ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বাগী -দেবাংশু সরকার


দে
শ স্বাধীন হবো হবো করছে। পৃথিবী জুড়ে তখনো বাতাসে বারুদের পন্ধ। প্রায় আট কোটি মানুষের রক্তপান করে শান্ত হতে চলেছে সর্বনাশা যুদ্ধ। ইতিমধ্যে সে মানব সভ্যতার ওপর, মানবতার ওপর হেনেছে নৃশংসতম, বিধ্বংসীতম পারমাণবিক বোমা। তার পরেও মানুষ আবার স্বপ্ন দেখছে নিজের জগতকে নতুন করে গড়ে তোলার! কামানের গোলার শব্দের বদলে মানুষ শুনতে চাইছে পাখির গান। আগুনের লেলিহান শিখার বদলে মানুষ দেখতে চাইছে বাগিচা জুড়ে ফুটে থাকা চেরি ফুলের সমাহার। সৈনিকের কঠিন কঠোর অবয়বের বদলে দেখতে চাইছে নিষ্পাপ শিশুর সরল হাসি। শান্তি কিনতে মানব জাতিকে অনেক বেশি দাম দিতে হয়েছে। আর শান্তিকে হারাতে চায় না সে। মৃত্যু মিছিল দেখতে চায় না। পৃথিবী জুড়ে মানুষ ভুলতে চাইছে  গোলা, বন্দুক, কামান, বিমানকে। ভারি মিলিটারি বুটের শব্দকে।


     সমগ্র পৃথিবীর মানুষ যেখানে শান্তি খুঁজছে, হন্যে হয়ে শান্তি খুঁজছে, সেখানে উত্তর মধ্য ভারতের চম্বল নদীর তীরে কিছু মানুষ যেন স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটছে! বন্দুককে আপন করে নিতে চাইছে! হানাহানি, রক্তপাতকে আপন করে নিতে চাইছে। বন্দুকের গর্জনে কত নিরীহ মানুষ হয়ে যাচ্ছে বাগী। আবার বাগীদের বন্দুকের গুলিতে কত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।


      ডাকু বল্লা! বেহড়ের ত্রাশ বল্লা! বল্লার বন্দুকের ইশারায় বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায়। বাগীদের মাথা বল্লা। গরিবের মসিহা বল্লা। এদিক ওদিক থেকে লুঠ করে আনা টাকাকড়ি, ধনসম্পত্তির অনেকটাই সবার অলক্ষ্যে চলে যায় গরিবদের ঘরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাহারদের ঘরে, হরিজনদের ঘরে।


      কাঁটা ঝোপে ঘেরা রুক্ষ এক নিচু টিলাতে বসে আছে বল্লা। কোলের ওপর রাখা আছে গুলি ভরা বন্দুকটা। হালকা হাওয়ায় লম্বা চুলগুলো উড়ে এসে তার মুখের ওপরে পড়ছে। অবাধ্য চুলগুলোকে হাত দিয়ে সরাচ্ছে বারে বারে। বহু দিনের না কাটা দাড়ি তার চিবুক ছাড়িয়ে গলায় কাছে নেমে এসেছে। জোব্বার মত কালো রঙের একটা পোশাক সে পরে আছে। রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য কালো রঙের পোশাক বাগীদের খুব পছন্দ। বেশ কিছুদুরে টিলার পাদদেশে কয়েকটা বেঁধে রাখা ঘোড়া আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। সবকটা ঘোড়ার গায়ে সাদা ধুসর ছাপ। কেবল কালু আলাদা। সম্পূর্ণ কালো কুচকুচে কালু বল্লার খুব প্রিয় ঘোড়া। ঝড়ের গতিতে ছুটতে পারে কালু। কোনো কিছুতে সে ভয় পায় না। কালু ছাড়া বল্লা অচল। যেখানেই যাক সে কালুর পিঠে চেপে যায়। এখন অবশ্য সে কালুকে নিয়ে ভাবছে না। সে একমনে তাকিয়ে আছে তার কোলে রাখা বন্দুকের দিকে। আর ভাবছে মানব জীবনে এই যন্ত্রটার কি খুব দরকার? মানুষ কি কখনো বন্দুক, গুলি, বারুদ, হিংসা, খুন জখমকে বাদ দিয়ে নিজেকে ভাবতে পারবে না? নিজের জীবন গড়তে পারবে না? জোব্বার পকেটে হাত ঢোকায় বল্লা। পকেট ভর্তি গুলি। বল্লা ভাবে একটা গুলি মানে একটা মৃত্যু! একটা জীবনের সমাপ্তি! একটা প্রাণের দুচোখ ভরে পৃথিবী দেখার আকাঙ্ক্ষা শেষ!


