ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

একটি দলহীন অরাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্য -সুভাষ কর



৯৭৯ সাল। মাস আর তারিখ মনে নেই। তবে বেশ মনে আছে ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকারের প্রধান শরিক হয়ে সিপিএম পার্টি তখন থেকেই রাজ্যে ক্ষমতার রাশ নিজেদের হাতে অনেকটাই ধরে রেখেছে; সীমিত ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার যতটা সম্ভব রক্ষা করার। আমাদের অফিসের যে বিশেষ ঘটনাটা আজ পাঠককে জানাব তার সাথে সরাসরি কোন দলীয় রাজনীতির যোগ না থাকলেও তৎকালীন সরকারের সাকারাত্মক কিছু ভূমিকার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে বলেই আগ বাড়িয়ে এ কথাটা বলে রাখলাম।

চুয়াত্তরে আমার অফিস অর্থাৎ একদার অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল (এজি) আসামের অধীন আগরতলাস্থিত ডিএজি অফিসটি পূর্ণাঙ্গ এজি অফিস হবার পর অফিসের কাজকর্ম হঠাৎ দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে। তার সাথে সঙ্গতি রেখে রাজ্য সরকারের দেয়া পুরনো বিল্ডিংয়ের সাথে শুধু আরো চারখানা বাড়ীই ভাড়া নেওয়া হয়নি, দপ্তরের বেস-পোষ্ট অর্থাৎ ‘অডিটর’ হিসেবে প্রচুর স্টাফের পোষ্টিং হয়। দপ্তরের আভ্যন্তরীন নিয়োগ-পদ্ধতিতেই তা করা সম্ভব হয়েছিল। তার উপরের দিকের সুপারভাইজারি পোষ্টগুলি প্রমোশনের দ্বারা কিছুটা পূরণ করে নেওয়া গেল; কিন্তু তলার দিকে স্থানীয়ভাবে গ্রুপ-ডি স্টাফ সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কিছু অসুবিধে ছিল। ফলে প্রয়োজন অনুপাতে নিয়মিত গ্রুপ-ডি স্টাফের সংখ্যা অনেক কম পড়ে যায়। অফিসের কাজকর্ম চালিয়ে নেবার ক্ষেত্রে ভীষণ রকমের অসুবিধে দেখা দেয়। দিল্লীর সিএজি (ক্যাগ) অফিস থেকে তখন ত্রিপুরার এজিকে স্থানীয়ভাবে কিছু আপৎকালীন বা ‘কন্টিন্জেন্ট’ স্টাফ নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়, যাদের দিয়ে সংখ্যায় ঘাটতি গ্রুপ-ডি স্টাফের কাজগুলি করানো যাবে।

এরপর থেকেই একজন দু’জন করে ক্রমান্বয়ে ওইরূপ অস্থায়ী নিয়োগ চলতে থাকে। বছর দুয়েকের মধ্যেই উল্লিখিত ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের সংখ্যা জনাচল্লিশে দাঁড়ায়। তারপরেও আরো বছর দু’য়েক ধরে এরা আগে নিযুক্ত মুষ্টিমেয় কিছু নিয়মিত গ্রুপ-ডি স্টাফের পাশাপাশি একই কাজ করে যাচ্ছিল, অথচ এদের দৈনিক মজুরি ছিল নিয়মিত স্টাফের মাসিক বেতনের তুলনায় অত্যধিক কম। তাছাড়া ছুটিছাটার কোন ব্যাপারই নেই, বরং রবিবার বা অন্য ছুটির দিনে কোন কাজ না থাকায় সরাসরি ‘নো ওয়েজ’। আমাদের একটি মাত্র স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন (যা বরাবরই রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ) এদের বিষয়ে খুবই সংবেদনশীল ছিল। এদের ক্ষেত্রে বেতনের এই বৈষম্যকে তারা মানবিক অন্যায় বলে মনে করত, এবং শুধু মজুরি বৃদ্ধি নয়- ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের সবাইকে রেগুলার কর্মী হিসেবে নিয়োগ করাকেই এই সমস্যার একমাত্র ন্যায্য সমাধান বলে মনে করত। কিন্তু এ নিয়ে প্রশাসনের সাথে কোন কথা বলতে গেলেই ‘এক্তিয়ার’-য়ের প্রশ্ন তুলে নেতাদের মুখ বন্ধ করে দেবার চেষ্টা হ’ত। অগত্যা স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন থেকে ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের বলা হল- তারা যেন নিজেরাই একটা ছোট ‘আন্দোলন কমিটি’ তৈরী করে নেয়, যাদের মূল দাবী হবে প্রত্যেকের চাকরীর নিয়মিতকরণ। কোনরকম আইনী স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হ'ল না বটে, তবুও বেশ একটা শক্তিশালী কমিটি তৈরী করা হ’ল। তাদেরকে আমাদের স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের তরফে সর্বাত্মক কিন্তু পরোক্ষ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হ’ল।

