ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

ফ্রিবি না ফ্রী-বাই? - সৌভিক বিশ্বাস

 

ফ্রী-তে বা গোদা বাংলায় বললে ফিরি-তে কিছু পেলে আমাদের আনন্দের পরিসীমা, ক্ষেত্রফল কিছু থাকে না–সে কী আনন্দ! মনে হয় যেনো দূর-দূরান্তের কোনো এক রাজ্য জয় ক'রে নিয়ে এলাম। এইরকম লাগামহীন অনুভূতি আমাদের মধ্যে চিরকালের। কেউ কোনো অনুষ্ঠানে একটা দামী কোনো উপহার দিলে মুখে যতই বলি–এসবের আর কী দরকার ছিল!– এদিকে মনে খুশির লাড্ডু ফুটতে থাকে। আবার একটু কমা (যার আর্থিক মূল্য কম কিন্তু তার হয়তো হার্দিক মূল্য অনেক বেশি) কিছু দিলেই আমাদের নাক-মুখ সিঁটকে যায় এবং যথারীতি বলতে থাকি–অ্যা! কী কিপটে রে বাবা।

 

এই বিনামূল্যে পেয়ে যাবার ক্ষেত্রের ব্যাপ্তি কিন্তু আমাদের জীবনে ব্যাপক। চল ওই সিনেমাটা দেখে আসি–ধুর, কিছুদিন পরেই তো টরেন্টে, টেলিগ্রামে পেয়ে যাবো। ওয়েব সিরিজ আবার কেউ সাবস্ক্রিপশন নিয়ে দেখে…পাগল শালা! দুনিয়াসুদ্ধ লোক এখান-ওখান থেকে ডাউনলোড ক'রে দেখে নিচ্ছে। বেকার বই কিনছিস কেনো?– পিডিএফ তো পেয়ে যাবি। আমরা সবাই জানি, এই চিত্র আজকাল বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে।

 

ছোটবেলায় দেখেছি বাবা কিশোর-ভক্ত হবার কারণে ঘরের বাঙ্কে একগাদা কিশোর কুমারের গানের ক্যাসেটের সম্ভার। পরে সেগুলো খারাপ হবার পর আমি ফিতে বের ক'রে চিত্তসুখ পেতাম সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তারপর যুগ পাল্টানোর সাথে সাথে দেখেছি বাবা সিডি কিনে আনতো। যুগের সাথে পাইরেসি বাড়ার সাথে সাথে পাইরেটেড সিডি-ও (তখন অবশ্য বুঝতাম না পাইরেসি খায় না মাথায় দেয়) দোকান থেকে কিনে আনতো। তারপর তো ফোনের মেমোরি কার্ডে গান লোড করা আর এখন তো পুরোটাই এসে দাঁড়িয়েছে ইউটিউব-স্পটিফায়-তে, অবশ্যই সাবস্ক্রিপশন না-নিয়ে, অর্থাৎ, নেমে এসেছি ওই ফিরিতে। শিল্পের জন্য পয়সা খরচ করাটাকে আমরা অর্থাৎ সাধারণ জনগণ কোনোদিনই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব'লে মনে করিনি। আগে যেটুকু প্রয়োজন লোকে মনে করত এখন আর কোনো প্রয়োজন পড়ে না কারণ–ওই ফিরি-তে পেলে আবার গাঁটের কড়ি কেনো খরচা করতে যাবো ভাই! ঠিক কথা। যেখানে মানুষ দু'মুঠো ভাত জোগাড় করতে গিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছে সেখানে কিনা শিল্প নিয়ে যত রাজ্যের আদিখ্যেতা। কবি তো কবেই বলে গেছেন—

"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি।"

 

ব্যাপারটা সবক্ষেত্রে কিন্তু এরকমটা নয়। এখন দেখা যাচ্ছে অবস্থাপন্ন ঘরের লোকজনের-ও সহজে ফিরির জিনিস নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। সে বই কিনে পড়বে না বরং যে কিনেছে তার থেকে নেবে অথবা ইন্টারনেট থেকে পিডিএফ নামিয়ে নেবে। এবার এখানে প্রশ্ন আসবে এখন মোবাইল-ইন্টারনেটের হাতছানি এড়িয়ে কতজনই বা বই পড়ে। ঠিক। কিন্তু এরকম লোক আছে যাদের কোনো বই পড়তে ইচ্ছে করলে তারা সে-বই কিনবে না, বরং অন্য উপায় খোঁজে– অতএব, মানে সেই ফিরি। তারা সিনেমা, ওয়েব-সিরিজ দেখার ক্ষেত্রেও এইসব উপায় অবলম্বন করবে।

 

আর আমাদের এই ফিরির মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ী টু রাজনীতিক যেমনভাবে পারছে নিজেরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। একজন হয়তো যখন  বলছে ৫ কেজি আলু নিলে ৯ টাকায় এক কেজি চিনি বিনামূল্যে, একটা ৩২ ইঞ্চির টিভি কিনলে একটা ইস্ত্রি ফ্রী, এই সার্ফ কিনলে পুজোর বেনারসি একদম ফ্রী, ৪০০০ টাকার কেনাকাটা করলে ১০০০ টাকার ভাউচার আবার ঠিক তখন অপর জন বলছে আমরা ক্ষমতায় এলে ফ্রী তে সবাইকে ইলেক্ট্রিসিটি দেবো, মেয়েদের বাসভাড়া মকুব ক'রে দেবো, গৃহিণীদের মাসে ৫০০ টাকা ক'রে দেবো, চাকরি যতদিন না-পাচ্ছেন ততদিন আপনাকে একটা মাসিক ভাতা দেবো– বলতে-বলতে মুখ ব্যথা হ'য়ে যাবে কিন্তু এই ফিরিস্তি হয়তো শেষ হবে না। ব্যবসায়ীরা এই চমক দেন তাদের অর্থনৈতিক মুনাফার জন্য সে তো সবার জানা কথা কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষকে পঙ্গু বানিয়ে রাখার যে নিরন্তর চেষ্টা ক'রে চলেছে তা ভয়ঙ্কর। পাশাপাশি, এই খয়রাতির রাজনীতি অর্থনীতির মূলে যেভাবে কুঠারাঘাত করছে তা আরো বেশি ভয়ঙ্কর।

 

তাহলে বিনামূল্যে জিনিস কি সবই খারাপ? না, ফ্রীতে শিক্ষাদান কখনো খারাপ হ'তে পারে না। বিনামূল্যে আশ্রয়হীন-কে বাসস্থান প্রদান কখনো নিন্দিত নয়, ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেওয়া সর্বদা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু সবকিছুতে সীমারেখাটা থাকা খুব দরকার। কোনো জিনিসে যখন স্বার্থের অনুপ্রবেশ ঘটে তখনই হয় গেরো। এক্ষেত্রেও ঠিক অনেকটা তাই। তাছাড়া আরেকটা জিনিসের কথা না বললেই নয়- সেটা হলো আমাদের মানসিকতা। সেইটা যদি ঠিক না হয় এই মুফত কালচার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। মূল্যহীনতা যেনো আমাদের অনেকক্ষেত্রে মূল্যবোধহীন ক'রে দিচ্ছে। যতদিন আমরা এটা না বুঝছি ততদিন ওই ফ্রী-তে সিনেমা, গান, বই দেদার ঘুরবে, ফিরবে– কেউ আটকাতে পারবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