ad

মাসিক ই-পত্রিকা ‘উৎস’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)।
অনুগ্রহ করে পত্রিকার ইমেলে আর লেখা/ছবি পাঠাবেন না।

মহাবিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত - অর্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়


 পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন বহু স্বনামধন্য বাঙালি চরিত্রের নাম পাওয়া যায় যাঁরা তাঁদের অসামান্য প্রতিভা এবং বিস্ময়কর কর্মদক্ষতার জোরে ভারত তথা  বিশ্বের আকাশের নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করেছেন  দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে  তাঁরা শ্বাস নিতে কষ্ট পেতেন তাই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন দেশ মুক্তির অভিপ্রায়ে।  কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ইতিহাসের পাতায় তাঁরা টুকরো টুকরো ভাবে স্থান পেয়েছেন।  এরকম একজন বিস্ময়কর প্রতিভার নাম হল ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর দাদা বিশ্ববন্দিত।  আজও প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে উচ্চারিত হয় মানুষটির নাম। কারণ? কারণ তিনি যে আর কেউ নন স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ ‘যুগপুরুষ' স্বামী বিবেকানন্দ  স্বামীজীর ‘জীবন ও আদর্শ’ আজও প্রাসঙ্গিক দেশে-বিদেশে।  তাঁর গড়ে তোলা রামকৃষ্ণ মঠ গোটা বিশ্বে পরিচিত।  কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ নামক সূর্যের বর্ণচ্ছটার কারণে মানুষ তেমনভাবে মনে রাখেনি স্বামীজীর ভাই,  শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে।  অথচ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মানুষটি মোটেই ভুলে যাওয়ার মতো ছিলেন না।  প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে যোগদানের কারণে সমকালীন সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত  একদিকে যেমন তিনি ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের কট্টর সমর্থক তেমন অন্যদিকে তিনি উচ্চ মানের একজন নৃতত্ববিদ, সমাজ সেবক এবং বহুভাষাবিদ।

 

নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে  ভূপেন্দ্র নাথ দত্তের যে পাণ্ডিত্য, তা তাঁর সমসাময়িক কালে কতজন ভারতীয়ের ছিল,  তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা করা যায়।  অপরপক্ষে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতরে থেকেও সমাজসেবার একদম ভূমি স্তরের সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথের ছিল নিবিড় যোগাযোগ।  বিবেকানন্দ যে সোস্যালিজম প্রতিষ্ঠাকে একান্ত কাম্য ও অপরিহার্য বলে মনে করতেন, তাঁর অনুজ ভূপেন্দ্রনাথ  সেই সোস্যালিজম কে লক্ষ্য বিন্দুতে রেখেই তাঁর সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। 

 

১৮৮০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর উত্তর কলকাতার সিমলা পল্লীতে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহন করেন।  তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী।  মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী।  বিশ্ববরেণ্য দাদা নরেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের চেয়ে তিনি ছিলেন ১৭ বছরের ছোট যে বছর তাঁর জন্ম, সে বছরই দাদা নরেন্দ্রনাথ দত্ত যাতায়াত শুরু করেছেন কেশবচন্দ্র সেনের নববিধান ব্রাহ্মসমাজে।    পরবর্তীকালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত - ও একই পথ ধরেন।  কৈশোরে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেওয়ার কারণেই হয়তো বর্ণহিন্দুত্বের পোশাক অনেকটাই আলগা হয়ে এসেছিল তাঁর গা থেকে।  ততদিনে তাঁর দাদা বিশ্বের মানুষের হৃদয় জয় করে হয়ে গেছেন আধুনিক ভারতের মুখ, পাশ্চাত্য  পৃথিবীতে ভারতের সফল উপস্থাপক।  ভূপেন্দ্রনাথ তখন সদ্য তরুণ পরবর্তীকালে অগ্রজের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল হয়েও নিজে আধ্যাত্মবাদী বা সন্ন্যাসী হননি কখনও। তার বদলে তিনি হয়েছিলেন বাস্তববাদী ও সমাজ বিপ্লবী।

 