      ভাবতে ভাবতে বল্লার চিন্তায় ছেদ পড়ে। সে দেখে ঘোড়াকে বেঁধে রেখে হীরা সিং টিলার উপরে তার কাছে আসছে। হীরা কেবল তার সাগরেদ নয়। সে বল্লার ভালো বন্ধু এবং পরামর্শ দাতা।


      হীরাকে দেখে বল্লা প্রশ্ন করে, "হীরা তোর হাতে ওটা কিরে?" 


      হীরা জানে বল্লা মাঝে মাঝে এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন করে। কিন্তু তার অন্য মানে থাকে। সে উত্তর দেয়, "এটা আমার আত্মরক্ষার যন্ত্র সর্দার।"


      - " ওটা দিয়ে তুই কোনো দিন কাউকে খতম করেছিস?"


      - "করেছি সর্দার।"


      - "কেন করেছিস? একটা জীবন দেওয়ার ক্ষমতা তোর নেই। তাহলে একটা জীবন নেওয়ার অধিকার তোকে কে দিলো?"


      - "আমি যদি তাকে খতম না করতাম, সে আমাকে খতম করতো সর্দার। নিজেকে বাঁচানোর জন্য দুশমনকেতো মারতে হবে। এটাই দস্তুর সর্দার।"


     - "এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য হীরা, ইচ্ছা না থাকলেও হাতে বন্দুক তুলে নিতে হয়! মন না চাইলেও রক্ত ঝরাতে হয়। মনে কর তোর হাতে বন্দুক নেই। তোর দুশমনদের হাতেও বন্দুক নেই এই দুনিয়াতে কোথাও কোনো বন্দুক নেই। তোরা দুজনে দুশমনি ভুলে হোলি খেলছিস! কেমন হবে ব্যাপারটা?"


      - "সর্দার তুমি ছোটো থেকে অনেক কেতাব পড়েছো। তাই এইসব উল্টো পাল্টা চিন্তা তোমার মাথায় আসছে।"


     - "কিতাব! কিতাবে কি লেখা আছে জানিস? আমরা যাকে দুশমন ভাবি, তারা আসলে আমাদের রিস্তেদার, আমাদের বেরাদার, আমাদের ভাই। আমরা যুগ যুগ ধরে নিজেদের মধ্যে লড়াই করছি। ভাইয়ে ভাইয়ের লড়াই করছি। নিজের দেশের লোকের সঙ্গে লড়াই করছি। সেই সুযোগে বিদেশীরা, আসল দুশমনরা যুগ যুগ ধরে আমাদের লুঠ করে যাচ্ছে। ভেবে দেখ কতটা বেকুফ আমরা।"


      - "ওসব কিতাবের কথা সর্দার। হকিকৎতো অন্যরকম। আমার বাবা, কাকা ঘাম ঝরিয়ে ক্ষেতে ফসল ফলাতো। যখন ফসল পাকতো ঠাকুর সাহেবের লেঠেলরা ক্ষেত উজাড় করে সব ফসল কেটে নিয়ে যেতো। বাঁধা দিতে গেলে লেঠেলদের লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটতো। আমার বাবা, কাকা সব লেঠেলদের হাতে মরলো! সেইজন্য রাগের মাথায়  আমি ঠাকুর সাহেবের বড় ছেলেকে খুণ করলাম। তারপর দেড়শো মাইল দূরে এখানে, এই বেহড়ে পালিয়ে এলাম।"


      - "সেই জন্যইতো আমি ঠাকুরদের লুঠ করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিই। একদিন দেখবি আমি বড়লোকদের থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে গরিবদের বিলিয়ে দেবো। কেউ বড়লোক থাকবে না, কেউ গরিব থাকবে না।"


    - " সর্দার, যখন আমরা গরিবদের হাতে টাকা তুলে দিই, তখন ওদের চোখ মুখগুলো আনন্দে ভরে ওঠে। তুমি দেখেছো সর্দার? তুমি দেখেছো?"


