আর্জেন্টিনার সাথে পরিচয়ের শুরু তাঁর কারণেই। তারপর বয়স এবং জ্ঞান বাড়লে একে একে চে, ওকাম্পো, বোরখেস, কোর্তাজার, পেরন, দারিন এবং মেসির সাথে আরো অগুন্তি ফুটবলারদের চিনলেও আর্জেন্টিনা বললেই ওই বেঁটেখাটো শক্তপোক্ত ক্ষিপ্র গতির অতি মানুষটার কথাই আগে মনে পড়ে।ফুটবলই তাঁর ভালবাসা,তাঁর প্রতিভা বিচ্ছুরণের খিড়কি। কোনোকালেই ফুটবলের সাথে আমার পেয়ারের সম্পর্ক নয়।টুকটাক ক্রিকেট নিয়েই একটু শখের ঘাম ঝরাতে না ঝরাতেই পড়াশোনার বোঝার সাথে বোঝাপড়া করতে করতে রীতিমত অরাজী যখন মন,তখন ফুটবলের কথা উঠলেই দেখতাম বাড়িতে বড়দের মাতামাতি করতে মারাদোনা মারাদোনা নাম নিয়ে।ছিয়াশিতে আমি মাত্র দুই।ফলে একা হাতে(বা বলা ভালো পায়ে)যে ফুটবল বিশ্বকাপ জেতা যায়,না সেইসব উপলব্ধির তখনও ঢের দেরী।নম্বইএও তাঁর লড়াই এবং ফাইনালে পরাজয় দেখেছি আরো দুবছর পরে রেকর্ডিংএ।ততদিনে তাঁকে জেনেছি পোস্টারে,চ্যুইং গামের সাথে পাওয়া ছবিতে আর বড়দের মুখে গল্পে।দেখেছি কিভাবে সুদুর দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশের দুই মহাতারকাকে(পেলে অন্য জন বলাই বাহুল্য)নিয়ে তর্ক থেকে হাতাহাতিতে মেতেছে তারা।তারপর চুরানব্বইএ রাত জেগে প্রথমবার ইশ্বরের দর্শন এবং গ্রিসের বিরুদ্ধে সেই অভাবনীয় গোল। তারপর ?তারপর আর কি শুধুই বিতর্ক: কখনও ড্রাগ, কখনও নারী কখনও বা অসুস্থতা।পেলের বেলা অনুশাসন যতটাই অনুগত,মারাদোনার বেলা ততটাই সে দলছুট। বা বলা ভালো অনুশাসন জিনিসটা যেন তাঁর অভিধানেই নেই। ওই একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব যা দিয়ে শাসন করতেন মাঠ,মাঠের বাইরেও তেমনটাই। রুটি দুধে ভিজে যেমন ন্যাকা ন্যাকা শান্ত অমায়িক হয়ে যায় তেমনই আমি ছিলাম বেশ। অথচ সেই আমারই এই ফুটবলের প্রমিথিউসটাকেই ভালো লেগে গেল।সারা দুনিয়া যখন চোখের জলে নাকের জলে অস্থির এই বুঝি গেল গেল বেশি ওজন সঙ্গে আরো কিসব জটিলতার কারণে ,তিনি মক্কেল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে হাসি (রাজপুত্র সুলভই বটে)দিয়েই খালাস।একেই এত বিতর্ক কিন্তু ওই যে বরাবরই কাঁটার মুকুট মাথায় দিয়ে গরল পান করে বিকল্প পথে আত্মানুসন্ধানেই তিনি বেশি মনোযোগী।গতানুগতিকে তাঁর আগ্রহ নেই কোনোকালেই আর তাই গ্ল্যামার যশ আর খ্যাতির সহজ রাস্তা ছেড়ে তিনি ভিড়ে গেলেন কাস্ত্রো ক্যাম্পে। ফলে ইউরোপে আমেরিকায় তাঁর জায়গা আর একটু ঢিলে হল।অনেকে ভাবলো এও বুঝি তাঁর কোনো খামখেয়ালিপনা। তারপর ক্রমেই চাভেজ, ইভো মোরালেজদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব এবং সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য উদ্বেগ চেনালো অন্য মারাদোনাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে(আমিও যেখানকার) কিন্তু এই কারণে তাঁর জনপ্রিয়তা গেল আরো বেড়ে। তারপর সদ্য বাবার অকালপ্রয়়াণের আঘাতে মলমের মতন তাঁর কলকাতায় আসা এবং সল্টলেকের স্টেজে তিনি আসবেন বলেও না এসে পাশ দিয়ে জ্যোতি বসুর বাড়ি চলে গেলে অন্যদের মতন আমারও তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সুুুভাষ চক্রবর্তীকে গালি দেওয়া,সবই মনে পড়ছে।
সব ঠিকঠাকই তো চলছিল, মাথার সফল অপারেশন,জন্মদিন ...তারপর যে এমনটা হবে!ফুটবলের মহানায়কের কেমন যেন অনায়োকোচিত সমাপ্তি;আধখ্যাঁচড়া,তাঁকেই হয়তো মানায়;ওইযে ডোন্ট কেয়ার ভাবটা,গতানুগতিক একদম নয়,ভুলেও নয়।তিনি গেলেন তো ঠিকই কিন্তু নিয়ে গেলেন আমার কৈশোর থেকে যৌবনের নির্মাণকালের স্মৃতির প্রায় সবটাকে চুরি করে নিয়ে।
0 মন্তব্যসমূহ