শিক্ষার্থী জীবনের প্রথম পর্বে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০০ সাল নাগাদ তিনি ব্রাহ্মসমাজে পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর সান্নিধ্য লাভ করেন শিবনাথ শাস্ত্রীর ইচ্ছা ছিল ভূপেন্দ্রনাথ কে কেন্দ্র করেই নতুন একটা প্রচারক মন্ডলীর সৃষ্টি করা,  কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ নিজে কখনো কট্টর ব্রাহ্মসমাজী বা সমাজের ধর্মপ্রচারে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি।  ততদিনে তিনি ইতালীয় বিপ্লবী গিউসেপ্পে মাৎসিনির লেখা বই এবং নিজের দাদা স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘কলম্বো থেকে আলমোরা’ পড়ে ফেলেছেন।  এই সকল বইগুলি পড়ে তাঁর মনে তাঁর দাদার মতোই স্পষ্ট ধারণা হয় যে - “ রাজনীতির সংস্কার না হইলে ধর্ম ও সমাজের সংস্কার হয় না।” যখন তিনি তাঁর নতুন জীবন শুরু করেন ততদিনে তাঁর দাদার জীবন প্রদীপ প্রায় নিভে এসেছে।  আগেই বলেছি তিনি স্বামীজীর মত আধ্যাত্মের পথ বেছে নেননি। তিনি বেছেছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পথ।  ১৯০২ - ০৩ সালেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সঙ্গে।  ব্রিটিশ  শাসনের অবসানের লক্ষ্যে ব্যারিস্টার পি.মিত্র যে নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেছিলেন ভূপেন্দ্র নাথ সেই সমিতিতে যোগদান করেন। তখন ঐ সমিতির সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার পি.মিত্র এবং সংগঠক ও মুখ্য নেতা শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। এছাড়াও ছিলেন অবিনাশ চক্রবর্তী, অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, দেবব্রত বসু, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস প্রমূখ।  তখন গুপ্ত সমিতিতে দীক্ষাদানের বেশ কিছু নিয়মাবলী ছিল। হিন্দু শাস্ত্র, তলোয়ার ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হতো এমনকি দীক্ষা দাতার নাম বলার শাস্তিও ছিল প্রাণদণ্ড।  কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণে হিন্দুশাস্ত্র ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে অস্বীকার করায় ভূপেন্দ্রনাথের বেলায় বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্র ছুঁয়ে দীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।  তবে ভূপেন্দ্রনাথ কখনো নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করেননি।  কখনো প্রকাশ করেননি তাঁর দীক্ষা দাতার নাম।  তবে তাঁর বিভিন্ন লেখায় আকারে-ইঙ্গিতে তিনি যেভাবে বুঝিয়েছেন তাতে যতদূর ধারণা করা যায় তা থেকে মনে হয় তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন স্বয়ং অরবিন্দ ঘোষ।  এই গুপ্ত সমিতি তে থাকাকালীনই ১৯ শে জুলাই ১৯০৫ - এ ব্রিটিশ সরকার এক কুখ্যাত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয় যা বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত।  সে সময় ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল ছিলেন ‘জর্জ নাথানিয়েল কার্জন’ ওরফে লর্ড কার্জন অফ কেডেলস্টন।  তবে বঙ্গভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই যে সমস্ত বিপ্লবী দল  এতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তেমন নয়।  এমনকি ভূপেন্দ্রনাথ নিজেও সেই উত্তাপ তখন পুরোপুরি বোঝেননি। তিনি তাঁর বই ‘ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম’ - এ লিখেছেন  “ ...... সমগ্র বাঙ্গলা ভ্রমণ করিয়া এই উপলব্ধি করিলাম, স্বদেশী যুগে ধনীদের স্বাধীনতা স্পৃহা বলিয়া যাহা প্রতীত হইয়াছিল তাহা মরুভূমির মরীচিকা মাত্র।  ইতিহাসের দ্বন্দ্বভাব জনিত বস্তুতন্ত্রবাদ (অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ) বলে, ইহার পশ্চাতে ছিল শ্রেণীস্বার্থ। “ সেই সময়ে নেটিভ স্টেটের যেসব রাজা এবং জমিদার ইংরেজদের থেকে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করছিলেন তাদের মনে শঙ্কা দেখা দেয় যে পাছে সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুলে দেয়।  তাই তারাও বিপ্লবীদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন।  ময়মনসিংহের মহারাজা শ্রী সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী বিপ্লবী সমিতির নেতাকে বোমা তৈরীর জন্য ১০০০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।  ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মত তরুণ বিপ্লবীরা এই সুযোগে বিপ্লব এবং স্বদেশী আন্দোলন কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন  এ প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন - “ স্বদেশী আন্দোলন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল এবং কংগ্রেসওয়ালাদের বক্তৃতার গরমে কৃতকার্য  হয় নাই, বরং প্রত্যেক জায়গায় বিপ্লববাদীরা কেন্দ্র স্বরূপ হইয়া স্বদেশী আন্দোলনকে পরিচালিত করিতেন ও তাহাকে কৃতকার্য  করিবার যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন।”