তারপর থেকে ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের তরফে প্রায়ই তাদের প্রতিনিধিরা এজি সাহেবের সঙ্গে দেখা করে নিয়মিতকরণের দাবী জানায়, কিন্তু তাতে কার্যকরী কোন ভূমিকা নিতে তিনি টালবাহানা করতে থাকেন। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে এজি সাহেবের করণীয় কাজটি ছিল শুধু দিল্লীতে সিএজি অফিসের কাছে এবিষয়ে সুপারিশ করা- কারণ ওনার পক্ষে হেডকোয়ার্টার-অফিসের অনুমোদন ছাড়া নিজে তাদের রেগুলার করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। অথচ তিনি বিষয়টিকে দিনের পর দিন এমনভাবে ঝুলিয়ে রাখেন যেন এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার মালিক পুরো তিনিই। প্রতিবারই তিনি এমন একটা ভাব দেখান যে একমাত্র ওনার যেদিন মনে হবে ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দেরকে রেগুলার করা দরকার- শুধু সেদিনই তিনি যা করবার করবেন। আর সেই দিনটা ছিল অনেকটা ‘আজ নগদ কাল বাকী’-র মতোই এক চির-ভবিষ্যতের মরীচিকা-ধাঁধাঁর মতো। ফলে দুপক্ষের একটা দ্বন্দ্ব ক্রমশ দানা বাঁধছিল।

ব্যক্তিগতস্তরে মানুষ হিসেবে তখনকার এজি খুবই সৎ এবং ভড়ংহীন ছিলেন বটে; কিন্তু ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে কেন জানি না ওনার মনে হয়েছিল এজাতীয় আন্দোলনের কাছে সহজে নতিস্বীকার করাটা অনুচিত। অথবা আমার এখনকার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে মনে হয় এর আর একটা কারণও হয়ত থাকতে পারে। কন্টিন্জেন্ট কর্মীদের নিজেদের নেতৃত্বে কিছু অতিবিপ্লবী মানসিকতার ছেলে ছিল, যাদের আচরণের কোন বাড়াবাড়ি হয়ত বা ওনার ‘ইগো’কে দিনদিন প্রচণ্ড জেদী করে তুলেছিল। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব কিন্তু সবসময়েই ছেলেগুলিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকবার পরামর্শ দিত, কিন্তু অন্যায় নীতি-প্রসূত সুদীর্ঘ বঞ্চনার মুখে এসব ‘হিতোপদেশ’ কি বেশীক্ষণ কাজ করতে পারে? যাই হোক, ঘটনার দিন নরমে গরমে তাদের আন্দোলন তুঙ্গে উঠল।

বর্ণিতব্য ঘটনার সময় এজি সাহেব বসতেন ‘মালঞ্চ নিবাস’ নামক একটি ভাড়া করা বাড়ীতে। সেটি ছিল ত্রিপুরার মহারাজার একসময়ের ঐতিহ্যশালী এক বাগান-বাড়ী গোছের, যাতে মহারাজের অতিথি হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও একসময় দু’তিন রাত কাটিয়ে গিয়েছিলেন। একসময়ের ঐ শান্তির নীড়ই বুঝিবা সেদিন আসন্ন এক বিদ্রোহের রূপ দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

