ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

বিষের যন্ত্রণা – মিথ্রিডেটিস -পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়



  • বই – মিথ্রিডেটিস
  • লেখিকা- সায়ন্তনী পূততুণ্ড
  • প্রকাশনী- মিত্র ও ঘোষ
  • প্রকাশকাল-জানুয়ারি, ২০১৯
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা- ২৩৫ 
  • মূল্য- ২৫০/-


“বিষে বিষে বিষক্ষয়”। অর্থাৎ বিষ দিয়ে বিষক্রিয়াকে প্রতিহত করা। মানু‌ষের শরী‌রে এক‌টি নি‌র্দিষ্ট প‌রিমা‌ণে নিয়‌মিত বিষ প্রয়োগ করা হয়, যার ফ‌লে সেই বি‌শেষ মানুষগু‌লো শরীরে যে কো‌নো রক‌মের বিষকে প্র‌তি‌রোধ করার ক্ষমতা গ‌ড়ে ওঠে। এই বি‌শেষ ধরণের মানুষ‌দের মি‌থ্রি‌ডে‌টিস বলা হয়। এবং এই প্রক্রিয়াকে মিথ্রিডেটিজম বলে।

কথিত আছে প্রাচীন ভারতে জন্মাবধি খুঁতযুক্ত কন্যা, যাঁদের বিবাহের সম্ভাবনা জন্মক্ষণেই কোনো কারণবশত  নির্মূল হয়ে যেত, তাঁদের শৈশব থেকে এই পদ্ধতিতে এমনভাবে রূপান্তরিত করা হত যে, এঁদের সংস্পর্শে মানুষের মৃত্যু ঘটত। এঁরা 'বিষকন্যা' নামে পরিচিত ছিলেন। 


শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের রাজ্যের গুপ্তবাহিনীতে ব্যবহার করা হত মূলত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা। কিন্তু বিষকন্যারা নিজেরা বিষক্রিয়াহীন ছিলেন। কোনও বিষ এঁদের কোনও ক্ষতি করতে পারত না। এঁদের শরীরে বিষের সহনশীলতা তৈরি হয়ে যেত।   

একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন উপকথায় বিষপুরুষদের অস্তিত্বের  উল্লেখও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একজন বিষপুরুষ ছিলেন। রাজমন্ত্রী চাণক্যের দূরদর্শী চিন্তা ও সহায়তায় তিনি মৌর্যসম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজাকে সম্পূর্ন নিরাপদ রাখতে  তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মিশিয়ে দিতেন চাণক্য। বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে উঠেছিল চন্দ্রগুপ্তের শরীর যা বিষের আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিল।

সায়ন্তনী পুততুন্ড লিখিত “মিথ্রিডেটিস” উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এই ঐতিহাসিক তথ্যের উপর নির্ভর করে কল্পিত। উপন্যাসের সম্পর্কে বলার শুরুতেই লেখিকার গুণমুগ্ধদের একটা বিষয়ে জানা দরকার তা হল এই উপন্যাস লেখিকার সৃষ্ট বিখ্যাত ‘অধিরাজ’ সিরিজের অন্তর্গত নয়। তাই আমার মত যারা অধিরাজের অপর একটি অসাধারণ কীর্তি ভেবে এই বই পড়তে শুরু করবেন তাঁরা নিঃসন্দেহে হতাশ হবেন। এরপরেও যারা এই বই পড়তে চান তাঁদের জন্য রইল বাকি পাঠ প্রতিক্রিয়া। 

কর্ণ ওরফে করণ ডিসুজা- কুখ্যাত কিন্তু অসম্ভব ব্যতিক্রমী রকমের সুদর্শন (লেখিকার অন্যান্য সমস্ত কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মতই ইনিও একজন ‘গ্রীক গড’!!!) দাগী মস্তান ও ফাঁসির আসামী যাকে তার বাবা শৈশব থেকেই বিষ প্রয়োগে বিষ পুরুষে পরিণত করেছিলেন। ফাঁসিকাঠে ঝোলার আগেই তিনি এক প্রভাবশালীর অনুরোধ বা অনুগ্রহে এক বিশেষ নার্সিংহোমে পৌঁছে যান যেখানে বেআইনিভাবে এডস রোগের নব্য আবিষ্কৃত ওষুধের প্রয়োগ করা হয়। মানে মানুষকে গিনিপিগ-রূপে অকাতরে ব্যবহার করা হয়। পুলিশ প্রশাসন যথারীতি টেবিলের তলায় হাত গরম করে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় আছন্ন থাকে। সাধারণত ফুটপাতের থেকে অভাগাদের তুলে এনে এই প্রয়োগ করা হলেও করণবাবুর বিশেষ শারীরিক ক্ষমতার জন্য তাঁর উপরেও এই ওষুধের প্রতিক্রিয়া দেখার দরকার হয়ে পড়ে। অতঃপর সুদর্শন ও কুখ্যাত/বিখ্যাত  অপরাধীটি কিভাবে সেই অপরাধের ঘন জাল কেটে বেআইনি চক্রটির ধ্বংস করেন তারই বীর বিক্রম কাহিনী। 