 

কালী সাধক গিরীন্দ্রনাথ কাব্যতীর্থ ‘স্বদেশী রামায়ণ’ রচনা করেন  তখনকার বিশিষ্ট বাড়িতে এই গান কথকতা হত।  এই সময় বিপ্লববাদ শুধুমাত্র গুপ্ত সমিতি গুলিতেই আবদ্ধ থাকে নি তা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার নানা প্রান্তে, গ্রামেগঞ্জে, মফঃসসলে সর্বত্র।

যার অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত  বই ফেরী করার অছিলায় তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্র লাল খাঁ-র সাথে।  এছাড়া সুবোধ চন্দ্র মল্লিক-ও বিপ্লবীদের বিপুল অর্থ এবং রাজনৈতিক সাহায্য করেন।  এর ফলে স্থাপিত হয় ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশন। ১৯০৬ সালের ২৫ শে জুলাই দক্ষিণ কলকাতার  যাদবপুরে তৈরি হলো ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’ বা ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ’ (বর্তমানে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি) ততদিনে সমগ্র বাংলাদেশে ইংরেজ বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।  এমন কি তার আঁচ পড়েছিল বাংলা ছাড়িয়ে কটকেও। তখন বাংলায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এর স্বদেশী পত্রিকা ' সন্ধ্যা ' এবং অরবিন্দ ঘোষের ইংরেজি পত্রিকা ‘বন্দেমাতরম্’ এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বলাবাহুল্য এই দুই পত্রিকাতেই  প্রচুর পরিমাণে অর্থ সাহায্য করতে  সুবোধ মল্লিক।  এরপর আসে ' যুগান্তর '। অরবিন্দ ঘোষের অনুরোধে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের সঙ্গে  ১৯০৬ সালে সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত পত্রিকার দাম ছিল মাত্র এক পয়সা।  কয়েকদিনেই পাঠকের সংখ্যা কুড়ি হাজার  অতিক্রম করল। কিন্তু যুগান্তরের এই প্রতিপত্তি ইংরেজ সরকারের সহ্য হলো না।  ফল স্বরূপ  ‘যুগান্তর’ সম্পাদনা ও ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি বে-আইনি ইস্তাহার প্রকাশের জন্য ১৯০৭ সালে ভূপেন্দ্র নাথকে গ্রেপ্তার করা হল।   এই মামলায় তাঁর পক্ষের কৌঁসুলি হিসেবে ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী, চিত্তরঞ্জন দাস, অশ্বিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়ের মতো নামজাদা  ব্যক্তিরা।  তবে তা সত্ত্বেও কিন্তু  আত্মপক্ষ সমর্থন করতে রাজি হননি ভূপেন্দ্রনাথ।  তিনি তাঁর বয়ানে লিখেছিলেন - “ সবাই যা সত্য বলে জানে এবং আমার সকল দেশবাসীর মনে যা আছে তা - ই আমি লিখেছি, কিন্তু আমি জানতুম যে সে কাজ করে ব্রিটিশ আদালতে কোন ন্যায়বিচারের সুযোগ আমি পাবো না আমি সর্বদাই  যে মত প্রচার করেছি তার সঙ্গে তাদের (ব্রিটিশ আদালতের) সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করাকে আমি সঙ্গত বলে মনে করিনা।” শান্ত অথচ দৃঢ় ভাষায়  চাবুকের মত উত্তর।  ভূপেন্দ্রনাথের এই পদক্ষেপ ছিল পরাধীন ভারতে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম অসহযোগ প্রদর্শন আর যেদিন এটা ঘটেছিল সেদিন ছিল ২২ শে জুলাই ১৯০৭ সাল। তাঁকে জামিন দিতে এগিয়ে আসেন ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণ কুমার মিত্র,  দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী এমনকি ভগিনী নিবেদিতাও। বলাবাহুল্য, ভূপেন্দ্রনাথকে জামিন দিতে উদ্যোগী হওয়ার কারণে  ‘ইংলিশম্যান পত্রিকা’ ভগিনী নিবেদিতাকে ‘জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়েছিল। এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হলো ভূপেন্দ্রনাথের।  তাঁকে এই সাজা শোনানোর পর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বেঙ্গলি’ কাগজের শিরোনামে লিখলেন  - “রিসিভড সেন্টেন্স উইথ সিরিন ডিগনিটি!”

