ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

মল্লভূমের দশাবতার তাস -সৌম্য ঘোষ

 


       পাশা খেলার প্রারম্ভ থেকে তাসের জন্মলগ্নের ইতিহাস কিছু কম নয়। ভারতবর্ষে তাস খেলার সূচনা শুরু হয় মোগলদের হাত ধরে। তা প্রায় ১৬ শতাব্দীর প্রথম দিকেই। ইউরোপীয়রা এদেশে আসার আগেই আঞ্চলিকভাবে তাস খেলার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। ১৫৬৫ সালে বিষ্ণুভক্ত হাম্বির দশাবতার তাসের প্রচলন করেন মল্লভূমে‌। পুরাণের দশাবতার অনুযায়ী মৎস্য, কুর্ম, বরাহ, বামন, পরশুরাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি। সারা বিশ্বে যাকে চিরাচরিত তাস বলতে বোঝায় অর্থাৎ ইস্কাবন, চিড়েতন, হরতন ইত্যাদি এদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ভাবনায় তৈরি হয় "দশাবতার তাস"। অবশ্যই এটি বিনোদনের একটি মাধ্যম। এই 'দশাবতার তাস'-এর  সূচনা হয় মল্লরাজ বীর হাম্বিরের সময়। 


           মল্ল রাজবংশের সূচনার পেছনে একটি লোকশ্রুতি কাহিনীর প্রচলন আছে। একদা গ্রীষ্মকালের কোন এক দুপুরে জগন্নাথ দর্শনে যাচ্ছিলেন একদল যাত্রী। তাদের সেই দলে ছিলেন এক রাজবংশীয় পুরুষ ও তার গর্ভবতী স্ত্রী। কোতলপুর অঞ্চলের কাছে তাদের একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। 

কিন্তু জন্মানোর পর বাচ্চাটি না কাঁদায় তার মাতা-পিতা মৃত সন্তান ভেবে সেই স্থানেই বাচ্চাটিকে রেখে  পুরী অভিমুখে যাত্রা করে। এই ঘটনার পরের দিন জনৈক বাগদী রমণী শিশুটিকে উদ্ধার করে ও প্রতিপালন করতে থাকেন। শিশুটির নাম রাখেন রঘুনাথ। সেই রঘুনাথ ক্রমশ শাস্ত্রবিদ্যা ও অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। বাগদী যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক নিজস্ব বাহিনী। চারিদিকে রঘুনাথের বীরত্বের কাহিনী বিস্তার লাভ করে। 

সেইসময় প্রদ্যুম্নপুরের রাজা নৃসিংহদেবের বিরুদ্ধে তার অধীনস্থ রাজা প্রতাপনারায়ণ যুদ্ধ ঘোষণা করলে রঘুনাথ তার বাহিনী নিয়ে সেই যুদ্ধ দমন করেন। এই ঘটনায়, নৃসিংহদেব খুব খুশি হয়ে রঘুনাথের উপর রাজ্যের ভার দিয়ে তীর্থে গমন করেন। কিন্তু রাজ্যের সেনাপতি রঘুনাথকে রাজ্যচ্যুত করে এবং রাজা ফিরে এলে তাকে পাগল আখ্যা দিয়ে রাজ্যগ্রাস করে নেয় সেই সেনাপতি। দামাল বীরশ্রেষ্ঠ রঘুনাথ এত সহজে দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। সে পুনরায় যুদ্ধ করে সেনাপতিকে পরাস্ত করে। ‌ পরবর্তীকালে রাজা নৃসিংহদেব নিজে কন্যার সঙ্গে রঘুনাথের বিবাহ দিয়ে রঘুনাথকে রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। এইভাবেই সূচনা হয় মল্লবংশের।

               সম্রাট আকবর সিংহাসনে আসীন হলে সমগ্র রাজ্যকে ১৫ টি সুবায় ভাগ করেন। সুবেদার নাজিম মল্লভূমকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলে মল্লভূমের বার্ষিক রাজস্ব ধার্য হয় এক লক্ষ সাত হাজার মুদ্রা। সেই সময় মল্লভূমের শাসনকর্তা ছিলেন ধাড়ীমল্ল। কথিত আছে, ধাড়ীমল্ল যে রাজস্ব সুবেদার নাজিমকে দিতেন তা আবার লুট করে নিজের রাজ্যে ফিরিয়ে আনতেন। ধাড়ীমল্লের পর রাজা হন হাম্বির। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে মল্লভূমের ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছিলেন। রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য, শিল্প সংস্কৃতি প্রভৃতির প্রভূত উন্নতি হয়। বীর হাম্বির নিজেও আধ্যাত্মিক অনুগামী ছিলেন। 


          ফিরে আসি, দশাবতার তাসের কথায়। মুঘল দরবারে যখন হাম্বির প্রথম তাস খেলা দেখেন, তিনি চমকিত হন এবং এই খেলার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন। একইসঙ্গে এই খেলার আদলে এক নতুন খেলা প্রবর্তনের কথা ভাবেন। ‌ তিনি ছিলেন  বিষ্ণুভক্ত। ‌ তার গুরু ছিলেন বৈষ্ণব শ্রীনিবাস আচার্য। ‌ আচার্যদেব ছিলেন উড়িষ্যার মানুষ। তৎকালে উড়িষ্যায় দশাবতার তাস খেলার প্রচলন ছিল। গুরু শ্রীনিবাস আচার্য এই তাস খেলার মাধ্যমে বৈষ্ণবধর্ম রাজ্যব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাইলেন।


মুঘল রীতি ও উড়িষ্যার রীতির সংমিশনে রাজা হম্বিরের আদেশে তার ফৌজদার কার্তিক তৈরি করলেন বিষ্ণুর দশ অবতার চিত্রিত দশাবতার তাস। 

            মল্লভূমে যে দশাবতার তাস পাওয়া যায়, তা ১২০টি তাসের সেট।আকৃতি গোল। ব্যাস  ৪ থেকে ১০ সেন্টিমিটারের মত। পুরু ১/৫ ইঞ্চি। প্রত্যেক তাস বিষ্ণুর দশাবতার স্মরণে নির্মিত। এই তাসের নির্মাণ ভারী চমকপ্রদ! তেঁতুল বীজ, শিরিষ আঠা, বেলের আঠা, সুতির কাপড়, খড়ি মাটি, ঝামা পাথর, বিভিন্ন ধরনের রং, ভুষো কালি, গিরিমাটি এইসব দিয়ে একসেট তাস তৈরি করতে সময় লাগে কমপক্ষে এক মাস। ‌

        আজও সেই ফৌজদার কার্তিকের বংশধরেরা এই তাস নির্মাণের দায়িত্ব বহন করে চলেছেন।

কিন্তু দশাবতার তাস খেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে এই তাস কেনার খরিদ্দারের অভাবে এই শিল্পটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলার এই নিজস্ব শিল্প ও ঐতিহ্যের হীরক খনি আজ অস্তিত্ব সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরকারি লোকশিল্প দফতরের সাহায্য পেলে হয়তো আমরা প্রাচীন বাংলার এই ঐতিহ্য ও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি।।


_______________________________

ঋণস্বীকার:

(১) "মল্লভূমের দশাবতার তাস" - রামামৃত সিংহ মহাপাত্র। সুপ্রকাশ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