সাথে অবশ্যই আছে প্রেম, নাটক, টুইস্ট, নাটকীয় সংলাপের বন্যা, বছরের পর বছর ধরে চলা বাংলা সিরিয়ালের মত সস্তার আবেগ, বিবেকের দংশন, আশির দশকের হিন্দি ছায়াছবির রক্ত ঝরানো প্রতিশোধ এবং চরম ট্র্যাজেডি দিয়ে কাহিনীর পরিসমাপ্তি। গল্প এই টুকুই। কিন্তু তাকেই ফেনিয়ে গেঁজিয়ে টেনে টেনে ২৩৫ পৃষ্ঠায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখলে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যতের বিষয়ে ভেবে সত্যিই দুঃখ হয়। তবে হিন্দি বি গ্রেড চলচ্চিত্রের অনুকরণে রচিত উপন্যাস পাঠে রুচিশীল পাঠকদের  ভালোই লাগবে হয়ত। কারণ এতে আছে অ্যাকশন, কমেডি, ড্রামা, ট্র্যাজেডি, প্রেম, বিচ্ছেদ, প্রতিহিংসা – প্রতিশোধ সহ অন্যান্য যাবতীয় মাল মশলা। কিন্তু সাহিত্যপ্রেমী পাঠক অবশ্যই সাবধান হন। অতিরিক্ত মশলায় চোঁয়া ঢেকুর ওঠা অবশ্যম্ভাবি।   

এই যুগের লেখিক–লেখিকাদের ভিড়ে সায়ন্তনী পুততুণ্ডকে একজন শক্তিশালী রচনাকার হিসাবেই বলা হয়ে থাকে। খুব অত্যুক্তি যে করা হয়না তা ওনার স্বাহা, অসভ্য চোখ, কৃষ্ণবেণী, জিঙ্গল বেল প্রভৃতি গল্প পড়লে বোঝা যায়। কিন্তু সেখানে এই ধরণের বালখিল্য এবং চরম বিরক্তি উদ্রেককারী গল্প কেন উনি লিখলেন, কিসের চাপে পড়ে লিখলেন তা জানার জন্য অবশ্যই কৌতূহল বোধ করছি। এমন একটি গল্প যা পড়ে যে কোনও সাহিত্য প্রেমী ও সুস্থ মানসিকতার পাঠকের রীতিমত মাথা যন্ত্রণা শুরু হতে বাধ্য।  

এই গল্পের মূল বিষয়  নতুন আবিষ্কৃত ওষুধের বেআইনি প্রয়োগ ও নিরীক্ষণ অর্থাৎ ইললিগাল ড্রাগ টেস্টিং। প্রথম বিশ্বের দেশ বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার অজুহাতে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের মানুষদের উপর বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এবং ক্লিনিকের মাধ্যমে নতুন আবিষ্কৃত এবং এক্সপেরিমেন্টাল ওষুধের মানবিক প্রয়োগ চালায়। এটা এই মুহূর্তে একটি ওপেন সিক্রেট এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে অন্যতম চিন্তার বিষয়ও। আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশ এই ধরণের প্রয়োগের জন্য অন্যতম বড় নিশানা, কারণ অপ্রমাণিত ওষুধের প্রাথমিক পর্যায়ে মানবিক প্রয়োগ ঘোরতর অপরাধ। প্রথম বিশ্ব অবশ্য নির্দ্বিধায় এই প্রয়োগ তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত কালো মানুষদের ওপর করে থাকে কারণ ‘নিগাররা ঠিক মানুষ হয় না’। এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপস্থাপিত করা ছাড়া এই বইয়ে বিশেষ কিছু ভালোলাগার জিনিস নেই। 

বরং বলতে বাধ্য হচ্ছি বিখ্যাত এক ইংরাজি সিরিজের প্রায় হুবহু নকলে লেখা, চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত কচকচানি, একঘেয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রদের ভগবানের অবতাররূপে দেখানো, অযথা আজেবাজে প্রচুউউউর সংলাপে পৃষ্ঠা ভরানো, বাস্তব ও যুক্তিবোধকে সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়ে দিয়ে এবং সমস্ত কিছুই অসম্ভবরকমের অনুমানযোগ্য ভাবে রচিত এই উপন্যাসটি পড়ার পর লেখিকার অন্য লেখা পড়তে বেশ একটা ভয়ই লাগছে – আবার না শরীর খারাপ হয়ে যায়!!  ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে যে এইরকম গ্রীক গডদের ছড়াছড়ি আছে তা এইসব লেখা না পড়লে পাঠকের অজানাই থেকে যেত। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের মত সাধারণ পাঠকরাই শুধু  তাঁদের বাস্তব জীবনে সশরীরে দেখতে পাননা। বইয়ের প্রচ্ছদ ছবিও তথৈবচ। গল্পের যোগ্য সঙ্গতকারী একেবারে। ছবিটি অর্থহীন হয়ত নয়, গল্পের অর্থহীনতার দ্বারা প্রভাবিত শুধু। 

লেখিকাকে বড় বলতে ইচ্ছা করে– ‘সাধারণ চেহারার সাধারণ অবস্থার মানুষরাও বড় বড় কীর্তি করেন। তাঁরাও প্রেম ভালোবাসা পান। তাঁদের নিয়েও কিছু গল্প লিখুন। যাতে থাকবে না কোনও অতি নাটকীয়তা বা অতিবাস্তবের ছোঁয়া। যা হবে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে যুক্তিবোধের আঙ্গিকে ঘিরে থাকা অতি সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। হাসি-কান্না, বিচ্ছেদ-বেদনা, সুখ দুঃখের আবর্তে রচিত জীবনের জটিল লড়াইয়ে হার – জিতের গল্প। মূর্খ চাটুকারদের চাটুকারিতা বা বিক্রীত সমালোচকদের নির্লজ্জ প্রচার নয়, অন্তত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ও সুস্থ মানসিকতার পাঠক সেই বই পড়ে আপনার জয়গান করুক। আপনার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে নিজের প্রতিষ্ঠা পাক।'  তা না হলে এই ধরণের উপন্যাস পাঠকের কাছে বিষ যন্ত্রণারই সামিল হবে। সাথে সাথে লেখিকা প্রকৃত পাঠককে হারাবেন।    




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