অরবিন্দ ঘোষ ‘বন্দেমাতরম্’ কাগজে লিখলেন - “ওয়ান মোর ফোর দ্য অলটার”  আর “ শ্রীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ”।  এগুলো ছাড়াও আরো নানা পত্র-পত্রিকা যেমন ‘বসুমতি’, ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘নবশক্তি’, ‘হিতবাদী’, ‘সঞ্জীবনী’ প্রভৃতি পত্রিকা গুলিতেও ভূপেন্দ্রনাথের গ্রেপ্তারের খবর নিয়মিত বের হতে লাগলো।

তাঁর গ্রেপ্তার এবং তারপর তাঁর অসহযোগ যেন নতুন করে প্রাণ এনে দিলো স্বদেশী আন্দোলনে। হ্যারিসন রোডে ডঃ নীলরতন সরকারের বাড়িতে  কৃষ্ণ কুমার মিত্রের স্ত্রী লীলাবতী দেবীর সভাপতিত্বে মহিলাদের তরফে ভুবনেশ্বরী দেবীকে  সংবর্ধনা দেওয়া হল। শোনা যায় পরবর্তীকালে জেল থেকে বেরিয়ে এই সংবর্ধনা প্রসঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবীকে বলেছিলেন “বিবেকানন্দের মা হয়ে তো তুমি কোন স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে তুমি জন - সম্বর্ধনা লাভ করেছ।”

 

