম্পন্ন প্রৌঢ়দের প্রতি আজীবন লালিত ঠাট্টা আরেকটি বিশেষ ধরনের সমস্যা।
- বহুবিধ অসামঞ্জস্যতার জন্য প্রবীণপ্রবরকে তামাশার বস্তুতে পরিণত করার অশোভন প্রয়াসও নিন্দনীয়।
এ সমস্ত ঘুটে পোড়ে,গোবর হাসে জাতীয় কতিপয় বিশেষ ধরনের সমস্যা নিয়ে ভাবনার
সময় এসেছে সভ্য সমাজের তরফে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে আমাদের শরীর পরিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং
সেই সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষাকেও। বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে
ব্যক্তিকেন্দ্রিক উচ্চমানেরআবশ্যকীয় বিশেষত্বই বার্দ্ধক্যবিদ্যা
(Geriatrics)। প্রবীণদের চিকিৎসা সম্বন্ধীয় যত্নের বিষয়টিই মূলতঃ এর আওতায়
পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এলাকা, বয়স, জীবনযাত্রা ও আবশ্যিকতার
বিচারে থাকা যেতেই পারে নিজেদের পাশে নিজেরাই!
সন্তান ভিন দেশ অথবা রাজ্যে! বিপদে আপদে পাশে থাকতে থানায় চালু হয়েছে
'প্রণাম' ডেস্ক। ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, বাড়ির গৃহকর্মীর নাম নথিভুক্ত করণ থেকে
রাতবিরেতে হঠাৎ প্রয়োজনীয় পুলিশি সহায়তার সুযোগ এটি। বিগত এক দশকে কলকাতা
শহরে প্রনামের সদস্য সংখ্যা ১৯ হাজার ছুঁই ছুঁই। অন্য বছরের ন্যায় আশা
করি,এবছরেও প্রণামের উদ্যোগে বর্ষীয়ান নাগরিকদের বরাতে জুটবে দুর্গাপুজোর
আনন্দ ভ্রমণ! এই অভিনব ও মহান প্রকল্পটির কথা মাথায় রেখেই নিবন্ধের নামকরণ
'প্রণাম'।
নতুন করে ২০২৩ -এর ১৫ ই আগস্ট তারিখে স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকাকে সাক্ষী
রেখে দেশমাতৃকার সন্তানদের শুভার্থে শপথ গ্রহণ করি! স্থান-কাল-পাত্র
নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরে শিশুদের সমান গুরুত্বে বরিষ্ঠদের প্রতি সচেতন ও
কর্তব্যপরায়ণ হতে আহ্বান জানাই মানব সমাজকে। শুধুমাত্র হাত ধরে রাস্তা পারাপার
করা কিম্বা বাসে ওঠা-নামায সাহায্য করাই নয়,পরিবারে অথবা সমাজের যে কোনও
স্তরে তাদেরকে তাদের মনের মত সুপরিচ্ছন্ন থাকতে সহযোগিতা করা
উচিৎ।তাদের রুচি ও পছন্দ অনুসারে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের
প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা উচিত প্রয়োজনে সাধ্যের বাইরে গিয়েও;
কারণ আমি আর আপনি সেটি পেয়েছিলাম শৈশবে পিতা-মাতার নিকট হতেই। আজ যারা
সুস্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা পছন্দ করেন, এক সময়ে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক,
সামাজিক ইত্যাদি নানান প্রতি বন্ধকতার দরুণ সেটি অটুটভাবে বজায় রাখা তাদের
নিকট হয়ে দাঁড়ায় সাধ্যাতীত, দুঃস্বপ্নের ন্যায়! কিন্তু তাদের মধ্যে নিজের
প্রতীতি চিনে নিতে পাঠক সমাজের কারও ভুল না হয়, বিন্দুমাত্রও। পরিশেষে,
Aldous Huxley র ভাষায় কানে কানে বলি,"The secret of genius is to carry the
spirit of the child into old age,which means never losing your
enthusiasm."
0 মন্তব্যসমূহ