      - "দেখেছিরে হীরা দেখেছি। ওদের মুখে হাসি দেখার জন্য আমি লুঠ করি। ডাকাতি করি। কাল রাতে ঠাকুর রতন সিংয়ের বাড়ি লুঠতে যাবো।"


    ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে একদল অশ্বারোহী দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে রাজ মহলের দিকে। আজ অবশ্য ঠাকুর রতন সিংয়ের লেঠেল বাহিনী পুরো তৈরি আছে। তাদের হাতে আজ লাঠি নেই। তার বদলে আছে বন্দুক। তাদের সঙ্গে আছেন স্থানীয় থানার দারোগা। সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তারাও তৈরি। ঘোড়া ছুটিয়ে রাজ মহলের কাছাকাছি চলে এসেছে বাগী বল্লা সিংয়ের দল। দারোগা সাহেব সবাইকে তৈরি হতে বলছেন। তখনো তিনি গুলি চালানের নির্দেশ দেননি। তিনি চাইছেন বাগীর দল আরো কাছে আসুক। এতবড় একটা বাগী দলকে আজ তিনি একেবারে খতম করতে চাইছেন। এরকম সুযোগ রোজ রোজ পাওয়া যায় না! 


      বেশ কাছে এসে গেছে অশ্বারোহী দল। গুলি ছোঁড়া শুরু হয়েছে। সামনে থেকে গুলি ছুটে আসছে। মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে ঘোড়ার দল। এবার দুপাশ থেকে শুরু হলো গুলি বর্ষণ। ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে গেছে বল্লার দল। একের পর এক বাগী গুলি খেয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যাচ্ছে। বল্লার পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাচ্ছে হীরা। বল্লা চিৎকার করে হীরাকে বলছে, "ঘোড়া ঘোরা হীরা। গলির মধ্যে ঢুকে আয়। আজ ওরা আমাদের দলকে শেষ করে দিলো। তবে শেষ কামড় দিয়ে আমি ফিরবো।"


      - "সর্দার, মনে হচ্ছে কেউ গদ্দারী করেছে!"


      - "ওসব কথা পরে ভাববো। এখন এদিকে আয়।"


      পাশের গলিতে ঢুকে যায় বল্লা, হীরা। নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। হাতের বন্দুকের নিশানা রাজ মহলের ছাদের দিকে। বল্লা আগেই দেখে নিয়েছে রতন সিং ছাদ থেকে লেঠেলদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বন্দুক উঁচিয়ে বল্লা অপেক্ষা করছে শিকারি বাঘের মত। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রাজ মহলের ছাদে আবছা অবয়ব দেখা গেলো রতন সিংয়ের। গর্জে উঠলো বল্লার বন্দুক। বল্লা বুঝতে পারলো কাজ হয়ে গেছে। হীরাকে বললো, "ভাগ হীরা ভাগ। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।" কথা শেষ করেই ঝড়ের গতিতে কালুকে ছোটালো বল্লা। পাহাড়, পর্বত, টিলা, জঙ্গল ছাড়িয়ে কালু বল্লাকে নিয়ে চলে গেলো অনেক দুরে। নিরাপদ জায়গাতে।


      রাজ মহলের ছাদে ঘটে গেছে চরম দুর্ঘটনা ।মাথায় গুলি লেগে তৎক্ষণাৎ মারা গেছেন ঠাকুর রতন সিং। রতন সিংয়ের ছেলে চেতন চিৎকার করে বলছে, "দারোগা সাহেব বাগী বল্লা আমার বাবাকে মেরে দিয়েছে। বল্লাকে ধরুন। আমার বল্লাকে চাই, জীবিত অথবা মৃত। আমার পোষা চিতা বাঘকে বল্লার মাংস খাওয়াবো।"


      আচমকা ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় সবাই হকচকিয়ে গেছে। একটু যেন থমকে গেছে। সম্বিত পেয়ে বল্লাকে ধরার জন্য সবাই ছুটতে লাগলো। ছুটছে লেঠেল বাহিনী। ছুটছে পুলিশ বাহিনী। আচমকাই দারোগার মুখোমুখি হয়ে যায় হীরা। হীরা বন্দুক তোলার আগেই গর্জন করে ওঠে দারোগার রিভলভার। অনেক খুঁজেও বল্লাকে না পেয়ে হীরার মৃতদেহ নিয়ে ফিরে আসে লেঠেল বাহিনী, পুলিশ বাহিনী। কিন্তু ঠাকুর চেতন সিং হীরার মৃতদেহ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তার চাই বল্লা। জীবিত অথবা মৃত।