১৯০৮ সালের জুন মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর শুরু হলো তাঁর সংগ্রামী জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।  এই পর্বে তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন তাঁর মাতৃসমা ভগিনী নিবেদিতা।  যিনি ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে ‘ভূ’ বলে ডাকতেন।  এই বছরেরই ১১ ই ডিসেম্বর ১৮১৮-র তৃতীয় রেগুলেশনে সুবোধ মল্লিক,অশ্বিনী কুমার দত্ত সহ যে ১০ জনের নামে দ্বীপান্তরের হুলিয়া বেরোয় তাতে নাম ছিল ভূপেন্দ্রনাথেরও।  তাই ভগিনী নিবেদিতার পরামর্শে তিনি ‘বসন্ত কুমার ব্রহ্মচারী’ ছদ্মনামে বেলুড়মঠে আত্মগোপন করেন। এরপর ভগিনী ক্রিস্টিনের পরামর্শে ইংরেজ সরকারের চোখে ধূলা দিয়ে আমেরিকায় চলে যান।  সেখানে স্বামীজীর আরেক শিষ্যা জোসেফিন ম্যাকলেওড,  ভগিনী নিবেদিতার অনুরোধে ভূপেন্দ্রনাথের বইপত্র থেকে শুরু করে জামা কাপড়, ট্রাম ভাড়া যাবতীয় সমস্ত খরচ খরচার ব্যবস্থা করেন। ১৯১০ সাল নাগাদ ভগিনী নিবেদিতা নিউইয়র্কে যান ভূপেন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে এবং এরপর ভগিনী নিবেদিতার পরামর্শেই  তিনি ‘নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ১৯১২ সালে স্নাতক হলেন।  এর দু'বছর পর রোড আইল্যান্ডের ‘ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে সমাজবিজ্ঞানে এম.এ পাস করেন।  এই স্নাতকোত্তরেই তাঁর স্পেশাল পেপার ছিল ‘সমাজতত্ত্ব’ এবং ‘নৃতত্ত্ব’। ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকাকালীন তিনি ‘গদর পার্টি’ র সংস্পর্শে আসেন ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় বিপ্লবীদের অনেকেই আমেরিকা ছেড়ে বার্লিনে চলে যান।  এদের মধ্যে ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথও।  বার্লিন থেকেই তাঁরা বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করতে মনোযোগী হন  ভূপেন্দ্রনাথ ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত বিপ্লবীদের সংগঠন ‘বার্লিন কমিটি’ র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অবিনাশ ভট্টাচার্য, সি.পদ্মনাভন পিল্লাই এবং তাঁর ভাই চম্পকরমণ পিল্লাই, ডঃ ধীরেন সরকার, এন.এস.মারাঠে, জে.এন.দাশগুপ্ত প্রমুখ  পরে এই কমিটির নাম রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটি’  ‘ইন্দো - জার্মান কন্সপিরেসি’ - র মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই কমিটির সদস্যরাই (বাঘাযতীন এবং তাঁর দলকে অস্ত্র সাহায্যের কথা থাকলেও তা ব্যর্থ হওয়ার কাহিনী)।   শুধু বিপ্লবী কাজকর্মই নয় তিনি ১৯২৩ সালে ‘হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ‘সমাজতত্ত্ব’, ‘নৃতত্ত্বের ‘ উপড় গবেষণা করে  ডক্টরেট উপাধি পান তিনি ‘জার্মান এনথ্রপলজিক্যাল সোসাইটি’ এবং   ‘জার্মান এশিয়াটিক সোসাইটি’ - র সদস্য ছিলেন।   প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ চলার সময়ে একমাত্র বাংলা এবং পাঞ্জাব ছাড়া সমগ্র ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল এরই মধ্যে বাঘাযতীনের  দলকে অস্ত্র সরবরাহের চেষ্টা বিফল গেছিল তাই  ১৯১৭ সাল নাগাদ বার্লিন কমিটি বুঝলো বিপ্লবের আর কোনো আশা নেই।  তাঁরা নিজেদের ত্রুটি গত দিকটিও বুঝতে পারেন যে - তাঁরা বিপ্লবের কথা বলে গেলেও দেশের জনগণের একটা বড় অংশের কাছে পৌঁছাতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।  এই বছরই ‘স্টকহোলমে’ বার্লিন কমিটির একটি শাখা খোলা হয়।  বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সেখানে গিয়ে লেলিনের খোঁজ করেন, কিন্তু লেলিন তখন পেত্রোগাদে চলে যাওয়ায় বীরেন্দ্রনাথ তাঁদের বক্তব্য এবং সোভিয়েতদের সাথে তাঁদের কাজের আগ্রহের কথা সবিস্তারে লিখে একটি চিঠি সোভিয়েত  রাশিয়ায় পাঠান।

এরপর ভূপেন্দ্রনাথও সেখানে আসেন।  তাঁর সঙ্গে কিরিল ট্রয়ানোভস্কির আলাপ হয়।  বীরেন্দ্রনাথ এবং ভূপেন্দ্রনাথ মূলত এই দুজনের উদ্যোগেই বার্লিন কমিটির ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে রুশদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়  এরপর তাঁর সাথে আলাপ হয় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের।  কিন্তু আদর্শগত ফারাক এর জন্য তাঁর সাথে ভূপেন্দ্রনাথের  মতবিরোধ ঘটে।  মানবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মত পার্থক্য কি ? এই বিষয়ের ব্যাপারে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে ভূপেন্দ্রনাথ বলেছিলেন “ রায় জাতীয়তাবাদীদের সাথে কাজ করতে চান না, কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলনে ভারতে  জাতীয়তাবাদী ছাড়া আর পাবেই বা কাকে!” ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদী সত্তাকে অতিযত্নে এবং সগৌরবে রক্ষা করেছিলেন   দেশছাড়ার ১৭ বছর পর ১৯২৫ এর এপ্রিল মাসে তিনি ভারতে এসে তাঁর কাজ শুরু করেন।  প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্ডিয়ান নিউজ এন্ড ইনফরমেশন ব্যুরো’।  এর আগে মস্কো থেকেই তৎকালীন ভারতের জন্য শ্রমিক কৃষক আন্দোলনের কর্মসূচি ১৯২২  সালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে পাঠিয়েছিলেন  ১৯২৭ - ২৮ সালে তিনি কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হয়েছিলেন এবং ১৯২৯ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্যতা লাভ করেন।  কংগ্রেসের সদস্য হয়েও দেশের শ্রমিক কৃষকদের অধিকার আদায়ের দিকেই তাঁর সর্বদা দৃষ্টি ছিল এবং সে সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব ১৯৩০ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে পন্ডিত জহরলাল নেহেরু কে দিয়ে গ্রহণ করাতেও তিনি সমর্থ হন।  ১৯৩৬ সালে তিনি ভারতের কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।  দু’বার  তিনি ‘নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের’  অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।  ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’ ও ‘গণসংস্কৃতি সম্মেলন’ সহ বহু সংগঠনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।  বৈপ্লবিক জীবনের শুরুতে তাঁর যেমন ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর দলের’ মতো বৈপ্লবিক সমিতিগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ঠিক তেমনি পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ এর সাথেও তাঁর গভীর যোগাযোগ গড়ে ওঠে।  বি.ভি - র  প্রধান হেমচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তাঁর গভীর হৃদ্যতা ছিল বরাবরই। 