সেদিন বেলা এগারোটা নাগাদ জনাচল্লিশ ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’ সবাই মিলে এজি সাহেবের চেম্বারের বাইরে তাদের ক্ষোভ ও অনুরোধ জানাতে জড়ো হয়, আর তাদের মধ্য থেকে গুটিকয় কর্মী ওনার সাথে কথা বলার জন্যে প্রতিনিধি হিসেবে দেখা করতে চায়। কিন্তু এজি সাহেব তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এবং কথা বলতে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। এদিকে কর্মীরা সবাই এজির রুমের সামনে বসে পড়েই শ্লোগান দিতে শুরু করে। বেশ কতক্ষণ এভাবেই চলতে থাকে কিন্তু এজি সাহেব ওনার অবস্থানে অনড় থাকেন। শুধু তাই নয়, দুপুরে টিফিন টাইমে রোজদিনের মতোই তিনি যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখিয়ে একসময় রুম থেকে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে উদ্যোগী হ’ন। তখনই আসল গণ্ডগোলের সূত্রপাত। কর্মীরা সিঁড়িতে প্রায় শুয়ে পড়ে এজি সাহেবের চলার রাস্তা আটকে দেয় আর বলে, “স্যার, আমাদের জন্যে কিছু না করেই আপনি যদি এভাবে চলে যেতে চান তাহলে আপনাকে আমাদের শরীরের উপর পা মাড়িয়ে বেরুতে হবে”। সঙ্গের ডিউটিরত আধিকারিকরা অনেক চেষ্টা করেও কর্মীদের সরাতে না পারায় এজি সাহেব আবার রুমে ফিরে যান এবং পিএ-কে ডেকে একটা অফিস অর্ডারের ডিক্টেশন দিতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর কর্মীদের জানিয়ে দেয়া হয় তাদের সবাইকেই ছাঁটাই করা হয়েছে এবং এই মুহূর্তে তারা যেন অফিস-বিল্ডিং ছেড়ে চলে যায়। নোটিশ-বোর্ড গুলিতে অর্ডারের কপি টাঙিয়ে দিতে নির্দেশও দেওয়া হয়।

এই খবর যখন কোনভাবে কিলোমিটার দুয়েক দূরে মূল বিল্ডিংয়ে অবস্থিত স্টাফ-অ্যাসোসিয়েশন রুমে পৌঁছয়, তখন নেতৃত্ব সাথেসাথে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় যে এইবার যে করেই হোক এই অন্যায়ের শেষ দেখে নিতে হবে। দাবানলের মতো শহরের ভাড়া নেয়া অন্য সবগুলি অফিস-বিল্ডিংয়ে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং নেতৃত্বের নির্দেশে সেই ভরদুপুরে দূর-দূরান্তের  বিল্ডিংগুলি থেকে মিছিল করে প্রায় একশভাগ স্টাফই মালঞ্চনিবাস-বিল্ডিংয়ে চলে আসে। যা  করা হ'ল সেই কাজটা আইনী কি বেআইনী, এসব ভাবার মতো মানসিকতা কারোরই ছিল না; কারণ তাদেরই একদল বঞ্চিত সহকর্মীভাইদের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। স্থানীয় নেতৃত্বের দিক থেকে দিল্লীর হেডকোয়ার্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে টেলিফোনে বার্তা-বিনিময়, টেলিগ্রাফিক মেসেজ ইত্যাদি সমানে চলতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লীর নেতৃত্বও বিষয়টি নিয়ে সিএজি অফিসের সাথে কথাবার্তা বলা শুরু করে দেয় (তখন ফ্যাক্স, মোবাইল ইত্যাদির সুবিধা ছিল না)। সেদিনও যখন বসে থাকা ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের সামনে স্টাফ-এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এজির কাছে জানতে চাওয়া হল যে আপনি তাদেরকে রেগুলার করার কোন পদক্ষেপ তো কখনও নিলেনই না, উল্টো কি করে আজ তাদের ভাত পর্যন্ত কেড়ে নেবার বন্দোবস্ত করলেন, এজির স্পষ্ট জবাব ছিল- সেই কৈফিয়ৎ উনি স্টাফ-অ্যাসোসিয়েশনকে দেবেন না, এবং সময় হ'লে যাকে দেবার ঠিক তাকেই দেবেন।