      সারারাত ঘোড়া ছুটিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বল্লা। একটা গাছের তলায় বসে সে বিশ্রাম নেয়। কোথায় এসে পড়েছে সে, কি নাম জায়গাটার কিছুই তার জানা নেই! তবে বেহড়ের থেকে যে বহু দুরে চলে এসেছে সেটা বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর উঠে দাঁড়ালো সে। কালুর কাছে গেলো। তার গলায় হাত বোলালো। তারপর তার বাঁধন খুলে দিলো। বেলাগাম করে দিলো তাকে। মুক্তি দিলো কালুকে। বললো, "যা কালু যা। আজ আমি তোকে মুক্তি দিলাম। এখন আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকলে হয়তো দুজনেরই বিপদ হবে।" কালো জোব্বাটাও খুলে ফেলে দিলো। ছোটো করে চুল কাটলো, গোঁফ দাড়ি কামিয়ে ফেললো, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। সঙ্গে সামান্য কিছু টাকা পয়সা ছিলো। সেই দিয়ে কয়েক দিন চালালো। এদিকে ওদিকে উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। এটুকু বুঝতে পেরেছে সে রাজস্থানের কোনো এক জায়গায় এসে পড়েছে। ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে হাতের টাকা পয়সা। এবার সে কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না! ক্লান্ত অবসন্ন বল্লা একটা মাঠের ধারে গাছতলায় শুয়ে পড়ে।


      পরের দিন সকালে হাজারো মানুষের কোলাহলে ঘুম ভাঙে তার। অবাক হয়ে দেখে সাত সকালে কাতারে কাতারে মানুষ জড় হয়েছে মাঠে। প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় বল্লা। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ভিড়ের দিকে। বুঝতে পারে কুস্তির আখড়া বসেছে। ভিন গাঁও থেকে অনেক পালোয়ান এসেছে। তারা কুস্তি লড়বে। যে জিতবে সে নগদ দশ টাকা পুরস্কার পাবে। পুরস্কার দেবেন ফৌজি অফিসার হ্যামিল্টন সাহেব।


      শুরু হলো প্রতিযোগিতা। বিশালদেহী পালোয়ানরা আখড়ায় নামছে। চলছে দাঁও প্যাঁচ। সবাইকে হারিয়ে দিয়ে পালোয়ান কুন্দন সিং উরু চাপড়ে হাঁকডাক করছে, "অউর কৈ হ্যায়। অউর কৈ হ্যায়।"


      ভিড়ের মধ্যে থেকে উত্তর আসে, "হ্যায়, বলদেও সিং হ্যায়।" শুরু হয় কুন্দনের সঙ্গে বলদেওয়ের কুস্তি। অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করতে করতে কিছুটা ক্লান্ত ছিল কুন্দন। বয়সে তরুণ বলদেওয়ের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলো না সে। 


      পুরস্কার দেওয়ার সময় হ্যামিল্টন সাহেব বলদেওকে বললেন, "হোয়াট এ স্ট্রং ম্যান ইউ আর! হোয়াই আর ইউ নট জয়েনিং আর্মি?"


       হ্যামিল্টনের পরামর্শে সে ভর্তি হয় ফৌজিতে। ঠিকানা হয় কুমায়ুণ রেজিমেন্টের ফোর্থ ব্যাটেলিয়ন। কুমায়ুণ রেজিমেন্ট ভর্তির পর বলদেওর সাক্ষাত হয় অসম সাহসী বীর সেনানী মেজর সোমনাথ শর্মার সাথে। খেলা পাগল সোমনাথ খুব ভালোবাসতেন হকি খেলতে। সোমনাথের বাবাও একজন মিলিটারি অফিসার ছিলেন। রয়েল মিলিটারি কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে সোমনাথ ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীর উনিশ ব্যাটেলিয়নে যোগ দেন। বিশ্বযুদ্ধের আরাকান ক্যাম্পেনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুমায়ুণ রেজিমেন্টের চার ব্যাটেলিয়নের ডেলটা কোম্পানির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।