 

শোনা যায় ভূপেন্দ্রনাথ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র  লেনিনকে  দিয়েছিলেন এবং লেলিন তার উত্তরে তাঁকে একটি চিঠিও লেখেন।  ভূপেন্দ্রনাথের বিপ্লবী চিন্তা ও বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডের পরিচয় ডঃ রণেন সেনের লেখা থেকে পাওয়া যায়  তিনি বলেছেন - “ ডঃ দত্ত ত্রিবেণীর মতো তিনটি বিপ্লবী ধারার সঙ্গমস্থল ছিলেন।  জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন, কংগ্রেস ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে সঙ্গমস্থল। “  আর বিনয় সরকারের ভাষায় “ সকলেই জানে যে, ভূপেন দত্ত সেকালের রামকৃষ্ণ পন্থী নন আর  একালে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের পথও মাড়ান না।  লোকে জানে তাঁকে স্বদেশী  যুগের অন্যতম যুগান্তর সাধক ও বিপ্লবের প্রবর্তক বলে। “

 

অনেকে তাঁকে মার্ক্সবাদী হিসেবে আখ্যা দিলেও তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন মুক্তমতি, ঐতিহ্য - সচেতন এক ব্যক্তি।  অগ্রজ স্বামী বিবেকানন্দের মতো তিনিও ছিলেন অকৃতদার 

 

তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজ তন্ত্র’, ‘বাংলার ইতিহাস’, ‘জাতি সংগঠন’, ‘যৌবনের সাধনা’, ‘সাহিত্যে প্রগতি’, ‘ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি  , ‘আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতা’, ‘প্রেট্রিয়ট প্রফেট’, ‘বিবেকানন্দ দ্য সোশ্যালিস্ট’, ‘ডায়ালেক্ট অফ্ হিন্দু রিচ্যুয়াল’ উল্লেখযোগ্য  এই মহান  দেশপ্রেমিক  বিপ্লবী ১৯৬১ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর তাঁর শেষ নিশ্বাস  ত্যাগ করেন। স্বাধীন ভারত দেখে যেতে পেরেছিলেন এই ছিল তাঁর পরম তৃপ্তি  জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল তাঁর জ্ঞান অর্জনের ক্ষিদে বিশ্বের কোন প্রান্তে নতুন কী ঘটছে, তা কখনওই তাঁর নজর এড়ায়নি।  ভূপেন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন অনেক নতুন দৃষ্টিকোণ, শিখিয়েছিলেন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সার সত্য।

 

তথ্যসূত্র :-

১) স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ

২) এই সময় Gold (eisamay.indiatimes.com)

৩) বিপ্লবীদের কথা (biplobiderkotha.com)

৪) onushilon.org

৫) aajkal.in (৪ঠা সেপ্টেম্বর  ২০২১, শনিবার )

৬) banglalive.com

৭) bongodorshon.com

৮) prohor.in (5th september 2019)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