সত্যিই কিন্তু তিনি এবার নিষ্ক্রিয় রইলেন না। ছাঁটাইয়ের পক্ষে সাধ্যমতো যুক্তি দাঁড় করিয়ে সিএজি অফিসকে বোঝানোর চেষ্টা চালালেন। কিন্তু সত্যিকে আড়াল করা মোটেও সহজ ছিল না। ততক্ষণে হেডকোয়ার্টার অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বিগত ক’বছরের পুরো ইতিহাসটা সহ আজকের সত্যিটা সিএজি অফিসের কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কানাঘুঁষা জানাজানি হয়ে গেল সিএজি অফিস নাকি উল্টো এজি সাহেবকে ‘ট্যাক্টলেস অফিসার’ বলে দায়ী করেছে। এদিকে মালঞ্চনিবাস-বিল্ডিংয়ে পুরো এজি অফিসের স্টাফ জড়ো হবার খবর কানে পৌঁছলে এজি সাহেব উনার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রাজ্য-সরকারের পুলিশ-দপ্তরের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নিয়মাবলী মেনে অচিরেই সেখানে পুলিশ-ফোর্স এসে পড়বার উপক্রম হ’ল।

অন্যদিকে আমাদের স্টাফ-অ্যাসোসিয়েশনও বসে ছিল না। অফিস-চত্বরে ঢোকার একমাত্র গেটটা বন্ধ করে কিছু স্টাফ সেখানে অনেকটা অবরোধের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। ত্রিপুরার সর্বজনশ্রদ্ধেয় সিপিএম নেতা, দীর্ঘ সময়ের এম পি, প্রয়াত বীরেন দত্ত তখন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী। এসোসিয়েশন থেকে ওনার সাথে যোগাযোগ করলে উনি সব শুনে ডিএম সাহেবকে প্রয়োজনীয় ‘ব্রীফ’ দিয়ে দিলেন। বিকেলের দিকে আইন-শৃঙ্খলার খোঁজ নিতে আসা এডিএম সাহেব পুলিশ-ফোর্সকে অনেকটাই দূরে দাঁড় করিয়ে একজন মাত্র সিকিউরিটি নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে এলে আমরা তার কাছে আজকের পুরো ঘটনাটা বিবৃত করলাম। তিনি শুধু জানতে চাইলেন- এখানে ‘ঘেরাও’-য়ের কোন ব্যাপার চলছে না তো? আমরা জানালাম- মোটেই না; এখানে ন্যায্য দাবী নিয়ে কিছু কর্মী স্রেফ শান্তিপূর্ণভাবে বসে অবস্থান-বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। স্বীকার করে নেয়া উচিৎ যে আইন বাঁচিয়ে চলার জন্যে এই অর্ধসত্যিটা আমরা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। এডিএম সাহেব বললেন উনি একবার ভেতরে গিয়ে এজি সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন- আমরা যেন অন্তত: উনার ডিউটির খাতিরে গেটটা ছেড়ে দিই।

সারাটা দিন কেটে গিয়ে তখন সন্ধ্যে হয় হয়। এডিএম সাহেব এজি সাহেবের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে বললেন- এজি সাহেব অনবরত আপনাদের দিল্লীস্থ অফিসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন- আপনাদের দিল্লীর নেতৃত্বও সেখানে হাজির রয়েছে- মনে হয় আজই কিছু একটা ফয়সালা হয়ে যেতে চলেছে। আমরা এখন এখান থেকে চলে যাচ্ছি- কিন্তু আপনারা প্লীজ দেখে রাখবেন যেন কোন গণ্ডগোল না হয়। পক্ষান্তরে বলা যায়, আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব একরকম আমাদেরই উপর ছেড়ে দিয়ে উনি পুলিশ-বাহিনী নিয়ে ফিরে গেলেন। বলতে কোন দ্বিধা নেই, শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় তখনকার নতুন গঠিত বামসরকারের আন্তরিক সহযোগিতা এইসব অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। পরবর্তীকালে ভারতের সর্বত্র বামশক্তির কি বিচ্যুতি হয়েছে না হয়েছে- এসব নিয়ে বিতর্কে যাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।