      অবশেষে স্বাধীন হলো দেশ। ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে লাল কেল্লায় উড়তে লাগলো তেরঙ্গা। বেজে উঠলো জাতীয় সঙ্গীত। দেশভাগের জ্বালাকে গায়ে মেখে আরো কিছু জটিলতাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পেলো স্বাধীনতা। প্রায় পাঁচশো দেশীয় রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ এবং কাশ্মীর রাজি ছিল না কোনো দেশের অন্তর্ভুক্ত হতে। কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং স্বাধীনভাবে থাকতে চাইছিলেন। কোনো পক্ষে যোগ দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হচ্ছিলো। এক বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। পাকিস্তানের মদতে কিছু অনুপ্রবেশকারী হামলা শুরু করলো। লুঠপাট, খুনজখম, অকথ্য অত্যাচারে অস্থির করে তুললো কাশ্মীরবাসীদের। ক্রমশ শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো অনুপ্রবেশকারীদের দল। মহারাজা হরি সিংয়ের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে সেই আশঙ্কায় তিনি সাহায্য চাইলেন ভারতের কাছে। এবং ভারতের অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে সাক্ষর করলেন। পরের দিন ভারতীয় সেনা নামলো শ্রীনগরে।


      পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই ছিলো। সতর্ক পাহারা ছিলো শ্রীনগর হাইওয়ের ওপর। কিন্তু বিশেষ সূত্রে খবর এলো হাইওয়ে দিয়ে না এসে গুলমার্গ দিয়ে  বডগামে প্রায় হাজার খানেক সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী আত্মগোপন করে আছে। ওয়ান হান্ড্রেড ওয়ান ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এল পি বগি সেন একটা বড় পেট্রোলিং ইউনিটকে বডগামে পাঠালেন। বেশ বড় পেট্রোলিং ইউনিট। যার নেতৃত্বে রয়েছেন কুমায়ুণ রেজিমেন্টের ডেলটা কোম্পানির মেজর সোমনাথ শর্মা। রয়েছে কুমায়ুণ রেজিমেন্টের ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানি এবং ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের দুই কোম্পানি। বডগামে পৌঁছে পরিকল্পনা মত ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের  কোম্পানি রওনা দিলো মোগামের দিকে। উদ্দেশ্য শত্রুদের ওপর নজর রাখা এবং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফার্স্ট ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরে যাওয়া। বডগামের পরিস্থিতি খুব শান্ত ছিলো। কোথাও কোনো অস্থিরতা চোখে পড়ছিল না। হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠালেন  মেজর সোমনাথ শর্মা। নির্দেশ এল ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানিকে ফেরত পাঠানোর। হাতে থাকা দুকোম্পানির মধ্যে এক কোম্পানিকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি অনুমান করতে তিনি কি ভুল করলেন? মাত্র এক কোম্পানি নিয়ে মেজর ঘাঁটি গাড়লেন একটা উঁচু টিলার উপরে। পরিস্থিতি শান্ত। কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। দুপুর দুটো নাগাদ আচমকাই গ্রামের দিক থেকে গুলি আসতে লাগলো। মেজর শর্মা বুঝলেন গ্রামের মানুষের মধ্যে মিশে আছে অনুপ্রবেশকারীরা। পজিশন নিলেন মেজর শর্মা। ভারি মাত্রায় গুলিবর্ষণ শুরু হলো। সামান্য এক কোম্পানি সেনা নিয়ে লড়ছিলেন মেজর। অনুপ্রবেশকারীদের একটা অংশ চেষ্টা চালাচ্ছিলো গোলাগুলি চালিয়ে ভারতীয় সেনাদের ব্যস্ত রাখতে। যাতে তাদের দলের অন্যরা বিনা বাধায় এয়ার পোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। বডগাম থেকে শ্রীনগর এয়ার পোর্ট  দখল নেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তারা এয়ারপোর্ট দখল করতে পারলে আর ভারতীয় সেনা শ্রীনগরে নামতে পারবে না। প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছিলো ডেলটা কোম্পানির ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানি সেনা। প্রায় অসম যুদ্ধ চলছিলো। মেজর শর্মা হিসেব করে দেখলেন প্রায় সাত জনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে একেক জন ভারতীয় সেনা। মুহুর্মুহু শহীদ হচ্ছেন সেনারা। শক্তিক্ষয় হচ্ছে ডেলটা কোম্পানির। মেজর শর্মা হেড কোয়ার্টারে সাহায্য পাঠানোর বার্তা পাঠালেন। কিন্তু উত্তর এলো ফিরে আসার জন্য। কিন্তু মেজর শর্মা লড়াই ছাড়তে রাজি ছিলেন না। তুচ্ছ প্রাণ বাঁচাতে দেশ মাতৃকাকে বিদেশী শত্রুর হাতে তুলে দিয়ে ফিরে আসতে রাজি ছিলেন না অসম সাহসী মেজর। ঠিক করলেন শেষ নিঃশ্বাস, শেষ বুলেট অবধি তিনি লড়াই চালাবেন। 


      আবার হেড কোয়ার্টারে মেজর শর্মার বেতার বার্তা এলো, "শত্রু আমাদের থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দুরে। আমরা প্রস্তুত এবং শত্রুকে পরাজিত করার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। এক ইঞ্চি পিছিয়ে যাবো না। শেষ নিঃশ্বাস এবং শেষ বুলেট পর্যন্ত লড়াই করবো।"


    সামান্য কিছু সেনা নিয়ে বিশাল একটা দলের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন মেজর। প্লাস্টার বাঁধা হাত নিয়ে মোর্চায় মোর্চায় দৌড়াচ্ছিলেন। অস্ত্র যোগান দিচ্ছিলেন। আচমকা এক বিস্ফোরণে মেজরের লড়াই শেষ হয়ে গেলো। শহীদ হলেন ভারত মাতার বীর সন্তান মেজর সোমনাথ শর্মা। কাছাকাছি ছিল সিপাহী বলদেও সিং, সিপাহী হনুমন্ত সিং, মেজরকে লুটিয়ে পড়তে দেখে প্রচণ্ড আক্রোশে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো শত্রুদের ওপরে। গাছ বা পাথরের আড়াল থেকে নয়, প্রকাশ্যে এসে, নিজেদের জীবন বিপন্ন করে প্রবল গুলি বর্ষণ শুরু করলো দুজনে। দিশেহারা হয়ে পড়লো শত্রু পক্ষ। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হলো তাদের অধিকাংশ সদস্য। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা গুলিতে শহিদ হলো দুই বীর সিপাহী। এয়ার পোর্ট দখল নিলো বিদেশী শত্রু। কিন্তু মেজর শর্মার ডেলটা কোম্পানি তাদের এতোটা ক্ষতি করে ছিল, এতোটা দুর্বল করে দিয়েছিল যে বেশিদিন তারা এয়ার পোর্টকে নিজেদের কব্জায় রাখতে পারেনি।


      ডেলটা কোম্পানির শহীদদের দীর্ঘ তালিকায় আছে সিপাহী বলদেও সিংয়ের নাম। ফৌজিতে ভর্তির সময়ে বাগী বল্লা ঠিকানা হিসেবে ঠাকুর রতন সিংয়ের গ্রামের নাম বলেছিলো।


      এক শহীদ ফৌজির কফিন বন্দি মরদেহ গ্রামে এসেছে। কিন্তু কেউ কোনো দিন তার নাম শোনেনি! তার বাড়ি কোনটা কেউ বলতে পারছে না! খবর পেয়ে তড়িঘড়ি এলেন থানার দারোগা। দেখেই চিনতে পারলেন কে এই শহীদ। থানার খাতায় রিপোর্ট লিখছেন দারোগা। মৃতদেহের নামের জায়গায় লিখেছেন 'শহীদ বলদেও সিং'। আচমকা সেখানে দল বল নিয়ে এসে পড়ে ঠাকুর চেতন সিং। দাবি করতে থাকে মৃতদেহের নামের জায়গায় লিখতে হবে 'বাগী বল্লা'। মৃতদেহটা তার হাতে তুলে দিতে বলে। রীতিমত কোলাহল, ঝামেলা শুরু করে দেয় সে। চিন্তায় পড়ে যান দারোগা। ভাবতে থাকেন নামের জায়গায় কি লিখবেন? 'শহীদ সিপাহী বলদেও সিং' নাকি 'মৃত বাগী বল্লা সিং'। ভাবতে থাকেন দারোগা। ভাবতে ভাবতে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেন  শয়ে শয়ে গ্রামবাসী এসে জড়ো হয়েছে। তাদের চোখে জল, মুখে শ্লোগান, "শহীদ বলদেও সিং অমর রহে। হামারা মসিহা বল্লা অমর রহে।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