যাই হোক, আশাবাদী হয়ে আমরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু একটু পরেই ভেতর থেকে খবর এল এজি সাহেব নাকি বলেছেন আজ কিছুই করা যাবে না- কাল সকালে ছাঁটাইয়ের আদেশ নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। দিল্লী অফিসের ধমকের খবরটা অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বের কাছে পাকা ছিল বলেই তারা ঠিক বুঝে নিয়েছিল- স্বল্প ব্যবধানেই এজির তরফে এই পরিবর্তিত নতুন অবস্থানটা আসলে নিছক মুখ-বাঁচানো ইগো-প্রসূত একটা কৌশল। তাছাড়া এদিকে এত অধিক সংখ্যায় উত্তেজিত লোকের সমাবেশ নিয়ে স্টাফ-নেতৃত্বও খুব উদ্বিগ্ন ছিল। যেকোন অসতর্ক মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল না। তাই সবাইকে বলা হল বাড়ী চলে যেতে এবং আগামীকাল সকাল সাড়ে দশটায় আবার এখানে জড়ো হ’তে। এজি সাহেবকেও বিনা বাধায় বাড়ী চলে যেতে দেওয়া হ’ল। কিন্তু একটা বিষয়ে নেতৃত্বের কোন নির্দেশ এমনকি পরোক্ষ কোন ইঙ্গিত ছাড়াই সমবেত জনতা এক অভিনব পদ্ধতিতে তাদের  ক্ষোভ এজি সাহেবকে সরাসরি দেখালো। এজি সাহেব যখন সকলের সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, সবাই তখন স্বত:স্ফূর্তভাবে এজির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল আমাদের তরফে এই অবাঞ্ছিত ও কিছুটা অশোভন ব্যবহারটুকু বোধহয় এজি সাহেব নিজেই ওনার ভুল আচরণের ফলে ডেকে এনেছিলেন। 

পরদিন জমায়েতটা আগের দিনের মতো ততটা উত্তাপময় ছিল না। তবে গতদিনের আন্দোলনের সুফল অবশ্যিই মিলল। ফার্ষ্ট-হাফেই ছাঁটাইয়ের অর্ডার তুলে নেবার খবরটা এসে গেল। প্রশাসনের তরফে আরো জানিয়ে দেয়া হ’ল অবিলম্বে সব ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’দের নিয়মিত করার কাজ শুরু হবে। শুনে উপস্থিত সবাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের জয়সূচক কিছু শ্লোগান তুলে এই অভাবনীয় সাফল্যের জন্যে তৃপ্তি প্রকাশ করে যার যার বিল্ডিংয়ে কাজে যোগ দিতে চলে গেল।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, উক্ত জনাচল্লিশ ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’-র প্রত্যেকেই কিছুদিনের মধ্যেই রেগুলার কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিল। পরে অনেকেই প্রমোশন পেয়ে উপরের পোষ্টেও কাজ করেছেন। দু’একজন তো এজির বিখ্যাত এস.এ.এস পরীক্ষা পাশ করে বেশ উপরেও উঠে গিয়েছিলেন।

এই সাফল্যের পেছনে অনেকেরই বিশেষ অবদান ছিল- সেসব নাম উল্লেখ করলে এক সুদীর্ঘ তালিকা হয়ে যাবে। একসময় নিজেও কর্মচারী-আন্দোলনে কিছু দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছি। সেই সুবাদে কখনো কখনো অন্ধ দলীয় আনুগত্যে কিভাবে আন্দোলনের মূল স্পিরিটটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নেতাদের সংকীর্ণ স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা হয় তাও খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং জেনেছি। কিন্তু আমাদের স্টাফ-অ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় নেতৃত্ব ছিল অনেকাংশেই তার ব্যতিক্রমী। সংগ্রামী মানসিকতা বজায় রেখেও সেখানে কোন দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হ'ত না, কিংবা নিতেও দেয়া হ’ত না। আর তাই আমাদের অফিসের ‘কন্টিন্জেন্ট কর্মী’-দের আন্দোলনের এই সাফল্য বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর জয় ছিল না- ছিল আমাদের সকলের সম্মিলিত জয় তথা শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমাজকে অনুপ্রাণিত করে পথ দেখিয়ে যাওয়া সেই লড়াকু আদর্শের জয়। তবে হ্যাঁ, তখনকার ক্ষমতাসীন বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি এবং ত্রিপুরার কিছু নিরপেক্ষ নির্ভীক সাংবাদিক আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস ও সহযোগিতা না যোগালে এই জয় কঠিন হ'ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